কুঞ্জছায়া পর্ব ৪+৫

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব৪
(কপি করা নিষেধ)
….
ধানমন্ডিতে অরন্যদের নিজেদের ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে।
বাড়ির সামনে বিরাট প্রকাণ্ড এক গেইট।গেইটের সামনেই রয়েছে গোল্ডেন শাওয়ার গাছ।বাড়িটিকে নয়নাভিরাম রূপে সাজাতে এবং প্রকৃতি পরিবেশের শোভা বর্ধনে এই গাছ সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় অনেক সড়কের দুই পাশে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সারিবদ্ধ ভাবে একই ধরনের গাছ লাগানো হয় । গ্রীষ্মকালে যখন সব গাছে একসাথে সোনালী ফুল ফোটে, তখন মনে হয় সোনালী আলোকচ্ছটায় চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে।
পত্র ঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সমস্ত পাতা ঝরে গিয়ে গাছ থাকে পত্র শুন্য এবং বসন্তের শেষে ফুল কলি ধরার পূর্বে গাছে নতুন পাতা গজায়। গ্রীষ্মে গাছের শাখা- প্রশাখা জুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জুরিতে সোনালী হলুদ রঙের ফুল ফুটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে গ্রীষ্মকাল পুরো সময় জুড়ে। পাতা হাল্কা সবুজাভ, মধ্য শিরা স্পষ্ট। গাছের শাখা-প্রশাখা কম, সোজা ভাবে উপরের দিকে বাড়তে থাকে, বাকল সবুজাভ থেকে ধূসর রঙের, কাঠ মাঝারি শক্ত মানের হয়। ফুল থেকে গাছে ফল হয়, ফলের আকার দেখতে সজিনা সবজির আকৃতির।

গেইটের ভিতরে ঢুকতেই বাম পাশে পড়ে বিশাল এক বাগান।বাগানে রয়েছে গোলাপ,বেলী,কুন্দ,কামিনী, রঙ্গন,টগর,শিউলি,গাদাঁ,ডালিয়া আরো নাম জানা বহু গাছ।বাগানটি করেছে অরন্যের মা জেসমিন খাতুন।তিনি বেশ শৌখিন এবং রুচিশীল মানুষ।তিনি আগে নিজেই বাগানের পরিচর্যা করতেন।এখন বয়স হয়েছে তাই আর পারেন না।বাগান দেখাশোনা করার জন্য মালি রয়েছে।

বাড়িতে থাকে জেসমিন খাতুন,আজমির চৌধুরী,আকাশ, আর অরন্যের ছোট বোন অনন্যা। অরন্যের বাবা আজমির সাহেব ঢাকা মেডিকেলের অধ্যক্ষ, মা জেসমিন খাতুন একজন শিক্ষিকা ছিলেন এখন তিনি অবসর নিয়েছেন।আকাশ এইবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে।অনন্যা হলো বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্য।ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছে বিজ্ঞান বিভাগে।এই বাড়ি হাসি খেলায় যেনো মাতিয়ে রাখে সবাইকে।

অরন্য বাসায় পা রাখতেই অনন্যা এসে এক ছুটে তাকে জরিয়ে ধরে বললো,

– ভাইয়ু এট লাস্ট এসেছো তুমি।আ’ম সো হ্যাপি। এই বাড়িতে কেউ আমাকে দাম দেয় না জানো? আমি কি বাচ্চা মেয়ে যে আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না।

অনন্যা মুখটা ফুলিয়ে ফেললো।নাকের ডগা কাঁপছে। নীল রঙা ফ্রক পড়া সুশ্রী মেয়েটাকে যেনী জীবন্ত পুতুল লাগছে।

অরন্য তাকে আদর করলো।

– আমি ভালো আছি।কে দাম দেয় না আমার পুতুলকে হু?সামনে আসুক একবার।
অনেক গুলা চকলেটের বক্স অরন্য তার দিকে এগিয়ে দেয়,

-তোর পছন্দের চকোলেটস।

অনন্যা চকোলেট গুলা ঝট করে নিয়ে এক চিৎকার দিয়ে বললো,

– আই লাভ ইউ ভাইয়ু।উম্মায়ায়ায়ায়া।

অরুন্য মৃদু হাসলো।আর সবার জন্যই কিছু না কিছু এনেছে।সবাইকে যার যার টা দিলো।
জেসমিন খাতুন সেই আসা থেকে কান্নাকাটি লাগিয়েছেন।অরন্যকে ধরে সেই কতো কথা বলে চলছেন।
জেসমিন খাতুন কান্নাভেজা কন্ঠে ছেলেকে বলতে লাগলেন,

– তোর এই আসার সময় হলো?কত শুকিয়ে গিয়েছিস। দেখ তোরা আমার বাবাটার কি হাল হলো।ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিসনি তাই না?

অরন্য মাকে হালকা জরিয়ে ধরে চোখের পানিগুলো মুছে দিলো অতি যত্নে।

– আমি ঠিক আছি মা। তোমরা শুধুই টেনশন করো।

আকাশ অভিমান করলো বেশ। কন্ঠে সেই অভিমানের প্রগাঢ়তা ফুটিয়ে বলে উঠলো ,

-আমরা তো সব রোহিঙ্গা আমাদের তো কেউ চোখেই দেখে না।

তখন জেসমিন খাতুন আকাশের কান টেনে দিয়ে ধরলো,

-হতচ্ছারা আমার বাচ্চাটা কতো বছর পর বাড়ি আসলো আর তুই হিংসা শুরু করে দিলি।

আকাশ আহ করে চিৎকার দিয়ে বললো,

-ছাড়ো মাম্মা ব্যথা পাচ্ছি।

অনন্যা তা দেখে হেসে কুটি কুটি।হাতে বেনুনি নিয়ে তা নাড়াতে নাড়াতে জিহ্বা বের করে আকাশকে দেখিয়ে বলে,

– বেশ হয়েছে।

আজমির সাহেবের চোখ জুড়ালো।এতো দিন বাড়িটা কেমন যেনো খালি খালি লাগতো।আজ তার বাড়ি পূর্ণ।
কন্ঠে প্রশান্তি ফুটিয়ে বললেন,

-এইবার বাড়িটা ভরা ভরা লাগছে।এইরকম যাতে বাড়িটা ভরা থাকে আমার আল্লাহর কাছে দোয়া করি।এইবার আমি আমার সন্তানদের কাছ ছাড়া করছি না।

অরন্যের মায়ের খালি বুকটা যেনো শীতল হলো গাঢ় প্রশান্তিতে। এতো বুকে চাপা কষ্টরা ভীর করেছিলো।দমবন্ধ লাগতো।আজ বহু বছর পর সে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।

-এইবার একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবো তাহলেই বাড়িটা একবারে পরিপূর্ণ হবে।

এইটা শুনেই অরন্যের মুখ কালো হয়ে গেলো।

– উফফ মা বাদ দাও তো আমার ইন্টারেস্ট নেই এইসবে।
এই বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সিড়ি বেয়ে উপরে অরন্য নিজের রুমে হনহন করে।সবাই চেয়ে রইলো অরন্যের যাওয়ার দিকে জেসমিন খাতুন এতক্ষনে প্রানকে লক্ষ্য করলো।

-আরে বাবা দেখেছো তোকে দেখলামই না ওই কোনায় দাড়িয়ে আছিস কেন? তুই তো এতো চুপচাপ না।

এতোক্ষন প্রান কিছু একটা ভাবছিল। জেসমিন খাতুন এর কথায় সেই ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে আর হুশ ফিরে।

-আরে না আন্টি তোমাদের মা ছেলের ভালোবাসা দেখছিলাম।

জেসমিন খাতুন নিজের চোখটা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন,

– হয়েছে এইবার হাত মুখ ধোঁয়ে খেতে আয়।আমি ছাড়ছি না তোকে।

প্রান সাথেই সাথেই না করলো আর বললো

– না আন্টি আজ নয় আসবো আরেকদিন।আজ কাজ আছে হসপিটালে।
কিন্ত জেসমিন খাতুন মানলেন না।তিনি নিজের কথায় অটল থাকলেন।এ যেনো তার নিঃসংকোচ আবেদন।প্রাণকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন।আজ এতোদিন পর সবাই একসাথে খেতে বসবে।প্রাণ থাকবে না তা হয়?জোর করে খাওয়ার জন্য রাজি করালেন।

অরন্য ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এসে বসলো খাওয়ার জন্য।আর অরন্যের মা এটা সেটা সব অরন্যের পাতে দিচ্ছে।অরন্য কিছুটা বিরক্ত হলো।

– আহ কি করছো মা আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না।আস্তে আস্তে দাও।

আকাশ হো হো করে হো হো করে হেসে উঠলো পুরো টেবিল কাপিয়ে।

-বুঝলে ভাইয়ু মাম্মা তোমাকে ভূড়িওয়ালা বানানোর ফন্দি করছে যাতে মেয়েরা তোমার দিকে কুনজর না দেয়।

অরন্য তাকে চোখ পাকালো।

আর অনন্যা ফিচেল গলায় আকাশকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-আর তোর দিকে তো এমনিতেই মেয়েরা তাকিয়েই দেখে না।
আকাশ ফুসে উঠলো,

-দেখ একদম ভালো হবে দিলাম বলে দিলাম।

অনন্যা আকাশের দিকে চেয়ে মুখ ভেংচি দিলো।

অরন্যের বাবা খাবার শেষে প্রান আর অরন্যকে বসতে বললো। সবাই যে যার খাবার খেয়ে চলে গেলো বাকি রইলো শুধু প্রান,অরন্য আর আজমির সাহেব।

এইবার আজমীর সাহেবকে বেশ উদাস দেখালো।ছেলের ফিরে আসার আনন্দে যেনো বাল্যকালের বন্ধুর চলে যাওয়া মাটি চাপা পড়ে গিয়েছিলো কিয়ৎকালের জন্য।কন্ঠে মলিন করে বললো,

-অরন্য তুমি জানোই যে নিজাম মারা গেছে।আমরা সবাই শোকাহত।কিন্তু তোমার সাথে তার অন্যরকম অ্যাটাচমেন্ট ছিলো আমরা সবাই জানি।একটু পর তার জানাযা।আর হসপিটালে প্রফেসর পদের একটা সিট খালি পরে আছে।আমরা চাইছি তুমি নিজ যোগ্যতায় সেটায় জয়েন করো।নিজামও চাইতো তুমি আমাদের হসপিটালে জয়েন করো।

অরন্য কিছুক্ষণ নীরব থাকলো।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবলো। রাজি হলো বাবার কথায়।আপাতত এইটাই তার ঠিক মনে হচ্ছে।

সুক্ষ্ম কন্ঠে বললো,

– ঠিক আছে তোমরা যা ভালো মনে করো।
এইটা বলে উঠে গেলো টেবিল থেকে আর প্রান বিদায় নিয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে।
….
ছায়াদের ক্লাস শেষ হলো তিনটায়।

নীলার কন্ঠে শোক স্পষ্ট,

-এই ছায়া স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন রে।এইভাবে স্যার চলে যাবে ভাবতেও পারিনি।

ছায়া দূর আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।সূর্যের তীব্র রোদ যেনো তার চোখ ঝলসে দিচ্ছে।তবু চেয়ে রইলো।চোখে পানি চলে গেলো।ছায়া চট করেই চোখটা বন্ধ করে ফেললো।অনেকক্ষণ রোদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চোখ বন্ধ করলে সব অন্ধকার লাগে।এরপর আস্তে আসে একটা উজ্জ্বল বস্তু সেই অন্ধকারে জায়গা করে নেয়।ধীরে ধীরে তার আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।এরপর চট করেই যেনো সব আলোকিত হয়ে যায়।

-ঠিক বলেছিস।জন্ম মৃত্যু আল্লাহর হাতে।আমরা শুধু দোয়া করতে পারি।

বর্ষাকালে হুট হাট যেমন বৃষ্টির আগমন হয় ঠিক তেমনি দুপুরে প্রভাকর যেমন পূর্ণ তেজে জ্বলে উঠে।রোদের তেজে রাস্তায় দাঁড়ানো দায়।ছায়ার ফর্শা মুখশ্রী একবারে লাল হয়ে গেলো।এক হাতে মুখ ঢেকে ছায়া একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো দুইজন।

রিকশা ছুটে চললো আপন গতিতে।জীবনও তো আপন গতিতে চলতে থাকে।কারও জন্য কি কারও জীবন থেমে থাকে?থাকে না।শুধু সময়ের স্রোতের সাথে নিজেকে অভ্যস্থ করে তোলে মানুষ।মাঝে মাঝে মনে তীব্র হাহাকার জেগে উঠে।তখন মানুষ নিজেকে মিথ্যে শান্তনা দিয়ে ভালো রাখার মিথ্যে প্রয়াস চালায়।কে জানে কে কতোটা সফল হয়? আদৌ সফল হয় কিনা!
#চলবে#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব৫
(কপি করা নিষেধ)
…….
সকাল নয়টা। নীলা আর ছায়া ক্লাসরুমে বসে আছে।ক্লাসরুমে সবাই কিছু না কিছু নিয়ে কথা বলছে।কেউ কেউ কানে এয়ারফোন চেপে গানে মগ্ন,কেউ বইয়ের পৃষ্ঠায় নিজেকে বন্দী করে ফেলেছে।যেনো বইয়ের ভেতরের জাদুকরী অক্ষরগুলি তাদের হিপনোটাইজড করে ফেলেছে।কেউ হাসি ঠাট্টায় ব্যাস্ত।

এক বেঞ্চে ছায়া, নীলা আর মেঘা বসেছে।মেঘা অনবরত তার বয়ফ্রেন্ডের প্রশংসায় গলা শুকাচ্ছে। নীলা আর ছায়া তা শুনে ঢোক গিলছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।তার প্রেমিক আপাতত লন্ডনে কিছুদিন পরই আসবে।সেই খুশিতে সে আত্মহারা।একবার হাসে তো আরেকবার তার গলায় রাগ প্রকাশ পায় আবার কখনো লজ্জায় মুখ রাঙা হয়।

-এই তোরা জানিস আমি তোদের দুলাভাইকে কতো ভালোবাসি?

এইটা বলে একটু লাজুক হাসি হাসলো।যদিও লজ্জা নাম শব্দটা তার ডিকশনারিতে নেই।

নীলা মজার স্বরে বললো,

– কতোটা?

মেঘা দুইহাত প্রসারিত করলো।যেনো প্রসারতা তার ভালোবাসার পরিমাপক এই মুহুর্তে।

– এত্তো গুলা।

এইটা বলেই আবার মুখ লুকালো নিজের উড়নায়।ছায়ার এইসব ন্যাকামি অসহ্য লাগছে।তাই ধুম করে মেঘার পিঠে ঝট করে একটা কিল বসিয়ে দিলো।

– ইশশ ঢং দেখো মেয়ের।এমনভাব করে যে প্রেম দুনিয়াতে একমাত্র সেই করে।

মুখটা ভেংচি দিয়ে পুনরায় বললো,
-ন্যাকার ষষ্টি।

মেঘা কাঁদোকাঁদো মুখ করে ফেললো।সে নাহয় একটু বেশিই ভালোবাসে তাই বলে তাকে নিয়ে এইভাবে মজা করবে?বান্ধবীদের বলবে না তো কাকে বলবে?কন্ঠে অতীব মাত্রার কষ্ট যোগ করে এইবার মেঘা বললো,

-এমন করিস কেনো ছায়ু?তোদের না বললে কাদের বলবো?পাশের বাড়ির অদু,মদু,কদুকে?এই নীলা আমার পিঠটা জ্বলে গেলোরে দেখ কি জোরে দিয়েছে।কি খাস রে ছায়ু? এতো জোর কই পাস?

ছায়া বিরক্তিকে চোখ মুখ কুচকে ফেললো।তার কপালে গুনে গুনে তিনটা ভাজ পড়লো,

-আরেকবার এইসব ফালতু কথা বললে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে আসবো। এখনই ক্লাস শুরু হবে তাই চুপ কর।
মেঘা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই স্যার ক্লাসে আসে তার সাথে আরো একজন ঢুকে প্রফেশনাল লুকে।কালো প্যান্ট,সাদা শার্ট,কালো কোর্ট।মুখে খোচা দাড়ি,ব্রাউন চুল কপালে পড়ে আছে,কালো শো,ব্রান্ডেড ওয়াচ। সব মেয়েদের শ্বাস মনে হয় কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতো সুদর্শন আর সুঠাম দেহি।

ব্যস্ততম ক্লাসের কোলাহল যেনো থেমে হলো হঠাৎ করেই।রহমান স্যার এইবার গলা ঝেড়ে কাশি দিলেন সবার মনযোগ আকর্ষণ করার জন্য। সবার সাথে পরিচিত করালেন অতি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে।

-তোমরা হয়তো সবাই চিনেই থাকবে।এতোক্ষণে হয়তো চিনে ফেলেছো আশা করছি।

রহমান স্যার পুনরায় গলা খাকারি দিলেন।

– সবাই কেমন আছো?আশা করছি ভালো আছো।তিনি হচ্ছেন অরন্য চৌধুরী।লন্ডন থেকে এম.বি.বিএস কমপ্লিট করেছেন।তিনি এই মেডিকেল কলেজেই অধ্যয়নরত ছিলেন সবাই চিনে গেছো এতোক্ষণে।কিছু বিশেষ কারণে স্কলারশিপ নিয়ে তিনি লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন আর সেইখানেই বাকি পড়া শেষ করেন।আজ থেকে ডক্টর অরন্য চৌধুরী তোমাদের ক্লাস নিবেন।

পুরো ক্লাস জুড়ে হৈ হৈ শুরু হয়। এ যেনো কোন উৎসবের আমেজ।সবাই অলরেডি ডক্টর অরন্যকে নিয়ে ফুসুরফাসুর করতে থাকে।

এইবার ছায়া,নীলা আর মেঘা অরন্যের নাম শুনেই চমকে উঠে।অস্ফুটভাবে মুখ চিরে বেরিয়ে আসে
অরন্য ভাইয়া!
তিন জনের চোখে মুখে বিস্ময় আর শঙ্কা।ভাইয়া ফিরে এলো এতো বছর পর?কোন বিশেষ কারনে নয়তো?
ওরা ছায়ার দিকে তাকালো।ওর মুখে আধার নেমে এলো সাথে ব্যথাতুর দৃষ্টি।ছায়া ধীরে ধীরে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।আর একবারও ফিরে তাকালো না।

অরন্য সবাইকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলো।যদিও তাকে সবাই আগে থেকেই চিনে।শুধু মধ্যে দিয়ে কয়টা বছর ছিলো না।কেউ জানতোও না সে কোথায়।সবার চোখে মুখে প্রফুল্লতা,হাসি।এইবার অরন্য একে একে সবার পরিচয় জানতে চাইলো।সবাই যার যার পরিচয় দিলো।এইবার ছায়াদের সারি অবধি এসে থেমে গেলো।নীলা আর মেঘা নিজেদের পরিচয় বললেও ছায়া উঠলোও না আর কিছু বললো না।কিছুক্ষণ পর নীলা বললো উঠে দাঁড়াতে। ছায়া দাড়ালো কিন্তু দৃষ্টি নিচের দিকে।কথা গলায় আটকে গেছে যেমন।কোন শব্দই যেনো মুখ দিয়ে।স্বরনালী কাঁপছে। বুকের গহীনে নামহীন অজানা ব্যথার অস্তিত্ব টের পেলো।

অরন্য এইবার সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।কন্ঠে তীক্ষ্ণতা আনলো,

-হুয়াট হেপেন্ড? হুয়াটস ইউর নেইম মিস?

ছায়া চমকালো, ভড়কালো।আর বিদ্যুৎ গতিতে অরন্যের মুখের দিকে তাকালো।দুজনের দৃষ্টি এক হতেই বুকে ঝটাকা লাগে।ছায়া দ্রুত গতিতে চোখ সরিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-কমলীনি ছায়া।
আর কিছু বলার সাহস হলো না।তার পুরো শরীরের কম্পন ধরেছে।এক খন্ড পাথরের টুকরা নদীর পানিতে ঢিল মারলে তা যেমন তরঙ্গ তৈরী করে কম্পিত হতে থাকে ঠিক তেমন তার শরীরেও যেনো কম্পন ধরেছে।ধপ করে বসে পড়লো সিটে।

অরন্য আর কিছু বললো না।চোখ সরিয়ে নিলো।সামনে গিয়ে নিজের মনকে পড়ানোতে মনোনিবেশ করলো।
একটাও অপ্রয়োজনীয় কথা বলেনি।কারো দিকে তাকায়নি।তাকালে বুঝতো কতো মেয়ে তাকে চোখ দিয়ে গিলছে।

অরন্যের ক্লাস শেষ হতেই অরন্য বিদায় নিয়ে চলে যায়।একবার ফিরেও তাকায় না।ফিরে তাকালে দেখতো ভয়ে জড়োসরো হয়ে আড়ষ্ট এক তরুণীকে।অরন্য চলে যেতেই মেয়েদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয় অরন্যকে নিয়ে।

এর মধ্যেই এক সুন্দরী মেয়ে তার সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার দুইহাত বুকে গুঁজে স্থিরচিত্তে বলে উঠে,

-আপনাকে তবে পেয়েই গেলাম।
ইশ কি লজ্জা!এই বলেই মুখ ঢাকে হাত দিয়ে।
মেয়রের মেয়ে বলে কথা বেশ ভালো ছাত্রী হলেও অনেক অহংকারী। তার কাছে অহরহ ছেলের প্রপোজাল আসলেও বিশেষ একজনের অপেক্ষায় ছিলো।আজ হয়তো পেয়েও গেলো।মেয়েটিকে তার বান্ধবী সীমা ডেকে বললো,

-অহনা কি তবে প্রেমে পড়লো।হুম সামথিং সামথিং?
অহনা লাজুক হাসলো।

…..

-ডাক্তার অরন্য চৌধুরী আপনি অবশেষে গুহা থেকে বের হলেন এইটা বলেই দাঁত বের করে কেবলা মার্কা একটা হাসি দিলো প্রাণ।সেও একজন ডাক্তার।তবে সে সাইকিয়াট্রিস্ট।

অরন্য তার হাতের ফাইল দিয়ে প্রানের পিঠে এক বারি দিলো আর বললো,

-গিভ মি সাম রেসপেক্ট ব্রো।

প্রান তার চোখ প্রসারিত করে হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বললো,

– একটা চুম্মা দিলে কি রেসপেক্ট করা হইব?

অরন্য মুখটাকে বিকৃত করে বললো,

ছিহ! কিসব কথা বার্তা।আম নট এ গে।গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।

প্রান হোহোহো করে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতে যেনো পেটে খিল লাগলো।মুখে হাসি বজায় রেখেই হাপাতে হাপাতে জিজ্ঞেস করলো,

-অভিক শালার কি খবর।হেয় কি অইখানেই পইড়া থাকবো নাকি দেশেও আসবো?

অরন্য এইবার মুখটাকে সিরিয়াস করে তুলে।

-অভিক তো আমি আসার সময়ই আসতে চাইছিলো।কিন্তু কিছু কাজে আটকে গেলো।আমি বলছি সব শেষ করে আস্তে ধীরেই আসতে।

প্রাণও এইবার হাসিঠাট্টা বাদ দিয়ে সিরিয়াস হলো।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অরন্যের মুখের দিকে তাকালো।বুঝার চেষ্টা করলো অরন্যের অভিব্যক্তি।

-যাক ভালো।তবে এইভাবে কতোদিন? বিয়ে করছিস না কেনো? আন্টি তোকে নিয়ে কতোটা চিন্তা করে জানিস? যেই সময়টা নাতি নাতনি নিয়ে কাটানোর সময় সেই সময়টা তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে হায় হুতাশ করে কাটাচ্ছে।

অরন্য কিছু বললো না বরাবরের মতোই চুপ থাকলো।
প্রান বরাবরের মতোই হতাশ হলো।
….
ছায়া ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে মুখে শীতল পানির ঝাপটা দিচ্ছে বারবার।এটা সম্ভব না।কোনদিন না।তার একটু শান্তির প্রয়োজন।আচ্ছা শান্তি কোথায় পাওয়া যায়?অতীত যে বারবার তার সামনে আসছে।সে কি পারবে ট্যাকেল দিতে?
তার মনে পড়লো কতোদিন বাড়ি যায় না।কয়েকদিন বাড়ি গিয়ে থেকে আসলে কেমন হয়? কতোদিন বাবা মায়ের সাথে কথা হয় না? পুরানো কিছু মান অভিমানের জন্য আজ সে পরিবার থেকে এতো দূরে।এখন সে ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে চায়।
অন্তত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হলেও কিছুদিন থেকে আসা দরকার।
ছায়ার বাবা রেজাউল হক একজন ব্যাংক ম্যানেজার।মা মীরা বেগম গৃহিনী,ছোট বোন আয়িশা রোজ।এইবার ক্লাস নাইনে পড়ে বিজ্ঞান বিভাগে।বেশ চটপটে মেয়ে আর বেশ ভালো ছাত্রী।কিন্তু রাগটা নাকে আগায় থাকে।চঞ্চলা এই কিশোরীর লতানো দেহ,সুদীর্ঘ কেশ,হলুদ ফর্শা গায়ের রঙ।বেশ নজরে নজরেই রাখে মেয়েদের মা মিরা বেগম।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here