এবং তুমি, পর্ব:২+৩

গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ২

প্রবল ঝাঁকুনিতে চোখ মেললাম। চারপাশে মানুষ আর মানুষ। হায়,হায়! এত মানুষ কেনো? এত মানুষ তো বিয়েতেও দেখা যায় না। মরে গিয়েছি নাকি? সাধারণত মরার সময় এত ভীড় চোখে পড়ে।

—‘আরে আরে, বউ চোখ খুলছে। নতুন বউ চোখ খুলছে। দেখো,দেখো।’

যাক বাবা,তাহলে বেঁচে আছি। মানুষজনের হৈচৈ ক্রমশ বাড়তে লাগলো। একজন অর্ধ বয়স্ক প্রৌঢ় মহিলা হাত উচিয়ে সবাইকে থামাচ্ছেন। কাউকে তার কথায় পাত্তা দিতে দেখছি না। সম্ভবত পাত্তা দিবেও না। এত লোকজনের ভীড়ে শুয়ে থাকাটা বেমানান ঠেকছে। বসে পড়লে কেমন হয়? হ্যা,বসেই পড়ি। ঝটপট বসলাম না, ধীরে ধীরে বসলাম। নাহলে লোকজন ভাববে অভিনয় করেছি। মাথার ঘোমটা টেনে বড় করে দিলাম। ঘড়িতে চারটা আটাশ বাজে। এত রাতে এতজন মানুষের সামনে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছে। চোখের পাতা ভার হয়ে আসছে। ঘুম পুরো হয় নি বলেই হয়তো।

—তোমাকে বসতে হবে না মা,শুয়ে পড়।

আমি মাথা নাড়ালাম। তবে শুলাম না। আধ শোয়া হয়ে বসলাম। মহিলার চেহারা স্যারের চেহারার সাথে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ইনি স্যারের মা নন। স্যারের মা কে আমি চিনি। কাজের সময় এসেছিলাম এ বাড়ীতে।আমার ধারনা, ইনি খুব সম্ভবত ফুফু হবেন।

— এত কম বয়সে এত বড় অসুখ। তোমার সাবধান থাকা উচিত মা।

আমি আবারো মাথা নাড়ালাম। মানুষের কোলাহলে আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। কিন্তু কারো যাওয়ার নাম নেই। সবাই মুখ বাড়িয়ে আমায় দেখছে। যেনো আমি কোনো অভিনেত্রী আর এখানে টিভি শো চলছে। চোখমুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে পাশের মহিলার দিকে তাকালাম। আমি নিশ্চিত তিনি চট করে সমস্যা বুঝে ফেলবেন। এবং সমাধানও করবেন। কেনো এতটা নিশ্চিত জানি না। হয়তো মা বলে ডেকেছেন বলেই।

—- আমাকে মনি ডাকতে পারো। আমি ইশানের ফুফু। তোমার বোনের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, তখন তুমি ছিলে না। তাই তখন তোমার সাথে পরিচিত হতে পারি নাই।

আমি অল্প হাসলাম। ইশানের ফুফু উঠে চলে গেলেন। ফিরে আসলেন ইশানকে নিয়ে। ইশান গম্ভীর কন্ঠে বললো,

— ডাক্তার বলেছে রেস্ট নিতে। কোনোভাবেই যেনো ডিস্টার্ব না করা হয়। আপনারা বুঝতে পারছেন তো?

—উনারা থাকুক। আমার সমস্যা হচ্ছে না। আমি ঠিক আছি।

—লিসেন,তোমাকে প্রশ্ন করা হয় নি। আন্ডারস্টেন্ড? আর আপনারা এখনো দাড়িয়ে আছেন কেনো?

মুখ ভার করে মাথা নামিয়ে ফেললাম। লজ্জা লাগছে। এত মানুষের সামনে ধমক খেলে লজ্জা তো লাগবার কথা। সবাই চলে যেতেই ফুফুমনি ইশানকে বললে,

— আহা ইশান,এভাবে কথা বলছিস কেনো?

— তো কীভাবে বলবো মনি? টাইম দেখছো? এসব নাটকের জন্য এখনো ঘুমাতে পারি নি। আরো নাটক করতে হবে?

—ইশান শুধু শুধু রেগে যাচ্ছিস। এতে মেয়েটার কি দোষ।

—-মেয়েটার ই দোষ ফুফি। সে কি জানে না, তার ডায়বেটিস। ডায়বেটিসের পেশেন্ট হয়েও সারাদিন না খেয়ে আছে প্লাস টেনশন করছে। এতে কি বুঝাতে চায়? লোকজন বলুক আমরা অত্যাচার করছি?

—তুই কি জানিস যে তুই মাধবির রাগ টা ওর উপর ঝারছিস?

ইশান হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বসে পড়লেন। ফুফিও বসলেন। আমি চুপ করেই আছি।

—ইশান সত্যি বল তো, কি করেছিস ওর সাথে? উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলি না?

ইশান থমথমে মুখে বললেন,

—ফর গড সেইক ফুফি, এ কথা আরেকবারও উচ্চারণ করবা না। তুমি দেখো নি ডাক্তার কি বলেছে? বলেন নি, ডায়বেটিসের পেশেন্ট খাওয়া-দাওয়া আর ঔষধপত্র বাদ দিলে এমনই হবে?

ফুফি ওর কথায় পাত্তা দিলেন না। তিনি আমার দিকে ফিরলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন,

—একদম ভয় পাবে না মা। সত্যি কথা বলবা ঠিক আছে। ইশান তোমার সাথে কিছু করেছে না? আমাকে বলো আমি এক্ষুণি ওর খবর করছি।

—না, না। তিনি কিছু করেন নি।

— সত্য বলছো? বলো তিন সত্যি।

—তিন সত্যি।

ফুফিমণি মিষ্টি হাসলেন। ইশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— দেখেছিস ইশান। মেয়েটা কত ভালো। তোকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। তোর কপাল এত ভালো কেনো রে?

—ফুফি আমি এমন কিছু করলে সে নিশ্চই বলতো।

ফুফুমনি আবারো হাসলেন। ইনার নাম নিশ্চই হাসি। কথায় কথায় হাসেন। অবশ্য নাম টা মন্দ নয়। ভালোই মানাবে। মিষ্টি হাসির লোকজন আবার আমার পছন্দ নয়। আনোয়ার চাচাও এমন হাসতেন। আমাকে দেখলেই হেসে হেসে বলেতেন, ‘কি খুকি? কেমন আছো? তোমার মা কেমন আছে?’ এমন ধরনের লোকদের নিশ্চই পছন্দ করা উচিত নয়। তাই ফুফিমণি কে পছন্দ করা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছি।

— আমি বসে আছি দেখো বিরক্ত হচ্ছো দুজনে? হবার ই কথা। আমি কিন্তু এমনি এমনি বসি নি। তোমাদের সাথে জরুরি কথা আছে বলেই বসে আছি।

ফুফুমণি সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছেন। ইশান গা ছাড়া ভাব নিয়ে বসে আছে। যেনো তিনি জানেন কি বলবে।

— ফুফু, তুমি যা বলতে চাইছো তা আমি মানতে প্রস্তুত নই। শুধু শুধু সময় নষ্ট।

— ইশান, বিয়ে কার সাথে হবার ছিলো সেটা ইম্পরট্যান্ট নয়। কার সাথে হয়েছে সেটা ইম্পরট্যান্ট! তুমি কিন্তু মাধবির চলে যাওয়ার রাগ টা বারবার প্রভাতির উপর দেখাচ্ছো। এখানে প্রভাতির কোনো দোষ নেই। লাইফ ইজ এ ট্রেজেডি। কখন কি হবে কারো জানা নেই। তোমার জোট প্রভাতির সাথেই ছিলো তাই ওর সাথে বিয়ে হয়েছে। বুঝেছো? নাউ, তুমি সব এক্সসেপ্ট করে নাও। এটাই বেটার!’

— সব মেনে নিবো ফুফি? আমার রেপুটেশন, অপমান সব মেনে নিবো? বিয়ে না করতে চাইলে ডিরেক্ট বলবে এভাবে পালিয়ে যেয়ে আমার মানহানি করার কোনো দরকার ছিলো না। তুমি জানো না ফুফি এসব ওদের সবার চাল। এ মেয়েকে আমার ঘাড়ে তোলার চাল।

ফুফি ধমক দিয়ে বললেন,

—ইশান…

— ধমক দিলে লাভ নেই ফুফি। সবাই জানে এ মেয়ের সত্য। কোনোদিন বিয়ে হবে না বলেই এরা বাপ-বোন মিলে এ প্ল্যান করেছে।

—ছিঃ, ইশান। তুই শিক্ষিত হয়ে এসব বলছিস?

— বলছি ফুফি। তুমি জানো ওর বাবা প্রথম ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো। এই জারজ সন্তানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো ভাবতে পারো?

ফুফুমনি দাড়িয়ে পড়লেন। ইশানের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। জোরে ছিলো কি না জানি না তবে ইশানের মুখ বন্ধ হয় নি। তিনি ঠিকই আনোয়ার চাচার অবৈধ মেয়ে বলে দম ফেললেন। আমি চুপচাপ রইলাম। এই গুজব কোনোদিন আর আমাকে শান্তি দিবে না। বাবা, চাচা, খালা,ফুফি সবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এখন কি স্বামীর বাড়ীতেও কারো স্নেহ পাবো না? শশুড়-শাশুড়িকে বোধ হয় এজন্যই এতক্ষণ দেখতে পাই নি। ফুফুমণি আমার পাশে বসলেন। মাথাটা তার বুকের সাথে মিলিয়ে আদর করলেন। ইশানের রাগ ঠান্ডা হচ্ছে না, তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করছেন।

—খবরদার, আজ যা বলেছিস আর কোনোদিন যাতে তোর মুখে না শুনি ইশান। তুই কিন্তু, কথা রাখছিস না। মনে রাখিস,আমাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিস তুই।

ফুফুমনি আরো বেশ কিছুক্ষণ ইশানকে বকলেন। সাথে আমাকে বুঝাচ্ছেন। অনেক অনেক উপদেশ দিচ্ছেন। শুধু শুনে যাচ্ছি। ইশান চুপ করে আছে। বোধ হয় রাগ টা কমে এসেছে।
ফুফু আবারো তাকে ছুঁয়ে কসম দেওয়ালেন। আমাকে এর পূর্বেই দিয়েছেন। আমি চুপচাপ কসম করলাম। এ সংসারে আমার মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা হয়ে গিয়েছে। তাই সব মেনে নিলেই ভালো।

—আই সোয়ার ফুফি, তুমি যা বলছো তা মেনে নিবো। কিন্তু মনে রেখো এমন না হয় যে তুমি নিজে এসে আমাকে রিকোয়েস্ট করো এই মেয়েকে ছেড়ে দিতে। তোমার কথায় বিয়ে করেছি ফুফি। মা কিন্তু সব রিস্ক তোমার উপর ফেলেছে। আবারো ভেবে নেও ফুফি এখনো কিছুই শেষ হয় নি।

— ভেবে নিয়েছি।

–ওকে ফাইন!

বলেই ইশান উঠে দাড়ালো। ফুফুমনি আবারো আমাকে উপদেশ দিলেন। তারপর চলে গেলেন। আমি এখনো কাঠ পুতুলের মতো বসে আছি। এ বাড়ীর সবাইও কি আমাকে ঘৃণা করে? আমার এখন কি করা উচিত? কষ্ট লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে। ইশান দরজা লাগিয়ে এদিকে আসছেন। আমি নিচে নামার জন্য উঠতে লাগলাম। বালিশে হাত দিতেই ইশান আমার হাত থেকে বালিশ ফেলে দিলেন। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে আমার উপর চড়ে বসলেন। আচমকা গাবড়ে গেলাম।

—স্ স্যার কি করছেন?

— যা তুমি চেয়েছো তাই করছি। হ্যাপি?

— স্যার,ছাড়ুন। আমার এমন কোনো শখ নেই।

স্যার শুনলেন না। শরীরের শক্তি প্রয়োগ করে কানের দুল টেনে খুলে ফেললেন। অবাকের উপর অবাক হচ্ছি। ইনি সত্যি আমার বস তো? যাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে দেখি নি, সে আজ এতশত কথা বলেছে। মানুষ কি মুখের উপর কোনো মুখোশ টুখোশ পরে নাকি? নাহলে আমি মানুষ কেনো চিনতে পারি না। নাকি দুই ধরনের রূপ হয়? ঘরে এক রকম,বাহিরে আরেক রকম। মাথা ধরে যাচ্ছে, ভাবতে পারছি না।

—শাড়িতে পিন আটকানো। আমি ব্যাথা পাচ্ছি, স্যার।

চলবে….

®সোনালী আহমেদ

গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ৩

—শাড়িতে পিন আটকানো। আমি ব্যাথা পাচ্ছি, স্যার।

স্যার বোধহয় শুনলেন না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনতা জল। জানালার পর্দা ভেদ করে দমকা বাতাস ছুঁয়ে গেলো আমাদের।

চারদিকে বিয়ের উৎসব লেগে রয়েছে। লোকজনের ভীড়ে চাপা পড়ে গেছি আমি। চোখ দুটো ঘুমে ঢুলঢুল করছে। কাল সারারাত নির্ঘুম কেটেছিলো। ভোর ছয়টার সময় ডেকে তুলা হয়েছিলো আমায়। তখনও জেগে ছিলাম। এখন সাড়ে আট টা বাজে, এখনও জেগে আছি। হ্যা,এর মধ্যে আমাকে মিষ্টিজাতীয় জিনিস খাওয়ানো হয়েছে। কাল ডায়বেটিস নীল হয়ে গিয়েছিলো। তাই আজ খাবার পূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন। আমার পাশের সব লোকজন অপরিচিত। কেউই এ পরিবারের সদস্য নয়। সবাই যে ইচ্ছে করে আসছে না, সেটা বুঝতে পারছি। কেননা স্যারদের ছোট সংসার নয় যে দু-একজনের সবাই ব্যস্ত তাই আসতে পারি নি। স্যারদের বড় সংসার। স্যারের পাঁচ ভাই-বোন। স্যার সবার ছোট। বাকি সবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের বাচ্চা -কাচ্চা রয়েছে। আপুর বিয়ের কথা ঠিক হবার পর আপু অবাক হয়ে বলেছিলো,’ এই প্রভাতি শুনেছিস, উনাদের কত বড় সংসার। ও মাই গড,ও মাই গড! এত বড় সংসার কীভাবে সামলাবো?’ আমি তখন হেসে ফেলেছিলাম। আজ আমার নিজের ই টেনশন হচ্ছে এত বড় সংসার কীভাবে সামলাবো? এত মানুষের মন কীভাবে জয় করবো? কেউ ই তো আমার সাথে কথা বলছে না। চিন্তায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। না জানি কবে আবার সেন্সলেস হয়ে যাই? ও গড একবারেই সেন্সলেস হয়ে যাই না কেনো? তাহলে তো আর টেনশন নেই। সবাই শান্তি! উফফ, আবার আজেবাজে চিন্তা করছি। ড্রয়িংরুমে ফুফুমণিকে দেখতে পেয়ে আমার বিরস মুখে উজ্জ্বলতার ছোঁয়া ফুটলো। উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। ফুফুমণি একজন বৃদ্ধমহিলাকে নিয়ে এদিকে আসছেন হাসিহাসি মুখে আমার দিকে ইশারা করে কিছু বলছেন মহিলার বয়স ষাটোর্ধ হবে। গালের মাংসপিণ্ড ঝুলে রয়েছে। তবে হাসি দেখে মনে হচ্ছে তিনি সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন।

— ফুলবউ, ইনি আমার মা। তোমার দাদী-শাশুড়ি! সালাম করো।

আমি ঝটপট পা ছুঁয়ে সালাম দিলাম। পা ছুঁয়ে সালাম দেওয়ার কারণ রয়েছে। আপুর বিয়ের আগের রাতে বাবা আপুকে পইপই করে বুঝিয়েছেন যে শশুড়বাড়ীর লোকজনকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে। নাহলে তারা নারাজ হন এবং আদব-কায়দা ও শিক্ষার উপর প্রশ্ন তুলেন। আমি চাই না আমার জন্য আমার পরিবারের উপর আঙ্গুল তোলা হোক। তাই সব রিতী / আদেশ-উপদেশ মানবো। সবাইকে দেখিয়ে দিবো, আমি আমার মায়ের মতন নয়। আর না কোনোদিন হবো। হুহু!

—-থাক,থাক। বেঁচো থাকো মা, স্বামী সোহাগী হও!

আমি লাজুক হেসে মাথা নুয়ালাম। দাদী খিলখিল করে হাসলেন। মনে হয় তিনি আমাকে লজ্জা পেতে দেখে ফেলেছেন। ইশশ, এবার তো আরো লজ্জা লাগছে। দাদীর হাসির কলধ্বনি শুনে ফুফুমণিও হাসলেন। আমি অবাক চোখে দুজনকে দেখছি। দুজনের হাসি অবিকল একই রকম। তাদের হাসি দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীও হাসছে। জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধ হয় তখন হয় যখন মা, মেয়ে একসাথে হাসে। আমার আবার মায়ের সাথে একসাথে হাসার সৌভাগ্য হয় নি। তবে হ্যা, কাঁদার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেদিনের ঘটনা বলি। একদিন আনোয়ার চাচা আমার হাতে ছোট কাগজের ব্যাগ দিয়ে বলেছিলেন মাকে দিতে। আমি জানতাম না ভেতরে কি ছিলো। তখন অসাবধানতাবশত একটা চুড়ি ভেঙ্গে যায়। মা কে এনে দেওয়ার পর তিনি এটা দেখলেন। এবং সাথে সাথে রেগে যান। সেদিন আমায় খুব মেরেছিলেন। ওনার হাতের গরম খুন্তি আমার হাতের তালুতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হাতে ফোসকা পড়ায় জ্বলছিলো,আমি খুব কাঁদছিলাম। মা সেটা দেখতে পান নি। কেননা তিনি তখন ভাঙ্গা চুড়ি হাতে নিয়ে কাঁদছিলেন।

—- ফুলবউ, তুমি কাঁদছো কেনো?

ফুফুমণি অস্থির হয়ে আমার পাশে আসলেন। দাদিমা বললেন,

—-কি হয়েছে নাতবৌ? কাঁদছো কেনো?

আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,

— কিছু হয় নি। ওই এমনি….

— মিথ্যা বলবা না। মিথ্যা আমার পছন্দ নয়।

আমি চুপ করে গেলাম। ফুফুমনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— মায়ের কথা মনে পড়েছে, তাই না? বোকা মেয়ে,এজন্য মন খারাপ করবা? আজ থেকে আমি তোমার এক মা। কি মানবে না আমায় মা?

আমি মাথা নাড়ালাম। ফুফু বললেন,

—তাহলে বলো মা।

আমি চুপ রইলাম।

— কি হলো? ডাকো মা।

আমি অনেক্ষণ চুপ রইলাম। ফুফুমনি আরেকবার বলতেই অস্ফুটসুরে বললাম, ‘মা’। ফুফুমনি তৃপ্তির হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আনন্দে কেঁদে দিলাম।

—- এই পঁচা মেয়ে, কাঁদছো কেনো? থামো বলছি। দেখো মেয়ের কান্ড থামছেই না। চোখের পানি আর নাকের পানি দিয়ে যে মেক-আপ নষ্ট করে ফেলছো সেই খেয়াল আছে? ইশশ রে কি বিচ্ছিরি হাল! এক্ষুণি যে লোকজন আমার মেয়ে আস্ত একটা ভূত বলে চিল্লিয়ে পালাবে তখন কি হবে?

আমি হেসে ফেললাম। ফুফুমনি আঁচল দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিলেন। আমার এই মুহূর্তে খুব জানতে ইচ্ছা করলো, ফুফু তুমি এত ভালো কেনো? কিন্তু জিজ্ঞাস করলাম না। মনের কথা মনেই রেখে দিলাম। ফুফুমনি শাসনের সুরে বললেন,

— আর যেনো কোনোদিন কাঁদতে না দেখি। মনে থাকবে তো?

আমি মাথা নাড়ালাম। ফুফুমনি মিষ্টি হাসলেন। আমি আবারো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলাম। কি অমায়িক হাসি। দাদিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

—-ইশান কই?

—ঘুমাচ্ছেন।

—-কিহ, দামড়া এখনো ঘুমাচ্ছে। হেলেনা, যা যেয়ে দামড়া টাকে নিয়ে আয়।

ফুফুমনি মিষ্টি হেসে উঠে গেলেন। দাদিমা আমার পাশে এসে বসলেন। তিনি গম্ভীর কন্ঠে আমায় ডাকলেন,

—নাতবৌ!

—জ্ জ্বি।

—-তোমার বোনের সাথে কি তোমার যোগাযোগ আছে?

—ন্ না।

—-সে কার সাথে পালিয়েছো জানো?

—ন্ না।

— ভালো, খুবই ভালো। এসব জানার দরকারও নেই। শুনো তুমি এখন আমাদের বাড়ীর বউ। ওই মেয়ের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখবে না, বুঝেছো?

আমি মাথা নাড়ালাম। দাদিমা আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

— আমি জানি মন খারাপ করেছো। কিন্তু আমি তোমার ভালোর জন্যই বলেছি। তুমি বুদ্ধিমান। সংসার সম্পর্কে হয়তো অবগত নয়। কিন্তু শীঘ্রই যখন অবগত হবে তখন বুঝবে কেনো বলেছি।

—জ্বি,বুঝতে পারছি।

— আরো একটা কথা, তোমার শাশুড়ির মুখ কিন্তু ভালো নয়। সে যা তা বলে দেয়। তবে মনটা ভালো। তাকে যদি একবার মানাতে পারো,তাহলে তোমার সংসার স্বর্গ হয়ে উঠবে। কিন্তু সমস্যা হলো সে তোমাকে এখন মেনে নিবে না। কারণ তো জানোই। তাই তুমি যদি একটু মানিয়ে নিয়ে মন জয় করো, তাহলে দেখবে সে তোমাকে কেমন ভালোবাসে। তোমার কাছে এখনকার কষ্ট তখন তুচ্ছ মনে হবে।কি তুমি মানিয়ে নিবে তো?

—হ্যা,মেনে নিবো।

দাদিমাকে দেখে মনে হলো তিনি খুশি হয়েছেন। তিনি পরম স্নেহের সহিত মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

—আল্লাহ যেনো তোমার সংসার খুশিতে ভরিয়ে দেন।

আমি চুপচাপ বসে রইলাম। ফুফুমনি ইশানকে নিয়ে এদিকেই আসছেন। তার চোখমুখ জুড়ে ঘুমের রেশ। মনে হচ্ছে ফুফুমনি টেনে তুলে এনেছেন। ইশানকে সোজা আমার পাশে বসিয়ে দিলেন। ইশান স্বাভাবিকভাবে আসে আছে,কিন্তু আমি অস্বাভাবিক কাঁপছি। হাত দুটো একে অপরের সাথে কচলাচ্ছি। আমাকে বিচলিত হতে দেখে দাদি বললেন,

— কি রে দাদুভাই, বউ এর মুখ দেখেছিস। কেমন এইটুকু। মনে হচ্ছে ত্যানা ত্যানা করে ছেড়েছিস।

— আমার বউ। আমার ইচ্ছা। তোমার কেনো জ্বলে?

—-বাহ। এখন আমাকে ভুলে গেছো? শুনো নাতবৌ, কয়েকদিন আগেও সে আমার পেছনে লাইন মারতো। এসব ফন্দিতে তুমি আটকে পড়ো না।

— তাই নাকি দাদী? আমি কি বলবো, কীভাবে…

—এই চুপ কর। লাজ-লজ্জা কিছুই নেই। তুই তো দিনদিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস ইশান।

ইশান লাজুক হেসে বলে,

—তুমি বুঝবে না দাদু। বউয়ের আদর পেয়ে বেহায়া হয়ে যাচ্ছি।

দাদিমা উঠে ইশানের কান টেনে দিলেন। আমি কান চেপে মাঝখানে বসে আছি। লাগামহীন কথাবার্তায় আমার শরীরের লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে। ছিঃ, এরা কি নির্লজ্জ! ঘরবর্তী মানুষজন কি চোখে পড়ছে না? সবাই কেমন তাকিয়ে হাসছে।

#চলবে…

®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here