কাছে দূরে পর্ব ৪৯

#কাছে_দূরে 💖
#moumita_meher
#পর্ব___৪৯

রংপুরের মিশন সাকসেসফুল করে অবশেষে ঢাকা ফিরলো সবাই। সাবাবের শরীর পূর্বের ন্যায় খারাপ। জ্বর কমার বদলে আরও তরতর করে বেড়েছে। ঘোর লেগে গেছে তার চোখে মুখে। কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে দেখে সবকিছু। হীর ভীষণ ভেঙে পড়লো সাবাবের অসুস্থতায়। সিয়ামের বাড়িতে কি এমন রহস্য উদঘাটন হয়েছে? যার প্রতিক্রিয়া এতো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে! তবে কি সে জ্ঞান হারানোর পরেই আসল রহস্যের দোর খুলেছে তারা?

—-‘ ডাক্তার সাহেব! কি দেখলেন?’

আজিম সাহেবের বিচলিত কন্ঠে মুখ উঁচিয়ে তাকালেন ডাক্তার সাহেব। বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের মুখপানে। নাজমা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে হীরের দিকে তাকালেন। সাবাবের দুশ্চিন্তায় হীরের মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। সবার থেকে তারই বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে সাবাবকে নিয়ে। যেন হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে গেলো সাজানো গোছানো কিছু মুহুর্ত! নাজমা বেগম হীরের হাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। হীরের ভ্রম কাটতেই চকিতে তাকালো নাজমা বেগমের দিকে। নাজমা বেগম চোখ ঝাপটে ভরসা দিলেন হীরকে। হীর যেন এই ভরসাটুকই খুঁজে বেড়াচ্ছিলো চারিপাশ। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বড়মার গা জড়িয়ে দাঁড়ালো হীর। সানিয়া,নেহাল,রাতুল এবং ইনান সবাই ডাক্তারের মুখপানে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। ডাক্তার সবার উৎসুক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সাবাবের নার্ভ চেক করলেন। হাতের ঘড়িতে সেকেন্ড মেপে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে দক্ষ হাতে প্রেসক্রিপশন লিখলেন। অতঃপর আজিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে চিন্তা সুলভ কন্ঠে বললেন,

—-‘ প্রচন্ড মানসিক আঘাতে মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ব্লাডপ্রেশার বেড়েছে খুব। সব মিলিয়ে শরীর সহ্য করতে না পেরে জ্বর এসেছে মাত্রাতিরিক্ত। জ্বর ১০৩°-এ এসে আঁটকে আছে। আর উঠছেও না নামছেও না। এমতবস্থায় হসপিটালে এডমিট করাই বেটার হতো কিন্তু আমি বলবো আপনারা উনাকে বাড়িতেই রাখুন। কারন বাড়িতে আপনারা ঘরোয়া ভাবে ট্রিটমেন্ট করতে পারবেন। আপাতত উনার জন্য ঘয়োরা ট্রিটমেন্টটা বেস্ট মনে করছি।’

আজিম সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,

—-‘ জি।’

—-‘ এখানে ঔষধপত্র সব লিখে দিয়েছি সময় মতো খাওয়াবেন। আশাকরি খুব জলদি সু্স্থ হয়ে যাবে।’

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিয়ে বললেন কথাটা। আজিম সাহেব প্রেসক্রিপশনটা নিতে হাত বাড়ালে রাতুল বলল,

—-‘ আঙ্কেল, আমি দেখছি।’

বলে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে নিলো। আজিম সাহেব শুঁকনো মুখে তাকালেন। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। রাতুল প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে যেতে লাগলে নেহাল তাকে দাঁড়াতে বলে সেও যায় তার সাথে। রাতুল আর নেহাল বেরিয়ে গেলে ডাক্তার সাহেবও যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ইনান তাকে সাহায্য করে বাসার বাইরে অব্দি ছেড়ে দিতে যায়। সাবাব বেঘোরে ঘুমচ্ছে। সানিয়া ভাইয়ের পাশ থেকে ঘুরে এসে হীরের পাশে দাঁড়ালো। আজিম সাহেব থমথমে মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হীর কারোর দিকে না দেখে সাবাবের কাছে এগিয়ে গেলো। সাবাবের পাশে বসতে নিলেই আচমকা ক্ষেপে গেলেন আজিম সাহেব,

—-‘ আমার ছেলের কাছে একদম যাওয়ার চেষ্টা করবে না হীর।’

হীর ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকালো আজিম সাহেবের দিকে। উপস্থিত নাজমা বেগম এবং সানিয়াও যেন ভড়কে গেলো আজিম সাহেবের ক্ষিপ্ত স্বরে। হীরের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো। ভেতরটায় অদ্ভুত এক বাতাস বয়ে গিয়ে মনে করিয়ে দিলো আজিম সাহেব তাকে কখনও নাম নিয়ে ডাকেনি। সর্বদা মায়ের ডাকে সম্মোধন করেছেন। হীরের দৃষ্টি কেঁপে উঠলো। চোখের পলক পড়লো। সে মনেমনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। একটা মানুষ আর কত যুগ তার আসল রূপ লুকিয়ে রাখবেন। এক যুগ তো পারই করে ফেললেন। নাজমা বেগম অস্থির নয়নে এর ওর মুখের দিকে বারবার তাকাতে লাগলেন। তিনি যেন মুহুর্তের মধ্যে অতীতের আচ পাচ্ছেন। এক ভয়ংকর অতীতের আচ। সানিয়া ফ্যালফ্যাল করে মায়ের ন্যায় এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তার মনের ভেতর অদ্ভুত লাগছে। সবার দৃষ্টি,সবার আচরন যেন দুই একদিনে হঠাৎ পাল্টেছে। মনে হচ্ছে সবাই নিজ নিজ আসল রূপে ফিরে আসছে। ভীষণ অদ্ভুত লাগছে।

হীর ক্ষনিকের জন্য অপেক্ষা করে আবারও বসতে নিলো সাবাবের পাশে। যা দেখে আজিম সাহেব আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন। ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,

—-‘ তোমাকে বারন করা হয়েছে আমার ছেলের কাছে না যেতে। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝতে চাইছো না।’

হীর আজিম সাহেবের দিকে না দেখেই অদ্ভুত করে হাসল। অতঃপর মুহুর্তেই দৃষ্টি মলিন করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

—-‘ আমি তোমার ছেলের কাছে যাচ্ছি না বাবাই। আমি আমার স্বামীর কাছে যাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছোনা?’

আজিম সাহেব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন হীরের দিকে। পূর্বের ন্যায় বললেন,

—-‘ তুমি আমার সাথে ইয়ার্কি করছো? ইয়ার্কি হচ্ছে এখানে? তুমি দেখতে পাচ্ছো না তোমার অভিশাপ লেগেছে আমার ছেলের উপর? তোমাকে বিয়ে করতে না করতেই ছেলেটার মরার দশা হয়েছে। দেখতে পাচ্ছো না তুমি?’

নাজমা বেগম আঁতকে উঠে আজিম সাহেবের হাত চেপে ধরলেন। অনুনয়ের সুরে বললেন,

—-‘ ওগো কি বলছো এসব? হীর আমাদের মেয়ে! তুমি ওর সম্মন্ধে এসব কি আবোলতাবোল বলছো। মেয়েটা কষ্ট পাবে যে! আর সাবাব শুনলে-

ঝাটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলেন আজিম সাহেব। নাজমা বেগম ছিটকে পড়লেন পেছনের দিকে। সানিয়া ছুটে গেলো মায়ের কাছে। মাকে ঝাপটে ধরে বাবার প্রতি অসহায় চোখে তাকালো। কিছু একটা বলতে চাইলো বাবাকে কিন্তু বলতে পারলো না। বাবার এই অদ্ভুত আচরন তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। নাজমা বেগমের চোখ থেকে টসটসে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। কোনো এক অজানা ভয় তাকে নিষ্পেষিত করে দিচ্ছে।

হীর মৃদু হাসলো। সাবাবের ঘুমন্ত মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে আবারও মৃদু হাসলো। ঘাড় ফিরিয়ে তার পেছনে দাঁড়ানো আজিম সাহেবের মুখের দিকে শান্ত চোখে তাকালো। আজিম সাহেব উত্তেজনায় ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। হীরকে নিজের ছেলের থেকে আলাদা করার জন্য সে যতদূর সম্ভব নীচে নামতে পারবেন। অবশ্যই পারবেন। হীর দৃষ্টি শান্ত রেখে গুনে গুনে তিন ধাপ সামনে এগিয়ে এসে আজিম সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াল। আজিম সাহেব রক্তিম চোখে হীরকে দেখছেন। হীর ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলল,

—-‘ ছোট থেকে স্বল্পভাষী শান্ত স্বভাবের মেয়েটা ইয়ার্কি করা খুব কমই শিখেছে বাবাই। কেউ না জানুক তুমি তো জানো? আর রইল বাকি অভিশাপের কথা? হ্যাঁ। আমি অভিশপ্ত। আমার গায়ে অভিশাপ লেগে আছে। আর সেই অভিশাপেই কেমন করে বাবা-মাকে হারিয়ে ফেললাম বলো? মনে আছে তো?’

‘মনে আছে তো?’ কথাটা অদ্ভুত ভাবে কাঁপিয়ে দিলো আজিম সাহেবের বুক। তিনি কেঁপে উঠে হীরের দিকে তাকাতেই হীর আবারও বলে উঠলো,

—-‘ ঐ যে ওখানে শুইয়ে আছে তোমার ছেলে- সে কিন্তু আমার স্বামী। তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে৷ বিয়েটা জোর করে হয়েছে। আর কে জোর করেছে মনে আছে তো বাবাই? তোমার ছেলে। জোর করে এই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে কাজী সাহেবের সামনে। আর বলেছে আগে আমাদের বিয়ে পড়ানো হবে। আগে তোমার আর এই অভিশপ্ত মেয়েটার বিয়ে হবে। বিয়ে তো হয়ে গেলো বাবাই। না তুমি আটকাতে পেরেছো না আমি। কেউ পারেনি। তোমার ছেলে নিজের ইচ্ছেয় আমার অভিশপ্ত জীবনে পা রেখেছে। সারা জীবন একসাথে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমার সুখ,আমার দুঃখ সব কিছুর ভাগ নিয়ে বসে আছে। কিন্তু আফসোস টা কোথায় জানো বাবাই? আফসোস টা হলো আমার জীবনে সুখ কম দুঃখ বেশি। অভিশপ্ত জীবনে এর চেয়ে ভালো কি হবে বলোতো? আমার দুঃখের আচ লেগে গেছে ঐ লোকটার উপর। সেটাই ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছি। তাকে সুস্থ করে ঠিক আগের মতো করে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। ভয় পেয়োনা বাবাই। তোমার ছেলে তোমার ছোট ভাইয়ের মতো মরবেনা। আমি মরতে দিবো না। কিছুতেই না।’

আজিম সাহেবের বুকের ভেতরটা আবারও কেঁপে উঠলো। হীর হঠাৎ করে কেমন বদলে গিয়েছে। চেনা যাচ্ছে না তার মুখ,তার দৃষ্টি, তার হাসি। এ যেন এক অচেনা হীর। এই কঠিন দৃষ্টি, কঠিন রূপ আর কঠিন এক একটা শব্দ সবটাই যেন রিয়াদ আহমেদের। হুবহু সেই চাহনি সেই কথার সুর। অদ্ভুত!

আজিম সাহেব নিঃশ্বাস আঁটকে ধরলেন। হীরের অদ্ভুত ব্যবহারে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরে নিঃশ্বাস আঁটকে ধরেছে। তাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। তার খুন করতে চাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে তাকে বের হতে হবে। নিঃশ্বাস নিতে হবে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে হবে। অন্যথা সে মরে যাবে।

আজিম সাহেব একপ্রকার পালিয়ে গেলেন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন। হীর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে স্মিত হাসল। নাজমা বেগম আজিম সাহেবের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হীরের কাছে ছুটে এলেন। হীরকে দু’হাতে আগলে ধরে কপালে,গালে,চোখে,মুখে সব জায়গায় চুমুতে ভরিয়ে তুললেন। তিনিও যেন দেখতে পেলেন হীরের ভেতরে রিয়াদের প্রতিচ্ছবি। সেই একই দৃষ্টি, একই কথার সুর। মিলে যাচ্ছে। সবটা একটু একটু করে মিলে যাচ্ছে।

_______________

গভীর রাত। হীর জেগে আছে। সারাদিন পার হয়ে গেলো সাবাবের সেবা করতে করতে। তবুও সাবাবের শরীরের কোনো উন্নতি নেই। সাবাবের শরীরে ক্রমশ অবনতি ঘটছে। তবে হীর সে বিষয়ে চিন্তিত নয়। সে চিন্তিত আজ রাতের হামলা নিয়ে। এখনই সেই সঠিক সময়। আজ তার উপর হামলা হবে। ভয়াবহ হামলা। যেটা সে খুব ভালো ভাবেই আন্দাজ করতে পারছে। সাবাবের মাথার কাছে বসে আছে হীর। সাবাবের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। সাবাবকে রাতের খাবারের শেষে করা ডোজের ঘুমের ঔষধ দিয়েছে সে। তবে তার থেকেও বেশি পাওয়ারের ঔষধ কেউ তার জন্য তৈরি রেখেছিলো। হীর চালাকি করে সেই ঔষধ পাল্টে সাবাবের শরীরের সাথে এডজাস্ট করতে পারে এমন ঔষধই দিয়েছে। সেই ডোজেই সাবাব বেহুঁশ হয়ে ঘুমচ্ছে। হীরের চোখ জোড়া সাবাবের মুখের উপর স্থীর। সাবাবকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সাবাব তার ছোটমা আর বাবাইকে ঠিক কতটা ভালোবাসে সেটার প্রমান তার এই অসুস্থতা। তার এই শুঁকনো মুখখানা। একটা মানুষ তার বাবা-মায়ের থেকেও যে কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারে সেটা হয়তো সাবাবকে না দেখলে জানাই হতো না হীরের।

ছোট বেলায় যখন সাবাব তাদের বাড়িতে আসতো তখন দু’জনের ঝগড়াই হতো তার বাবা-মা কে নিয়ে। সাবাব সব সময় রিয়াদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতো। কনিকার সাথেও তাই তবে রিয়াদের প্রতি সাবাবের টান নাকি জন্মের পর থেকেই। নাজমা বেগম বলতেন, সাবাব জন্মের পর তার বাবার হাত ধরার আগে রিয়াদের হাত আগে ধরেছিল। তার বাবার আগে সে রিয়াদকে প্রথম ‘বাবাই’ বলে ডেকেছিল। হীরের জন্মের আগে সাবাব রিয়াদের এমন সম্পর্ক আজিম সাহেবের কাছে অসাধারণ লাগলেও হীর কনিকার গর্ভে এসেছে শুনেই তা যেন শূন্যে মিলিয়ে গেলো। কনিকা ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট থাকাবস্থায় আহমেদ ভিলা ছেড়ে চলে যায় তারা। আর কখনও ভুল করেও আহমেদ ভিলায় পা রাখেনি। তবে নাজমা বেগম সানিয়া আর সাবাবকে নিয়ে রিয়াদের বাড়িতে সবসময়ই যাওয়া-আসা করতেন। মুলত সাবাবের পাগলামির জন্যই তাকে আসতে হতো রিয়াদের কাছে।

হীর সাবাবের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ বুজলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝাপ্সা ঝাপ্সা ভেসে উঠলো অতীত। অন্ধকার,রক্ত,একাকিত্ব, শূন্যতা। সব কিছু তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিলো। তার ভয়ানক চিৎকার চারদেয়ালে বারি খেয়ে বারবার ফিরে এসে তাকেই গ্রাস করে নিচ্ছিলো। সেই যন্ত্রণা ছিলো মৃত্যুর থেকেও ভয়ানক।

ভেতরের অন্ধকার এতোটা ভয়াবহ ছিলো যে বাইরে রাত না দিন সেটাও বোঝার উপায় ছিলো না। অনুমান মোতাবেক রিয়াদ-কনিকার মৃত্যুর সাত-আট ঘন্টা পরই জ্ঞান ফিরে হীরের। চোখ খুলতেই নিজেকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় আবিষ্কার করে সে ‘মা-বাবার’ নাম নিয়ে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু পাষাণ তার বাবা-মা কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসেনি। বাচ্চা মেয়েটা বাবা-মাকে কাছে না পেয়ে বারবার অজ্ঞান হয়েছে আবার জ্ঞান ফিরেছে। বারবার জ্ঞান ফিরে সেই ভয়ংকর জায়গাটাকেই আবিষ্কার করতে হয়েছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করেও এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অন্ধকার তাকে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্টে নিয়েছিলো যে ঐটুকু বাচ্চা মেয়েটাও নিজের মৃত্যু কামনা করতে লাগলো।

টানা ৪৮ঘন্টা পার হলে ফেরেশতা হয়ে হাজির হয় জাফর ইকবাল। তার দক্ষ হাত আর সুক্ষ্ম মস্তিষ্ক ঠিকই হীরকে খুঁজে বের করেছে। ততক্ষণে কনিকা-রিয়াদের লাশ কবরের নীচে রাখা হয়। পাশাপাশিই তৈরি হয় তাইয়্যেবা আর মালির কবর। চারজন মানুষ নিস্তেজ হয়ে পরে থাকে কবরে। থেকে যায় তাদের অতৃপ্ত বাসনা। থেকে যায় তাদের অপূর্ণ কিছু স্বপ্ন। থেকে যায় কনিকা-রিয়াদের ভালোবাসার ছোট্ট হীরপরি। হীরকে উদ্ধার করে আনতে আনতে হীরের অবস্থা হয়ে যায় শোচনীয়। তাকে হসপিটালে নিতে নিতে সেও নিস্তেজ হয়ে ঢলে যায় জাফরের বুকে। বাকি সবাই হাল ছেড়ে দিলেও জাফর হাল ছাড়েনি। সে অটুট বিশ্বাসের সাথে বলেছিলো ‘হীর বাঁচবে।’ আর ঠিকই হীর বেঁচেছে। কিন্তু শত্রুরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। কারন তারা জানতো রিয়াদের মৃত্যুর রহস্য জাফর যেকোনো ভাবে সামনে আনবেই। কারন সেও ছিলো রিয়াদের মতো প্রখর বুদ্ধিমান লোক। তার বুদ্ধির কাছে এমন বড়বড় শত্রুরাও টিকে থাকতে পারবেনা। তারা সেই আন্দাজেই তাকেও নৃশংস ভাবে হত্যা করে। সব কিছু শেষে বেঁচে থাকে হীর একা। আজিম সাহেব আবারও পাল্টে যান। ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে তিনি পাথর হয়ে যান। হীরকে সে কিছুতেই আর চোখের আড়াল করেন না৷ নাজমা বেগমের কথায় হীরকে নিয়ে আসেন তাদের সাথে। তারপর আস্তে আস্তে হীর তাদের সঙ্গেই থাকেন। আজিম সাহেব হয়ে যান হীরের বাবা। নিজের মেয়ের মতো স্নেহ দিয়ে বড় করে তোলেন হীরকে। হীরের নিরাপত্তার সমস্ত ব্যাবস্থা সে নিজের হাতে করেন। হীর বাবা-মা, নাচের ম্যাডাম,মালিকাকা,জাফর আঙ্কেল সবাইকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। এবাড়িতে এসে যতই মায়ের ভালোবাসা,বাবার ভালোবাসা পাক না কেন মনের কোথাও একটা থেকে যায় শূন্যতা,একাকিত্বতা। এতো এতো সিকিউরিটি থাকা স্বত্বেও তার প্রতি হামলা থামেনি। তার প্রতি মৃত্যু বান কম ছোঁড়া হয়নি। তবে হীর তার প্রত্যেকটা হিসাব কড়ায়-গণ্ডায় রেখেছে। হাতে কলমে হিসাব করে রেখেছে।

অতীত ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এসেছিলো হীরের। আচমকা ঘাড়ের উপর মোটা লাঠির আঘাত পড়তেই বিছানা থেকে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেলো সে। তীব্র যন্ত্রণায় ঘাড়ে হাত চেপে চাপা আর্তনাদ করলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। ঘরে ডিম লাইটের আলোতে কারোর ছায়া ভেসে উঠলো সামনে। হীর নিঃশ্বাস আঁটকে রেখে কোনো রকমের উঠে দাঁড়ালো। তার সামনে দাঁড়িয়ে দু’জন মুখোশধারী লোক। হীর তাদের পানে চেয়ে মুচকি হাসলো। লোকদুটো হীরের হাসি দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। চোখে চোখে কথা বললো। অতঃপর দ্বিতীয় আঘাতের জন্য প্রস্তুত হতেই হীরে নীচু হয়ে তাদের এড়িয়ে অন্যপাশে চলে গেলো। প্রথম লোকটার লাঠির আঘাত শূন্য ভেসে তার দিকেই তেড়ে এলো। লোকটা ভড়কে গিয়ে পেছন মুড়ে হীরের দিকে তাকালো। দ্বিতীয় লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে পূনরায় আঘাত করতে উদ্যত হলো। হীর তাকেও বোকা বানিয়ে ছিটকে গেলো অন্যপাশে। লোক দুটো এবার একসাথে তেড়ে গেলো হীরের দিকে। হীর আর এবার পালালো না। বরং তাদের বিপরীতে পাল্টা আঘাত করে বসলো। হীর চোখের পলকে সামনের লোকটার হাতের রগ কেটে দিয়ে পেছনের লোকটার গলায় ছুরি ধরলো। লোকটা আতংকে কেঁপে উঠে হাতের লাঠি নীচে ফেলে দিলো। আঘাত পেয়ে সামনের লোকটা চেঁচিয়ে উঠলো। পেছনের লোকটা মরার ভয়ে আল্লাহর নাম জব করছে। হীর সামনের লোকটার উদ্দেশ্যে অদ্ভুত কন্ঠে বলল,

—-‘ শশশ- একদম শব্দ নয়। আমার স্বামী ঘুমচ্ছে। তোমাদের চিৎকারে যদি তার ঘুম ভেঙে যায় কেউ জানে বেঁচে ফিরতে পারবেনা বলে দিলাম।’

দু’জনেই আতংকে নিজেদের মুখ চেপে ধরলো। পেছনের লোকটা আকুতি মিনতি করে বলতে লাগল,

—-‘ আ..আমাদের ছেড়ে দিন মেডাম আমরা আর কোনো দিন এমুখো হবোনা।’

হীর তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,

—-‘ বাঁচলে তো এমুখো হবে!’

—-‘ আ..আমাদের ছেড়ে দিন মেডাম। আপনার পায়ে পড়ি। ও আমার ছোট ভাই। আমরা পেটের দায়ে এই কাজ করি মেডাম। আমাদের ঘরে আমাদের অসুস্থ মা-

লোকটার কথা শেষ করার আগেই হীর এক টানে তার হাতটাও কেটে দিলো। লোকটা ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠলো। হীর তার দিকে রক্তিম চোখে তাকাতেই সে অন্যহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো। হীর দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

—-‘ চিন্তা নেই। মরবেনা তোমরা। যে তোমাদের এখানে পাঠিয়েছেন তিনি অলরেডি তোমাদের মৃত্যুর ব্যবস্থা করেই পাঠিয়েছেন। কি ভাবছো? আমাকে এখানে মেরে ফেললে উনি তোমাদের কারি কারি টাকা দিবেন? হা হা হা। বোকার দল। এখানে আসার পূর্বে তোমাদের মনে করিয়ে এক গ্লাস জুস তো খাইয়েছে তাই না?’

লোকদুটো অবাক চোখে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। হীর পূনরায় তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,

—-‘ ওটা জুস ছিলো না। ওটা ছিলো তোমাদের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মরন জাল। যে জাল গায়ে জড়িয়ে তোমরা এখানে এসেছো। বিষাক্ত কেমিক্যাল তোমাদের শরীরে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা কাজ শুরু করবে আর মাত্র বিশ সেকেন্ড বাদেই৷ আর তোমাদের শরীর থেকে যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত ঝড়ে যায় তাহলে তোমরা বেঁচে গেলেও যেতে পারো।’

লোক দুটো নিজেদের হাতের দিকে তাকাতেই হীর বলল,

—-‘ ডান। এবার এখান থেকে বেরিয়ে নিজেদের হাত ব্যান্ডেজ করে নিও। যাও।’

লোকদুটো কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে হীরকে দেখে রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দড়ি ধরে নেমে গেলো। হীর তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

—-‘ মিশন ফেইলড! ইশশ এবার কি হবে?’

#চলবে_

[ বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here