ইতি মাধবীলতা পর্ব -অন্তিম

ইতি মাধবীলতা – অন্তিম পর্ব
আভা ইসলাম রাত্রি

কাঁচুমাঁচু হয়ে মাধবী বসে আছে কেদারায়। তার ঠিক সম্মুখে নিলাংসু হাতে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিলাংসুর হিংস্রতা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে মাধবীর ছোট্ট মনকে। নিজ চোখে তার সাজানো গোছানো বিশ্বাস ভেঙে যেতে দেখে মাধবীর প্রাণ হু হু করে কেঁদে উঠছে। নিলাংসু ধীর পায়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মাধবীর সামনে। মাধবীর গেল ছুরি স্পর্শ করলো। ঘৃণায় মাধবী মুখ আড়াল করে ফেললো। নিলাংসু কিঞ্চিৎ হাসলো। মাধবীর সারা মুখে ছুরি স্পর্শ করতে করতে বলল,
— আমায় একটুও ভালোবাসতে পারলে না। অথচ আকাশসম অবিশ্বাস ঠিকই করে নিলে। কেনো, মাধবীলতা?

মাধবী ক্ষেপা কণ্ঠে বলল,
— কারণ আমি নিজ চোখে দেখেছি আপনাকে রক্ত মুছতে। আপনি একটা খুনি, খুনি আপনি!

মাধবীর তেজপূর্ণ কণ্ঠ নিলাংসুর একটুও সহ্য হলো না। সে মাধবীর দুগল আঙ্গুলের মাথায় চেপে ধরলো। ব্যথায় মাধবীর গাল লাল হয়ে গেল। বেপরোয়া নিলাংসু খচখচ কণ্ঠে বলল,
— যে চোখ আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজে বেড়ায়, সে চোখ আমি উপড়ে ফেলি। কিন্তু আপসোস, আমার ভালোবাসা তোমার গায়ে আঘাত হানা শিক্ষা দেয়নি। বেচে গেলে!

মাধবীর চোখে জল এলো। আস্ত সাগর টলমল করে উঠলো তার দু নয়নে। অতঃপর নিলাংসু কোনোরূপ বাক্য ক্ষয় না করে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে ঘরবন্দী করে গেলো মাধবীকে।

সম্পূর্ণ একা এক বিশাল বাড়িতে বসে থাকতে মাধবীর ভয় লাগছে। নানা ভূতুরে চিন্তা মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। কিন্তু সব চিন্তার মূল চিন্তা, নিলাংসুর সত্যিটা তবে কি?
মাধবীর মস্তিষ্ক যখন ছক সাজাতে ব্যস্ত তখন পাশে টিংটিং করে বেজে উঠলো টেলিফোন। মাধবী ধ্যান ভেঙে চকিতে তাকালো পাশে। হন্তদন্ত হয়ে টেলিফোন নিজের কানে ধরলো। ওপাশ থেকে কেউ যেনো বলছে,
— বাবু, আগারগাও এর বাড়িতে একবার আসবেন। ছেলেগুলি বেশ হট্টগোল করছে। বাবু, বাবু? শুনতে পারছেন আপনি?

মাধবী মস্তিষ্ক তাৎক্ষণিক সজাগ হয়ে গেলো। সে ফোন কেটে দিলো মুহূর্তেই। এখন কি করে এ বন্ধ বাড়ি থেকে বের হবে সে?

সম্পূর্ণ বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে বের হওয়ার কোনো উপায় পেলো না মাধবী। তবে হঠাৎ চোখ গেলো পাশের এক পরিত্যক্ত কক্ষে। সেখানটা এখনো খুঁজে দেখেনি সে। মাধবী কালবিলম্ব না করে পা চালিয়ে পরিত্যক্ত কক্ষে প্রবেশ করল। সে কক্ষে ছিল বিশাল এক জানালা। জানালা পেরিয়েই এ বাড়ির উঠোন নজরে এলো। বেশ উঁচু জায়গাটা। তবে মাধবী শিব নাম জপ করে জানালা হতে লাফ দিলো। গড়িয়ে পড়ল শক্ত মাটিতে। হাত পায়ের ত্বক ছিলে গেলো তার। তবুও এ নারী দমে গেল না। হাতে একটা পোলারয়েড ক্যামেরা নিয়ে রিকশা করে চললো আগারগাও।

নিজ নাম লুকিয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছালো কাঙ্ক্ষিত গলিতে। তবে এখন বিপত্তি সাধলো বাড়ি নং খোঁজার বেলায়। মাধবীর হেঁটে হেঁটে চারপাশ দেখলো। কোন বাড়িতে নিলাংসু আছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবুও নারী মন চেষ্টা চালিয়ে গেলো।

হঠাৎ একটা বড় ট্রাক সে গলিতে প্রবেশ করলো। মাধবী তাতক্ষিনক লুকিয়ে পড়লো একটা গাছের আড়ালে। এরপর যা দেখলো তাতে মাধবীর আত্মা রীতিমত কেপে উঠলো। ট্রাক থেকে কতগুলো কিশোর ছেলে মাতাল অবস্থায় নামছে। এদের হাতে হাতকড়া, গায়ের জামা স্থানে স্থানে ছেড়া-ফাটা। শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন। মাধবী তাদের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো। এদের মধ্যে একজন মলি কাকার ছেলে! তবে কি গ্রামের কৃষক ছেলেদের নিলাংসুই অপহরন করে? মাধবী হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। নিলাংসু এত জঘন্য পুরুষ? মানুষের সামনে ভগবান হয়ে, পেছন পেছন তার এত বড় হিংস্রতা? মাধবী আর ভাবতে পারলো না।

অতঃপর, দুজন পালোয়ান পুরুষ কিশোরদের একটা বড় কারখানাতে প্রবেশ করালো। মাধবী বুঝতে পারলো, বাড়ি নয় বরং নিলাংসুর সব কুকীর্তি সাধন হয় এ কারখানাতে।
মাধবী গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে কিশোরদের ভিড়ে ঢুকে গেলো। পালোয়ান দুজন একদম পেছনে থাকায় তারা মাধবীকে লক্ষ্য করলো না। মাধবী হাতের ক্যামারা শক্ত হাতে চেপে ধরে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করলো।

কারখানার ভেতরটা বেশ অন্ধকার। টিমটিম আলোর ছটাকের উপস্থিতে মাধবী ক্যামেরা চালু করলো। এই ক্যামারে নতুন বেরিয়েছে। মাধবী তার পাঠশালায় এই ক্যামেরা চালানো শিখেছিল। আজ সেই শিক্ষারই প্রয়োগ ঘটাচ্ছে সে।

সেই কিশোরগুলোকে নিয়ে এক পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। দুজন লোক কিশোর গুলোর হাতের কি একটা ইনজেকশন দিচ্ছে। ইনজেকশন দেওয়ার পর পরই কিশোর গুলো কেমন যেনো পাগলের মত বিলাপ করতে লাগলো। নিজেদের শরীরে আঁচড় কাটতে লাগলো ক্রমাগত!
কিছুক্ষণ পর কিশোরগুলো শান্ত হয়ে গেলো। তার খানিক পরই দেখা মিলল নিলাংসুর। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত অশুভ এক পুরুষ! নিলাংসুকে দেখেই মাধবী চট করে এক স্থানে লুকিয়ে পড়লো। নিলাংসু কিশোরগুলোকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে লোকদুটিকে বললো,
— এদের এখন কাজে লাগিয়ে দাও। সম্পূর্ণ প্রস্তুত তারা। বাবাকে বলে সামনের মাসে আরো কজন ছেলে আনিয়ে ফেলো। ওদিকে আরো কজন লাগবে।

কি কাজে লাগাবে, মাধবী তা বুঝতে পারলো না। সে এর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।
অতঃপর কিশোরদের নিয়ে প্রবেশ করানো হলো এক বিশাল কক্ষে। কক্ষের মধ্যে কি বিদঘুটে গন্ধ! মাধবীর বমি চলে এলো। ওড়নার অগ্রভাগ চেপে ধরলো নাকে। এখানে অনেকগুলি মেশিন রাখা। মেশিন নিয়ন্ত্রিত এ কক্ষে ক্রমাগত মদ তৈরি হচ্ছে। লোকদুটো কিশোরদের নিয়ে এ কাজে লাগিয়ে ফেললো। কাজে বিন্দুমাত্র গাফলতি হলে তাদের শরীরে আঘাত করে দায়িত্বে থাকা কর্মচারী।
এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া মাধবী নিজ ক্যামেরায় তুলে নিলো। সন্ধ্যা হতেই কারখানা বন্ধের সময় মাধবী ভিড়ের মধ্যে ঢুকে কারখানা থেকে বেরিয়ে এলো। আজ যা দেখেছে, তাতে মাধবীর মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে! এক্ষুনি বোধহয় লুটিয়ে পড়লো সে।
____________________________
— নিলাংসু বাবু, আপনার আর আপনার বাবার বিরুদ্ধে কেইস আছে একটা। বিশাল বড় মাপের কেইস। এতদিন তো প্রমাণের অভাবে আপনাদের দুজনকে ধরতে পারিনি। আজ কোথায় পালাবেন আপনি? এবার তো আমার দখলে আসতেই হবে আপনাদের! আপনার বাবা এবার বেচে উঠতে পারবেন না, বাবুমশাই!

আচমকা নিজ বাড়িতে পুলিশের আগমন নিলাংসুকে তটস্থ করে তুললো। কপাল, নাক ঘেমে নেয়ে বিশ্রী অবস্থা। চোখের সামনে নিজের কালো সম্রাজ্যের ধ্বংস দেখতে পেয়ে তার রাগ আকাশ স্পর্শ করলো। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রক্তলাল চোখে তাকালো মাধবীর পানে। মাধবী চোখ শীতল করে চেয়ে আছে নিজ স্বামীর পানে। অপমানে নিলাংসুর চোখে জল চলে এল। নিলাংসু তেড়ে এসে মাধবীর গলা টিপে ধরলো। দাত খিচিয়ে বললো,
— আমার ভালোবাসার অপমান করার সাহস হয় কি করে তোর? কোনমুখে তুই পুলিশের হাতে সব প্রমান তুলে দিয়েছিস? বল?
মাধবীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ব্যথায় চোখে বুজে এলো। তবুও এ নারী হেসে বললো,
— আমার ভালোবাসা কখনো কাউকে খারাপ হতে শেখায় না, নীল বাবু। আমার ভালোবাসা আপনাকে ভালো করে তুলবে।
মাধবীর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে নিলাংসু এক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে পড়ল। আজ প্রথম মাধবী নিজ মুখে স্বীকার করেছে নিজের ভালোবাসার কথা। নিলাংসুর হাত অবশ হয়ে এলো। অচল হাত নেমে এলো মাধবীর গলা থেকে। মাধবী মুচকি হেসে নিলাংসুর ললাটে চুম্বন আকলো। নিলাংসুর অবাক মাত্রা এবার যেনো আকাশ ছুলো। মাধবী সরে দাড়ালো। বললো,
— আপনি সুস্থরূপে ভালো হয়ে ফিরে আসুন! আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্যে! আমি আপনার আছি, আপনারই থাকবো। শুধু আপনি ভালো হয়ে যান। সব ছেড়ে শুধুমাত্র আমার হয়ে যান। কথা দিচ্ছি, আপনার হয়ে থেকে যাবো আজীবন!

নিলাংসু তখনো অবাক চোখে মাধবীর পানে চেয়ে। তার কান আজ ঠিক শুনছে ত? তার মাধবীলতা তাকে ভালোবাসে বলেছে? এই একটা শব্দ শুনে নিলাংসু ভুলে গেলো সব রাগ, তুচ্ছ হয়ে পড়ল সব ক্ষোভ। সে চক্ষু শীতল করে চেয়ে রইল মাধবীর পানে।
অতঃপর পুলিশ নিলাংসু এবং তার বাবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল জেলে। সম্পূর্ণ জমিদার বাড়ি আজ হু হু করে কাদছে। রেখা দেবী ছেলে স্বামীর শোকে পাথর হয়ে গেছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। সবার মুখে একটাই কথা, এমন ভগবানতুল্য মানুষ কি করে অসুর হয়ে যেতে পারে?
আজ সবার চোখে জল এলেও একজনের চোখ শুষ্ক! সে হলো নিলাংসুর মাধবীলতা! অপরাধী স্বামীকে নিজ হাতে জেলে প্রবেশ করানোর মনোবল সবার থাকে না। সেজন্যে হতে হয়, অন্যায়ের জন্যে প্রতিবাদী সত্তা! মাধবীলতা পেরেছে। এ সংসার থেকে এক অন্যায় ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে সে।

কেটে গেলো কয়েক বছর। আজ নিলাংসুর মুক্তি পাওয়ার দিন। সেদিন মাধবী সেজেছে নতুন রঙে! গায়ে জড়ানো লাল সাদা শাড়ি! কপালে ছোট্ট এক লাল টিপ! চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া কোমর অব্দি! সে কি মায়াবী নজর এ নারীর! এ কটা বছর জমিদার বাড়ীর সবাই মাধবীকে নানাভাবে অত্যাচার করেছে। অনেকবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। তবুও মাধবী সবশেষে পুনরায় ফিরে এসেছে স্বামীর এ বাড়িতে! শত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে অপেক্ষা করেছে স্বামীর! আজ তার সব অপেক্ষার শেষ হবে। আজ মাধবী পুনরায় মাধবীলতাতে পরিণত হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে তার গল্প! মাধবী নাম ভেঙেচুরে রচিত হবে এক নতুন নাম, ‘মাধবীলতা’

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here