আলো_আঁধার পর্ব ১৮

#আলো_আঁধার_১৮
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরও একটা মাস এভাবেই কেটে গেল। আলো কাজে যায়। ছুটির দিন বাড়ি থাকে। মাঝে মাঝে নিজের হাতে সবার জন্য রান্না করে। রাতে সবার সাথে খাবার টেবিলে বসে কত গল্প জুড়ে দেয়।
শুভ্র বেচারা কয়দিন ধরে নিজের মনকে নিয়ে বড় মুশকিলে পড়েছে। নাছোড় মন কী চাইতে তা সে নিজেও বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। কত দ্বিধা, কত লজ্জা, কত অনিশ্চয়তায় ভোগে শেষে সে যা ঠিক বুঝতে পেরেছে তা হলো। সে আলোকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। আলো তার খুব ভালো বন্ধু। আলো হয়তো তাকে বন্ধু ছাড়া অন্য কোন চোখেই দেখে না। কিন্তু সে যে কবে নিজের অজান্তে আলোকে বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু ভাবতে শুরু করেছে। এই নিয়ে শুভ্রর লজ্জার শেষ নেই। আলো জানতে পারলে কখনো তার সাথে কথাই বলবে না। সে কীভাবে আলোর মত একটা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলল। আলো কি ভালোবাসায় বিশ্বাস করবে? তার অলরেডি ভালোবাসা নামক শব্দটার উপর ঘৃণা বসে গেছে। আলো নিজেই একদিন শুভ্রকে বলেছে,

-“পৃথিবীতে আর কোন ছেলের সঙ্গ চাই না আমি। সবাইকে এক পাল্লায় মাপতে গেলে হয়তো আমি ভুল প্রমাণ হব। কারণ আমার স্বামীর মত মানুষ যেখানে আছে, সেখানে তোমার মত ভালো মানুষও আছে। তবুও আমি নিজের জীবনে আর কোন পুরুষের দখলদারি চাই না। বাকি জীবনটা নিজের মত করে বাঁচতে চাই।”

আলোর মুখে এই কথা শোনার পরও শুভ্র কোন মুখে আলোকে নিজের মনের কথা বলবে! আলো উল্টো তাকেই ভুল বুঝতে পারে। তাদের বন্ধুত্বের মিষ্টি সম্পর্কটাও নষ্ট হতে পারে। তাই শুভ্র ঠিক করল আলোকে কিছু জানাবে না সে। আলো তার চোখেই সামনেই তো আছে। ও থাকুক না ওর নিজের মত। শুভ্র দূর থেকেই নাহয় আলোকে ভালোবেসে যাবে। আমরা যাকে ভালোবাসি, সে-ও যে আমাদের ভালোবাসবে, সব সময় কি এমনটা হওয়া প্রয়োজন? কিছু অনুভূতি অপ্রকাশিত থাকাই ভালো। আবার কিছু সম্পর্ক অসম্পূর্ণ রেখে দেয়াই ভালো। সব সময় সব গল্পের সুন্দর সমাপ্তি আশা করতে নেই। থাক না কিছু গল্প অসমাপ্ত।
শুভ্র ইদানিং নিজের মনের সাথে যুদ্ধে পেরে না উঠে আলোকেই এড়িয়ে চলছে। আগের মত কথা বলে না। সামনেও পড়ে না। ভুল করে আলো তার সামনে চলে এলে দায়সারা ভাবে, ‘কেমন আছো?’ ‘দিনকাল কেমন কাটছে?’ জানতে চেয়েই সরে পড়ে। এর বেশি আর কথা বলে না। শুভ্রর ভয় হঠাৎ যদি কোনদিন মুখ ফসকে আলোর সামনে তার মনের কথা বেরিয়ে যায়!
আজও শুভ্র আলোকে দেখে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে টুলের সাথে পা লেগে পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। আলো তা দেখে হেসে ফেলে। পেছন থেকে ডেকে বলে,

-“আজকাল তুমি সব সময় অত তাড়ায় থাকো কেন? কিছুদিন ধরেই দেখছি চোখের মত বাড়িতে আসো। আবার চোরের মত বেরিয়ে যাও। আমার সাথে পর্যন্ত কথা বলো না। কী ব্যাপার বলো তো শুনি। কোন মেয়ের পাল্লায় পড়লে নাকি? মেয়ে ঘটিত ব্যাপার হলে কি বন্ধুকে ভুলে যাবে!’

শুভ্র দাঁড়ায়। ঢোঁক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। হাসতে চেষ্টা করে বলে,

-“তুমি যা ভাবছ তেমন কিছু না।”

-“তাহলে কেমন কিছু? আমাকে দেখে পালাচ্ছিলে কেন?”

-“পালাইনি তো।”

-“তুমি মিথ্যে কথাও ঠিকঠাক ভাবে বলতে পারো না। কেমন গলা কাঁপে। এখন বলো তো আসল ঘটনা কী?”

-“কিছুই না।”

-“বলবে না তো!”

অসহায় শুভ্র এদিকওদিক তাকায়। আলোর উপর বারবার চোখ চলে গেলে অপরাধীর মত চোখ সরিয়ে নেয়।

-“হাসপাতালে কাজের চাপ একটু বেড়েছে।”

-“আজকের দ্বিতীয় মিথ্যা।”

শুভ্র শেষে হার মানল। কপালের ঘাম মুছে বলল,

-“ব্যাপার একটা ঘটেছে। কিন্তু তা তোমাকে এখন বলতে পারব না। রাতে আমি বাড়ি ফিরি তারপর বলব। এখন আমার লেট হচ্ছে।”

আলো হাসল। সম্মতি জানিয়ে বলল,

-“আচ্ছা।”
________________________
শুভ্র বাড়ি ফেরার তাড়াহুড়োয় ছিল। আজকের মত সবকিছু গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তখনই একজন অ্যাক্সিডেন্টের রোগী নিয়ে আসা হয়। লোকটা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করছিল। অসাবধানতা বশত সামনে থেকে আসা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায়। আঘাত মারাত্মক। শরীরের অনেক জায়গায় জখম হয়েছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। ওকে নিয়েই শুভ্র আটকে পড়ে। ডাক্তারের কাছে তার রোগী সবার আগে। সে রাত বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুভ্রর অনেক দেরি হয়ে যায়। এদিকে আলো তার জন্য অপেক্ষা করে বসে ছিল। বসে থাকতে থাকতে একসময় আলো বিরক্তবোধ করে। সময় কাটানোর জন্য শুভ্রর লাইব্রেরিতে যায়। কয়েকটা বই উল্টেপাল্টে দেখে। কয়েকটারই প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে রেখে দেয়। শেষে একটা বই হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা অনাগ্রহে শুধু চোখ বুলিয়ে যায়। তারপর এমন একটা আকর্ষণ কাজ করে যে পড়তে পড়তে কখন ঘড়ির কাটা বারোটার ঘরে পৌঁছে যায় আলো খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়তে উঠে দাঁড়ায়।

-“আজ আর ডাক্তার সাহেবের দেখা পাব বলে মনে হচ্ছে না। শুভ্র আমাকে মিথ্যে কেন বলল! বলেছিল রাতে ফিরে কথা হবে। ফিরবেই না যখন তখন এই কথা বলে গেল কেন?”

বই হাতে নিয়েই আলো লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো। শুভ্রর উপর মনে মনে যে তার রাগ হচ্ছে এটা আলো নিজেও বুঝতে পারছে। রাগ হওয়াটাই কি স্বাভাবিক না? শুভ্রর জন্য সে নয়টা থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে। এখন বারোটা। তিনটা ঘন্টা! এই তিন ঘন্টা কতটা দীর্ঘ ছিল তা শুধু আলোই জানে।

-“আসতে পারবে না জেনেও আমাকে অপেক্ষা করাল। বজ্জাত।”

ঘরে এসে আলোর আরেকটা কথা মাথায় এলো। সত্যিই তো! এতক্ষণ তো ওইদিকটা সে ভেবেই দেখেনি। শুভ্র নিশ্চয় জরুরি কোন কাজে আটকা পড়ে গেছে। রোগী ফেলে রেখে সে তো আর চলে আসতে পারবে না। আসা উচিতও না।

-“দূর! এতক্ষণ শুধু শুধু বেচারার উপর রাগ করছিলাম। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। শুভ্র তো আর আমার মত বেকার না। অবশ্য আমিও এখন বেচার না। তবুও ওর কাজ কি আর আমার কাজের মতন! ওর উপর কত দায়িত্ব।”
_________________________
সকালে শুভ্রই নিজে থেকে আলোর সাথে দেখা করতে এলো। আলো নিশ্চয় তার উপর রেগে আছে। সে যেহেতু বলে গিয়েছিল রাতে ফিরলে কথা হবে। তার মানে আলো তার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছে। শুভ্রর উচিত ছিল আলোকে একটা কল করে জানিয়ে দেওয়া। শুধু শুধু বেচারিকে অপেক্ষা করিয়েছে। শুভ্রকে দেখেই আলো একগাল হেসে বলল,

-“ডাক্তার সাহেব দেখছি! সকাল সকাল কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”

শুভ্র হাসল। বলল,

-“তোমার ঘরেই যাচ্ছিলাম।”

-“চলো ছাদে যাই৷ সকালের শীতল বাতাস গায়ে মেখে আসি।”

-“হুম।”

ছাদে পা রেখেই শুভ্র বলল,

-“সরি। কাল তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলে নিশ্চয়।”

-“হ্যাঁ। তবে তোমাকে সরি হতে হবে না। আমি জানি তুমি ব্যস্ত ছিলে।”

শুভ্র কিছুটা অবাক হলো।

-“কীভাবে জানলে?”

আলো শব্দ করে হাসে।

-“আরে বুদ্ধু, এই সহজ ব্যাপারটা না বোঝার কী আছে? তুমি ব্যস্ত ছিলে বলেই লেট করে ফিরেছে। নইলে রোজ তো লেট করো না। তুমি যে চরিত্রের ছেলে তাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে যে বাড়ি ফিরতে লেট করবে এটা হতেই পারে না।”

-“তার মানে তুমি আমার উপর রাগ করে নেই!”

-“রাগ করব কেন বলো তো! এখন বলো রাতে কোন কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলে?”

-“একজন অ্যাক্সিডেন্ট করে অবস্থা খারাপ হয়ে হাসপাতালে এসেছিল। বাঁচা মরা অবস্থা। ওর বাড়ির লোকেরা আসতে আসতেই অনেক রাত হয়ে গেল।”

-“হুম। বেঁচে আছে লোকটা?”

-“হ্যাঁ। পায়ের হাড় ভেঙেছে। তবে ঠিক আছে।”

-“আচ্ছা এখন ওই কথা বলো।”

-“কোন কথা?”

-“কাল রাতে যেই কথা বলবে বলেছিলে।”

-“অহ!”

-“অহ না মশাই। বলুন এবার। ঘটনা যে মেয়ে ঘটিত তা তো পরিষ্কার। এখন বলো কাহিনী কী?”

-“তেমন কিছুই না আলো। বলার মত কিছু না। তুমি শুধু শুধু জেদ করছ।”

-“তুমি একটা মেয়েকে পছন্দ করো।”

শুভ্রর কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতে অদ্ভুদ চোখে আলোকে দেখল। আলো মিটিমিটি হাসছে। শুভ্রর ভয় লাগতে লাগল। আলো কোন ভাবে তার মনের কথা জেনে ফেলেনি তো! জেনে ফেললে সর্বনাশ!

-“তু-তুমি জানলে কীভাবে?”

-“বোঝা যায়। তোমার হাবভাব আচার-আচরণ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। মশাই কারো প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়া ভালো। এখন বলো মেয়েটা কে?”

-“আছে একজন।”

-“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। কে সেই লাকি গার্ল!”

শুভ্র আলোকে দেখে। মনে মনে হাসে। এখন লাকি গার্ল বলছে। যখন জানবে সেই মেয়ে ও নিজে তখন এই কথা বলবে তো!

-“আমি আসলে শিওর না আলো। মেয়েটার মনের কথা আমি জানি না। হতে পারে আমি ওর জন্য যেরকমটা ফিল করি, ও আমার জন্য তেমন কিছুই ফিল করে না। আমার ভালোবাসা ওয়ান সাইডেড।”

-“এই ভয়ে তুমি বলতে পারছ না!”

-“উঁহু।’

-” আরে বোকা ভালোবাসার কথা বলে দিতে হয়। মনের ভেতর লুকিয়ে রাখতে হয় না। যত তাড়াতাড়ি বলে দিবে ততই ভালো। নইলে পরে সে অন্য কারো হওয়ার চান্স আছে।”

-“হবে না। আমি যাকে ভালোবাসি তার অন্য কারো হওয়ার জিরো পার্সেন্ট চান্সও নেই।”

-“বাবাহ! কী কনফিডেন্স! ভালো ভালো। তা মেয়েটা কে তা কি আমাকে দেখানো যাবে? আমিও একটু দেখব, ওর কোন গুণে আমাদের ডাক্তার সাহেব পাগল হয়েছে।”

শুভ্র হাসছে। আলোর চোখে আগ্রহ দেখে তার ভালো লাগছে। আবার এটা ভেবেও হাসি পাচ্ছে, সে যদি এখন আলোকে বলে মেয়েটা আর কেউ না। সে হচ্ছ তুমি। তখন আলোর কেমন রি-অ্যাকশন হবে? এই মিষ্টি মিষ্টি কথা মুখে থাকবে তো? নাকি সোজা থাপ্পড় বসিয়ে দিবে। বলা যায় না। আলোর দ্বারা সব সম্ভব। থাপ্পড় মারতেও পারে। আলো বলে যাচ্ছে,

-“কী হলো? দেখা করাবে না?”

শুভ্র সব কথার মাঝে হঠাৎ অন্য একটা কথা বলে ফেলল,

-“আলো তুমি ডিভোর্স নিচ্ছ না কেন? যতই তুমি তোমার হাজবেন্ডের থেকে আলাদা থাকো। কাগজে কলমে এখনো তোমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ। তুমি ওই লোকটার থেকে ডিভোর্স নিয়ে নাও। নিজেকে ওর সাথে জুড়ে রেখে লাভ কী বলো? তুমি যত শীঘ্রই পারো, ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করো। আমি তোমাকে সব ধরনের হেল্প করব। তোমার সব সমস্যাতে আমাকে পাশে পাবে তুমি।”

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here