ইতি মাধবীলতা পর্ব -০৫

ইতি মাধবীলতা – ৫
আভা ইসলাম রাত্রি

নিলাংসু নিজ কক্ষে বসে তখন হুক্কা টানছিল। এমনিতেই এসব ছাইপাঁশ টানার নিলাংসুর বদস্বভাব নেই। কিন্তু কদিন ধরে যা চিন্তা যাচ্ছে মস্তিষ্ক বেয়ে, তাতে হুক্কার এক-টান দু’টান নিলে আহামরি ক্ষতি তো হয়ে যাবে না। বরং মনটা বেশ শান্তি লাভ করবে।
খানিক পর দরজা খোলার আওয়াজ শুনে নিলাংসু সামনে তাকালো। মাধবী এসেছে। হাতে বড় প্লেট, তাতে দু গ্লাস দুধ। দুধের রঙটা একটুখানি ঘোলাটে লাগলো নিলাংসুর কাছে। তার ভ্রু খানিক কুঁচকে গেলেও বেশ স্বাভাবিক দেখালো তার বদন। নিলাংসু আরো একবার হুক্কায় টান দিয়ে বললো,
— আসতে এত দেরি হলো কেনো? কি করছিলে বাইরে বসে?

মাধবী তাকালো তবে বিশেষ কোনো উত্তর প্রদান করলো না। হাতের প্লেটটা ধীর হাতে টেবিলের উপর রাখলো। অতএব, ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
— আমি কখন কি করবো তা বুঝি আপনাকে জানিয়ে করতে হবে? কিনে নিয়েছেন আমায়?

নিলাংসুর রাগ হলো বেশ। তবে মুখে নিছক হাসি টেনে বললো,
— বিয়ে করা বউ তুমি আমার। এখন বিয়েকে যদি তুমি এককথায় কেনা বলতে চাও, তবে বলতেই পারো তুমি।

নিলাংসুর এহেন আধিক্ষেতা খুব একটা হজম হলো না মাধবীর। তবে এখন পাল্টা কোনো জবাব দিলো না সে। এখন মূল কাজ হাসিল করাটাই মূখ্য। বাকি সব চুলোয় যাক! মাধবী এক গ্লাস দুধ নিলাংসুর দিকে এগিয়ে দিল। কণ্ঠনালি যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বললো,
— আপনার মা খেতে বলেছেন। খেয়ে দেয়ে উদ্ধার করুন আমায়।

নিলাংসু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
— আমার মা মানে? আমার মা তোমার কি হয়?
— কিছুই হয়না। আমি মন থেকে যেখানে এই বিয়ে মানিনা, সেখানে আপনার মা কেনো? আপনিও আপনার কিছু হন না।

নিলাংসু বেশ অপমানিত বোধ করলো। কিন্তু পরক্ষণেই একথা মস্তিষ্কে কিলবিল করলো, ‘ আসলেই, মাধবী যেখানে এ বিয়ে মানে না, সেখানে তার কাছে এ সম্পর্কের মূল্য আশা করা নিছকই বোকামি! ‘ নিলাংসু ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। হুক্কার মেশিনটা একজায়গায় রেখে দুধের গ্লাস হাতে নিল। মাধবী পাশেই ঠাঁট মেরে দাড়িয়ে রইলো। মাধবীর এমন করে দাঁড়িয়ে থাকা নিলাংসুর বেশ খটকা লাগলো। আবার দুধের রং এতটা ঘোলা হওয়া তার মনকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। সে যা ভাবছে, তাই কি সঠিক? একবার পরখ করে দেখা যাক!

— ওদিকের আলমারিটায় আমার একটা নতিপত্র আছে, নিয়ে আসো তো।

মাধবী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। বললো,
— আমি আপনার কোনো আদেশ মানতে বাধ্য নই।

নিলাংসু হাসলো খানিক। দুধের গ্লাসটা পুনরায় প্লেটে রেখে দিলো। বালিশে মাথা দিয়ে ওপাশ ফিরে বললো,
— ঠিকাছে তবে। আমি এখন খাবো না, ঘুমাবো। বড় বাতিটা নিভিয়ে দাও। নাকি এটাও পারবে না?

মাধবী পড়লো মহাবিপদে। এ কি জ্বালাতন? এ গ্লাসের দুধ না খেলে তো মাধবীর পরিকল্পনা সফল হবে কি করে? মাধবী তরিগরি করে বললো,
— আচ্ছা, দিচ্ছি। উঠেন, আর নাটক করতে হবে না।

নিলাংসুর খটকা এবার আরো মজবুত হলো। এই দুধের মধ্যেই নিশ্চয়ই কিছু আছে! নাহলে মাধবী এমন করে তা খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো না! নিলাংসু আবারও হাসলো। আশ্চর্য্য! তার ভালোবাসার মানুষ, তার প্রিয়তমা তাকে বিষ খাইয়ে মারার পরিকল্পনা করছে, আর সে বেহায়ার মত হাসতে ব্যাকুল। মানব মন বোঝা এ ভুবনে কার সাধ্য!

মাধবী যখন আলমারিতে নতিপত্র খুঁজতে ব্যাকুল, ঠিক তখনই নিলাংসু দুধের গ্লাস অদল বদল করে ফেললো। নিজে মাধবীর জন্যে আনা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে তা বেশ অর্ধেক গলাধঃকরণ করে ফেললো। মাধবী হাতে নতিপত্র নিয়ে নিলাংসুর কাছে এলো। নিলাংসু বাকি অর্ধেক দুধ টুকু খেয়ে ঠোঁট মুছে গ্লাসটা টেবিলে রেখে দিল। মাধবীর হাত থেকে নতিপত্র নিজ হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলাতে মশগুল হয়ে পড়লো। নিলাংসুকে পুরো দুধটুকু খেতে দেখে মাধবী মনে মনে কুটিল হাসলো। এবার বুঝবে বাছাধন, কত ধানে কত চাল? একবার মরো, তারপর বুঝবে, সারাক্ষণ মাধবীলতা বলার শাস্তি কিরূপ? মাধবী এবার নিজের জন্যে আনা দুধটুকু খাওয়ার জন্যে গ্লাস হাতে নিল। ঠোঁটের সংস্পর্শে আনতেই ব্যগ্র হাতে মাধবীর হাত আটকে নিল নিলাংসু। মাধবী থমকে গেলো। অবাক নয়নে তাকালো নিলাংসুর পানে। নিলাংসু বললো,
— খেও না, ওতে বিষ আছে।
মাধবীর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে অবাক কণ্ঠে বললো,
— এ গ্লাসে বিষ কি করে? বিষ তো আপনার…
ইস, এক্ষুনি কি বলতে যাচ্ছিল সে। মাধবী দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। নিলাংসু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে মুখোমুখি হলো তার মাধবীলতার। প্রিয়তমার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে গম্ভীর সুরে বললো,
— আমার মৃত্যু এত সহজ না, মাধবীলতা। আমাকে আমি না মারতে চাইলে, এ ভুবনে কেউ আমায় মৃত্যু দিতে পারবে না, একমাত্র ভগবান ব্যতীত। এমনকি তুমিও না।

মাধবী স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে রইলো, তার মগজ চক্র খাচ্ছে! নিলাংসুকে মারার পরিকল্পনা এবারও কি তবে ভেস্তে গেলো! ইশ, কি দুর্ভাগ্য!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here