আলো_আঁধার পর্ব ১৭

#আলো_আঁধার[১৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আলো মিসেস আমিনার শপে কাজে যোগ দিয়েছে দুই সপ্তাহ হলো। ওর কাজে আমিনা রীতিমতো অনেক খুশি। এত সহজে আলো কাজ বুঝে নিয়ে, অত সুন্দর করে গুছিয়ে করতে পারবে তা তার ধারণা দিল না। আলো উনার সাথে সকালে আসে, আবার রাতে ফিরে যায়। সপ্তাহে শুক্রবারটা আমিনাই তাকে জোর করে ছুটি দিয়েছে। কাজে থাকলে আলোর দিন কীভাবে কেটে যায় সে বলতে পারে না। রোজ রোজ নতুন মুখের সাথে পরিচয় হয়। নতুন মানুষদের সাথে কথা বলেও ভালো লাগে। জীবনে এগিয়ে যাবার একটাই কারণ এখন, নিজেকে ভালো রাখা। অতীত আলো কবেই ভুলে গেছে। নাসির, দীপ্ত ওরা তার অতীতের দুঃস্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ঘুমের ঘোরে আর দেখতে চায় না। বাচ্চাটার কথা প্রতিদিনই মনে পড়ে। ও থাকলে আলো আরও ভালো। আলো আরও সুখী হতে পারত। নিজেকে তখন একা লাগত না। এখনো অবশ্য লাগে না৷ পৃথিবীতে মিসেস আমিনা আর শুভ্রর মত মানুষ থাকতে আলোর মত মেয়েরা কখনও খারাপ থাকবে না। ওরা আলোর জন্য যা যা করেছে তার আলোর নিজের বাবা মা’ও করেনি।
আজ শুক্রবার। আলোর ছুটির দিন। আজকের সারাদিন সে বাড়িতেই থাকবে। আলো এখন এই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে থাকে। এখানে থাকার জন্য মিসেস আমিনাকে টাকা দিবে। এই শর্তেই আলো এখানে থাকতে রাজি হয়েছে। নইলে অন্য কোথাও চলে যেত। কাজের প্রথম মাসটা গেলে নিজের রান্নাও নিজেই করে খাবে।
শুভ্র কয়দিন ধরে হাসপাতালে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। ওর সাথে আলোর দেখাই হতো না। আলো শপে চলে যেত। সে নিজেও হাসপাতাল থেকে ফিরতে অনেক রাত করত। আজ ছাদে যাবার সময় সিঁড়িতে দু’জনের দেখা হয়ে গেল। আলোর মাঝে আগের বাঁধোবাঁধো ভাবটা এখন নেই। শুভ্রর সাথে দেখা হলে পরিচিতদের মতই কথা বলে। আলো আন্তরিক হেসে বলল,

-“আজ তাহলে বাড়িতে আছেন। আপনাকে তো বাড়িতে দেখাই যায় না। অবশ্য যাবে কীভাবে বলুন, অত বড় ডাক্তার। দায়িত্ব তো কম না।”

-“আপনিও তো আজকাল বাড়িতে থাকেন না। দিনের সবটা সময় শপে কাটে। আমি বাড়ি থাকলেও আমাকে দেখার কথা না আপনার।”

আলো হাসল। লোকটা কথা বলতে পারে। কিন্তু দেখে মনে হয় উনি কথা বলতে জানেনই না। এখন ‘অ’ ‘আ’ ‘ক’ ‘খ’ শিখছেন। ওরা একসাথে ছাদে চলে এলো।

-“কাজের জায়গা কেমন লাগছে? কাজ পছন্দ হয়েছে? মন বসছে তো।”

-“হুম। আমার জন্য এই কাজটাই দরকার ছিল। অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়। কাস্টমারদের সাথে কথা বলে বলেই সময় কেটে যায়।”

-“তাহলে তো ভালোই।”

-‘আপনার দিনকাল কেমন কাটছে?”

-“সব সময় যেমন কাটে। রোগশোক, রোগী, ডাক্তার, নার্সদের নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালোই সময় কেটে যাচ্ছে।”

ওরা পাশাপাশি ছাদ জুড়ে হাঁটছে। আলো এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসল শুভ্রকে।

-“আপনার বয়স কত হবে বলুন তো?”

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বয়স! এভাবে হুট করে কেউ কারো বয়স জানতে চায়? তবুও সে উত্তর দিল।

-“সাতাশ/আটাশ তো হবেই। আপনার কী মনে হয়? আমার বয়স কত হতে পারে?”

আলো শুভ্রকে দেখিয়েই হেসে ফেলল। শুভ্র ওর হাসির কারণ জানতে চাইল।

-“হাসলেন যে!”

-“ছেলেদের বয়স অত সহজে ধরা যায় না। ছেলেরা বুড়োও হয় দেরিতে। মেয়েরা তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে যায়। এক বাচ্চার মা হলে বিশ বছরের মেয়েকেও ত্রিশ/পয়ত্রিশ লাগে।”

-“মোটেও না। মেয়েরাও আজকাল তাদের ফিটনেস সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। জিম-টিম, ডায়েট ফায়েট করে নিজেদের স্লিম রাখছে। পার্লারের কথা তো বাদই দিলাম। ত্রিশ বছর বয়সী মহিলা পার্লার থেকে আঠারো হয়ে বেরিয়ে আসে। সবই মেকআপের জাদু।”

অনেকদিন পর আলো মন খুলে হাসল। শুভ্রর কথা শুনে হাসতেই আছে। চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারছে না। আলোকে এভাবে হাসতে দেখে শুভ্র লজ্জা পেল। অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল,

-“যা বলেছেন! আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম আপনি কথা বলতে জানেন না। এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি কেমন কথা বলতে জানেন আপনি। আপনার পেশার দিকে তাকালে মনে হয়, হ্যাঁ বয়স যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হয়, এ তো কচি খোকা। মায়ের আদেশ যেভাবে পালন করেন তাতে বাচ্চা ছেলেই লাগে। তা এত বয়স হয়েছে এখনো বিয়ে করছেন না কেন? নাকি শুধু ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবলেই চলবে। ফিউচার নিয়েও তো ভাবতে হবে।”

-“ভাবতে চেয়েছিলাম তো একবার। ব্যর্থ হয়েছি। উল্টো মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছি।”

-“রাহার কথা বলছেন?”

-“হ্যাঁ।”

-“রাহাকে আমি তেমনভাবে না চিনলেও যতটুকু বুঝেছি ও আপনার জন্য ঠিকই ছিল।”

-“আমার কিন্তু এমনটা মনে হয়নি।”

-“হয়নি! তাহলে কেমন মেয়ে পছন্দ আপনার? আমাকে বলতে অসুবিধা আছে? থাকলে বলতে হবে না। তবে যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে বলতে পারেন। বন্ধু হিসেবে তেমন মেয়ে খুঁজতে সাহায্য করব।”

শুভ্র হাঁটতে হাঁটতেই আলোর মুখের দিকে দেখল। সাহস করে বলেই ফেলল,

-“যে আমার লাইফ পার্টনার হবে তাকে আপনার মত সাহসী ও কঠিন কোমল ধাঁচের হতে হবে। আপনি ঠিক আমার মায়ের মতন। মা-ও আপনার মত স্ট্রং।”

-“কেউ শুরু থেকেই স্ট্রং হয় না। হতে পারেও না। জীবনের বিভিন্ন পরতে পরতে ঠুকর খেতে খেতেই শিখতে হয়। আমাকে আপনি প্রথম দিকে দেখলে বুঝতেন, কতটা কল্পনা বিলাসী মেয়ে ছিলাম আমি। জীবন নিয়ে কখনো সিরিয়াস হইনি। আজকের আমির সাথে আগের আমির কোন মিল পাবেন না। আস্তে আস্তেই শিখতে হয়। বিয়ের পরে জীবনের আসল রূপ দেখেছি আমি। বাইশ বছরের জীবনে কতকিছু দেখে ফেলেছি। মানুষ চল্লিশ বছরেও এতকিছু দেখে না হয়তো। স্বামী-সংসার, মানুষের আসল চেহারা। ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা, সন্তান হারিয়ে বাইশ বছরের এই ছোট জীবনে নিঃস্ব হয়ে বসে আছি। তবে এসব অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নিয়েছি। ভালো খারাপের তফাত বুঝতে পারি এখন।”

রাতে শুভ্র আজ মা’কে নিয়ে বাইরে খেতে যেতে চাইল। মা শুনেই বলল,

-“যাওয়া যায়। অনেকদিন ধরে আমরা কোথাও বেরোইনি। তোমারও কাজের চাপ। আমিও সময় দিতে পারি না।”

-“তাহলে আজ রাতে ডিনার কোন রেস্টুরেন্টে করব।”

-“হুম। অহ আলোকে বলবে না? আমরা দু’জন যাব। ও বাসায় একা থাকবে? ওকেও আমাদের সাথে যেতে বলো। ওরও ভালো লাগবে।”

-“হুম।”

এই কথাটা বলার জন্য শুভ্র আলোর ঘরে এলো। আলো শুয়েছিল। শুভ্রর গলা পেয়ে উঠে বসে। শুভ্র ঘরে আসে।

-“এই সময় এসে ডিস্টার্ব করলাম না তো?”

-“আরে না। আসুন। বসুন তো। কোন কাজ নেই তাই শুয়ে ছিলাম। আপনি আসার কথা বলার মানুষ পেয়ে গেলাম।”

শুভ্র মৃদু হাসল। আলোর সাথে কথা বললে তার সময়ও খুব ভালো কাটে। তবে দ্রুতও যেন কাটে। এক ঘন্টা যেন চোখের পলকে কেটে যায়।

-“কিছু বলতে এসেছিলেন। আপনি তো এই সময় আমার ঘরে আসেন না। আমিও মাঝে মাঝে গিয়ে আপনাকে এই সময় ঘরে পাইনি। খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, আপনি নাকি সন্ধ্যার এই সময়টা লাইব্রেরিতে কাটাতে পছন্দ করেন।”

-“সময় না কাটলে বই পড়ি। বই নিঃসঙ্গতার ভালো সঙ্গী জানেন তো।”

-“আমি বাবা অত বই টই পড়ি না। পড়তে পারি না। বই পড়তে অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। আমার সেই ধৈর্য নেই।”

-“ধৈর্যের সাথে কিছুটা অভ্যাসও প্রয়োজন। প্রথম প্রথম ভালো না লাগলেও এক সময় বই পড়া নেশা হয়ে যাবে।”

-“আপনি তো এত পড়াশোনা করে ডাক্তারি পাস করেছেন। ভাল জব করছেন। এখন এত কী বই পড়েন বলুন তো।”

-“একদিন সময় করে আমার লাইব্রেরিতে যাবেন। ভয় নেই। জোর করে বই হাতে পড়তে বসিয়ে দেব না। দু-চোখে শুধু দেখে আসবেন।”

-“আচ্ছা যাব। এখন বলুন কী কথা বলতে এসেছিলেন। কাজের কথা রেখে অকাজের কথাই বলে যাচ্ছি তখন থেকে।”

শুভ্র ইতস্তত ভাব কাটিয়ে বলে উঠল,

-“আজ রাতের ডিনারে আপনাকে আমন্ত্রণ করতে এসেছি।”

-“আমি তো রোজ রোজই আপনাদের সাথেই খাই।”

-“আজ আমি আর মা বাইরে ডিনার করতে যাচ্ছি। তাই সাথে আপনাকেও গেস্ট হিসেবে আশা করছি। মা’ই বলল আপনাকে সাথে যেতে বলতে। উনার ভালো লাগবে। আর আপনিও নিশ্চয় রোজরোজ ঘরের খাবার খেয়ে বোর হচ্ছেন। একদিন একটু ট্যাস্ট পালটানো হলো।”

-“হুম। কিন্তু কিসের জন্য এই ট্রিট দেওয়া হচ্ছে সেটা তো বললেন না।”

-“বিশেষ কোন কারণ নেই।”

-“বিশেষ কারণ ছাড়া শুধু শুধু খরচা করবেন! আমি কিন্তু প্রথম শ্রেনীর খাদক। আপনাকে ফতুর না করে ছাড়ব না।”

আলোর কথায় শুভ্র শব্দ করে হেসে ফেলল। আলো কোনো প্রকার আপত্তি না করে রাতে ওদের সাথে যেতে রাজি হয়ে গেল। আলো এতদিনে এটা বুঝে গেছে মানুষগুলো তাকে দয়া দেখিয়ে নয়, বরং আপন ভেবেই ওর জন্য ভাবে। তিনজন একসাথে ডিনার করে, অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে এলো৷ আজকের রাতটা অন্য সব রাতের থেকে স্পেশাল বানিয়ে দেওয়ার জন্য শুভ্রকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া হলো না। ওদের সাথে সময়টা খারাপ কাটেনি। সত্যিই ঘরের খাবার খেতে খেতে মুখ বিস্বাদ হয়ে উঠেছিল। আলো রুমে চলে এলে কথাটা মনে পড়ল।

-“শুভ্রর একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here