কুয়াশা মন (এক টুকরো স্মৃতি)

#কুয়াশা_মন
“একটুকরো স্মৃতি”
.
সুদূর পানে মিহির তাকিয়ে দেখছে সাবিহা মুচকি হাসছে, ঠিক যেমনটা একসময় তার রাগ ভাঙাতে সাবিহা হাসত। সামিরা তার বাবার কাঁধে মাথা রেখে বলছে, ‘মা দেখতে কেমন ছিল?’
‘নিজেকে আয়নায় কখনও দেখেছ? তোমার মাঝে আমার চেহারার কিছুটা ছোঁয়া আছে। আমার চেহারার সেই ছোঁয়াটা বাদ দিয়ে একবার কল্পনা করে দেখো, তুমি বড় হয়েছ। নিজেকে ভাবো আঠারো বছর বয়সী এক মেয়ে। দেখবে আয়নায় তুমি তোমার মাকেই দেখছ। তার শূন্যতা অনুভব না করার জন্যই হয়তো তুমি একদম তার মতোই।’
মিহির একহাত সামিরার কাঁধে রেখে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখ, তোমার মা বীচের যে অংশজুড়ে হাঁটছে, তার বালিগুলো কেমন। তার মন কতটা বিষণ্ণ! আমাকে বলেছিল, “আসুন, একসাথে হাঁটি।”
আমি বললাম, “তোমার সাথে হাঁটতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। তোমার অনেক জোরাজুরিতে এখানে সময় বের করে এসেছি। এরচেয়ে অধিক আর কিছু করতে পারব না বুঝলে?”
তোমার মা মাথা নেড়ে হাসিমুখে সায় দেয়। আমি এখানে, এই জায়গায় নির্লিপ্ত ভাবে বসে রইলাম। সে হাতদুটো পেছনে রেখে বেখেয়ালি হয়ে হাঁটতে শুরু করল। কেমন হেলেদুলে হাঁটছে! এই যেন পড়ে না যায়। মাঝে মাঝেই সে ঢালা শাড়ি পরত, কুঁচি শাড়ি থেকে একঘেয়েমি আসায়। এখনও পরেছে। তাকিয়ে দেখ, ওর চুলগুলোকে বাতাস কীভাবে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র ওর পাশে নয়, ওর চোখে। আমার ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যাশায় এই সমুদ্র সে তৈরি করেছে। ভেবেছে একদিন তা পেলে এখানে সে ডুবে ডুবে তৃপ্ত হবে। তৃপ্তি না মিটলেও ডুব খাবে, ডুব খাবে আমার মাঝে। আমি যদিও বা সময় বের করে খিটখিটে এক মেজাজ নিয়ে এসেছি, ওর হাঁটা, ওর বেখেয়ালিপনা দেখে মুহূর্তেই সেই মেজাজটা আর আগের মতো রইল না।
ওর পা শাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। খালি পায়ে হাঁটছে, একের পর এক পা ফেলে। হাঁটার ভঙ্গি দেখে একবার ইচ্ছে হয়েছিল দৌড়ে যাই; বলি, এইভাবে কেন হাঁটছ পাগলি? কোনসময় তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাবে বুঝতেই পারবে না। তখন বালি তোমার শরীরে মাখামাখি হয়ে যাবে। এভাবে খালি পায়ে হেঁটে অঘটন ঘটাতে যেও না। যদি কোথাও ওয়াইনের বোতলের টুকরো পড়ে থাকে?
এখন ওকে আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার মতো কিছু বেখেয়ালি পুরুষও আছে, যারা একমুঠো ভালোবাসা পাওয়ার আশায় দিনের পর দিন নিজের গলায় বিষ ঢেলে চলে, মনের সুখে মদ খায়। তুমি মদ খাওনি, তবু এমন বেখেয়ালি কেন? তুমিও কি ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যাশা রাখো? তোমার আর ওদের মাঝে ফারাক আছে কি?
আমি যদি সন্ধ্যায় একটিবার ওর হাত ধরে আমার হৃদস্পন্দনও অনুভব করাতাম, সে মৃদু হেসে আমার দিকে অপলক চেয়ে থাকত। তাকে কষ্ট দেওয়ার মুহূর্তগুলো নিমিষেই ভুলে যেত। কিন্তু সময় থাকতে আমি তার হাত একটিবার ধরে আমার হাতের সাথে খাপে খাপে মিলালাম না, দুজনই পেছন থেকে কালো পোর্ট্রেট হয়ে ডুবন্ত সূর্য দেখলাম না। আমি এখনও দেখছি ও একা দাঁড়িয়ে সূর্যের কিরণকে তার কাছ থেকে ভেদ করে আসতে দিচ্ছে না। হাতের ওপর হাত গুঁজে রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। আমি এভাবেই এখানে বসে ভাবছিলাম, আমাকে ছল করে বিয়ে না করলে আজ ওর পাশে আরেকটা অবয়ব হিসেবে আমি থাকতাম। ওর মাঝের শূন্যতাটা আর থাকত না। তুমি বারবার আমাকে বোঝালে, আমায় ভালোবাসো, ছলটা করোনি। আমি ওটাকে আত্মসাতের তৃপ্তির নাম দিয়ে দিয়েছি।
সাবিহা সুখেই ছিল, আপন একপক্ষের ভালোবাসা নিয়ে। আমাকে সে আমার মতো করেই থাকতে দিয়েছে। কখনও কলার টেনে জেদ করে বলেনি, আর কত মানালে আপনি নিজেকে বদলাবেন? আমি আপনার সামনে আর কত ভিনভিন করে নিজের ভালোবাসা বোঝাতে থাকব?
সে কিছুই বলত না। কর ভেতরটা সম্ভবত ফেটেই যেত, প্রকাশ করত না। ওর ডায়েরিটিতেও অপ্রকাশিত রাখল এসব অনুভূতি, একদিন যাতে আমি নিজেই এসবের কাছে পৌঁছাই। সে সার্থক হয়েছে।
দেখো, ওকে জয় করতে দেখে মৃদু হাসছে সে। আমি এখনও ভ্রান্তিবিলাস করি সামিরা। ভাবি, মনটা কুয়াশাময় আমার ছিল নাকি তার?’
সামিরা তাকিয়ে দেখে বালির চড়ে ঢালা শাড়ি পরিহিতা কেউই নেই। বাবা কি আজও এখানে তাকে দেখে? কেন সাপ্তাহিক ছুটিতে বাবা তাকে এখানে নিয়ে আসে? কী আছে এই জায়গায়? বাবা আরেকটা বিয়ে করছেন না কেন? মা কি এখনও তাঁর সাথে দেখা করতে আসে? মা কি আমাকে দেখছে? মা কি এতই স্বার্থহীন ছিলেন যে, আজ তাঁর পরিবর্তে বাবার কাছে অমূল্য রতন হিসেবে তাকে দিয়ে গেছে? আজ মা সামিরার কাছে না থাকলেও কেন যেন দুঃখ তেমন লাগে না। সেও কি মায়ের মতো হতে চলেছে? দূরে থেকেও কারো মনে ভালোবাসা জাগানোর কলাটা কি তার মাঝেও এসেছে?
মিহির আলতো করে সামিরার চুলে বিলি কেটে দেয়। কপালে হালকা করে একটা চুমু খায়। ক্রমে নিজের মাথাও কাঁধে রাখা সামিরার মাথার ওপর রেখে দেয়। না, তার সাবিহা আশেপাশেই আছে। হয়তো মিহিরের অন্য কাঁধে সেও মাথা রেখেছে। মিহির চোখ বন্ধ করে ফে।
সে দেখছে, মা না থাকায় সাবিহা রান্না করছে। সে জিজ্ঞেস করতে এলো, কেন মা তাকে কক্সবাজার থেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাবিহা “জানি না” বলে অজান্তেই উত্তপ্ত কড়াই ধরে ফেলেছে। পুড়ে যাওয়ায় মিহির তাড়াতাড়ি তার হাত পানির রাশিতে ধরে রাখল। সাবিহা তখন তার পুড়ে যাওয়া ভুলে গিয়ে মিহিরের দিকে অবিরাম তাকিয়ে থাকে। মিহির মলম এনে তার হাতে লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্লিজ বাবাকে বলো না। প্লিজ।’
সে হয়তো মনে মনে বলছে, আপনাকে নিয়ে অভিযোগ দেওয়া দূরে থাক। এভাবেই আমার সামনে মিনতি করতে থাকলে আমি হাজারবার পুড়তে চাই।
সামিরা খিলখিল করে হেসে উঠল।
‘হাসছ কেন?’
‘আপনাদের ওই মুহূর্তটা আমি দেখেছি।’
‘তাই? কোথায়?’
‘মায়ের ডায়েরি পড়ে।’
‘ইশ, সময় থাকতে যদি আমি একবার ওটা দেখতাম! কেউ আমাকে এতটুকু ভালোবাসে জানলে তাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতাম, অবহেলা করতাম না। সে ছিলই এমন, সবই লুকাতো। ডায়েরিটাও আমার কাছ থেকে আজীবন লুকিয়ে রেখেছিল, যাতে না পাই।’
দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে মিহির। বাতাসে তা মিলে যায়। হয়তো পৌঁছে যাচ্ছে সাবিহার কাছে।
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here