#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০২]
কলিংবেলের শব্দে তরীর ঘুম ভেঙে গেলো। কাচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখ জোড়া বদ্ধ অবস্থাতেই কপালে কুচকে গেলো তার। পিটপিট করে চোখ মেললো। জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো ধরনী ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে। নিভু নিভু আলো। সাবিয়া বেঘোরে ঘুমোচ্ছে পাশে।
ফজরের সময় দুজন উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। তবে বেশিক্ষণ হয়নি। তরীর ঘুম কিছুটা পাতলা। এজন্য কলিংবেলের শব্দটা তাকে এসেই বিরক্ত করলো। আবারও কলিংবেলের তীক্ষ্ণ শব্দ কানে আসে। তরী আবার চোখ বুজে এবার উঠে বসে। চোখ বুজেই বালিশের পাশে হাতড়ে ওড়নাটা হাতে নিলো। অতঃপর সেটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বিছানা ছেড়ে নামলো। অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার কাছে গেলো। সদর দরজা খুলে দেখলো কেউ নেই। বিরক্তিতে তরীর ঘুম উড়ে গেলো। এই অসময়ে এমন ফাইজলামির মানে কী? দিলো তো ঘুমটা ভেঙে। নিশ্চয়ই উপর তলার বাচ্চা ছেলেটার কাজ। এই বদ ছেলেটা আগেও বেশ কয়েকবার এই অকাজ করেছে। অন্যের ঘরের কলিংবেল বাজিয়ে এরা কী রকম পৈশাচিক আনন্দ পায়?
তরী দরজা বন্ধ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো এক বাচ্চা ছেলে হাতে প্লাস্টিকের রেহাল দুলতে দুলতে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। গায়ে সাদা-মাটা টি-শার্ট, প্যান্ট। মাথায় টুপি। বাচ্চাটা কী মনে করে তরীদের বাসার জানালার দিকে তাকালো। যেহেতু থাই গ্লাসটা লাগানো, সেহেতু বাচ্চাটি তরীকে দেখতে পেলো না। জানালার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি মুখ চেপে হাসলো। অতঃপর আবার দুলতে দুলতে চলে গেলো। তরী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো বাচ্চা ছেলেটার যাওয়ার পানে। এর মানে তরীর ধারণাই ঠিক ছিলো!
তরী সোফায় গিয়ে সটান মেরে বসে রইলো। কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। ঘুম পুরোপুরি কেটে গেছে। তরী এক ধ্যানে কতক্ষণ বসে থেকে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। এক ধ্যানে কিছুক্ষণ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। এভাবে শুয়ে-বসে থেকে কাজ হবে না। এজন্যে তরী আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। ফুপি কখন আসবে সেটা বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ভোর ছয়টা বেজে গিয়েছে। তরী নাস্তা বানালেই ভালো হবে। এজন্যে ধীরে-সুস্থে নাস্তা বানানো শুরু করলো। সাবিয়া তখনো ঘুমোচ্ছে।
নাস্তা বানাতে বানাতে আটটা বেজে গেলো। তখন আবার কলিংবেল বেজে ওঠে। তরী হাতের কাজ রেখে মাথায় ওড়না টানতে টানতে দ্রুত সদর দরজার দিকে ছুটলো। দরজা খোলার আগে দূরবীনে দেখে নিলো কে এসেছে। ফুপি! তরী চটজলদি দরজা খুললো। তরীকে দেখতেই ফুপি ক্লান্তিমাখা হাসি উপহার দিলো। তরী সালাম দিয়ে বললো,
–“অবশেষে এসেছো!”
ফুপি ভেতরে প্রবেশ করতেন করতে বললো,
–“হ্যাঁ রে মা। দুঃখিত, বেশি দেরী করে ফেলেছি। কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
ফুপির কথা শুনে তরীর মুখ ফসকে বেরিয়ে আসতে নিয়েছিলো গত রাতের ঘটনা। কিন্তু তরী নিজেকে সংগত করে নীরব রইলো। গত রাতের ঘটনা বলার মতো না। তরী মৃদু স্বরে বললো,
–“কোনো সমস্যা হয়নি।”
ফুপি বোরকা খুলতে খুলতে ভেতরে চলে গেলো। তরী দরজা লাগাতে নিবে ওমনি বাহির থেকে বাড়িওয়ালার চেঁচামেচির শব্দ শুনলো। গলার স্বর নিচে থেকে আসছে৷ তরীদের ফ্ল্যাট দো’তলায়। এজন্য শুনতে অসুবিধে হলো না। কিন্তু এই সকাল সকাল আবার কাকে বকাবকি করছে কে জানে? তরী এত দিকে মনযোগ না দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ফুপি কিছুক্ষণের মধ্যে হাত-মুখ ধুঁয়ে এলো রান্নাঘরে৷ এসে দেখলো নাস্তা বানানো প্রায় শেষ! ফুপি তা দেখে মুখ ভার করে বললো,
–“তুই কেন কষ্ট করে বানাতে গেলি মা?”
তরী আলতো হেসে বললো,
–“ঘুম খুব ভোরেই ভেঙে গিয়েছিলো। অবসর সময়ে কী করবো, এজন্যে ভাবলাম নাস্তাটা-ই বানিয়ে ফেলি। ফেরার পর তুমি এমনিতেই ক্লান্ত থাকবে। এজন্যে ইচ্ছে করেনি তোমাকে খাটাতে!”
ফুপি মুগ্ধ হলো ভাইঝির কথায়। মেয়েটার প্রতি একটু বেশি-ই সন্তুষ্টি অনুভব হয় তার। চেহারা জুড়ে যেমন মায়া তেমনই তার কথাতেও মায়া মায়া ভাব। ফুপির মাঝেমধ্যে খুব আফসোস হয় এই ভেবে, তরীকে তার ছেলের বউ করতে পারবে না। তার ছেলে যে খুব ছোটো। সাবিয়ার সমান। ক্লাস টেনে পড়ে। অথচ তরীকে দেখলে বড়ো ছেলের আকাঙ্খা মনে এসে ভীড় করে। তার প্রথম বাচ্চাটা জম্মের পরপর মূর্ছা না গেলে আজ তার বউ তরী থাকতো। ফুপি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভাগ্যকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই।
তরী রাঁধতে রাঁধতে বললো,
–“নিচে বাড়িওয়ালা কার ওপর চেঁচামেচি করছিলো ফুপি?”
ফুপির ধ্যান ভাঙে। বললো,
–“এইতো পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটার উপর। রাতে নাকি কী ঝামেলা হয়েছিলো। অনেক শব্দ করেছিলো। এজন্য বাড়িওয়ালা ভীষণ ক্ষিপ্ত। তুই কোনো হুঁদিশ পেয়েছিস নাকি?”
তরী ভাঁজি নাড়তে গিয়ে হঠাৎ খুন্তিটা থমকে যায়। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে মৃদু গলায় বললো,
–“না, পাইনি।”
ফুপি সেদিকে আর ধ্যান দিলো না। সে চলে গেলো সাবিয়াকে ডাকতে। বেলা হয়ে গেছে। মাদ্রাসাতেও যে যেতে হবে।
—————–
বাড়িওয়ালার হাতে বেশ কিছু টাকা গুজে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে আসলো অনয়। নয়তো তার মুখ থামানো মুশকিল হয়ে পরেছিলো। এমনিতেই ব্যাচেলর মানুষ। সহজে কেউ ব্যাচেলর ভাড়া দিতে চায় না। ফ্ল্যাটে ফিরে দেখলো সিদাত সোফায় পা তুলে আপেল আর পেপসি খাচ্ছে। টিভিতে তার গভীর মনোযোগ। অনয় চোখ বড়ো বড়ো করে সিদাতের দিকে চেয়ে বলে,
–“ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ফকির করতে উঠে পরে লেগেছিস?”
সিদাত ঘাড় বাঁকিয়ে অনয়ের দিকে সরু চোখে চেয়ে তাকে দেখিয়ে পেপসিতে চুমুক দিলো। অনয় চোখে-মুখে রাগী ভাব আনার চেষ্টা করে বললো,
–“সামান্য মায়া-দয়া নেই আমার উপর? তোর জন্যে সারা রাত স্ট্রাগল করলাম। এখন বকুনি খেয়ে এলাম। আর তুই মাতাল হয়ে শুধু ঘুমিয়েছিস!”
সিদাত হাই তুলতে তুলতে বললো,
–“আমি ইচ্ছাকৃত ওগুলো গিলিনি। এক পাবলিক ফিগারের গতকাল পার্টি ছিলো। আমি পার্টিতেই গিয়েছিলাম। ওখানে কোন শালা আমার ড্রিংকে গোলমাল করেছে কে জানে? জানলে তো ইহ-জীবনেও এসব পার্টির ধার ধারতাম না।”
অনয় চট করে সিদাতের কাছে এসে বললো। ভ্রু-দ্বয় কুচকে বললো,
–“আর-জে সিদাত আজকাল পার্টিতেও যাচ্ছে নাকি?”
সিদাত টিভির দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললো,
–“হেল্পলেস ছিলাম।”
অনয় সেসব বাদ দিয়ে মুখটাতে অস্বাভাবিক সিরিয়াস করে বললো,
–“ড্রিংক করার পর তোর সাথে কী কী হয়েছে সব আমাকে বল।”
সিদাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“ড্রিংক করার পরপরই বাবার কল এসেছিলো। বললো, দ্রুত বাড়ি ফিরতে। আমি তাই সময় বিলম্ব না করে পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। বের হওয়ার পর পার্কিং লট পর্যন্ত যাওয়া অবধি মনে হলো কেউ আমার পিছু নিচ্ছে৷ আমি সেদিকে ফোকাস করতে পারছিলাম না। কারণ আমার পা জোড়া খুব টলমল করছিলো। মাথাটাও ভার হয়ে আসছিলো। তাই কোনোরকমে বাইক নিয়ে বেরিয়ে আসি। দুর্বল অনুভূতিটা বেশি হচ্ছিলো এজন্য তোকে ব্যাপারটা আগে জানাই, যে আমার কেউ পিছু নিচ্ছে। এরপর বাড়ী যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে কোনো রকমে তোর কাছে এসে পৌঁছাই। পরে আর কিছু মনে নেই!”
অনয় গালে হাত দিয়ে সিদাতের দিকে চেয়ে বললো,
–“আমার কাছে নয়। ভুলবশত একজন মেয়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছিস!”
সিদাত যেন আকাশ থেকে পরলো এমন ভাব৷ ভ্রু কুচকে অস্ফুট স্বরে বললো,
–“হোয়াট! তোর বাসায় মেয়ে কোথা থেকে এলো? আর ইয়্যু কিডিং উইথ মি?”
অনয় নাক কুচকে বললো,
–“জি না। আপনি আমার ফ্ল্যাটে না এসে পাশের ফ্ল্যাটে আধমরা হয়ে পরে ছিলেন। সেখানে একটা মেয়ে ছিলো!”
সিদাত হতভম্ভ, বিমূঢ়। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এত রাতে কোনো মেয়ের ঘরে? অসম্ভব। সিদাত বিব্রত হয়ে বললো,
–“আমার দ্বারা কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে বন্ধু?”
–“নাহ। তুই তো দরজার কাছে পরে ছিলি, অবহেলিত পাত্রের মতো। মেয়েটা তোকে ছুঁয়েও দেখেনি মনে হয়। হাহা, সো ফানি।”
বলেই অনয় হাসতে লাগলো। সিদাতের ভ্রু কুচকে গেলো। হালকা করে বললো,
–“হোয়াট!!”
অনয় হাসতে হাসতে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সিদাত অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো অনয়ের দিকে। সিদাত, মেঝেতে? অসম্ভব!!
অনয় সিদাতের ঘোর কাটাতে অন্য প্রসঙ্গে বললো,
–“আরে শোন না আগের কাহিনী। তুই কল দেওয়ার পরপর আমি আঙ্কেলকে কল করে সব জানাই। আঙ্কেল তৎক্ষণাৎ লোক পাঠায় আমার বাসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ততক্ষণে ওই লোকেরা চলে আসে। হাতের কাছে যা পেয়েছি তা দিয়েই খুব পি*য়েছি শা*দের। আমার এক সেট গ্লাস আর এক সেট কাচের প্লেট শেষ। দুটো থেকেই দুই তিনটা করে গ্লাস আর প্লেট ভেঙে গেছে। এরপর আঙ্কেলের পাঠানো লোক আসার পরপর শা*রা কোনোরকমে পালিয়ে যায়।”
সব শুনে সিদাত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর বিদ্রুপ করে বললো,
–“থাক বন্ধু, কাঁদে না। নতুন একটা ডিনারসেট কিনে দিবো নে। ওটা তোমার বিয়ের অগ্রীম উপহার।”
অনয় ঠাস করে সিদাতের পিঠে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললো,
–“তোর টাকার ধার ধারি না। যা সর। নিজের জীবন বাজি রাখলাম আর সে আমার বিয়ের চিন্তা করে। কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। তোর মতো বন্ধু আমার লাগবে না!”
সিদাত আলতো হাসলো। আবার বললো,
–“দুটো ফুলদানিও দেখলাম ভেঙে পরে আছে। ওটাও পরিশোধ করে দিবো!”
অনয় গরম চোখে তাকালো। সিদাত কোনোরকমে হাসি থামিয়ে আবারও পেপসিতে চুমুক দিলো। দুই ঢোঁক খেতে না খেতেই অনয় সেটা জোর করে কেড়ে নিলো। যার ফলস্বরূপ সিদাতের গলা সহ সাদা শার্ট ভিঁজে গেলো। সিদাত তার শার্টের দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বললো,
–“শিট!”
অনয় শার্টের দিকে চেয়ে বোকা হাসলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“আমার একটা সাদা শার্ট আছে। ওটা তোরে দিয়ে দিবো নে। এরপর হিসাব বরাবর!”
——————-
বিশাল এক বাগানের মাঝে বড়ো দুটো ছাতা বাঁধা। ছাতার নিচে বেতের সোফা সেট। মাঝে ছোটোখাটো বেতের টি-টেবিল। ছাতার ছায়ায় সাঈদ সাহেব সহ আরও দুজন বসে আছে। মুখোমুখি। একজন থানার ওসি এবং আরেকজন ওসি সাহেবের সহকারী। তারা দুজন-ই মুখখানা ছোটো করে বসে আছে। সাঈদ সাহেব অত্যন্ত ক্ষিপ্ত। রাগে একপ্রকার ফুঁসছে সে। বাকি দুজন অপেক্ষায় আছে সাঈদ সাহেবের কঠিন ধমক শোনার জন্যে। অবশেষে সেই অপ্রিয় অপেক্ষার অবসান হলো। চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাঈদ সাহেব।
–“আমার ছোটো ছেলের উপর হামলা করলো। কে বা কারা করলো সেটা আপনারা ধরতে পারছেন না। তাহলে আপনাদের এই উচ্চপদ দিয়ে কী করবো? মুড়ি খাবো আমি? আপনারা সাধারণ জনগণ নাকি উচ্চপদস্থ আইনজীবি আমি সেটাই বুঝতে পারছি না!”
ওসি কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,
–“আমরা তো বলিনি যারা সিদাতের ওপর হামলা করেছে তাদের চিনতে পারিনি। অবশ্যই চিনেছি। তারা ছিলো আপনার বিরোধী দলের লোক। কিন্তু সঠিক প্রমাণ না থাকায় আমরা কিছু করতে পারছি না!”
মাথা অত্যন্ত গরম হয়ে গেলো সাঈদ সাহেবের। মাথাটা ভনভন, চিনচিন করছে। কান দিয়ে যেন গরম বেরোচ্ছে তার। হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে চুপসে গেলো। মুখ খুললেই গরম কথা বেরোবে, যা সাঈদ সাহেব চাচ্ছে না। ওসির সহকারী আড়ষ্ট হয়ে বললো,
–“আমার মনে হয় আপনার বড়ো ছেলে সাইফ রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কারণে ওরা হঠাৎ এরকম হামলা করেছে। হয়তো-বা এই হামলা সাইফকে রাজনীতির পথ থেকে সরানোর কোনো বার্তা ছিলো।”
———————
সাবিয়াকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসে তরী। বেশ কিছুদিন বাসায় থাকবে বলে-ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। নয়তো ফুপিকে একা বাসায় রাখতেও তার মন মানে না। তরী এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। বাংলা বিভাগে৷ সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলো ওমনি পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে,
–“এইযে, নিকাব রাণী। গতকাল কী তুমি-ই আমাকে হামলার হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলে?”
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৩]
–“এইযে, নিকাব রাণী। গতকাল কী তুমি-ই আমাকে হামলার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে?”
তরী হঠাৎ থমকে যায়। পিছে ফিরে একপলক তাকায় সিদাতের দিকে। সিদাত নীরবে চেয়ে রইলো সেই চোখ জোড়ার দিকে। কাজলে আঁকা অদ্ভুত সুন্দর চোখ জোড়া। মায়াবী, অনবদ্য। এই চোখ জোড়ার উপমা দিতে আপাতত সে ব্যর্থ। সিদাত নিজের অজান্তেই সেই চোখের গভীরে প্রবেশ করতে চাইলো যেন। তবে সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। সিদাতকে অগ্রাহ্য করে তরী হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। ঠিক অনয়ের পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েই দাঁড়ায়। সিদাত তার উত্তর পেয়ে গেছে। অধর বাঁকিয়ে হাসলো সিদাত। হয়তো-বা মেয়েটি স্বল্পভাষী অথবা অন্য স্বভাবের। তবে সিদাতের ভীষণ ভালো লাগলো।
——————-
–“আজ মনে হলো ওই মেয়েটাকে দেখেছি!”
অনয় চুইংগাম চিবুতে চিবুতে সিদাতের দিকে চাইলো। সিদাত তখন মাথা নিচু করে ফোন স্ক্রল করছে। অনয় ভ্রু কিছুটা কুচকে বললো,
–“কোন মেয়ে?”
–“যার বিবরণ সকালে দিলি। তবে নিকাব পরা ছিলো!”
অনয় হাসতে শুরু করে সিদাতের কথা শুনে। বললো,
–“ভুলেও ওদিকে নজর দিস না বন্ধু। জীবন ছারখাড় হয়ে যাবে, একদম সন্ন্যাসী বানিয়ে ছাড়বে তোকে!”
সিদাত এবার ফোন রেখে ভ্রু কুচকে তাকালো অনয়ের দিকে। অনয় তখনো হাসছে। সিদাত থমথমে সুরে বললো,
–“মানে কী?”
–“মানে হচ্ছে ওটা পুরা হুজুর ফ্যামিলি। ওই মেয়ের বাপ কোনো এক মাদ্রাসার শিক্ষক মনে হয়৷ এখন উমরাহ্ করতে গেছে। মেয়ে দুটোও সারাক্ষণ পর্দার আড়ালে থাকে। তাই পুরো জীবন সাধনা করলেও মনে হয় না এই মেয়ের মুখ দেখতে পারবি!”
সিদাত মহা বিরক্ত হলো অনয়ের কথায়। ভারী কন্ঠে বললো,
–“তাতে আমার কী? আমি এসব জানতে চেয়েছি নাকি? পর্দা করছে, প্র্যাক্টিসিং মুসলিম। আই রেসপেক্ট হার। তুই এভাবে বলছিস যেন আমি সত্যি সত্যি প্রেমে পরেছি?”
–“প্রেম তো আর সময় দেখে না। সে যেকোনো ভাবেই হোক মানুষকে তার ফাঁদে ফেলে। তাই বন্ধু, তুই সাবধান হ। মনে রাখিস, এই প্রেমের বাঁশ আমিও একসময় খেয়ে এসেছি। এই বাঁশ মারাত্মক শক্ত। ব্যথা ভুলাতে কারো বছরখানেক তো কারো পুরো জীবন লেগে যায়।”
সিদাত অনয়ের মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে,
–“ভুল মানুষের প্রেমে পরলে এই অবস্থা হবেই। পার্টনার আবেগের বশে চুজ না করে বিবেক দিয়ে চুজ করতে হয়। এখন থাক। আমি অফিস যাচ্ছি!”
বলেই সিদাত চলে যাচ্ছিলো, হঠাৎ থেমে পিছু ফিরে অনয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমি ওই মেয়ের প্রেমে পরবো না রে অনয়। দেখে নিস!”
অনয় তখন মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–“কিন্তু আমার মন বলছে তুই পরবি। মন তো আর সবসময়ের জন্যে খাচায় বন্দি থাকে না। একদিন না একদিন সে মুক্ত হয়-ই। এখন হয়তো তোরটার মুক্ত হওয়ার সময় হয়ে এসেছে!”
সিদাত গরম চোখে চাইলো অনয়ের দিকে। অনয় চোখ জোড়ায় দুষ্টুমি ফুটিয়ে চোখ টিপ দিলো। সিদাত অনয়ের থেকে চোখ সরিয়ে গ্যারেজের ছেলেটাকে বললো,
–“ভাই, কত টাকা?”
গতকাল রাতে তাড়াহুড়ো করায় বাইকের বেশ কিছু ক্ষতি হয়েছে। টায়ারটাও লিক৷ যেন কেউ ইচ্ছাকৃত করে রেখেছে। এজন্যে আশেপাশের এক গ্যারেজে এনে বাইকটাকে আবার রিকোভার করলো। সিদাতের বড্ড সখের এই বাইক। এই বাইকের জন্যে তার মন যে কত কাঁদতো। কিন্তু সিদাত কখনো বাবার কাছে চাইতে পারেনি। জড়তা কাজ করতো। বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে সে। বাবার মুখের ওপর কখনো কিছু বলেনি। বাবাও তাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু কোথাও না কোথাও ভয়, আড়ষ্ট কাজ করে। সেটা একমাত্র বাবার জন্যেই। বাবা যেমন ভালোবাসার তেমনই হালকা-পাতলা ভয়েরও।
সিদাত বেশ কয়েকবার ফোন দেখলো। বাবাকে কল দিতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে,
–“বাবা, আমি একদম সুস্থ আছি। এখন অফিসে যাচ্ছি। আমার শো শুনবে তো? তুমি ফ্রী থাকলে শুনে নিও তো বাবা। যদি কোথাও ভুল হয় ধরিয়ে দিও।”
সিদাত ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল পকেটে পুরলো। আজ সারাদিন বাড়ী যাওয়া হয়নি। অনয়ের সাথেই ছিলো। বাবাকে না সিদাত ফোন করেছে আর না বাবা সিদাতকে। এক অদৃশ্য দেয়াল দুজনের মাঝে সবসময় গলায় কাটার মতো আটকে আছে। তবে সিদাত নিশ্চিত, তার প্রতিটি মুহূর্তের খবর কোনো না কোনো উপায়ে বাবার কাছে ঠিকই পৌঁছাচ্ছে। নয়তো বাবা তো একবার হলেও কল দিতো।
এসব আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে সিদাত বাইকে উঠে বসলো। তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। সিদাত সবেই ফোনটা পকেটে পুরতে নিচ্ছিলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই সিদাতের চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। চটজলদি কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরলো। মৃদু কন্ঠে বাবাকে সালাম দিলে সাঈদ সাহেব সালামের উত্তর নিলো৷ অতঃপর খুব শান্ত, শীতল গলায় বললো,
–“অফিস থেকে তাড়াতাড়ি এসো। একসাথে ডিনার করবো আব্বু। আমি অপেক্ষা করছি।”
তৃপ্তি, ভালো লাগায় সিদাতের মন-প্রাণ শীতল পানির ন্যায় হয়ে গেলো। সিদাত কোনো রকমে আওড়ালো,
–“আচ্ছা বাবা।”
শুধুমাত্র এইটুকু কথপোকথন। তাও এই অল্প-স্বল্পতে কতশত অনুভূতি, শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসা মিশে আছে।
অফিস পৌঁছাতেই সিদাতের আরেকটা কল এলো। কলটি ছিলো সাইফের। সিদাতের বড়ো ভাই। সিদাত কল রিসিভ করতেই সাইফ ব্যস্ত সুরে বললো,
–“ভাই আমার। তুই ঠিকাছিস তো? তোর লাগেনি তো? কোথায় আছিস?”
সিদাত চারপাশে একনজর চেয়ে বললো,
–“অফিসে। আর আমি একদম ঠিকাছি ভাইয়া। চিন্তা করো না!”
–“চিন্তার কী শেষ আছে রে? রাজনীতি ঢুকে মনে হচ্ছে সারা গায়ে বিষ নিয়ে চলাফেরা করছি। একদম দম বন্ধকর অবস্থা। আবার নাকি বাবাও আমায় এখনই বিয়ে দিবে। কোনো মানে হয়?”
একসঙ্গে সব বলে সাইফ থামলো। সিদাত সব মনোযোগ দিয়ে শুনে হেসে দিলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“রাজনীতি তুমি নিজে পছন্দ করেছো। তাই বিষ বহন করতে হবেই। আর রইলো বিয়ের কথা। দ্রুত বিয়েটা করো তো। তোমার কারণে আমার সিরিয়াল আসছে না।”
ওপাশ থেকে সাইফ অবাক সুরে বললো,
–“নিজের স্বার্থে আমাকে বলির পাঠা বানাবি? ছিঃ সিদাত। তোকে ভালোবাসার এই ফল দিলি?”
–“নাটক কম করে বলো, বিয়ে কেন করতে চাচ্ছো না? কোনো পছন্দ আছে নাকি?”
–“ছিলো তো স্কুল জীবনে। এরপর মন মতো পাই না আর। এজন্যে একটু ঘাবড়ে আছি, বাবা আবার কোন খালাকে আমার বউ করে আনে!”
–“কোনো খালা আনবে না। বাবার পছন্দে বিশ্বাস রাখো। আর হ্যাঁ, আমার শো শুরু হতে আর মাত্র কিছুক্ষণ বাকি। বাসায় গিয়ে কথা হবে।”
–“হ্যাঁ, তা তো বাবার কানে ব্লুটুথ দেখেই বুঝলাম শো শুরু হতে যাচ্ছে। যেভাবে ঘটা করে বসেছে!”
সাঈদ সাহেব ছোটো ছেলের কোনো শো মিস দেননি। অসম্ভব কাজের চাপেও এক কানে ব্লুটুথ থাকবেই। ছেলের বচন-ভঙ্গি, পটু কথা শুনলে তার ভেতরের ক্ষতটা মিলিয়ে যায়। চোখ বুজে অনুভব করে সে ছেলেকে। ছেলে ভালোবেসে যা করে সাঈদ সাহেব তা ভালোবেসে উপভোগ করে। কী সুন্দর, অমায়িক বাবা-ছেলের সম্পর্ক। নীরবে, অপ্রকাশ্যে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ হয়। সবসময় তো মেয়ে-বাবার ভালো সম্পর্ক-ই দেখা যায়। বাবা-ছেলের ভালোবাসা কতজন-ই বা দেখে এবং প্রসংশা করে?
সাইফের কথায় সিদাত আত্মতৃপ্তি, অনুপ্রেরণা, মনোবল পেলো। এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে অধর জোড়ার কোণে। অনুভূতি কীভাবে ব্যক্ত করতে হয় তা সিদাতের জানা নেই। তবে সে ব্যক্ত নয় অব্যক্ততে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে শো এর প্রস্তুতি নিতে চলে গেলো।
————————————–
সাঈদ সাহেব হাতে ফাইল নিয়ে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। কানে তার ছেলের পটু কথা বাজছে। ছেলে তার শো-তে ব্যস্ত৷ আর সাঈদ সাহেব ব্যস্ত তা উপভোগ করতে। কাজ তো বাহানা মাত্র। এমন সময়ই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এলো ফিরোজ খাতুন। সাঈদ সাহেব তাকে লক্ষ্য করেনি। তিনি সাঈদ সাহেবের সামনে চা রাখতেই সাঈদ সাহেবের বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেলো। তাও তিনি একবারের জন্যেও ফিরোজা খাতুনের দিকে তাকালো না। ফিরোজা এতে তপ্তশ্বাস ফেললো। এগুলো এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনুভূতি গুলো সে কবেই মাটিচাপা দিয়েছে সে।
কিছু না বলেই ফিরোজা খাতুন চলে যেতেন। কিন্তু তার মনটা অশান্ত, উশখুশ করছে। কিছু একটা প্রশ্ন করার জন্যে অস্থির হলেও তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। অনেকটা সংশয়ে। তাও নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে ফিরোজা খাতুন নিচু গলায় বললো,
–“শুনছেন! শুনলাম, সিদাত বাবার ওপর হামলা হয়েছে। ও ঠিকাছে তো? সে বাড়ি আসেনি কেন?”
ফিরোজা খাতুনের কন্ঠস্বর যেন সাঈদ সাহেবের সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে তুললো। তাও নিজেকে সংগত করে বললো,
–“ভালো আছে। অফিস শেষে ফিরবে। আপনি রান্না-বান্না করতে চাইলে করতে পারেন!”
ফিরোজা আহত নজরে চাইলো সাঈদ সাহেবের দিকে। তার কথায় কেমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব। ফিরোজা খাতুন আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। যেতে যেতে ঠিকই দুই ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। সাঈদ সাহেবের ব্যবহার আজও বদলালো না। সে এখনো তার প্রথম স্ত্রীতে মত্ত। এ নিয়ে তো ফিরোজার কোনো অভিযোগ নেই। সে তো একটু সম্মান, ভালো মনোযোগ চায়। আর কিছু তো জীবনে চায়নি। সন্তানের জায়গায় সিদাত, সাইফকে বসিয়েছে। তাদের মায়ের মমতা দিচ্ছে। তাও তার মধ্যে কিসের কমতি? সে সাঈদ সাহেবের প্রথম স্ত্রী নয় বলে?
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]