এক মুঠো প্রেম পর্ব -০৭

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ০৭

নিজের বুকে স্পৃহার উপস্থিতি আদ্রের ভেতরটা যেন শীতল করে দিলো। স্পৃহার আবেগমিশ্রিত কথাগুলো ওকে বরফের মতো জমিয়ে দিচ্ছে। নির্বাক ভঙ্গিতে কম্পিত দুই হাত স্পৃহার পিঠে ও মাথায় রাখলো সে।

স্পৃহা কান্নামিশ্রিত গলায় আবারও বললো,

-আমার একটা আশ্রয় চাই, আদ্র। যে আশ্রয় আমাকে তার ভুবনে সম্পূর্ণভাবে বন্দী করে দেবে। সেই বদ্ধ শহরে ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর। এতো এতো ভালোবাসা থাকবে যে, পৃথিবীর সকল প্রেম তার সামনে ঠুনকো লাগবে।

স্পৃহা মাথা তুলে আদ্রের চোখে চোখ রাখলো। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আপনি হবেন আমার সেই আশ্রয়?

আদ্র বিগলিত চোখে তাকালো। স্পৃহার মায়াবী মুখটা বড্ড আদুরে ঠেকছে। হাত দিয়ে লালাভ গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। স্পর্শ করতে এতদিন যে সংকোচবোধটা কাজ করতো, সেটা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। তাই আজ নিজেকে আর বাঁধা দিলো না আদ্র। এক হাত স্পৃহার গালে রেখে কোমল স্বরে বললো,

-আমার কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণ নেই, স্পৃহা। তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে ভালোবাসার অধিকার নিয়ে কিছু বলার নেই। তাই আমি তোমাকেই ভালোবাসতে চাই।

আদ্রের সম্মোহনী চোখজোড়ায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো স্পৃহা।

গোধূলির হলুদ আকাশ এখন লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতিতে বয়ে চলেছে হৃদয় শীতল করার মতো মৃদু মন্দ হাওয়া। লেকের একপ্রান্তে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে আহির। তার ঝাপসা দৃষ্টি লেকের বিপরীত পাড়ে বসে থাকা আদ্র-স্পৃহার ওপর নিবদ্ধ। বুকের ভেতর চাপা কষ্টটা আজ দামামা বাজিয়ে আস্ফালন ঘটাতে চাইছে। আহির তো চেয়েছিল স্পৃহা আদ্রের সাথে সুখী হোক! ভালো থাকুক। তাহলে ওদের দুজনকে একসাথে দেখে তার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে?

-সহ্য হচ্ছে?

শব্দ দুটো কানে আসতেই পাশ ফিরে তাকালো আহির। পাশে আনিলা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। আহির চোখ দুটো পানিতে পূর্ণ। আনিলা সেটা দেখে শুকনো হেসে বললো,

-এটাই তো চেয়েছিলে তুমি! তাই না? স্পৃহা আদ্রকে মেনে নিক। স্পৃহা সময়ের সাথে সাথে ঠিকই আদ্রের সাথে মানিয়ে নিবে। এটা তোমার ধারণা ছিল।

আহির জোরপূর্বক হেসে আটকে যাওয়া কন্ঠে বললো,

-হ্যাঁ, ছিল তো!

-ধীরে ধীরে সেটা সত্যি প্রমানিত হচ্ছে, তাই না?

-হ্যাঁ, হচ্ছে তো!

-তুমি তো তাহলে অনেক খুশি, তাই না?

-হ্যাঁ, খুশী তো!

আনিলা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-কাদছো কেন তাহলে? তোমার ইচ্ছে তো পূরণ হয়েছে! তোমার চোখে এখন জল মানায় না।

আহির অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। চশমার আড়ালে থাকা অশ্রু সিক্ত চোখ দুটো দেখে আনিলা শ্লেষাত্মক হেসে বললো,

-আমি জানতাম, আহির! আমি জানতাম! তুমি সহ্য করতে পারবে না। কোনোদিন সহ্য করতে পারবে না।
________________________

প্রচন্ড জ্বরে বারবার শরীর কেঁপে উঠছে স্পৃহার। পাশেই চিন্তিত মুখে বসে আছে আদ্র। কপালে জলপট্টি দিতেই আরেকবার টেম্পারেচার চেক করলো। নাহ্! জ্বর কমছে না। ১০৪° এর নিচে নামছেই না।

স্পৃহার মলিন ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকাতেই প্রচন্ড কষ্ট লাগছে আদ্রের। মাঝরাতে ডাক্তার পাওয়া সম্ভব নয়। আপাতত সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। স্পৃহার পাশে বেডে হেলান দিয়ে বসলো সে। ঘুমের ঘোরে কখন চোখ লেগে গেল টেরই পেল না।

সকালে রোদের আলো চোখে মুখে এসে পড়তেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো স্পৃহা। মাথাটা ভার হয়ে আছে তার। কপালে হাত দিতেই আলগা কাপড়ের উপস্থিতি টের পেল সে। অবাক চোখে কাপড়টার দিকে তাকিয়ে পাশে ফিরতেই আদ্রকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। বেডসাইড টেবিলে থার্মোমিটার আর পানিভর্তি বোল দেখে ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো ও। মুহুর্তেই চোখে পানি চলে এলো ওর। আনমনেই বললো,

-আজ পর্যন্ত ভাইয়া ছাড়া কেউ আমার অসুস্থতায় সেবা করেনি। এমনকি নিজের মা-ও না!

স্পৃহা চোখ ঘুরিয়ে আদ্রের দিকে তাকালো। শ্যামবর্ণের ঘুমন্ত মুখটা রোদের আলোয় মায়াবী ঠেকছে। সেদিকে তাকিয়েই ঠোঁট উল্টিয়ে হাসলো স্পৃহা। বললো,

-আপনি আমায় কবে ভালোবাসবেন, আদ্র? আমি যদি আপনাকে আগে ভালোবেসে ফেলি! তখন কী হবে?

আদ্র চোখ বন্ধ রেখেই দুষ্টু হেসে বললো,

-কী আবার হবে? ডজন খানেক বাচ্চা হবে আর আমাদের একটা ক্রিকেট টিম হবে। ব্যাপারটা দারুণ না?

অগত্যা আদ্রের মুখে এমন কথা শুনে হকচকিয়ে গেল স্পৃহা। তারমানে আদ্র জেগে আছে? স্পৃহার বলা কথাগুলোও শুনেছে? ভাবতেই স্পৃহার হাসফাস লাগছে। ভীত ও ইতস্ততপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও আদ্রের দিকে।

আদ্র চোখ খুলে রহস্যময় একটা হাসি দিল। স্পৃহার সংকোচবোধটা ওর বেশ ভালো লাগছে। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই কপাল কুঁচকে বললো,

-কী হলো? বলো! তুমি চাও না আমাদের একটা ক্রিকেট টিম হোক?

স্পৃহা আমতা আমতা করে বললো,

-কীসব বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে?

-আমি একদম ঠিক আছি। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

স্পৃহার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। আদ্র সেটা উপেক্ষা করে বললো,

-তোমার ক্রিকেট পছন্দ নয়? সমস্যা নেই। আমরা তাহলে ফুটবল টিম বানাবো। ওকে?

বলেই সোজা হয়ে বসলো। স্পৃহার দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়লো আদ্র। স্পৃহা চোখ বড়বড় করে নিজেও পেছনের দিকে ঝুঁকে পড়লো। আদ্র আরও এক ধাপ ঝুঁকে একদম কাছাকাছি আসতেই স্পৃহা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। আদ্রের নিঃশ্বাস ওর মুখের ওপর পড়ছে।

কয়েক সেকেন্ড পর, ওভাবে চোখ খিঁচে থাকতেই স্পৃহার ভ্রু কুঁচকে এলো। কিছু একটা ভেবে চোখ খুলতেই দেখলো আদ্র নিজের জায়গাতেই সোজা হয়ে বসে থার্মোমিটার দেখছে। স্পৃহাকে ওভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্র ভ্রু নাচিয়ে বললো,

-কী দেখছো?

স্পৃহা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-তার মানে আপনি এটা নেওয়ার জন্য ওভাবে ঝুঁকেছিলেন?

আদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,

-হুম! কেন? তুমি কী ভেবেছিলে?

-আমি তো…

-থেমে গেলে কেন? বলো! বলো!!

স্পৃহা থতমত খেয়ে বললো,

-অব… না, কিছু না। ঐ এমনি আর কি!

আদ্র এবার শব্দ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতেই বললো,

-তোমার ভীতু ফেইসটা জাস্ট ওয়াও! আই লাইক ইট।

_________________________

আনিলা ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ঘরে আসতেই আশফিকে দেখে চমকে গেল। আশফির হাতে একটা ছবি দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল সে। ছবিটা সবসময় আনিলার বালিশের নিচে থাকে। আজ কোনোভাবে সেটা আশফির চোখে পড়ে গেছে। আশফি ভ্রু কুঁচকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ছোট্ট মাথায় নানা রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন।

হঠাৎ আনিলার দিকে চোখ যেতেই আশফির চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। বেশ কৌতূহলী গলায় বললো,

-মাম্মা, তুমি এসেছো! আমি তোমার জন্যই ওয়েটা করছিলাম। আচ্ছা, মাম্মা! এই ছবিটাতে তোমার পাশের আঙ্কেলটা কে?

আনিলা ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। কয়েকটা শুকনে ঢোক গিলে সামনে এগোলো সে।

আশফি ঠোঁট আঙুল দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,

-এখানে তোমাকে আর আঙ্কেলটাকে ব্রাইড-গ্রুম কেন সাজানো হয়েছে? তোমাদের কি বিয়ে হয়েছিল? তাহলে পাপার সাথে কি পরে তোমার বিয়ে হয়েছে?

আনিলা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না! কী উত্তর দেবে সে? ভাবনার মাঝেই আহির সেখানে উপস্থিত হলো। তাড়া দিয়ে বললো,

-বেলা কতটা হয়েছে খেয়াল আছে? ব্রেকফাস্ট করবো কখন আমরা?

আশফি আহিরকে দেখে খুশি হয়ে গেল। ছুটে এসে ওর টি-শার্টের নিচের অংশ আঁকড়ে ধরে বললো,

-পাপা, বলো না! এই ছবির আঙ্কেলটা কে?

আনিলাকে করা প্রশ্নগুলো আহিরকে করতে লাগলো আশফি। আহির ছবিটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। একবার আনিলা আর একবার আশফির দিকে তাকালো। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে আশফিকে কোলে তুলে বললো,

-জানতে চাও এটা কে?

আশফি ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বললো,

-হুম।

আহির ওর নাক টেনে বললো,

-এটা তোমার পাপার, মানে আমার ছবি।

আশফি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-এটা তোমার ছবি, কিন্তু তোমার সাথে তো এটা মিলে না!

-এটা তো অনেক আগের ছবি! প্রায় সাত বছর আগের। সময়ে মানুষ বদলে যায়, ইউ নৌ? আমিও বদলে গেছি।

আশফি বুঝদারের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ছবিটা আহিরের হাতে দিয়ে বললো,

-ওকে। আমি এখন কার্টুন দেখতে গেলাম।

আশফি চলে যেতেই আনিলা বললো,

-তুমি আশফিকে মিথ্যে বললে আহির?

-তো কি বলতাম? বলতাম যে, এটা ওর বাবার ছবি? বলতাম যে, এই ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে? বলতাম যে, আমিহ্… আমি ওর কিচ্ছু হই না? ওর সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই? এটাই বলতাম??

আহিরের কথায় ক্রোধ স্পষ্ট। আনিলা মাথা নিচু করে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,

-আমি ওভাবে বলিনি তোমায়! কিন্তু …

-আমি বুঝতে পারছি, আনিলা! আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারি। আমার কথা রাখতে গিয়েই তোমাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।

আনিলা ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

-ডোন্ট ফিল গিল্টি,, আহির। তুমিও আমার জন্য অনেক করেছো। আশফিকে পিতৃপরিচয় দিয়েছো। আমার বিপর্যস্ত জীবনটাকে গুছিয়ে দিয়েছো। আমার দুঃসময়ে তুমি আমার পাশে ছিলে। তোমার জন্য এটুকু করতেই পারি।

আহির মলিন হাসলো। নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে শুধু একটি বাক্যই ধ্বনিত হয় তার,

-ভালোবাসি, স্পৃহা! অনেকট ভালোবাসি। নিজের জীবনের থেকে বেশি, কিংবা তার থেকেও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি!!!

# চলবে…

🎀 কপি করা নিষেধ 🎀

]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here