হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ১৪

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১৪)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
আর আরিয়ান,,,, আসলেই পাগল। মিরাকে আমার দেওয়া শাস্তিটা ওর হয়তো পছন্দ হয়নি। এটা বুঝলাম ওর রাগে। কেননা ওরা রুম থেকে বের হওয়ার পরই আরিয়ান আমার দিকে কটমট করে তাকালো।আবারও ধুপধাপ পায়ে ওর রুমের বারান্দায় চলে গেল।কিন্তু যাওয়ার সময় বারান্দার দরজাটাকে নিজের গায়ের সব শক্তি দিয়ে ধরাম্ করে ধাক্কা দিলো।যেন সব দোষ ঐ দরজার।
.
.
তারপর ধীরে ধীরে আম্মু আর আংকেল রুম থেকে বের হয়ে গেল। আয়াত আমার বুকে নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। হয়তো ওকে কেউ কিছু খাওয়ায় নি। আমার বাম হাতে কেটে গেছে। কিন্তু ডান হাতটা ভালো।আন্টিকে বললাম অল্প করে খাবার আনতে, আয়াতকে খাওয়াতে হবে। কিন্তু আন্টি আমার কথার পাত্তা না দিয়ে, আমার কাছে এসে আমার দুই গালে তার হাত রেখে বললেন,
— আমার নাতির প্রতি তোমার দরদ আছে তা আমি জানতাম, কিন্তু নিজের শত্রুর প্রতিও যে এতো দরদ তা জানতাম না।
তারপর আমার কপালে চুমু আঁকলেন।
.
আমার আম্মু আমাকে অনেক ভালোবাসে, আমার ভালো চাই। তবে আমার আম্মু আর আমাকে নিয়ে এখন দুঃশ্চিন্তা করে না। কারন আম্মু, আরিয়ান আর ওর ফ্যামিলিকে দেখেছে। কিন্তু ফাহমিদা আন্টির কাছে যে ভালোবাসা টা পাচ্ছি তা কোন সম্পর্কের টানে আমি জানি না। কেন জানি চোখটা পানিতে ভরে উঠলো। সবাই আমাকে এতো কেন ভালোবাসে ? আমি কি এদের এতো ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারবো ? আমি কি আরিয়ানকে আমার মন-মন্দিরের সেই জায়গায় বসাতে পারবো যেখানে ফাহাদ ছিলো। আমার চোখে আন্টি কাজল দিয়ে যে বাঁধ তৈরী করছিলো, সে বাঁধ উপচে চোখের পানির স্রোত বয়ে যেতে লাগলো।
.
শুক্রবার পর্যন্ত আর কেউ অপেক্ষা করলো না। রাতেই সবাই সিদ্ধান্ত নিলো যে কাল সকালেই বিয়ে হবে। আমি চুপ থাকলাম। আমাকে আর আম্মুকে রাতটা এই বাড়িতেই থাকতে বললো। আমি না বলায়, সবার চোখ রাঙ্গানী খেতে হলো।
.
সম্পূর্ণ জাঁকজমকহীন ভাবে বাড়িটা নতুন বউ এর স্বাগতম করতে তৈরী। আমার পড়নে লাল রং এর নতুন সুতি জামদানী শাড়ি। চুল গুলো ঢিলা করে বেণী গাঁথা। কানে মাঝারি একজোড়া ঝুমকো, গলায় মোটা চেইন, হাতে কাঁকন। আয়নায় দেখখলাম আমার ব্লাউজের গলাটা খুব বড় হয়ে গেছে। পিঠ ঢেকে আঁচল তুলে ডান কাঁধে আনলাম। ধুউর, খুব বেশি বউ বউ দেখাচ্ছে আমাকে। আঁচলটা ফেলে দিলাম। রুম থেকে বার হওয়ার সময় আবার আঁচল তুলে নিলাম পিঠের উপর, কোনো ভাবেই আরিয়ানের রক্ত আমি গরম করতে চাই না। তাতে লাগুক আমাকে বউ বউ।
.
শিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম নিচে সবাই বসে আছে শুধু আরিয়ান নেই। আমিও গিয়ে বসলাম সবার মাঝে। আয়াত ঝাঁপিয়ে আমার কোলে উঠে বসলো। সবার কথার মাঝে জানতে পারলাম যে আরিয়ান নাকি একটু বাইরে গেছে। বাড়িতে আমরা আমরাই। খুব ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হচ্ছে।
.
কিছুক্ষণ পর দেখলাম আরিয়ান বাড়িতে ঢুকছে। সে সম্পূর্ন সাদা রং এর পাঞ্জাবি আর সাদা রং এর গ্যাবাডিং প্যান্ট পরেছে। পায়ের নিচের দিকে প্যান্ট গুটায়ে ভাজ করে তোলা। পায়ের গোড়ালি দেখা যাচ্ছে। মাথায় সাদা রং এর টুপি। হাতে একটা নতুন কোরআন শরিফ। কেন জানি মনে হলো ও একজন পবিত্র ফেরেশতা। যে আমার ভাঙ্গাচুরা জীবনকে গড়তে এসেছে।
.
ও এসে আমার পাশে বসলো। কোরআন শরিফ টা টেবিলের উপরে রাখলো। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
— বিয়ের দেনমোহর তুমি কি পরিমাণ ধার্য করতে চাও পাখি ?
— আমার কোনো দাবি নাই এ বিষয়ে। আপনার ইচ্ছা।
.
কিন্তু মনে মনে ভাবলাম আরিয়ান কি তার টাকা দিয়ে আমাকে কিনে নিতে চাই….
.
কিছুক্ষণ পর একজন কাজী আর উকিল আসলো। আন্টি একটা সুন্দর লাল রং এর জর্জেট কাপড়ের ওর্না এনে আমার মাথায় দিয়ে দিলো। যা দেখে আয়াত খুব খুশি হলো আর আমার গলা জরিয়ে ধরে খেলতে লাগলো। প্রথমে আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হবে। কাগজ পত্র ঠিক করে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। ও এক টানেই সিগনেচার করে দিল। তারপর আমার কাছে এগিয়ে দিলো। আরিয়ান আমার কোল থেকে আয়াতকে নিয়ে নিলো। আর বললো,
— নাও সিগনেচারটা করে ফেলো।
.
আমি একটা ছোট্টো নিঃশ্বাস ফেলে মন টা কে শক্ত করে মনে মনে বলালাম এটা আমার জীবনের নতুন সূচনা। তারপর সিগনেচার করে দিলাম। সবাই খুব খুশি হলো। তারপর কাজী আমাদের বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। কিন্তু আমি কাজীর মুখে, আমার বিয়ের দেনমোহর শুনে একদম আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আর সেই সাথে আরিয়ানের প্রতি সন্মান আর শ্রোদ্ধা বহুগুন বেড়ে গেল।
.
আরিয়ান আমার বিয়ের দেনমোহর হিসেবে একটা কোরআন শরিফ ধার্য করেছে। সে আমাকে টাকা দিয়ে কিনে নেয়নি। আমার জীবনকে সুন্দর ভাবে পরিচালনার জন্য আমাকে শান্তির গাইড বুক দিয়েছে। আসলেই আরিয়ান আমাকে অনেক ভালোবাসে। মন থেকে সন্মান করে আমাকে। ওর প্রেম পবিত্র। মানুষটা সত্যিই অসাধারণ।
.
ওর জীবনে যা কিছু খারাপ ঘটেছে তা ও কখনই ডিজার্ভ করে না। একটু শান্তির আশায় আমাকে কাছে চেয়েছে। আমি আজ নিজেকে কথা দিচ্ছি, আমি আমার সারা জীবন ওর পাশে থাকবো।
কাজী যখন ওকে কবুল বলতে বললো, সাথে সাথেই বলে ফেললো। কিন্তু যখন আমাকে কবুল বলতে বললো, আমার বুক কেন জানি কাঁপতে লাগলো, আর আমি ঘাবরে গেলাম। তখনি দেখলাম ফাহমিদা আন্টি নিজের আসন ছেরে উঠে আমার পেছনে দাড়ালো। তারপর তার দুই হাত দিয়ে আমার দুই কাঁধ শক্ত করে ধরলো। যেন সে আমাকে সাহস দিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে কবুল বললাম। সবাই একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে মোনাজাত শুরু করলো। আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে দুই চোখ ভরে আমাদের দেখছে। কিন্তু চোখের কোনায় পানি। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
.
সন্ধ্যার পর আরিয়ান ডিউটি থেকে ফিরে আসলো। সবাই এক সাথে অনেক মজা করছে। আমারও ভালো লাগছে। আমি দেখছি সবাইকে, সবার হাসি খুশি মুখ। এই সব কিছুই কি আমাদের বিয়ের জন্য সম্ভব হয়েছে ? আগে আংকেল আন্টি কেমন মন মরা হয়ে থাকতো। কিন্তু এখন তারা কত খুশি। আমার আম্মুও মন খুলে হাসছে। আর আয়াতের তো কথায় নাই, সে আজ তার পাপায় আর মাম্মাম এর বিয়ের সাক্ষী…. ওর মুখের হাসি দেখলেই নিজেকে সার্থক লাগছে।
.
আর আরিয়ান,,,,, তার চোখ বার বার এটাই বলে দিচ্ছে আমাকে যে, “তুমি আমার”
.
.
রাতে আম্মুকে আরিয়ানদের বাড়ির ড্রাইভার বাড়িতে পৌছে দিবে, আরিয়ান নিজে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু আম্মু মানা করে দিয়েছে। আরিয়ানও আম্মুকে আশ্বাস দিলো যে কাল সকালে আমাদের নিয়ে ওই বাড়িতে যাবে। কিন্তু আম্মু যাওয়ার সময় আমার জান বের হয়ে যাচ্ছিলো। বিয়েটা এমন ভাবে হলো যে সব উল্টো। কারন আরিয়ান দের বাড়িতেই বিয়েটা হয়েছে। আম্মুকে জরিয়ে ধরে খুব চোখের পানি ফেলেছি। আমার বিয়ের কোনো বিদায়ী হয় নি, কিন্তু বিদায়ীর সময় সব মেয়ের মনের হাল হয়তো এমনই হয়।
.
.
অতঃপর আমার ঝামেলা বাঁধলো ঘুমানোর সময়। এর আগেও আমি এ বাড়িতে রাত কাটিয়ছি। কিন্তু তা আয়াতকে নিয়ে ওর রুমে। আর আজ আমাকে আরিয়ানের সাথে আরিয়ানে রুমে থাকতে হবে কারন আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে। কথাটা ভাবতেই কেমন জানি ভয় লজ্জা দ্বিধা সবকিছুর সংমিশ্রণে একটা অনুভুতি হচ্ছে। আর তাই আমার পুরো শরীর টা কাঁপছে। আমি ছিলাম আয়াতের রুমে। আর আরিয়ান আয়াতকে নিয়ে ওর রুমে খেলছিলো। তখনই আন্টি আমার কাছে একদম দৌড়ে আসলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো,
— তারপর নতুন বউ কি অবস্থা বলো, আজ কিন্তু তোমার বাসর রাত। হি হি (এপাশ ওপাশ করে হেলে দুলে, সুর টেনে কথাটা বললো)
.
আন্টির মধ্যে এখনো একটা বাচ্চামো ব্যাপার আছে। যা আমার তার থেকে কম বয়স হয়েও নেই। আমি ভাবছি ভবিষ্যৎ এর কথা। এখন ওনার আরিয়ান আয়াতকে নিয়ে কোনো টেনশনও নাই। না জানি কি কি দেখবো আমি আর। আমার কোনো উত্তর না পেয়ে বলতে লাগলো,
— চলো তোমাকে দিয়ে আসি আমার ছেলের কাছে। (কথাটা বলে আমার কাঁধে একটা ধাক্কা দিলো)
আমি আর কোনো কিছুই বলার সুযোগ পেলাম না। আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল পাশের রুমে। আচ্ছা আমার কোনো ননদ বা দেবর নাই বলে কি আন্টিই ওদের রোল টা প্লে করছে নাকি,,, কি জানি।
.
রুমে ঢুকে দেখি আরিয়ান বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে আর আয়াত ওর বুকের উপর ঘুমাচ্ছে। আমাকে বিছানার কাছে দাড় করিয়ে আন্টি বললো,
— বাবা অনেক রাত হয়েছে, তোমরা এবার ঘুমিয়ে পরো। সারা দিনে সবাই অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছো।
আরিয়ান বললো,
— হ্যা মা। ক্লান্ত লাগছে।
এবার আন্টি বললো,
— আজ তোমাদের বিয়ের প্রথম রাত, আয়াতকে আমার কাছে দাও। কাল থেকে আয়াত তোমাদের কাছে ঘুমাবে।
.
কথাটা শুনে মনে হলো আমার হৃদপিন্ড টা কেউ দু’হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। সাথে সাথে আমি বললাম,
— আন্টি আমি বলছিলাম যে……
আমার কথা শেষ না হতেই আন্টি প্রায় আমাকে ঝারি মেরে বললো,
— এই মেয়ে কখন থেকে এই আন্টি আন্টি কি লাগায় রেখেছো হ্যা? মা বলবে আমাকে, বুঝেছো মা বলবে। কি বলবে ?
.
আমি আরিয়ানের দিকে তাকালাম, সে আমাকে কোনো সাহায্য করলো না। বরং উল্টা তার ঠোঁট বেকিয়ে, কাঁধ দুটো উঁচু করে ছেরে দিলো। অর্থাৎ তার কিছুই করার নাই।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— উম,,, মা,,, আমি,,, বলছিলাম,,, যে…….
আবারও আমার কথা কেটে আমার শাশুড়ী মা বলে উঠলো,
— তুমি চুপ থাকো। আরিয়ান, আয়াতকে আমার কাছে দাও।
আমার কেমন জানি মাথা ঘোরাতে লাগলে।
আরিয়ান মা কে বললো,
— না মা, তুমি যাও। আজ আয়াত আমাদের কাছেই ঘুমাবে। ওর পাপায় আর মাম্মাম এর সাথে।
·
·
·
চলবে…………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here