ইতি মাধবীলতা পর্ব -০৬

ইতি মাধবীলতা – ৬ (ক)
আভা ইসলাম রাত্রি

মাধবীকে এরূপ স্থির দেহে লক্ষ্য করতেই নিলাংসুর অধর কোণে চাপা হাসি ছড়ালো। সে ঠোঁট রাখলো মাধবীর কানের লতিতে। কানের লতি নিজ দন্ত দ্বারা কামড়ে ধরতেই সম্ভিত ফিরে পেলো মাধবী। ক্ষেপে উঠলো তার রক্ত, শিরা উপশিরা। সে নিলাংসুর বুকে হাত রেখে এক ধাক্কায় তাকে নিজের থেকে সরিয়ে ফেললো। নিলাংসু সরে গেলো ঠিকই, তবে ঠোঁটে সবজান্তার ন্যায় এক অদ্ভুত বক্র হাসি টেনে চেয়ে রইলো নিজের প্রিয়তমার পানে। রাগে মাধবীর সম্পূর্ণ শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। সে ভীষন রকমের তেজ নিয়ে বললো,
— আমাকে ছোঁয়ার স্পর্ধা হয় কি করে আপনার? একবার বলেছি না, আপনার স্পর্শে আমার ঘৃনা হয়! তাও কেনো বারবার একই কাজ করেন?

নিলাংসু একটুখানি হাসলো। বুকে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে তীক্ষ্ম চাওনি নিক্ষেপ করলো মাধবীর দিকে। বললো,
— কেনো? ভয় হয় আমার স্পর্শে? যদি না নিজের মন হারিয়ে ফেলো?

মাধবী কিছুটা থতমত খেলো। মানুষটা এত ত্যাড়া কেনো? স্বাভাবিক কথার এরূপ অস্বাভাবিক অর্থ বের করাই কি তার সহজাত ধর্ম? মাধবী ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। তথাপি একরত্তিও কথা বাড়ালো না। চুপচাপ নিলাংসুকে পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে বালিশ হাতে নিল। বারান্দার দিকে পা বাড়ালে নিলাংসু পেছন থেকে প্রশ্ন করে বসে,
— কোথায় ঘুমাবে তুমি?

মাধবী যেতে যেতে বলে,
— আপনার পাশে তো অবশ্যই নয়! বারান্দায় ঘুমাবো এখন থেকে।

এবার নিলাংসুর বেশ রাগ হলো। রাগের উত্তাপে নাকের ডগা লাল টকটকে হয়ে গেলো। রক্তিম ঠোঁটজোড়া নিছক কেঁপে উঠলো। সে তেড়ে আসলো মাধবীর পানে। অন্যমনস্ক মাধবীকে হুট করে নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা পাজকোলা করে নিয়ে ছুটলো নিজের বিছানার পানে। মাধবী হতবাক হলো, অতি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকালো নিলাংসুর পানে। অতঃপর, অস্থির হয়ে উঠলো। পা নাড়াতে লাগলো ক্রমাগত, হাত দিয়ে নিলাংসুর বুকে অজস্র আঘাত বসালো। তবে নিলাংসুর তা দেখার বিন্দুমাত্র অবসর নেই। সে তার কাজে মত্ত! মাধবীকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মাধবী চঞ্চল হয়ে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বসে চিৎকার করে বললো,
— এসব কি ধরনের অভদ্রতা? ছাড়ুন, আমি এখানে ঘুমাবো না।

নিলাংসু শুনলো। উত্তরে শুধু এটুকু বললো,
— আমার মর্জি যেখানে, তোমার রাত সেখানেই পোহাবে, মাধবীলতা!

অতঃপর, মাধবী হার মানলো মানুষটার কাছে। নিলাংসুর শক্তপোক্ত দেহের চাপে নিজের এহেন জীর্ণশীর্ণ দেহ কোথায় হারিয়ে গেলো টেরই পেলো না। নিলাংসু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে মাধবীকে। মাধবীর কোমল কাঁধে নিলাংসুর ওষ্ঠ! তার ঠোঁটের স্পর্শ মাধবীর ত্বক বেধ করে শিরা উপশিরা অব্দি পৌঁছে গেছে। মাধবী নিলাংসুর থেকে মুক্তি পেতে চড়ুই পাখির ন্যায় ছটফট করলো খানিক। তবে নিলাংসুর শক্ত হাতের স্পর্শে নিজের শক্তি খুব একটা কাজে দিলো না। মাধবী একসময় হার মানলো। রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
— আমার রাগ লাগছে, কিন্তু! ছাড়ুন আমায়।
— রাগ লাগুক! বাঁধা দিচ্ছে কে?
— আমি কিন্তু সব ছারখার করে দেবো!
— আমি তো সেই কবেই তোমার প্রেমের অনলে ছারখার হয়ে আছি!
— এর জন্যে বহুত পস্তাবেন আপনি!
— তোমাকে ভালোবাসে আমি যেটুকু সহ্য করেছি, তাতে এই পস্তানো নিছক সামান্য বটে!

মাধবী আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। নিলাংসুর ইতিমধ্যে ঘুমের চোটে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যস্ত! তবে মাধবীর চোখে ঘুম কই? তার শরীরে হিম কাঁপন সৃষ্টি হচ্ছে। গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এ কি অসহ্য অত্যাচার!
_____________________________
আজ জমিদার বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতি বছর এই ঘোরোয় উৎসব জমিদার বাড়ীর ঐতিহ্য! উৎসবের খাতিরে সম্পূর্ণ বাড়ি সেজে উঠেছে। নিলাংসু সকাল থেকে এই উৎসবের জন্যে কাজে ব্যস্ত! মাধবী আপন ঘরে বসে আছে। বিশেষ কোনো কাজ নেই তার। আর কাজ থাকবেই বা কি করে? এ বাড়ির সবাই মাধবীকে কিছু ছুঁতে অব্দি দেয়না। পাছে ছোট জাতের স্পর্শে যদি কিছু অপবিত্র হয়ে যায়?

হঠাৎ মাধবীর ঘরে দাসীর আগমন ঘটলো। দাসী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নম্র কণ্ঠে জানালো,
— বড় কত্তি, মেঝো গিন্নিমা আপনায় ডেক’চেন!
মাধবী ছোট্ট করে বললো,
— বলে দাও, আসছি আমি।

দাসী চলে গেলো। মাধবী লম্বা চুলে খোঁপা বেঁধে পা চালালো রান্নাঘরের ওদিকে।

— তোমার বাপ নাকি এসেছে এ বাড়িতে?
নিলাংসুর মেঝো কাকীর কণ্ঠে কথাটা শুনে মাধবী একপ্রকার স্তব্ধ’ই হলো। তার চোখে অবাক, বিস্ময় খেলা করলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো সে,
— আমার বাবা? কোথায় তিনি?

মেঝো কাকী চুলোয় লাকড়ি ঠেলতে ঠেলতে জবাব দিলেন,
— কোথায় আবার? সদরের সামনে। যেই না উৎসবের খবর পেয়েছে, ওমনি নাক শুঁকতে শুঁকতে এ বাড়ি অব্দি চলে এসেছে। এইজন্যেই বলে, নিচু জাত তো বেহায়ার জাত। আমি বাপু…

মাধবী আর একটুও কথা শুনলো না। ছুঁটতে ছুঁটতে চললো সদর দরজার দিকে। তার বাবা এসেছেন? কতদিন পর?

সদরের সামনে শীতল পাটি পেতে রাখা। তাতে গরীব মানুষের ভোগ খাওয়ানো হচ্ছে। নিজের বাবাকে সেখানের এক স্থানে ঠায় বসে থাকতে দেখে মাধবীর আত্মা যেনো ছলকে উঠলো। নিজের ভগবান তুল্য পিতার এরূপ অপমান মাধবীর একটুও সহ্য হলো না। মাধবী এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুঁটে গেলো বাবার পানে।

— বা-বাবা?
এতদিন পর বহু প্রতীক্ষিত মেয়ের কণ্ঠে নিজ সম্বোধন শুনে রামনাথ ফিরে তাকালেন। মাধবীর ছলছল করা চোখে দৃষ্টিপাত করতেই তার বক্ষপিঞ্জরে লুকিয়ে থাকা হৃদপিন্ড আঁতকে উঠলো। মাধবী দৌঁড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। মাধবীর চক্ষু থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে রামনাথের ঘাড় স্পর্শ করলো। রামনাথ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিয়ে মগ্ন। মাধবী বলতে লাগলো,
— এতদিন কই ছিলে, বাবা? আমি খবর পাঠিয়েছিলাম বেদপুরে!! কিন্তু খবর দেইনি কেউ। এতদিন কেনো এলে না তুমি?

রামনাথ উত্তর খুঁজে পেলেন না। আসল বিষয় তো কোনো অন্য! মেয়ের প্রতি রাগ, ক্ষোভ তাকে এতদিন অন্ধ করে রেখেছিল। চোখ থাকতেও তিনি বেপরোয়া ছিলেন। আজ মাধবীর মা, কাজল কত করে বলেছে, মেয়েকে দেখে আসতে। তাই কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে রওনা হয়েছিলেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ীর দিকে। রামনাথ উত্তরে মনযোগ দিলেন না। নিজে প্রশ্ন করে বসলেন,
— তুহ সুখ আছিস তোহ, মেরি বাচ্চা?

মাধবী সরে দাঁড়ালো। কণ্ঠনালি স্বাভাবিক করে নতমুখে বললো,
— খুব আছি বাবা। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না।
রামনাথ যা বোঝার বুঝে গেলেন। মেয়ের মুখের রেখা বলে দিচ্ছে, মেয়ে তার বেশ অসুখেই আছে! এ কদিনেই চোখের নিচে কালশিটে হয়ে গেছে। যে চোখে সারাক্ষণ কাজলের রেখায় ডুবে থাকতো, আজ সেই চোখে নির্ঘুমের দুর্বিষহ চিন্হ! রামনাথের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতে পারলো, তার মেয়ে সুখে নেই। তবে তিনি তার একটুও বুঝতে দিলেন না মেয়েকে। বললেন,
— সোন, মেরি বাচ্চা! তু যে সামাজ মে এসেছিস, এ সামাজ হাম লুগোকে লিয়ে নেহি হে। এ সামাজ সাপের মত বিষে ভরা। এরা শুধু ছোবল দেনে কি মওকা ঢুন্তে হে। সাবধানে থাকবি মেরি বাচ্চা! হামারি আশীর্বাদ হামেশা তেরি উপার হে।

মাধবী ডানে বায়ে মাথা নাড়লো। মাধবীর বুকখানা কান্নার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। সমাজের জাত নিয়ে এরূপ তারতম্য তাকে অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছে। তবুও সে দমবে না। সে বেদপুরের সরদারের মেয়ে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবার মত ছোট মন নিয়ে তার জন্ম হয়নি। তার চিন্তা বিকশিত, তার মন সুগঠিত!

— আরে, কাকামশাই! আপনি এখানে?
নিলাংসুর কথা শুনে মাধবী সামনে তাকালো। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবিতে আচ্ছাদিত এক ভয়ঙ্কর পুরুষকে দেখামাত্রই যে কেউ বলতে বাধ্য, ‘ এ এক খাঁটি সুপুরুষ বটে ‘ এতক্ষণ কাজ করার দরুন তার কপাল, গলা ঘেমে উঠেছে। গলায় বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা বলিষ্ট বুকের গহ্বরে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। নিলাংসু রামনাথের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
— ভেতরে আসুন না, কাকামশাই! উৎসবের ভোগ খেয়ে যাবেন। আসুন!

রামনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। নিলাংসুকে পূর্বে মাঝেম্যেই বেদপুরে দেখা যেত। ইতি-ওতি ঘুরে বেড়াতো, আর খামখেয়ালী ভাবে খানিক পর উঁকি দিত সরদার বাড়ির জানালার দিকে। তখনো তিনি জানতেন না, এ ছেলে তার মেয়ের এইরূপ ক্ষতি করে দিবে। রামনাথ গম্ভীর সুরে বললেন,
— তার দরকার নেহি হে, বাপু! এসেই যা খাতিরদারি পেলুম, তাতেই পেট হামারা ভারগায়া। ওর নেহি চাহিয়ে হামকো!

নিলাংসুর ভ্রুতে সূক্ষ্ম এক ভাঁজ পড়লো। রামনাথের এহেন কথার প্যাঁচ বুঝতে তার বেশ সময় লাগলো। সে উত্তরের আশায় মাধবীর দিকে তাকালো। তবে নিরুত্তর মাধবীকে দেখে সে আশায়ও ঝরঝর করে পানি পড়লো। নিলাংসু হঠাৎ করে মনে পড়লো, রামনাথ এই গরীবশালায় কি করছেন? তার তো এখন বাড়ীর ভেতরে থাকার কথা! নিলাংসু মাথায় খানিক চাপ প্রদান করলো। অতঃপর, পুরো বিষয়টা তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো। নিলাংসু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কাকা, আপনাকে কেউ বাড়ীর ভেতরে যেতে বলে নি?
— উসকি কই জরুরত নেহি হে, বাপু। রেহনে কে লিয়ে হামারি ঘর আছে। আচ্ছা বেটি, এখন হাম যাই। তেরি মা একলা হে না? তুহ সাবধানে থাকিস, মেরি বাচ্চা!

অতঃপর, মাধবীর মাথায় কতক্ষণ হাত বুলিয়ে রামনাথ জমিদার বাড়ি প্রস্থান করলেন।

রামনাথ চলে যেতেই নিলাংসু মাধবীর বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরলো। মাধবী নিলাংসুর দিকে তাকালে নিলাংসু বেশ রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার বাড়িতে তোমার বাবার এরূপ অপমান হচ্ছিল, তুমি কিছু বলো নি কেন?

মাধবী খুব অবাক হওয়ার ভান করলো। আকাশ থেকে টপকে পড়ার মত চেহারা নিয়ে বললো,
— আমার বাড়ি? কোনটা আমার বাড়ি? ওহ হ্যাঁ, এই জমিদার বাড়ি যেখানে আমার বিন্দুমাত্র ইজ্জত নেই, এটা আমার বাড়ি? যে বাড়ীর প্রতিটা বস্তু ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই, এটা আমার বাড়ি? বাহ্, রসিকতা করা তো কেউ আপনার কাছে শেখে!

নিলাংসুর ভ্রু কুচকে মাধবীর পানে চেয়ে রইলো। মাধবীর বদনে স্পষ্ট কিছু কষ্ট! এ নারী ভাঙবে, তবু মচকাবে না! হে বিধাতা, নারী মনের কি বৈচিত্র্য!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here