এক মুঠো প্রেম পর্ব -১৯

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৯

স্পৃহাকে ছাদের একদম কিনারার দিকে পা বাড়াতে দেখা যাচ্ছে। আর এক চুল এগোলেই সোজা ছাদ টু ফ্লোরে পড়ে যাবে ও। প্রণব ছুটে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর হাত টেনে নিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করালো। হাতে আকস্মিক টান পড়ায় স্পৃহা চমকে সামনে তাকায়। প্রণব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। সেটা দেখে ও চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

প্রণব ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো,

-ইউ স্টুপিড গার্ল! অতি শোকে পাগল হয়ে গেছেন নাকি আপনি? মরার এতো শখ আপনার! সুইসাইড করতে এসেছেন এখানে? ইচ্ছে তো করছে আপনাকে নিজেই ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেই।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। প্রণবের কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছে সে। প্রণব ঝাঁঝালো কণ্ঠে পুনরায় বললো,

-ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? লাইফে দুঃখ – আনন্দ দুটোই থাকে। কষ্ট পেলেই জীবন শেষ করে দেবেন- এটা কোনো লজিক হলো? আজকালের ছেলেমেয়েদের মনে এতো আবেগ কোত্থেকে আসে, কে জানে?

স্পৃহা প্রণবের কথাগুলো শুনে ওর গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এখন ওর বিরক্ত লাগছে। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে ও ছাদের আরেকদিকে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রণব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে এতো কথা শোনালো, অথচ মেয়েটা কিছুই বললো না! মেয়েটা কি সত্যিই কথা বলতে জানে না না-কি?

প্রকৃতিতে শীতের আগমন ঘটে-ই গিয়েছে প্রায়! হিমশীতল উত্তরে হাওয়া বারেবারে ত্রিধারে ছড়িয়ে পড়ছে। স্পৃহা গায়ে জড়ানো শালটা দিয়ে গা আরো ভালো করে মুড়িয়ে নেয়। শো শো করে বয়ে চলা বাতাসগুলো ওর খোলা চুল বারবার হাওয়ায় এলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেদিকে স্পৃহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! লক্ষ্যহীন শূন্য দৃষ্টিতে সম্মুখ পানে তাকিয়ে আছে ও।

প্রণব স্পৃহার দিকে তাকিয়ে ওকে বোঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই অনেকটা খোলা বইয়ের মতো মনে হয় তার, যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আদৌ কি মেয়েটার এই ক্ষুদ্র জীবনটায় কাহিনীর বিস্তৃতি অসীম দ্বার পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত? ভাবতে ভাবতেই নিজের হাত থেকে গিটারটা টেবিলের ওপর রেখে স্পৃহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নীবরতার ইতি টেনে বললো,

-একা একা রাতের আকাশ দেখতে অনেক ভালো লাগে, তাই না?

এমন কথা শুনে স্পৃহা সামনে থেকে চোখ ঘুরিয়ে প্রণবের দিকে তাকালো। প্রণব-ও স্পৃহার দিকে দৃষ্টি না দিয়েও সেটা বুঝতে পারলো। স্পৃহা বেশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রণব পুনরায় বললো,

-রাতে ছাদে একা এসেছেন, আপনার ভয় লাগেনি?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-ভয় কেন লাগবে?

স্পৃহার মুখের এই তিনটি শব্দ প্রণবের কানে বেজে উঠতেই ও চোখ বড়বড় করে ফেললো। স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনি কথা বলতে জানেন? আই থট, আপনি কথা বলতে জানেন না! আমি আরো প্রান্তিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম যে, আপনার ব্যাপারে এতো কিছু বললো, অথচ আপনি বোবা- এটা কেন আমায় জানালো না!

স্পৃহার কুঁচকানো ভ্রু যুগল আরো সংকুচিত হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই মন পড়লো, আজ বহুদিন পর সে মুখ ফুটে কিছু বললো আর এটাই প্রণবের সাথে বলা তার প্রথম কথা। ভেবেই চোখ সরিয়ে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো স্পৃহা। সাথে সাথেই কানে ভেসে এলো,

-তবে আই শ্যুড এডমিট দ্যাট, আপনার ভয়েসটা অনেক সুইট!

স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব বাঁকা হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পৃহা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রণব বলে উঠলো,

-প্রান্তি জীবনেও এই রাতের বেলা একা ছাদে আসতে পারতো না। আপনি এসেছেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কী!!

-যার পুরো জীবনটা-ই অন্ধকার, তার এই সামান্য আঁধারে ভয় থাকে না, জনাব। মানুষ যেটাকেই ভয় পাক না কেন, তার পেছনে একটা কারণ থাকে। সেটা হলো মৃত্যু। মানুষ মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতেই ভয়কে মনে পোষে। যার বেঁচে থাকার কোনো বাসনা থাকে না, তার কাছে এসব ভয় নিছক ও অবান্তর।

প্রণব অবাক চোখে স্পৃহার দিকে তাকালো। আবছা আলোয় স্পৃহার মলিন শুকনো মুখটার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। স্পৃহার যুক্তির প্রতিটা শব্দের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছে ও। ভেবেই ভ্রু বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো,

-এ জন্যই আপনি একটু আগে সুইসাইড করতে চাইছিলেন?

স্পৃহা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-আমি কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সুইসাইড করতে চাইছিলাম না। তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে কেউ সুইসাইড করে না।

বলেই গটগট করে চলে গেল। সবার মাঝে থাকতে বিরক্ত লাগছিল বলেই একটু ছাদে এসেছিল স্পৃহা একা কিছুক্ষণ থাকার জন্য। কিন্তু এখানেও এসে একটু নিরিবিলি প্রকৃতিবিলাস করা সম্ভব হলো না।

প্রণব এখনো বোকার মতো তাকিয়ে আছে। পরমুহূর্তেই সবটা মাথায় আসতেই নিজের মাথায় নিজেই চাটি মেরে আপনমনে হাসলো। গিটার হাতে নিয়ে সুর টুংটাং তুললো। গলা ছেড়ে গাওয়ার চেয়ে এখন সুর তুলতেই ভালো লাগছে তার।
__________________________

স্পৃহার দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে এখন। প্রান্তি সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকে ওর সাথে। এক মুহুর্তের জন্যও মন খারাপ করে থাকতে ধেয় না। স্পন্দন প্রতিদিন-ই দেখা করতে আসে বোনের সাথে। স্পৃহাকে কথা স্বাভাবিক ভাবে বলতে দেখে, ওর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেশ দেখে স্পন্দন মনে মনে একটু স্বস্তি পায়।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বসতেই প্রান্তি স্পৃহার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এক্সাইটেড হয়ে বললো,

-পিহুউউউউ!!! তোর জন্য আজ জম্পেশ একটা সারপ্রাইজ আছে।

স্পৃহা বিছানায় পড়ে যেতে নিলেই নিজেকে সামলে চোখ বড়বড় করে তাকালো। হতভম্ব হয়ে বললো,

-সারপ্রাইজ? কী সারপ্রাইজ?

-চল! চল!! বাইরে যাই। ওখানে গেলেই দেখতে পাবি।

বলেই প্রান্তি ওর হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। বাগানে যেতেই সামনে তাকিয়ে স্পৃহার চক্ষু চড়কগাছ!

-স্কুটি? তুই স্কুটি কিনেছিস?

স্পৃহা অবাক চোখে প্রান্তির দিকে তাকাতেই সে খুশিমনে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-এটা তোর জন্য, ইয়ার! তুই তো আগে এটা দিয়েই ভার্সিটি যাওয়া-আসা করতি! তাই আমি এটা তোর জন্য কিনেছি।আমরা দুজন এটা দিয়েই এখন থেকে ভার্সিটি যাবো, ইয়ার! আ’ম সো এক্সাইটেড!!

স্পৃহার চোখে পানি জমে উঠলো। সত্যিই স্কুটি ওর খুব পছন্দের। ভাবেনি কখনো যে, স্কুটি চালিয়ে আগের মতো চলাচল করার সুযোগ ওর কখনো হবে। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে স্কুটি টাতে হাত বুলিয়ে দিতেই উপর থেকে কারো কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

-যাক! পছন্দ হয়েছে তাহলে। এটা নিয়েই টেনশনে ছিলাম।

স্পৃহা মাথা উঁচিয়ে উপরে তাকাতেই দেখলো, প্রণব ওর ঘরের বেলকনি দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। উপর ছেড়ে চাবি ছুঁড়ে প্রান্তির হাতে দিয়ে প্রণব বললো,

-এখন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে খেয়েদেয়ে ভার্সিটি যা আজ থেকে। পড়াশোনা তো ছেড়েই দিয়েছিস বোধ হয়!

বলেই হাই তুলতে তুলতে নিজের ঘরে চলে গেল প্রণব।

ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটির জন্য স্পৃহাকে জোর করে রেডি করিয়ে দিলো প্রান্তি। মিস্টার চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো দুজন। স্পৃহা স্কুটির সামনে বসলে প্রান্তিও পেছনে বসে পড়লো। স্পৃহা চোখে মুখে আনন্দ ফুটিয়ে পাড়ি জমালো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রণব সেই দৃশ্য দেখে বাঁকা হাসলো।
____________________

হসপিটালে মিসেস মেহরীনের চেম্বারে বসে আছে স্পৃহা আর প্রান্তি। তিনি বেশ কয়েকটা মেডিক্যাল টেস্ট করিয়েছেন স্পৃহার। চোখের চশমাটা খুলে নিয়ে তিনি বললেন,

-রিপোর্ট না দেখে আমি কিছু বলতে পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, বলতে চাইছি না। তবে তোমার ফিজিক্যাল কন্ডিশন আগের থেকে অনেকটা ইম্প্রুভড্ হয়েছে। অ্যানিমিয়া নিয়ে যেই ভয়টা ছিল, সেটা আর নেই।

প্রান্তি ব্যস্ত হয়ে বললো,

-মা, তাহলে এখন কী করা উচিত?

-যেমন চলছে, চলতে থাক! রিপোর্ট রেডি হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

স্পৃহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সম্মতি জানালো। এসব নিয়ে আর কোনো আশা ওর মনে নেই। ঘুরেফিরে ভাগ্যে শুন্য ছাড়া কিছু মিলবে না!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। স্পৃহা আর প্রান্তি ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে তাকিয়ে চমকে গেল। সোফায় আনিলা বসে আছে আর তার পাশেই চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা। আনিলা এতো দিন পর হঠাৎ এখানে কেন এলো? তার মানে তো আহিরও এসেছে! কিন্তু আহিরকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না! ভেতরে গিয়েছে নাকি? হয় তো স্পৃহার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! ভেবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল স্পৃহা। আনিলা সেটা লক্ষ করে বললো,

-আহিরকে খুঁজছো?

এমন প্রশ্ন শুনে স্পৃহা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। পরমুহূর্তেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-প্রতারকদের খোঁজার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। যারা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না, তাদের মুখদর্শনও করতে চাই না আমি।

# চলবে……

✘কপি করা নিষেধ✘

[আগামী পর্বে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে চলেছে🙂।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here