ডির্ভোস পেপার টা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে নীর। চোখের পানিতে পেপারের এককোনা ভিজে যাচ্ছে, সেদিকে কোন খেয়াল নেই তার। বিয়ের আট মাস পর জন্মদিনে স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া উপহার এই ডির্ভোস পেপার।ডির্ভোস পেপার যে বার্থডে গিফট হতে পারে এটা নীরের স্বপ্নাতীত। পার্টিতে এতো এতো মানুষ সবাই অবাক চোখে দেখছে নীর আর আয়ান কে। এরকম বার্থডে পার্টি এর আগে ওরা কখনো দেখেনি যেখানে স্বামী তার স্ত্রীকে ডির্ভোস পেপার উপহার হিসেবে দেয়।নীর কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিল আয়ান,
নীর, কি দেখছো অমন করে, তাড়াতাড়ি সাইন করো বলছি।
নীর কান্নাভেজা চোখে আয়ানের দিকে একবার তাকাল, তারপর কোন কথা না বলে সাইন করে দিলো।ওর সাইনে একটা সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। সাইন করে দিয়ে নীর ওখান থেকে দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় আয়ান কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে বললো,
যাওয়ার আগে কেকটা তো কেটে যাও তুমি।বলা তো যায়না পরের বছর তোমার বার্থডে পার্টিতে আমাকে তুমি ইনভাইট নাও করতে পারো।কেক কেটে তারপরে যাও তুমি, পার্টিতে এতো মানুষ এসেছে তাদের আনন্দ টা মাটি করে দিওনা প্লীজ।
নীর চোখে পানি নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
ওদের আনন্দ তো আপনি আগেই মাটি করে দিয়েছেন আয়ান। আমার ভালবাসার এই দাম দিলেন?চিন্তা করবেন না আপনি,পরের বছর আমার বার্থডে পার্টি হলে আমি নিশ্চয়ই আপনাকে ইনভাইট করবো,আজ আমি কেক কাটবো না।এ কথা বলে নীর আর একমুহুর্তও ওখানে দাঁড়ালো না, বাবার কাছে চলে এলো।বাবা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে কলিজার টুকরা মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছেন,একটা সমস্যার জন্য পার্টিতে যান নি উনি।নীর কে এতো তাড়াতাড়ি করে আসতে দেখে ওর বাবা আমিন চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,
কি হয়েছে মা, পার্টি ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?কেক কেটেছো কি? কেমন ইনজয় করলে ওখানে?
তুমি যে চলে এসেছো আয়ান রাগ করবে না?বাবার একসাথে এতগুলো প্রশ্ন শুনে নীর থেমে থেমে বললো,
আগে বাসায় চলো বাবা, তার পর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে তুমি।
আমিন চৌধুরী মেয়েকে আর কিছু বললেন না,নীর গাড়িতে উঠে বসলো।একটু পরেই গাড়ি চলতে শুরু করলো,নীর একবার শুধু গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে পিছনের দিকে তাকালো।চোখ থেকে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে তার,বেহায়া চোখ বাঁধা মানছে না আর। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো নীর।নীর কে এইভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন আমিন চৌধুরী, নিজের জন্মদিনে এইভাবে কাদছে কেন নীর?বাসা থেকে আসার সময় কতখুশি ছিল সে, আয়ান ওর বার্থডে পার্টি থ্রু করেছে এটা শুনে নীর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল তাহলে ফিরে যাওয়ার সময় এইভাবে কাঁদছে কেন।নীরের কান্না সহ্য করতে পারেন না আমিন চৌধুরী তাই জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তার।নীর কিছু না বলে শুধু কাঁদছে। আধঘন্টা পর নীরদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে নেমে নীর দৌড়ে বাসার ভিতরে চলে গেল,আমিন চৌধুরী ও পিছনে পিছনে বাসার ভিতরে চলে আসলেন।
নীর রুমে এসে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলো, বুকটা ভিতর থেকে ফেটে যাচ্ছে তার। নিজের ভালোবাসার মানুষ টাকে হারানো কতটা কষ্টের সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে, আয়ান ওকে ভালো না বাসলেও তাকে যে খুব ভালো বাসে নীর, তাকে ছাড়া কিছু ভাবতেও পারে না,আর সেই আয়ান ওকে ডির্ভোস দিলো এটা ভাবতেই ওর আরও কান্না পাচ্ছে। কেন করলো এমন টা আয়ান, কি দোষ ওর? শুধু মাত্র কালো বলেই কি আজ আয়ান ওকে ডির্ভোস দিলো? তখন আমিন চৌধুরী নীরের রুমে এলেন,নীর বাবা কে দেখে উঠে বসলো। আমিন চৌধুরী নীরের বিছানায় বসে নীরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
কি হয়েছে আমার মা টার? এইভাবে কাঁদছে কেন তখন থেকে? পার্টিতে কি কিছু হয়েছে নীর?
নীর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
আয়ান আমাকে ডির্ভোস দিয়ে দিয়েছে বাবা।বার্থডে গিফট হিসেবে ও আমাকে ডির্ভোস পেপার দিয়েছে। আমাকে সবার সামনে ডির্ভোস দেওয়ার জন্য পার্টি থ্রু করেছিল, আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে বাবা, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।নীর বাবা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমিন চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে গেছেন নীরের কথা শুনে। আয়ান এটা কি করে করতে পারলো নীরের সাথে, বিয়ের সময় আয়ান নিজে ওনাকে কথা দিয়েছিল যে সারাজীবন নীর কে ভালো রাখবে সে। কখনো কোনো কষ্ট দেবে না নীর কে। তার সেই কথার ভরসায় নীরকে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন এটা কি করলো আয়ান। আমিন চৌধুরী নীরকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,
তুমি থাকো মা,আমি এক্ষুনি আয়ানের কাছে যাচ্ছি,ওর সাহস হয় কি করে আমার মেয়েকে ডির্ভোস দেওয়ার, বিয়ে করেছে কি ডির্ভোস দেওয়ার জন্য? আমি এখুনি যাচ্ছি ওর কাছে, তুমি কেঁদো না আর।
নীর বাবাকে আটকে দিয়ে বললো,
না বাবা, তুমি যাবেনা, ওনার মুখটাও তুমি দেখবে না আর।ওই মানুষ টার কাছে কেন যাবে তুমি হ্যা যে আমাকে কে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করে না, বিয়ের পর একটা দিনও ভালো ভাবে কথা বলে নি আমার সাথে, ভালো ব্যবহার করে নি আমার সাথে। তোমার কালো মেয়ে ওনাকে ভালোবাসলেও উনি ভালোবাসেন না বাবা, তোমার মেয়ে যে কালো বাবা। আমি কি ভেবেছিলাম জানো,যে উনি হয়তো আজ সবার সামনে আমাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করবেন সেজন্য আমার বার্থডে পার্টি থ্রু করেছেন। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছি বাবা, উনি আমাদের সম্পর্ক শেষ করতে পার্টি রেখেছেন। একদিন সবার সামনে আমাকে বিয়ে করেছিলেন আর আজ সবার সামনে আমাকে ডির্ভোস দিলেন উনি।
নীরের কথা গুলো শুনে আমিন চৌধুরী অনেক কষ্টে নিজের রাগটা কে সংযত করে রেখেছেন। না পারছেন নীরকে শান্তনা দিতে না পারছেন আয়ান কে কিছু বলতে।নীরের একটা সামান্য কথাও ফেলতে পারেন না তিনি। ছোটবেলায় মাকে হাড়িয়েছে নীর, তখন থেকে আমিন চৌধুরী ই নীরের বাবা মা হয়েছেন।যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন মেয়ে কে। কালো বলে নীর কে কেউ পছন্দ করতো না, কিন্তু আমিন চৌধুরীর কাছে নীর হীরের টুকরো। কোন কিছুর অভাব দেননি তাকে, চোখ থেকে একফোঁটা পানিও পড়তে দেননি তিনি।আর আজ নীর একটা ছেলের জন্য এইভাবে কাঁদছে এটা সহ্য হচ্ছে না ওনার। ইচ্ছে হচ্ছে কলিজার টুকরা টাকে কাদানোর জন্য আয়ান কে গুলি করে মারতে, কিন্তু পারছেন না।
কিছুক্ষণ পর নীর নিজের কান্না থামিয়ে বললো,
বাবা আমার খুব খারাপ লাগছে, তুমি এখন আমার রুম থেকে যাও আমি ঘুমাবো।আর হ্যা রাতে আমাকে ডাকবে না আর, কোনো কিছুর জন্য ডিস্টার্ব করবে না আমাকে।
আমিন চৌধুরী নীরের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।নীর দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসছে চোখের সামনে, গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো নীর।
সকাল নয়টার দিকে ঘুম ভাঙল নীরের। ঘুম থেকে উঠে নীর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেল, ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। একটা কালো মুখ আয়নায় ভেসে উঠেছে, নিজের মুখটাকে দেখে কান্না পাচ্ছে নীরের, কেন যে আল্লাহ তাকে কালো করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।আজ কালো বলে ভালোবাসার মানুষ টিকে হারাতে হলো তাকে,যদি আজ কালো না হতো তাহলে হয়তো আয়ান এইভাবে ওকে কাদাতো না,কাঁদতে শুরু করল নীর। কালো মেয়েদের কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই?
(চলবে……….. ইনশাআল্লাহ)
#কৃষ্ণবতীর_মায়ায়
#সুচনা_পর্ব
#লেখিকা_সাদিয়া_জান্নাত_সর্মি
(