এখানে আকাশটা ভালোবাসার পর্ব ২৯

#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ২৯
.
সায়ান চলে আসার কিছুদিন পরেই সবার সম্মতিতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল রায়ান আর সানজানার।
সানজানা পুরোপুরি রিদিমার বিপরীত চরিত্র।
কিন্তু তবুও বেশ মানসিক চিন্তায় ফেলেছিল জাহরা আর সাহরাফ কে।
জাহরা ভয় পেতেন, বড় ছেলের অবস্থা আর ছোট ছেলের না হয়।
রায়ান সানজানা আর নওশি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব বুঝিয়েছিল বাবা মাকে
“মা তুমি ছোট ভাবির সাথে এত কম কথা বল কেন?”
“কই কম বলি!”
“মা আমি বুঝতে পারছি রিদিমার জন্য আমাদের পরিবারে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার জন্য তুমি ভাবির সাথে এমন করতে পারো না!”
বলা মাত্রই নওশির মনে হলো কথাটা বেশ রূঢ় হয়ে গেছে।
দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বুঝাতে থাকে মাকে।
এর পর রায়ান আর সানজানাও বুঝিয়েছিল মা বাবাকে।
অবশেষে জাহরা বেগমের ও মনে হয়, একটা সুযোগ দিয়েই দেখেন সানজানাকে।
ভালবেসে দেখেন একবার।
সত্যিই সানজানা কথা রেখেছে।
সাহরাফ সাহেবের পরিবারের হাসিমাখা ছবি আবার দেখা যায়।
সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে, তা হয়তো সানজানা আর রিদিমাকে না দেখলে এত সুন্দর করে বোঝা যেত না।
এক মেয়ে যে সংসারে হাসি নিভিয়ে গিয়েছিল,
ঠিক বিপরীতে আরেক মেয়ে এসে হাসির প্রদীপ জ্বালিয়েছে আবার।
এভাবেই চলছিল সাহরাফ আর জাহরার সাজানো সংসার।
গল্পটা এইখানেই শেষ পারত।
এইতো সব সুন্দর, এখানেই শেষ!
কিন্তু না! জীবন হাসিকান্নার প্রভেদ করে না। জীবনের গল্প গুলো শুধুমাত্র দুঃখ বা সুখের জন্য তৈরি হয় না।
কিন্তু জীবন নিজের গতিতে চলতে থাকে।
সময়ের স্রোতে দিনগুলো ভেসে যায়, কারোর জন্য অপেক্ষা করে না।
আর এই সময়ের পাশে থেকে থেকেই উত্থান পতন ঘটে।
এভাবেই কেটে যায় সময়।
.
সেই হাটিহাটি পা ছোট মায়া আজ অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।
বিকালে মায়া বারান্দায় বসে আছে, আজ তার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর রেজাল্ট দিয়েছে। বরাবরের মতোই সবচেয়ে বেশী নাম্বার নিয়ে ফার্স্ট হয়েছে সে।
পড়ালেখাতে ভীষণ ভাল মায়া।
আস্তে আস্তে মায়ার প্রতিভাগুলোর সাথে পরিচিত হব।
মায়ার মন খুব খারাপ।
কিন্তু কারণটা কাউকে বলতে পারছে না সে।
আজ সবাই খুব খুশি তার রেজাল্টের জন্য। সবাই গিফট দিয়েছে।
তবুও কোথায় যেন মায়ার একটা মন খারাপ থেকেই গেছে কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না।
হয়তো মেজ ফুপি কিছুটা বুঝেছে।
তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তার মন খারাপ কেন। কিন্তু মায়া উত্তর দেয়নি।
আজ কোনো ভাবেই শান্ত করতে পারছে না।
বারান্দা থেকে উঠে আস্তে আস্তে মেজ ফুপির ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ধীরে ধীরে মায়ার চোখের কোনা দিয়ে অশ্রুর ধারা বইতে লাগল।
মায়ার নিজের উপরেই খুব রাগ হচ্ছে।
কেন নিজেকে শান্ত করতে পারছে না!
একপর্যায়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো মায়া।
.
ঘুমন্ত মেয়েকে শোয়াতে এসে অবাক হয়ে গেল নওশি।
ঈশরাত ঈশান আরজু।
নওশি আর ঈশানের মেয়ে।
চার বছর বয়স। ভীষণ রকমের পাকা।
সারাদিন দুষ্টুমি করে এখন একটু ঘুমিয়েছে।
মায়ার দিকে আরেকবার তাকিয়ে মেয়েকে ধীরে ধীরে শুইয়ে খাটের পাশে গিয়ে বসল যেখানে মায়া শুয়ে ছিল।
“মামনি…!”
চমকে উঠল মায়া। কিন্তু যে কান্নাকে এতক্ষণ গলার কাছে চেপে রাখতে চাইছিল সেটা হঠাৎ বেরিয়ে আসতে চাইল।
ফুঁপিয়ে উঠলো মায়া।
নওশি আর কোনো প্রশ্ন করলো না।
আস্তে আস্তে মায়ার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলো নওশি।
মায়ের মতো ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল মায়া।
মায়ার কান্না দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল নওশির।
কিন্তু কিছুই বললো না। হাত বুলাতে লাগল মায়ার মাথায়।
ছোট বেলা থেকে এই মেয়েটাকে কাছে কাছে রেখেছে। অধিকাংশ সময় নিজের কাছে রাখত।
মায়াকে নিজের মেয়ের থেকে কম দেখেনা নওশি।
মেয়ের খারাপ লাগার কারণ বুঝতে অসুবিধা হয়না ওর।
চেষ্টা করে মায়ার সেই অভাবটা কিছুটা হলেও চাপা দেওয়ার।
তবে অভাব পূরনের চেষ্টা করেনি নওশি।
কারণ জীবনে কিছু কিছু অপূর্নতা থাকে, কৃত্রিম পূর্নতা দিয়ে সেই অপূর্নতার খালি জায়গা পূরন করার চেষ্টা বোকামি।
না পাওয়ার গ্লানিকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
মায়ার চুলে বিলি কাটতে কাটতে এসব ভাবছিল নওশি।
একসময় খেয়াল করল ঘুমিয়ে গেছে মায়া।
ধীরে ধীরে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো নওশি। তাদের পরিবারে এখন আগের মতোই শান্তি ফিরে এসেছে।
কিন্তু মায়া! রিদিমার একি করে গেল!
ভাবতে ইচ্ছে করছে না রিদিমার কথা।
সায়ানের বিয়ের কথা ভাবছে নওশি অনেকদিন থেকেই।
তার ভাবার কারণ তার বান্ধবী তানহা।
অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে।
তানহাদের অবস্থা ভালো না।
অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা মা। কিন্তু তানহার স্বামী ভালো ছিল না। টাকা আর অত্যাচারের কারণে বাধ্য হয়েই বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তানহার পরিবারকে।
সেই থেকে তানহা আবার পড়াশোনা করছে।
তানহার সাথে নওশির বেশ ভালোই পরিচয়।
সায়ানের সাথে বিয়ের কথাটা ভেবেও মায়ার জন্য চুপ করে ছিল নওশি।
বাবা মাকেও বলেনি।
বাবা মাকে বললেই বাবা মা উঠে পড়ে বিয়ের জন্য লেগে যাবে। প্রভাব গিয়ে পড়বে মায়ার উপর
নওশি কোনো ভাবেই চায় না এসবের কোনো রকম প্রভাব মায়ার উপর পড়ুক।
কিন্তু আজ মায়াকে কাঁদতে দেখে তার মনে হলো মায়া নিজের জগৎ কে তৈরি করে নিয়েছে আলাদা ভাবে।
মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।
নতুন কাউকে মা হিসেবে মায়া মেনে নিতে পারবে কিনা যথেষ্ট ভাববার বিষয়।
কিন্তু এখনও তো মায়া ভাল নেই।
এ ব্যাপারে নওশি তার বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করল।
.
“মা আমি দেশে যাব”
বেশ সুন্দর বাংলা বলে নাহিয়ান।
নাহিয়ান অস্ট্রেলিয়াতেই বড় হয়েছে।
“যাব বাবা আমরা যাব” ছেলের দিকে হাসিমুখে উত্তর দেয় নিশিকা।
“কবে যাব?”
“আমরা নেক্সট ভ্যাকেশন এ যাব।”
“ও রিয়েলি মা!”
“রিয়েলি”
“কি কথা হচ্ছে মা ছেলের মাঝে?”
অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে প্রশ্ন করে জয়।
“ছেলে দেশে যাবে”
“নেক্সট ছুটিতে যাওয়া যায়”
“আমিও সেটাই বলছিলাম।” উত্তর দেয় নিশিকা।
নিশিকার ছোট্ট একটা সংসার।
খুব সুন্দর ভাবেই কেটে যায় নিশিকার সময়গুলো।
মা বাবা, শ্বশুর শাশুড়ি, ভাইবোনগুলো, বিশেষত মায়ার জন্য নিশিকারও মন কেমন করছে।
সেও চাইছিল দেশে যেতে।
“যাক ভালোই হলো”
বলে উঠে গেল নিশিকা।
“মনে হচ্ছে এখনই ব্যাগপ্যাক করবে!”
হাসতে লাগল জয়।
জয়ের দিকে একবার কপট রাগ দেখিয়ে রুম থেকে মুচকি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল নিশিকা।
.
রিদিমা!
রিদিমার সঙ্গী এখন একাকীত্ব।
শেষ বিয়েটা টেকেনি তার।
অন্য বিয়ে গুলো নিজেই ভেঙে দিয়েছে।
আর শেষ বার নিজেকেই চলে আসতে হয়েছে।
অপরাধ এর ফলাফল পেতেই হয়।
তবে রিদিমার কতটা পাচ্ছে আর কতটা পাবে আর ঠিক কতটা রিদিমা সহ্য করতে পারবে সেটা রিদিমাই জানে।
আজকাল ছেলেমেয়ে দুটোর কথা মনে হয় খুব।
মাঝে মাঝে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এক অদৃশ্য বাঁধা হয়তো সেটা পাপবোধ যেতে দেয় না অনিক বা মায়ার কাছে।
খুব বেশি সময় কাটেনি কিন্তু রিদিমার মাঝে একটা বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।
এখন আর আগের মতো অভিনয় করতে পারে না তাই হয়তো শেষ স্বামীটা টিকেনি ওর।
আর কত মানুষকে নিয়ে খেলবে রিদিমা!
কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে নেয় রিদিমা।
বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই।
তবে মায়া আর অনিকের সাথে একটু দেখা করতে ইচ্ছে করে।
আচ্ছা ওরা তো স্কুলে আসে।
একটু লুকিয়ে দেখা করলে কি সমস্যা?
নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে নিজেকেই লুকোচুরি করতে হবে ভাবতেই চোখের পানি বাঁধ মানেনা রিদিমার।
কেন সে এমন করল!
কেন!
মায়া আর অনিকের সাথে দেখা করবে বলে ঠিক করলো রিদিমা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here