#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৮
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
রাত দুটোর দিকে বাসায় ফিরল দুর্জয়। ঘরে লাইট জ্বেলে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখল চাবির গোছা আর চশমাটা। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর। পরনের শার্টের পারফিউমের সুঘ্রাণে মিশে গেছে ঘামের গন্ধ। বোতাম খুলতে খুলতে বেডরুমের দিকে যায়। বেডরুমের লাইট জ্বালাতে পকেটের মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে। ফ্যানের সুইচ অন করল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার ভাসছে। পার্সোনাল মোবাইলে এত রাতে আননোন নাম্বার থেকে পরিচিত কেউ কল দেবে? এই মুহূর্তে কলটা রিসিভ করতে ইচ্ছে করে না ওর। বেডের সাইড টেবিলে ওটা রেখে শার্টটা খুললো। তারপর বেল্ট ও প্যান্ট। মেদহীন অ্যাথলেটিক দেহে অবশিষ্ট রইল কালো রঙের কেলভিন ক্লেইনের বক্সার আন্ডারওয়্যার। ফ্যানের বাতাস নগ্ন ত্বকে আরাম দিচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তি একটু যেন কমে। রিংটোনের শব্দ এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেল।
বিছানায় বসে দুর্জয় সাইড টেবিল রাখা পানির বোতল তুলে নেয়। বোতলে চুমুক দিতে আবার সেই রিংটোনের শব্দ। একই নাম্বার। ইমার্জেন্সি হতে পারে ভেবে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কলটা তুললো।
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
ওপাশে কেবল থেমে থেমে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। দুর্জয় আবার প্রশ্ন করে। কিন্তু এবারও কোনো জবাব আসে না। কলটা কেটে দিতে গিয়েও থেমে যায়। কানের পাশে নিলো ফের মোবাইলটা। নিঃশ্বাসের শব্দে কি মানুষকে চেনা সম্ভব? তবুও দুর্জয় চিনতে চেষ্টা করে। এমন বোকামি করার কারণ ওর জানা নেই। এক মিনিট, দু মিনিট এমন করে প্রায় দশ মিনিট পেরিয়ে যায়। নিঃশ্বাসের শব্দ একসময় নাক টানার শব্দ ছেড়ে ফুঁপানোর শব্দে পৌঁছে। দুর্জয় যেন বুঝতে পারে কে। বিস্ময়হত। বুকের ভেতর কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হয়। এই তো কিছুক্ষণ আগেও সে জায়গাটা শান্ত ছিল, ভীষণ শান্ত।
“ঈপ্সা!” প্রশ্ন নয়। দুর্জয় নিশ্চিত এটা ঈপ্সা। কিন্তু ওপাশে ততক্ষণে নীরবতা নেমেছে। কলটা কেটে দিয়েছে ঈপ্সা। শুনতে কি পেয়েছিল দুর্জয়ের কম্পিত কণ্ঠে ওর নাম? বোধহয় না। নিজের মনকে স্থির করতে কিছুটা সময় লাগল ওর। ঈপ্সা ওকে কোনোদিন কল করেনি। কেন করবে? আজই কেন করল? কেন ওই নীরব কান্না? কত প্রশ্ন! কিন্তু জবাব কোথায়?
পরিচিত কাওকে হঠাৎ কল দেওয়া সাধারণ ব্যাপার। সৈয়দ সাহেব অসুস্থ। এহসাস নিখোঁজ। হয়তো কোনো প্রয়োজনে কলটা ছিল। লজ্জা বা সংকোচে কথা বলেনি। হতে পারে না এমন? পারে। কিন্তু দুর্জয়ের মন মানে না কেন? কেন এই অস্থিরতা? লোকে শুনলে কী বলবে! ত্রিশ তো কম বয়স না। সেই তুলনায় ঈপ্সা একটা বাচ্চা মেয়ে। সদ্য স্কুলের গন্ডি পেরোনো তরুণী। ওকে নিয়ে মনে কিছু আনাও তো পাপ।
“পাপ, পাপ,পাপ..” দুর্জয় মন্ত্রের মতো পড়তে থাকে। আল্লাহকে ডাকে। এক তিনিই পারেন মনের সকল পাপ মুছে দিতে, সঠিক পথ দেখাতে। বড্ড সংযমী দুর্জয়, শৃঙ্খল জীবন ওর৷ যা পাপ ভেবেছে, অন্যায় জেনেছে তার থেকে নিজেকে হেফাজত করেছে৷ এক্ষেত্রেও পারবে, নিশ্চিত পারবে। দুর্জয় শান্ত হয়।
মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল ঈপ্সা। দুর্জয় অন্য কারো হবে, ওর মনে অন্য কেউ বাস করে- এ কথা জেনে এত কেন খারাপ লাগছে। ওই মানুষটা ঈপ্সাকে বড়োলোকের বখে যাওয়া মেয়ে ছাড়া কিছু ভাবে না। সামনে পড়লে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। কঠিন পাহাড়। যাকে ঈপ্সা মুখ তুলে দেখলে কেবল গম্ভীরই দেখে। ঈপ্সার জন্য হেসেছে? না। ঈপ্সাকে ফিরে দেখেছে কোনোদিন? না। তার চোখে ঈপ্সা বাচ্চা মেয়ে। যাকে উপদেশ দেওয়া যায়, ধমক দেওয়া যায়, সামান্য স্নেহও করা যায় কিন্তু ভালোবাসা যায় না। তাহলে এত কেন কষ্ট হয় ওই মানুষটা অন্য কাওকে ভালোবাসে জেনে। ঈপ্সার কান্না বাড়ে৷ বুকের ভেতর হাহাকার করে।
“মিনি, এই মিনি।” ঈপ্সা চমকে যায়। ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। দাদাভাইয়ের আগমনের খুশিতে বর্তমান কষ্ট কোথাও ঘাপটি মারল। চোখ মুছে এক লাফে বিছানা ছেড়ে নামে। দরজা খুলতে সামনে ওর প্রিয় দাদাভাইকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের ওপর৷
“দাদাভাই, তুমি এসেছ!”
এহসাস বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঈপ্সা সিক্ত মুখটা ওর বুকের ওপর থেকে তোলে।
“তুমি সত্যি এসেছ, দাদাভাই?”
এহসাস একটু জোরেই বোনের গাল টেনে ধরে।
“দাদাভাই!”
“এবার বিশ্বাস করলি তো?” ঈপ্সার পাশ কেটে বিছানার ওপর বসল এহসাস।
“এত রাত পর্যন্ত জেগে জেগে কাঁদছিলি কেন তুই?”
যে ভাইয়ের ফিরে আসার খুশিতে কেঁদে কেটে একাকার করেছে এখন তার দিকে রেগে তাকালো ঈপ্সা। কোনো ভালোমন্দ জানতে চাইল না এহসাস। অন্তত কেমন আছিস বলাও তো যেত। তা না, গাল টেনেছে। ঈপ্সার মুখটা গোলগাল। ছোটোবেলায় বেশ নাদুসনুদুস ছিল। পরিচিত -অপরিচিত সকলে আদর করে গাল টানত। এখনও কেউ কেউ কাজটা করে৷ প্রচন্ড রাগ হয় তখন ঈপ্সার। গাল জিনিসটা কী টানাটানির?
“ব্যথা পেয়েছিস?” এহসাস বিদ্রুপ করে। ঈপ্সা গালে হাত বুলাতে বুলাতে গাল ফুলিয়ে বলে,
“না, খুবই আরাম পেয়েছি। তোমাকে কতবার বলেছি গাল টানবে না।”
“বলেছিলি না কি। কই? মনে টনে তো পড়ছে না৷”
এহসাস হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে। ঈপ্সা নাকে কাঁদতে কাঁদতে ওর সামনে বসল,
“তুমি একটা মিথ্যুকই না, ট্রিকস্টারও।”
“বড়োভাইকে ট্রিকস্টার বলিস? ছি! মিনি বিড়াল ছি!”
“মিনি বিড়াল বলবে না।”
এহসাস কিছু বলতে যাচ্ছিল ঈপ্সা থামিয়ে দেয়।
“চুপ! এসব কেন বলছো বুঝতে পারিনি ভেবেছ? কোথায় ছিলে এতদিন? সকলে যা বলছে তা কি সত্যি? খবরদার যদি ফের মিথ্যা বলেছ তো। ফের আমাকে ভুলাতে চেয়েছ। আমাদের কথা তুমি ভাবোই না৷ তোমার চিন্তায় আমরা মরে যাই তাই বুঝি চাও?”
এহসাস বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। কত বড়ো হয়ে গেছে মিনি। এখন ওকে ফাঁকি দেওয়া দুরূহ। এই তো সেদিনও ছোট্ট মিনি ফ্রক পড়ে ওর আঙুল ধরে ধরে হেঁটে বেড়াত। এহসাসের সকল মিথ্যাকে সত্য বলে ধরে নিতো।
আট বছরের ব্যবধান ওদের বয়সের। কিন্তু মাঝে মাঝে মিনি যেন গুরুজন হয়ে যায়। শাসন করে আবার এহসাস দুঃখ পেলে মাথাটা নিজের কোলে রেখে সান্ত্বনা দেয়। স্বার্থপর দুনিয়াতে একমাত্র মিনিই যেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা নির্ভেজাল। ঠিক ওর মতোই। বড়ো আপন মিনি ওর। পঁচা গলা নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মিনিরা পবিত্র। সব মিনিকে তো আগলে রাখা এহসাসের পক্ষে সম্ভব না। নিজের মিনিকে তাই সবটা দিয়ে আগলে রাখে। পাপের সাগর সাঁতরে এসেছে ও। মিনি জানতে চাইছে সেই সাগর অতলে কী দেখেছে, কী করেছে ওর ভাই৷ এহসাস তো বলবে না। মিনির পবিত্র মনে নিজের পাপের ছায়া পর্যন্ত পড়তে দেবে না ও। তার জন্য বিশ্বাস ভাঙতে হলেও ভাঙবে।
“কী হলো বলো? ওরা বলছে তুমি খুন করেছ। সত্যি কী করেছ দাদভাই?”
“তুই বল?” এহসাসের পালটা প্রশ্নে ঈপ্সা থতমত খায়।
“আমি!”
“হ্যাঁ, তুই বল। তোর সকল প্রশ্নের জবাব তুই দে মিনি। তোর কাছেই তো জবাব আছে। আমি তোর মুখে শুনি। বল মিনি, তোর ভাই সত্যি কি খুন করেছে?”
ঈপ্সা মাছের মতো মুখ খুলে আবার বন্ধ করে। কী বলবে? দাদাভাই ওকে এমনি করে কেন দ্বিধায় ফেলে। কেন সহজ জবাব দিতে চায় না।
এহসাস উঠে দাঁড়ায়। মাথায় হাত বুলাতে ঈপ্সা ভাইয়ের দিকে তাকায়। সেই ছোট্ট অবুঝ মিনির মতো।
“এত রাত জাগিস না। বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়। সকালে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। ওহ! আর কাঁদবি না কিন্তু, ঠিক আছে?”
ঈপ্সা ঘাড় সামান্য কাত করে একদিকে। এহসাস মুচকি হাসে। সহজ হাসি৷ ঈপ্সার ভয় দূরীভূত হয়। বিশ্বাস করে ভাইয়ের কথা ও ভাইকে।
“আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে রে মিনি। তুইও ঘুমিয়ে পড়। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এহসাস রুম থেকে বেরিয়ে গেলেও ঈপ্সা অপলক তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাইকে বিশ্বাস করে ভাইয়ের কথার পুনরাবৃত্তি করে,
“সব ঠিক যাবে মিনি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সৈয়দ বাড়িতে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ডিম লাইটের আলোয় আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে এহসাস। ওর রুমটা একেবারে পুবদিকে। করিডোর ধরে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা রুমের দরজা খুলে গেল। রুমটা ওর কাকা একরাম আজাদের। এহসাস ভেবেছিল একরাম আজাদ হবে। কিন্তু না, ক্যামেলিয়া দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেছে। চমকিত চোখে ধীরে ধীরে লজ্জা প্রকাশ পায়। আর কী? এহসাস বুঝতে চায় না। পা বাড়ায় সামনে।
“এহসাস!”
ক্যামেলিয়া ধরা গলায় ডাকে। মুহূর্তে কত কী মনে পড়ে এহসাসের। এহসাস থামে না। দ্রুত হাঁটে। কী এক অনুভূতি ধীরে ধীরে ওর সমস্ত শরীরের শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হতে থাকে। ঘৃণা, হ্যাঁ ঘৃণাই তো বলে সেই অনুভূতিকে।
চলবে,,,