এক মুঠো প্রেম পর্ব -১৮

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৮

একজোড়া তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে স্পৃহা মিইয়ে গিয়ে নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিল। মিস্টার প্রত্যয় চৌধুরী খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রু কুঁচকে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রান্তি সেটা খেয়াল করে বললো,

-বাবা, ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। এখন থেকে এখানেই থাকবে কয়েকদিন। আর পিহু! উনি আমার বাবা।

স্পৃহা একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললো। মিস্টার চৌধুরী স্পৃহার এমন নীরবতা দেখে বিগলিত হেসে বললেন,

-তার মানে এটাই তোর পিহু! যেমনটা বলতি, তার থেকেও বেশি চুপচাপ দেখছি মেয়েটা।

পরমুহূর্তেই স্পৃহাকে উদ্দেশ্য করে স্নেহময় কন্ঠে বললেন,

-এতো ইতস্তত কেন করছো, মা? ডোন্ট বি প্যানিকড্, মাই ডিয়ার! তুমি তো আমার দৃষ্টিতে প্রান্তির মতোই আমার মেয়ে এন্ড আমিও তোমার বাবার মতোই। এম আই রাইট?

স্পৃহা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো মিস্টার চৌধুরীর দিকে। ‘আমিও তো তোমার বাবার মতোই’ – কথাটা শুনতেই ওর ভেতরটা শীতল হয়ে গেল। এই প্রথম কারো কন্ঠে পিতৃ স্নেহপূর্ণ কথা শুনতে পেল যেটা ওর বাবাও থেকেও কখনো পায়নি। আবেগে কান্না পাচ্ছে ওর। দাঁতে দাঁত চেপে কান্নাটাকে দমিয়ে নিল সে।

স্পৃহাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিস্টার চৌধুরী হালকা হেসে বললেন,

-এভাবে দাঁড়িয়ে-ই থাকবে নাকি? চাইলে এই অধমটার পাশে বসতে পারো! প্রান্তি ছাড়া তো আমাকে বোঝার মতো কেউ নেই! আপন মানুষ থেকেও নেই। তোমার মতো আরেকটা মেয়ে পেলে মন্দ হয় না।

প্রান্তি মিস্টার চৌধুরীর পাশের চেয়ারটা টেনে স্পৃহাকে বসিয়ে দিলো আর নিজে গিয়ে বাবার আরেক পাশে বসলো। মিস্টার চৌধুরী নিজে ব্রেডে বাটার লাগিয়ে স্পৃহার আর প্রান্তির প্লেটে দিতে লাগলেন। ভাইয়ের পর এই প্রথম কারো চোখে নিজের জন্য স্নেহ দেখতে পেল স্পৃহা। জলভরা চোখে তাকালো মিস্টার চৌধুরীর দিকে।

স্পৃহার চোখে পানি দেখে তিনি অবাক হলেন না। প্রান্তির কাছ থেকে মোটামুটি সবটাই শুনেছেন তিনি স্পৃহার পরিবার সম্পর্কে। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,

-এভাবে কাঁদলে কষ্ট কমবে না, মা। বরং বাড়তেই থাকবে। নিজেকে আরো অনেক বেশি শক্ত করতে হবে তোমার। মনে রেখ, নরম মাটিতে সবাই আঘাত
করতে পারে। কিন্তু শক্ত মাটিতে কেউ আঘাত করতে আসে না। কারণ এতে নিজেকেই আঘাত পেতে হয়।

স্পৃহা নিজের চোখের পানি গুলো মুছে নিল। বার কয়েক মাথা দুলিয়ে বোঝাল, সে নিজেকে শক্ত করে তুলবে।

এমনসময়ই প্রণব হাই তুলতে তুলতে নিচে এলো। পরনে হোয়াইট টি-শার্ট আর গ্রে কালারের ট্রাউজার। চুলগুলো অগোছালো। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকাতেই নিজের বাবাকে দেখে আর চেয়ার টেনে বসলো না। প্রান্তির দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমার খাবারটা আমার রুমে পাঠিয়ে দিস তো!

প্রান্তি অবাক হয়ে বললো,

-আজ তোর কোনো রেকর্ডিং, অডিশন নেই?

-কাল মাত্র দেশে ফিরলাম। আজ আর বেরোচ্ছি না।

কথাটা বলেই প্রণব নিজের ঘরে চলে গেল। মিস্টার চৌধুরী নিজের মতোই খেয়ে যাচ্ছেন। যেন বর্তমানে তার আশেপাশে তিনি ব্যতীত আর কোনো মানুষ নেই। স্পৃহা এমনটা দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। এই বাবা আর ছেলের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে নাকি?
_____________________

আহান, নীড় আর প্রান্তি স্পৃহার সামনে গোল হয়ে বসে আছে। স্পৃহা বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। নীড় আপাতত কিছু একটা ভাবছে আর আহান ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। ওরা আসার পর-ই প্রান্তি ওদের আলাদা ডেকে সবটা বলেছে।তারপর থেকেই ওরা এভাবে বসে আছে। নীরবতা ভেঙে আহান নীড়কে কনুই মেরে বললো,

-কী এতো ভাবোস বল তো? আসার পর থেকে খালি থিংকিং মোডেই আছোস!

নীড় চোখ দিয়ে স্পৃহার দিকে ইশারা করে বললো,

-পিহুর কথা ভাবছিলাম। ও নাকি ডিভোর্সের পর থেকেই চুপ হয়ে গেছে! কোনো কথা বলছে না কারো সাথে।

আহান স্পৃহার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-ওই ছ্যাড়ি, সমস্যা কী তোর, হুম? এই বাড়িতে থাকতে কোনো প্রব্লেম হইতাসে? হইলে আমারে বল! আমি.……

আহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রান্তি দাঁত কটমট করতে করতে বললো,

-ওই! ওই!! কী বলতে চাইছিস তুই? আমার বাড়িতে থাকতে প্রব্লেম কেন হবে রে? আমি ওর যত্নের কোনোদিকেই কমতি রাখছি না।

আহান মুখ বাঁকিয়ে বললো,

-হ্যা, সেটা তো রাখবি-ই! বড়লোক মানুষ বলে কথা!! মা ডাক্তার, বাপে জমিদার, ভাইয়ে রকস্টার আর নিজে কোনো একদিন হইয়া যাবি সুপারস্টার। এতো নক্ষত্র মিলে পিহুটারে যদি জ্বালাইয়া ফেলে দেস? সেই জন্যই জিজ্ঞেস করলাম।

নীড় আহানের কথা শুনে মুখ লুকিয়ে হাসতে লাগলো। প্রান্তি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে যেন চোখ দিয়েয় ভস্ম করে দেবে।

দিনটা এমন আড্ডা বাজিতেই কেটে গেল ওদের।
_______________________

আদ্রের বাবা দেশে ফিরে এমন কিছু মোটেই আশা করেননি। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি আদ্র আর মিসেস সামায়রার দিকে। আদ্র মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রের বাবা ওর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

-আই উইশ, এমন একটা দিন দেখার আগে আমার মৃত্যু হয়ে যেত! তুমি আমার ছেলে এই কথাটা ভাবতেই আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে, আদ্র।

আদ্র চোখ তুলে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-বাবা!……

-এমন কিছু তোমার কাছ থেকে এক্সপেক্ট করিনি আমি, আদ্র। স্পৃহার মতো একটা মেয়েকে তুমি কীভাবে ……… এসময়ে ওর কেউ একজনের সাপোর্ট দরকার। আর তুমি কিনা ওর হাতটাই ছেড়ে দিলে!

-বাবা, আমি অনেক ভেবেছি। ওর ভাই ওকে এ বাড়িতে পাঠাতে চায়নি। ওকে আলাদা রাখতে বলেছিল। সবদিক বিবেচনা করেই আমি সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।

আদ্রের বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললেন,

-তুমি ওর ভাইকে এ ব্যাপারে কোনো রিকোয়েস্ট করেছিলে? এক বারও বলেছিলে তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিতে?

আদ্র একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলে। আদ্রের বাবা নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

-মাঝপথে একটা ছোট ঝড়ের মুখে পড়েই জীবনসঙ্গীর হাত ছেড়ে দেওয়াটাকে পুরুষত্ব বলে না। এমন একটা কাজের জন্য ভবিষ্যতে তোমাকে পস্তাতে হবে, আদ্র!

আদ্র নিজের মায়ের দিকে তাকালো। কিন্তু মিসেস সামায়রার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলো, তার সিদ্ধান্তে তার মা-ও তেমন সন্তুষ্ট নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে আসতেই ফোন বেজে উঠলো ওর। টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে কানে তুলতেই শুনতে পেল,

-কখন থেকে কল দিচ্ছি কোনো রেসপন্স-ই নেই! ফোন ফেলে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি বল তো?

আদ্র শুকনো হেসে বললো,

-প্রণব, তুই? কবে দেশে ফিরলি?

-এই তো কাল রাতেই! তা কেমন চলছে তোর দিনকাল? বাবা হচ্ছিস অনেক আগেই শুনেছিলাম। তোর বউ কেমন আছে এখন?

আদ্র খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল এমন প্রশ্নে। আমতাআমতা করতে করতে বললো,

-আব্… আ…আছে ভালোই।

-ভালো থাকলেই ভালো। আমি এখন ফ্রী-ই আছি। তোদের বিয়েটা তো এটেন্ড করা হয়নি! ভাবীকেও দেখা হলো না। তাই ভাবলাম একটা ইভেন্টের এরেঞ্জমেন্ট করি। কী বলিস?

আদ্র হকচকিয়ে গিয়ে বললো,

-এখন? এখন এসবের দরকার নেই। আসলে…

প্রণব কিছু একটা ভেবে বললো,

-ওকে ওকে… বুঝতে পেরেছি। পরে কখনো দেখা করবো তাহলে। এখন দরকার নেই।

আদ্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। প্রণবকে এসব কিছু জানতে দিলে চলবে না। বাইরের কাউকেই কিছু জানাবে না সে।

আদ্রের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোনটা রাখলো প্রণব। আদ্র যে ওর কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে, সেটা তার কথার ভাজে ঠিকই বুঝতে পেরেছে ও। কিন্তু কী লুকোচ্ছে? ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, এ ব্যাপারে জানাটা জরুরি। আবার মনে হচ্ছে, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটা ঠিক হবে না। মানসিক দোটানা নিয়েই গিটারটা হাতে নিল সে। বাইরে তাকিয়ে দেখলো রাতের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে অনেক আগেই। তাই গিটারটা নিয়ে ছাদে চলে গেল। কিন্তু ছাদে যেতেই মাথায় রক্ত উঠে গেল প্রণবের।

# চলবে…

✘কপি করা নিষেধ✘

[ভুল ত্রুটি মার্জনীয় ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here