এবং তুমি, পর্ব:১৬

0
871

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৬

উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছিলো। খেয়াল করেছিলাম, ফোনটিও ঠিকঠাক ধরতে পারছি না। বারবার কান থেকে সরে যাচ্ছে। ফোনের ওপাশ থেকে ততক্ষণে টুট টুট শব্দ ভেসে আসছিলো। অর্থাৎ শাশুড়িমা ফোন কেটে দিয়েছেন। নিশ্চই আমার কথাটা শুনেন নি। বিষণ্ণ মনে আমি আবারো ফোন দিলাম। কিন্তু ধরলো না। পর পর দুবার দিতেই ফোন বন্ধ শুনালো। ইংরেজী কন্ঠে ভেসে আসছিলো, -‘The number you have call is currently switched off.’ আমার নিঃশ্বাস আটকে গেলো। মনে হচ্ছিলো কেউ বোধহয় আমার গলা চেপে ধরে রেখেছে। দমবন্ধ-শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। আমার ভেতর কি যে ভয়ংকর ঝড় বইছিলো তা বলে বুঝাতে পারবো না। পাগলের ন্যায় পরিবারের বাকি সদস্যদের ফোনে কল দিলাম। কিন্তু কেউ ধরলো না। সারা রাত আমার চোখে ঘুম লাগলো না। অল্প পানির মাছের মতো ছটফট করছিলাম।

সকাল না হতেই আমি ছোট হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এলোমেলো, বিচ্ছিরি পোশাকে। বাবা তখন ঘুমে। একবার ভাবলাম ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলে যাই। পরক্ষণে বাদ দিয়ে দিলাম। দরজা টা ভিড়িয়ে বেরিয়ে আসলাম। আমার শশুড়বাড়ীতে পৌঁছাতেই দেখলাম গেইট তালাবদ্ধ। কিন্তু কেনো? সবাই কই গেলো? আমার বুক দ্বিতীয়বারের মতো কেঁপে উঠলো। আশেপাশে কোনো লোকজন দেখতে পেলাম না। মোবাইলে তখন সাত টা বত্রিশ বাজে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কি করবো?কই যাবো? বুঝতে পারছিলাম না। কেনো যেনো কান্না পেলো। ভীষণ কান্না। টলমল চোখে একটু পথ পাড়ি দিতেই আশার আলো দেখতে পেলাম। অন্ধকারে এক চিলতে আলো। সেই আলো হলেন ইদ্রীস চাচা। তিনি পাশের বাসায় থাকেন। আমার শশুড়ের সাথে গলায় গলায় খাতির।
আমাকে দেখেই তিনি অবাক হয়ে বললেন,

—তুমি এখানে? তুমি ওদের সাথে যাও নি?

আমি লম্বা শ্বাস নিলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছিলাম। কারণ আমার ভাবভঙ্গি দেখে যে কেউ স্পষ্ট বুঝবে আমি এখন কতটা পেরেশানিতে রয়েছি। হালকা হেসে বললাম,

— কোথায় যাবার কথা ছিলো? আসলে,আমি আমার বাবার বাড়ীতে ছিলাম তো,তাই আর কি…..

ইদ্রীস চাচা বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তিনি বোধহয় আশ্চর্য হয়েছেন। হবার ই কথা। বাড়ীর বউ অন্যের কাছ থেকে যদি এমন প্রশ্ন করে তাহলে তো যে কেউ ই হবে। তিনি আশ্চর্য হয়েছেন দেখে আমার ভেতরে কোনোরুপ পরিবর্তন আসলো না। আমি কন্টিনিউয়াসলি উনাকে প্রশ্ন করে গেলাম,’ তারা কই গিয়েছেন?’

ইদ্রীস চাচা আমার কথাটা বোধহয় কর্ণপাত করলেন না। উল্টো তিনি আগ্রহী কন্ঠে বললেন,

—তোমাদের কি মনমালিন্য চলছে? ইশান কি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে?

—চাচা এসব পরে বলবো, আমাকে প্রথমে বলুন উনারা সবাই কই গিয়েছেন? প্লিজ, আমার জন্য খুব জরুরী।

ইদ্রীস চাচা মনে পড়া ভঙ্গিতে বললেন,

—-ওহ,হ্যা। তুমি বোধহয় জানো না, প্রতি ২৬ এপ্রিল ওরা সবাই ওদের দেশের বাড়ী কুমিল্লায় যায়। ইশানের দাদার মৃত্যু বার্ষীকি পালন করতে। খুব আয়োজন করে লোকজন খাওয়ায়। আমি গত নয় বছরে কোনোবার ই ওদের না যেতে দেখি নি। মরে পিঠে হলেও ওরা যায়। আমি ভাবলাম এ বছর বোধহয় তুমি যাবে কিন্তু…

— সবাই গিয়েছেন? উনি মানে ইশান স্যার ও গিয়েছেন?

—কি বলো ইশান যাবে না কেনো? প্রত্যেকবার তো ইশান সবার আগেই যায়। কিন্তু আজ আমি ওদের যেতে দেখি নি। বুঝলে, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছিলো। তোমার চাচীর জন্যই উঠতে পারলাম না। শেষরাতে তার নাকি কোমরে ব্যাথা দেখা দিয়েছে। ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি।তাই ওদের যাওয়ার সময় দেখতে পাই নি।

—স্যার এবার বোধ হয় যান নি। কারণ শাশুড়ি মা গতকাল বলেছিলেন ইশান নাকি বাড়ী ফিরেন নি।

ইদ্রীস চাচা ভ্রু কুচকে বললেন,

—তুমি কি কিছু বললে?

—না,না। কিছু বলি নি। ধন্যবাদ! আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ।

কথাটা বলে দাড়ালাম না। দ্রুত হেটে সেখান থেকে চলে আসলাম। আমার গাট ফিলিংস বলছে ইশান স্যার যান নি। তিনি নিশ্চই এখন অফিসে রয়েছেন। রাত টা ও বোধহয় সেখানে কাটিয়েছিলেন। ইদ্রীস চাচা মিথ্যা বলেন নি। সত্যি সত্যি আমার শশুড় বাড়ীর লোকজন দেশের বাড়ীতে গিয়েছেন। উনারা প্রতিবছর এই দিনে যান। আমিই অতিরিক্ত টেনশনে ভুলে গিয়েছিলাম। সকালের থেকেও দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে অফিসে চলে আসলাম। পাক্কা আড়াই ঘন্টা লেগেছে। অথচ অন্যসময় দুই ঘন্টাও লাগে না। মানুষ ঠিক ই বলে,বিপদের সময় এগোয় না। এই যে দেখো আজ আমার সময়ও কেমন ধীরে চলছে।

অফিসের চারপাশের ছোট্ট জায়গা জুড়ে শত মানুষের ভীড়। এত এত মানুষ দেখে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। সবাই এখানে কি করছে? দ্রুত পায়ে হেটে অফিসের ভেতর প্রবেশ করলাম। প্রথম যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা হলো, নাফিয়া আপা, মাধবি আপাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। মাধবি আপা এখানে?কিন্তু কেনো? তারপরেই জোরপূর্বক ইশান স্যারকে খাওয়ালেন।স্যার খেতে চাইছেন না বারংবার বারণ করছেন। কিন্তু নাফিয়া আপা কিসব বলে খাওয়াচ্ছেন। নাফিয়া আপা এখানে কাজ করেন। ডিজাইনিং এর বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় তিনি। আমাদের সকল প্রজেক্টের ডিজাইনিং তিনিই করেন। খুব ভালো একজন মানুষ। মুহূর্তের মধ্যেই আমার ধারনা হয়ে গেলো এখানে কি চলছে। সেই মুহূর্তে দুনিয়া টা অন্ধকার,কুৎসিত কালো রঙের দেখলাম। মনে হচ্ছিলো কেউ আমার কলিজায় খামছে ধরেছে। আমার নিঃশ্বাস যেনো পুরোপুরি আটকে গেলো। কিন্তু আমি সেদিনের মতো উল্টো বেরিয়ে গেলাম না। মনে অদম্য সাহস নিয়ে আওয়াজ তুলে পা ফেলে ভেতরে যাচ্ছিলাম। মুহূর্তেই সবার নজর আমার দিকে চলে আসলো। ইশান, আমার দিকে হতভম্ভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। যেনো এই মুহূর্তে উনার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এখানে এসেছি। হালকা হেসে টেবিলের কাছে দাড়ালাম আমি। আনন্দিত কন্ঠে বললাম,

—কংগ্রেচুলেশন আপা,কংগ্রেচুলেশন স্যার।

আপা ভীষণ আনন্দিত হলেন। কান্নামাখা গলায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

— ওরা আমাকে শেষ করে দিয়েছে রে। একদম শেষ করে ফেলেছে।

আমি বললাম,

—তো কি হয়েছে? এখন তো আবার তোমার সব ফিরে পেতে যাচ্ছো।

আপা ব্যাথাতুর কন্ঠে বললো,
—যা চলে যায় তা ফিরে পাওয়া যায় না, রে বোন। মেয়েদের ইজ্জত এমনই জিনিস। আমার সাথেই কেনো এমন হয় বলতো?

কথাটা বলেই আপা কেঁদে দিলেন। আপার কথার সঠিক অর্থ বুঝতে পারলাম না। তবে ধারনা করলাম রিয়াজ ভাইয়ের সত্যি বোধহয় বের হয়ে এসেছে তাই দুঃখ পাচ্ছেন।

আমি বললাম,

— আপা তুমি একদম কেঁদো না। স্যারের সাথে আমার কিন্তু কোনোরকম সম্পর্ক ছিলো না। আমাকে তিনি ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন নি। উনি তোমাকে এখনোও ভালোবাসে। তোমার অপেক্ষায় এতদিন কাটিয়ে ছিলেন।আগে যা হয়েছে ভুলে যাও। আবার নাহয় নতুন করে সব শুরু করবে।

আপা তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিলেন। কান্না থামিয়ে অবাক কন্ঠে বললেন,

—কি বলছিস তুই? কিসের সম্পর্ক, কিসের ভালোবাসা?

—সত্যি বলছি আপা। এমনকি আমরা এক বিছানায় পর্যন্ত ঘুমায় নি। তিনি আমাকে মেনে নেন নি তো। যদিও তুমি এসব জানো,তবুও তোমার বিশ্বাসের ওন্য আরেকবার বলছি।
উনি কিন্তু এতদিন তোমার অপেক্ষায় ছিলেন।

মাধবি আপার চোখ ততক্ষণে আরো গোল হয়ে গিয়েছে। ইশান স্যার তো সাথে সাথেই দাড়িয়ে পড়লেন। সবাই অবাক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। যা আমার নিকট অস্বাভাবিক লাগলো,খুবই অস্বাভাবিক। আমি আপার হাত ধরে বললাম,

— তুমি এভাবে দেখছো কেনো? বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি সত্যিই বলছি। আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। থাকবেই বা কেনো তিনি তো তোমাকে ভালোবাসতেন। শুনো, শীঘ্রই আমি ডিবোর্স দিয়ে তোমার সংসার তোমাকে পুনরায় ফিরিয়ে দিচ্ছি। এবার কিন্তু আর কেঁদো না। ঠিক আছে? আর সত্যিই আমাদের মধ্যে কিছুই ছিলো না। উনি আমাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেন নি।

মাধবি আপার কাশি উঠে গেলো।চোখভর্তি জল নিয়ে বললেন,— এসব কি বলছিস তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো? কি ডিবোর্স? কি ফিরিয়ে দিবি?

আপার রিয়েকশনে আমি অবাক হলাম। ভীষণ অবাক। মুখ দিয়ে আ বের করতেই, ইশান গর্জন করে বললেন,

—শাট আপ! মুখ বন্ধ করো। দ্বিতীয়বার উল্টাপাল্টা শব্দ বের করলে ঠোঁট সিলি করে দিবো।

ইশান স্যার হুট করেই রেগে গেলেন। সবাইকে শান্ত স্বরে বেরিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু কারো নড়চড় দেখা দিলো না। এবার তিনি অসম্ভব জোরে ধমক দিয়ে সবাইকে বের করে দিলেন।আমি সহ উপস্থিত সবাই কেঁপে উঠেছিলাম। ইশান দরজা আটকে দিলেন। গটগট আওয়াজ তুলে আমার সামনে খবরের কাগজ টা বারি দিয়ে রাখলেন।

—পড়ো এটা…

আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। ইশান আরো জোরে আওয়াজ করে বললেন,

—কি হলো? হাতে নাও বলছি..

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে নিলাম। প্রথমেই দেখলাম পত্রিকার প্রথম পেইজে গোটা গোটা বড় অক্ষরে লেখা,

” রিয়াজ রাজ চৌধুরী এবং রিপন রাজ চৌধুরীর গোপন কুকীর্তি ফাঁস। তথ্যসূত্রে জানা গিয়েছে, জনাব রিয়াজ নিজের মামাতো বোন মাধবি নামের মেয়েকে জোরপূ্র্বক ধর্ষণ করেছেন। এ ঘটনায় তার বাবাও শামিল ছিলেন। বিস্তারিত, ৪ পৃষ্টা কলাম ৫।”

#চলবে….

®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here