গল্পের নাম— #এবং_তুমি♥
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ৪
.
ফ্যানের গটগট শব্দে মাথা ভনভন করছে। ভলিউম বাড়িয়ে রাখার ফলেই এমন শব্দ, ভলিউম মিডিয়াম করলেই বোধ হয় ঠিক হবে। হাত বাড়িয়ে কাউকে বলা উচিত, কিন্তু বলতে পারছি না। ইশানের মা কাঁদছেন, সবাই তাকে দেখতে ব্যস্ত। এ সময়ে আমার কথাটি বলা বেমানান। তাছাড়া বললেও যে কেউ কর্ণগোচর করবে না তাও আন্দাজ করতে পারছি। ইশানের মায়ের নাম মিনা। দেখতে শুনতে খুব রুপবতী। ইশান স্যার আর তার ভাই-বোনের রুপের উৎস যে মহিলা তা যে কেউ পলকেই বুঝে ফেলবে। ভদ্রমহিলার কান্নার আওয়াজ বোধ হয় মেইন রোড থেকে শুনা যাচ্ছে। লোকজন বেশ ভীড় জমাচ্ছেন। অথচ তিনি কোনো কিছু বলার নাম ই নিচ্ছেন না- সেই তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছেন। ভদ্রমহিলার দুপাশে শো-পিজের মতো সুন্দর সুন্দর দুটি মেয়ে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। যা খুবই বেমানান। ফ্যান চলছে তবুও কেনো বাতাস করবে? তারা হয়তো খেয়াল করে নি ফ্যান চলছে কি না! কাউকে বলা উচিত, এই তোমরা থামো, ফ্যান চলছে। আশ্চর্য তো, কেউ ই এ কথা বলছে না। সবাই ব্যস্ত ইশানের মা কেনো কাঁদছেন তা জানতে। ভদ্রমহিলা বোধহয় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে মুখ খুলবেন না। ইশান তার মায়ের সামনে বসে আছেন। সে বোধহয় এ নিয়ে হাজার বার প্রশ্ন করেছে -কেনো কাঁদছে?
ইশান বিরক্ত কন্ঠে বললো,
— মা,কি হয়েছে বলবা নাকি চলে যাবো?
—হ্যা,যা যা বউ এসে গেছে মায়ের কি দরকার। মা মরে গেলেও তো কিছু না।
— মা,তুমি বলবে কি হয়েছে নাকি সত্যি সত্যি চলে যাবো?
ভদ্রমহিলা কিছু বললেন না। তিনি কেঁদেই যাচ্ছেন। তার বাম পাশে বসা সুন্দর গড়নের মেয়েটি বললো,
—কি আর হবে? শুধু ১০২ ডিগ্রি জ্বর উঠেছিলো আর হালকা সর্দি আর কাশি। তাই না আম্মা?
—কিহ। কখন হলো এসব?
এবার ডান পাশের মেয়েটি বললো,
— যখন রাতে বউয়ের সেবা করছিলেন তখন। অথচ আপনার খবর ই নেই। বউ পেয়ে দেখি মা, বোন-ভাবি সবাইকে ভুলে গেছেন, ভাই। অথচ আগে কি বলতেন মনে আছে? যে ভাবী দুনিয়া উল্টে যাবে তবুও আপনাদের ভুলবো না। আর দেখো,একরাতেই ভুলে গেছো।
ইশান অবাক হয়ে বসে আছেন। হাবভাব বলে দিচ্ছে সে সত্যিই এসব জানতো না। ফুফুমনি ইশানের দিকে এগিয়ে আসলেন। স্বাভাবিক সুরে বললেন,
–তেমন কিছু হয় নি,ইশান। রাতে আমি ডাক্তার দেখিয়ে নিয়েছি। এখন ভাবী পুরোপুরিভাবে সুস্থ।
–কিন্তু ফুফু,আমাকে বললে না কেনো?
ফুফুমনি নিরব রইলেন। ইশান ব্যকুল হয়ে তার মায়ের নিকট গেলো। ব্যস্তভঙ্গিতে মায়ের কপালে হাত দিলো। শরীরের তাপমাত্রা নরমাল। মিনা বেগম দুবার কাশি দিলেন। তার কাশির ধরন বলছে ভনিতা।ইশান বুঝতে পেরেছে কি না, জানি না। তবে তাকে দেখে মনে হলো সে অনুতপ্ত। ফুফুমনি আমাকে ইশারায় বললেন ইশানের মায়ের কাছে যেতে। আমি মাথা নিচু করে তার পাশে গেলাম। ইশানের মায়ের পায়ের উপর হাত ছুঁয়ে ইতস্ত কন্ঠে বললাম,
—এখন কেমন লাগছে,মা?
— এই মেয়ে এই,তুমি মা বললে কেনো? আমি কি তোমার মায়ের মতো? হ্যা,বলো আমি তোমার ওই মায়ের মতো? তুমি কি এটা বুঝাতে চাইছো? এই দেখো তো আমাকে কি ওই মহিলার মতো দেখাচ্ছে?
—জ্বি, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আপনাকে কি বলবো?
ইশানের মা মুখ খুলবার পূর্বে ফুফুমনি আহত কন্ঠে বললেন,
—আহা,মিনা এভাবে বলছিস কেনো? শাশুড়ি দের কি আজকাল শাশুড়ি ডাকে নাকি তাদের তো মা,আম্মা ই ডাকে। দেখ মেয়েটার মুখ কেমন এইটুকুন হয়ে গিয়েছে।
— তাই বলে আপা, সে কেনো আমায় মা ডাকবে? তাকে বলো মাদার-ইন-লো বলতে। দেখো না , রুবি- জেবা আমায় মাদার-ইন-লো ডাকে। আমাকে কি বুড়ি দেখা যাচ্ছে? যে মা-আম্মা ডাকবে।
তর্ক শেষ করেই কান্না জুড়ে দিলেন তিনি। ইশান স্যারের বাবা পাশেই ছিলেন। তিনি বারবার বলছেন, ‘ না,না। তোমাকে একদম প্রিন্সেস ডায়ানা লাগছে।’
ইশানের মা কান্না থামিয়ে স্বামীর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
–তুমি মশকরা করছো আমার সাথে?
ইশানের বাবা মিনমিন গলায় বললেন,
-একদম না,একদম না। মশকরা করবে আমার শত্রু। আমি সত্যি কথা ই বলছি। আজ সকালে কি হয়েছে জানো? মেঝেতে এক পুরানো খবরের কাগজে দেখতে পেলাম তোমার ছবি। আমি তো বিষ্ময়ে অবাক। পরে হেডলাইন পড়ে দেখলাম এটা বিখ্যাত প্রিন্সেস ডায়ানার ছবি। ইন্টারেস্টিং না?
ইশানের মা খুশি খুশি হয়ে বললেন,
–সত্যি বলছো?
–হু
— কই আমাকে দেখাও তো। ইশশ, আমার তো লজ্জা লাগছে।
ইশানের বাবা আমতা আমতা করে বললেন,
— সেটা তো আমি প্রিন্টিং করতে পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে। কিন্তু এখন কীভাবে দেখাবো? আচ্ছা, চলো তোমাকে নিয়ে দেখাই। না থাক, দোকান থেকে আসলেই দেখিয়ে দিবো।
ইশানের মা খুশি খুশি মা হয়ে মাথা দুলালেন। শশুড়মশাই গোপনে শ্বাস ফেললেন, যেনো তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কথাগুলো যে মিথ্যা তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। অথচ স্যারের মা কে দেখো,তিনি দিব্যি খুশিতে মুচকি হেসে যাচ্ছেন। আমি নিশ্চিত তাকে দেখলে কেউই বলবে না সে এতক্ষণ অসুস্থ ছিলো। ফুফুমনি আমার কাছেই ছিলেন। তিনি মাথাটা নামিয়ে ফিশফিশ করে বললেন,
—আজ আমার ভাই টা বেঁচে গেছে।
—মানে?
— ভাবীর মাথায় একটু গন্ডগোল বুঝেছো। জন্ম থেকেই বোধহয় এমন। কয়েকদিন পর তুমি নিজেই বুঝবে। এখন চাপ নিও না। আপাতত তোমার উপর থেকে বিপদ সরে গেছে।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। সবার আজব কর্মকান্ড আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিবারের সবাই মনে হচ্ছে এমনই। ওহ,গড এবার কি হবে প্রভাতি? ফুফুমনি জানালেন, কাল আমি অসুস্থ ছিলাম সেজন্য ইশান আসতে পারে নি। ইশানের মা কিছুই বললেন না। তিনি নির্বিকারে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। ইশান বললো,
–মা, আজ আমার কাজ আছে। আমি এখন যাই, ঠিক আছে?
–যাবি? আচ্ছা যা। আসার সময় আমার ছবি নিয়ে আসবি। আর শুন, ছবি টা সবার প্রথমে আমাকে দেখাবি। মনে থাকে যেনো। তোর বাবার থেকে দোকানের ঠিকানা নিয়ে যা।
ইশান মাথা দুলালো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–একটু রুমে আসো।
কথাটা শেষ না করেই সে গটগট করে বেরিয়ে গেলো। সবাই আমার দিকে তাকালো। আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। মাথা নিচু করে উঠে আসতেই ইশান আমাকে টেনে রুমে নিয়ে গেলো। দরজা টা লাগিয়ে ঠাস করে আমায় বিছানায় বসিয়ে দিলো। ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঠৌঁটের লিপস্টিক ঘষে এলোমেলো করে ফেললো। আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অদ্ভুত কর্মকান্ড দেখছি। ইশান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? এভাবে তাকিয়ে থেকে তো কোনো লাভ নেই। আমি তোমার সাথে টিনেজারের মতো প্রেম করবো বলে তো ডাকি নি।
–তাহলে এসব করছেন কেনো?
— ইট’স নরমাল। আমার ফ্যামিলি যাতে বুঝে তোমার আর আমার মধ্যে প্রেম জমে ক্ষীর। একচুয়েলি আমি চাই না, আমাদের প্রবলেম ফ্যামেলি জানুক। আমি চাই তারা যাতে বুঝে তোমার সাথে আমি হ্যাপি। কখনো, কোনোভাবেই যেনো কেউ এটা জেনে কষ্ট না পাক আমি তোমার সাথে হ্যাপি নই। আন্ডারস্ট্যান্ড?
–জ্বি, আমার রাতের কথা মনে আছে।
—গুড।
ইশান আমাকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ড্রয়িংরুমে এসে শশুড়মশাই কে বললেন কাগজে ঠিকানা লিখে দিতে। শশুড় মুখ কাচুমাচু করে রুমের দিকে চলে গেলেন। প্রায় পাঁচমিনিট যাবৎ স্যারের বাবার অপেক্ষা করলো ইশান। শশুড়মশাইয়ের খবর না পেয়ে সে ভেতরে গেলো। ইশানের বাবা মাত্রই বাথরুম থেকে বের হয়েছেন। তার চোখমুখ নেমে গেছে। এ নিয়ে বোধ হয় দু-তিনবার বাথরুমে গিয়েছে।
–ও,মাই গড! বাবা তোমার এ কি হাল? আর কাগজ কই? কোন দোকানে দিয়েছো?
–আরে ব্যাটা, রাখ তোর কাগজ….
পুরো কথা শেষ না করেই তিনি বাথরুমে দৌড় দিলেন। দরজার চিটকানি লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘আমার ডায়রিয়া হয়ে গেছে রে ইশান।’
#চলবে…
®সোনালী আহমেদ
গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ৫.
গত আধঘন্টার মধ্যে বিশবারের মতো বাথরুমে যাওয়া আসা করেছেন ইশানের বাবা। উনার অবস্থা বর্ণনা করার মতো নয়। বেচারার চোখে পানি চলে এসেছে। আমি দুবারের উপরে স্যালাইন গুলিয়ে খাইয়েছি। তবুও উনার পেট ধরছে না। কোনো দিক না পেয়ে ছুটে গেলাম শাশুড়ি মায়ের কাছে। তাকে যেয়ে সর্বপ্রথম যে খবর টা দিলাম তা হলো, ‘ মাদার-ইন-লো, ফাদার-ইন-লো এর ডায়রিয়া হয়ে গেছে। তার অবস্থা খুবই নাজুক।’
শাশুড়িমা তখন পান চিবুচ্ছিলেন। তিনি পান খাওয়া বাদ দিয়ে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি এর উৎস ধরতে পারলাম না। বুঝেই উঠি নি কেনো তিনি এত রেগে গেলেন।
— আমার কি কোনো ভুল হয়েছে?
শাশুড়িমা জবাব দিলেন না। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
— কোথায় সে?
— ডানপাশের রুমে।
শাশুড়িমা রাগে গজগজ করতে করতে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে ফোঁসফোঁস করে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি যেয়ে সর্বপ্রথম হুংকার দিয়ে ডাক দিলেন শশুড়মশাইকে। শশুড় হুরহুর করে বেরিয়ে আসলেন বাথরুম থেকে। তিনি এক হাতে বদনা আর অন্যহাতে লুঙ্গির গিট ধরে হুশিয়ারি দৃষ্টিতে শাশুড়ির মুখপানে চেয়ে রয়েছেন। আমি হাসার পূর্বে আরো দুজনের হাসির আওয়াজ আসলো। দুজনই সম্ভবত আমার জা হবেন। তারা আমার পেছনেই দাড়িয়ে রয়েছেন।
শাশুড়িমা আমাদের দিকে তাকালেন না। তিনি চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,
— সত্য সত্য কথা বলো। আমার সাথে কিসের মিথ্যা কথা বলেছো?
শশুড় বললেন,
— বিশ্বাস করো, আমি কোনো মিথ্যা বলি নি।
— আবার মিথ্যা! ইশানের বাবা, তুমি জানো তো কখন তোমার ডায়রিয়া হয়? ওহ, তুমি তো এখন জানবে না। দাড়াও,আমি বলছি। যখন আমার সাথে মিথ্যা বলে ধরা খাওয়ার ভয় হয় তখন। ভালোই ভালোই বলে দেও কোন মিথ্যা কথাটা বলেছো?
শশুড়মশাই ভীষণ ইতস্ত করতে লাগলেন। দু হাত আটক থাকায় বেচারা তেমন সুবিধা করতে পারলো না। শাশুড়িমাও রেগে আগুন। খুবই কঠিন কঠিন কথা শুনাচ্ছেন। শশুড়মশাই জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। এর মধ্যেই তার আবার বেগ পেয়ে গেলো। বদনা, লুঙ্গি ফেলে বাথরুমে দৌড় দিলেন। শাশুড়িমা কঠিন সুরে বলতে লাগলেন,
–ইশানের বাবা,দাড়াও বলছি। দাড়াও!
শশুড়মশাই দাড়াতে পারলেন না। তার অবস্থা এমন হলো যে সে বাথরুমের দরজায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করে কখন বাথরুম আসবে আর তিনি যাবেন। ইশানের মা হুলস্থুল কান্ড করলেন। ডাক্তার ডাকা হলো চেকআপের জন্য। ইশান আর কাজে গেলো না। অথচ আজ তার খুবই জরুরী মিটিং রয়েছে। সে নিজেই জানিয়েছিলো আমায়। ভাবসাব নিয়ে বলেছিলো,
—শুনো, প্রভাতি। কাল আমি কোনো ফাংশান টাংশান করতে পারবো না। খুবই ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে বুঝেছ। খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। সাড়ে সাত লক্ষ টাকার প্রজেক্ট। এটা যে যা তা ব্যাপার নয়, বুঝতেই পারছো?
আমি হা না কিছুই বলি নি। অথচ আমার বলা উচিত ছিলো,’ স্যার, আমিও যাবো আপনার সাথে অফিসে। আরো জানা দরকার ছিলো যে আমি কি আর আপনার সাথে চাকরী করতে পারবো কি না?’ কিন্তু কিছুই বলা হলো না। স্যারের আকস্মিক বদলে যাওয়ায় আমি মুখ দিয়ে কথাই বের করতে পারি নি। বিষ্ময়ে হাত পা কাঁপছিলো। ধারনা ই করি নি যে আমাকে কাঁদতে দেখে লোকটা আর এগুবে না আমার দিকে, ভোগ করবে না লালসা আর ক্রোধে। আমি সবসময় কাঁদতে চাইতাম না। কারন আমি কাঁদলেও যা হবার তাই হতো,না কাঁদলেও তাই হতো। কেউ কখনো সিদ্ধান্ত বদলাতো না। তাই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে শুধু শুধু কেঁদে কষ্ট পাবো না। এই চেষ্টার ফলেই কাঁদতাম না, কান্না আসলেও কাউকে দেখাতাম না। অথচ, অথচ, দেখো আমার কান্নার কারণে জীবনের খুব বড় একটা কঠিন অংশ থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম।
ইশান স্যারের মাঝারি অবস্থার একটা অফিস রয়েছে। ওয়েডিং ডিজাইনিং এর। সেখানে চাকরী করি আমি। আসলে বাবার দোকান টা বেঁচার কারণে সংসারে টাকার টান দেখা দিচ্ছিলো। তাই আপুর মতো আমিও চাকরী খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম। এবং সৌভাগ্যবশত স্যারের অফিসে চাকরী পেয়ে যাই। আমি অফিস বলছি দেখে বড় কোনো দালান-টালান ভাববেন না আবার। খুবই ছোটখাটো একটা রুম। এখানে স্যারসহ আটজন কাজ করি। বিভিন্ন বিয়ের ফাংশনে কাজ করি। মজার ব্যাপার কি জানেন, আপুর বিয়েতেও আমিই সাজিয়েছিলাম এবং মেইন দায়িত্বে আমি ছিলাম। সবসময় কিন্তু স্যার মেইন দায়িত্বে থাকতো, কিন্তু এবার আমি দায়িত্বে ছিলাম। অবাক হচ্ছেন না,আমিও অবাক হয়েছিলাম। তাইতো বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম, স্যার কেনো দায়িত্বে থাকবেন না?
নিশা মেয়েটা আমার উপর উপহাস করলো। ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বললো,
—আরে গাধী,স্যারের তো নিজের বিয়ে, তিনি কীভাবে দায়িত্বে থাকবেন?
অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টের কারণে স্যারের বিয়ের কথা মাথা থেকে চলে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ইশান তখন সেখানে ছিলো না। নাহলে নিশ্চই রাগ করে রিডিকুলাস বলে হনহন করে হাটা ধরতেন।
দুপুরের দিকে হসপিটালে এডমিট করানো হলো ইশানের বাবা কে। তার অবস্থা ভালো নয়। বাড়ীর সবার সাথে আমিও গেলাম। সেখানে যেয়ে শুনলাম, তিনি এখানের রোজকার কাস্টমার। মাসেই নাকি দু-একবার জ্বর,ডায়রিয়া ইত্যাদি হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে এখানে এসে এডমিট হন। ডাক্তার রা গা ছাড়া ভাব নিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখেছেন। যেনো এটা নিত্য দিনের কর্মকান্ড। আমার খুব রাগ হলো। ইচ্ছা হলো তাদের যেয়ে বলি, আপনারা এভাবে রোগীদের সেবা করেন। এমন হলে তো রোগী এমনিতেই মারা যাবেন। কিন্তু বলা হলো না। ইশান কই থেকে এসে আমাকে ডাক দিলেন। আমি সচেতন চোখে তাকালাম।
—ও মাই গড, ও মাই গড! প্রভাতি, তোমার চোখ এত লাল কেনো? তুমিও বাবার মতো আবার কোনো মিথ্যাটিথ্যা বলো নি তো?’ ইশান কথা থামিয়ে আবারো বললো, এই, এই তুমি মাথায় হাত দিয়ে রেখেছো কেনো? কি হয়েছে?কি হয়েছে?
আমি শান্তস্বরে বললাম,
— কিছুই হয় নি।
ফুফুমনি ও এগিয়ে এসে বললেন,
— কিছু হয় নি মানে? আলবাত কিছু হয়েছে। দেখো তোমার চোখ কত লাল।
আমি আবারো বললাম কিছু না, এমনিতেই। কিন্তু কথা শেষ করতে পারলাম না। শরীর নাড়া দিয়ে উঠলো। সবাইকে দুবার দেখতে লাগলাম। ইশান আমাকে ধরে ফেললেন। ধমক দিয়ে বললেন,
—কিছু হয় নি বলছো, তাহলে এবার মাথা ঘুরাচ্ছে কেনো?
আমি ইশানের থেকে সরে যেতে চাইলাম। ইশান ছাড়লেন না। উল্টো আমায় কোলে নিয়ে নিলেন। ফুফুমনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— আমি ডাক্তারের চেম্বারে যাচ্ছি ফুফু। তুমি টেনশন নিও না। মাথা ব্যাথা করছে বোধহয়। তুমি সবার সাথে বাবার পাশে থাকো।
আমি বারণ করলাম। ইশান শুনলেন না। আমায় কোলে নিয়ে বাবার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি মোটেই রোগা-পাতলা মেয় নই, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পরনে ভারী শাড়ী এবং অর্ণামেন্টস ও রয়েছে। আমি জানি ইশানের কষ্ট হচ্ছে। খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে সে হয়তো দু-এক মিনিটের বেশি রাখতেও পারবে না। আশেপাশের ডাক্তার আর নার্সরা সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। হসপিটালে এমন সুস্থ জলজ্যান্ত মানুষকে কোলে নিলে তো তাকাবেই। আমি অতিরিক্ত লজ্জা বা অস্বস্তি কিছুই অনুভব হলো না। আমার কি যে হলো, বুঝতে পারলাম না। ইশানকে একবারও বললাম না আমাকে নামিয়ে দিন। স্বাচ্ছন্দ্যে কোলে রইলাম। ইশান ও নামালেন না। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ওয়ার্ড নাম্বার ৯০২ এর দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।
#চলবে….
®সোনালী আহমেদ