#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা
কোরবানির ঈদ! আর মাত্র চারদিন দিন পর। বিয়ের পর এই প্রথম ঈদ আমার ও আপুর। এবার আমার আপুকে ছাড়া একা ঈদ করতে হবে মনটা ভার। আপু শশুর বাড়ি নতুন মানুষ জন নিয়ে দিনটা পার করবে আর আমি বাসায় আব্বু আম্মুর সাথে। আপুর মতো যে আমাকে শশুর বাড়ি যেতে হয়নি তাই আমি স্বস্তি পাচ্ছি। কারণ আপুর মতো আমাকে যদি স্পর্শরা নিয়ে যেতো তাহলে আমাকে বাবা মাকে ছাড়া ঈদ করতে হতো আর আমি খুব কষ্ট পেতাম।
আপুর সাথে দিনরাত ফোনে কথা বলা হয়। তার মনটাও খারাপ কিন্তু কিছু করার নাই। বাবা আমাকে আর আপুর জন্য সেম দুই রঙের থ্রি পিস এনে দিয়েছে। শাশুড়ি মা দুইটা শাড়ি দিয়েছে একটা পড়ে ঈদের দিন তার বাসায় যেতে হবে।
আমি আমতা আমতা করে রাজী হয়েছি।
রাতে একটা টেক্সট করলাম স্পর্শকে। তিনি ফোন দিল আমাকে একটু আধটু কথা হয় এখন আগের মতো আর ইগনোর করে না।
আমি ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলাম। উনি বলল, ‘ শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘ আপনি পছন্দ করেছেন?’
‘ না আম্মুর পছন্দ। সব সময় আমি পছন্দ করি এজন্য এবারের আর আমাকে পছন্দ করতে দেয়নি।’
‘ ওহ খুব সুন্দর হয়েছে। আম্মুর পছন্দ তো খুব সুন্দর।’
‘ আমার পছন্দ করা জিনিস সুন্দর না?”
‘ ভালোই কিন্তু আম্মুর পছন্দ বেশি সুন্দর।’
‘ তাই। আমার পছন্দের জিনিস পছন্দ না হলে ও তোমার সেসব পরতেই হবে। ‘
‘ আপনার পছন্দ খারাপ হলেও আমি পরতামই। কারণ আপনি মানুষটাই আমার খুব প্রিয়। তাই আপনার সব জিনিস আমার কাছে খুবই স্পেশাল।’
কথা বলার পর আমি চুপ মেরে ছিলাম। স্পর্শ কে এই ভাবে প্রিয় বলে দিলাম। কথার তালে তালে। স্পর্শ যে আমার মুখে এসব শুনে খুশির জোয়ারে ভাসতেছে আমি জানি। স্পর্শ আর কথা বলছে না আমি আমতা আমতা করে নিশ্চুপ আছি। হঠাৎ টুং টুং আওয়াজ হয়ে কলটা কেটে গেল আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। এটা কি হলো আমার এতো আবেগ মাখা কথা শুনে উনি কিছু না বলেই কল কেটে দিল।
আমি রাগ করার টাইম পেলাম না তার আগেই টুং করে মেসেজ এলো স্পর্শের নাম্বার থেকে। আমি ওপেন করে দেখি,
‘ এতো আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা দেখিয়ে আর কখনো আমার সাথে কথা বলবে না। আমি এসব সহ্য করতে পারিনা। মন চাই ছুটে গিয়ে তোমাকে বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরি। কিন্তু সেসব এই মুহূর্তে অসম্ভব। আমি বাধা।তাই আমাকে কন্ট্রোল লেস করবে না। যত ভালোবাসা, সব আমার কাছে এসে দেখাবে, বলবে, আমি অনুভব করবো, আমাকে ছটফট করতে হবে না!’
আমি জল ভরা দৃষ্টিতে লেখা গুলো পরলাম। স্পর্শের কষ্ট গুলো যেন আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আমি তার ভালোবাসার গভীরতা যেন অনুভব করতে পারলাম।
স্পর্শের কথা ভাবতে ভাবতে আমি সারা রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারলাম না। সকালের দিকে আমার ঘুম চোখে নেমে এলো। সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমার বেলা হয়ে গেল। এদিকে মায়ের ডাকা ডাকি চোখের ঘুম সব নিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠলাম।
বিকেলে আমি পাশের বাড়ির ঝিনুক আপুর সাথে টেইলার্স এর দোকানে এলাম তার সাথে। বাসার সামনেই দোকান তিনি জামা বানাতে দিয়েছিল সেটা নেব আর আমি তার সাথেই ঘুরতে এসেছি। দোকান থেকে ফিরার সময় দেখা হলো এলাকার রিপন ভাইয়ের সাথে। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি দূর থেকে তার কালো মুখে সাদা দাঁত গুলো দেখতে পেলাম। গুঞ্জনের শুনেছি ঝিনুক আপুর সাথে নাকি তার প্রেম আছে। কতোটা সত্যি জানি না। ঝিনুক আপু আমার আপুর থেকেও অনেক বড় তাই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব পূর্ণ কোন সম্পর্ক নাই। বড়র মতো সম্মান দিয়ে চলি এসব জিজ্ঞেস করার ও সাহস নাই। উনার যে রাগ আমি ক্লাস ফাইভে থাকতে উনার কাছে প্রাইভেট পরেছি। পড়া না পাড়লে খুব মারতো। সেই থেকে ভয় পাই।
রিপন ভাইয়ের দিকে একবার তাকালো ও না আপু আমি সিআইডির মতো দুজনকে লক্ষ্য করে বাসায় এলাম। আজকের বিহেভিয়ার দেখে মনৈ হচ্ছে রিপন ভাই ই আপুকে পছন্দ করে আপু করে না। কিন্তু আমি সবাইকে বলাবলি করতে দেখেছি কি মাখামাখি দুজন। কই আপু চোখ একবার তাকালো ও না।
আমি রাতে এসব নিয়ে পাঁচ বান্ধবী দের পারে আড্ডা দিলাম। আর একদিন ঈদের। সবাই গরু কিনে ফেলেছে আমাদেরটাও চলে এসেছে লাল রঙের গরু। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছি শুধু। গরুটার কাছে ঘেঁষতে পারিনি পারবো কি করে? সিং খাড়া করেই রাখে মনে হয় কাছে গেলেই গুতা মারবে। আমি আবার এই ভয় খুব পাই। স্পর্শ ও আমাকে কল করে তাদের কেনা গরু দেখালো পরদিন। দুইদিন আগেই আমাদের কোরবানির গরু কেনা হতে গেছে। স্পর্শদেরটা কেনা হয়েছে ঈদের আগের দিন। আমাদের ফ্ল্যাটের ও পাশের ফ্ল্যাটের সবাই সন্ধ্যার আগেই এসে আমাকে গুতাচ্ছে মেহেদী দিয়ে দিতে। প্রতিবার আপু আর আমি দুজনেই মিলে এই কাজ করি। এবার আমাকে একা করতে হবে। আমি অলস ভঙ্গিতে বসে আছি। ভাল্লাগছে না। আপুকে ভিডিও কল দিয়ে দেখলাম তিনিও এই কাজই করছে ননদ টনদ সবাইকে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। আপু অনেক ভালো মেহেদী পড়াতে পারে আমি অতো সুন্দর করে পারিনা আপুর মতো। এবার আমাকে কে মেহেদি পরিয়ে দেবে। আপুর শাশুড়ি মা নাকি আপুকে বলেছে কাজ বাদ দিয়ে মেহেদী দিয়ে দিতে আপুও তাই করছে।
আমি কোন রকম ফুল পাতা দিয়ে কাজ শেষ করলাম। তারপর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আপুর কল করে বললাম,
‘ এবার আমাকে কে মেহেদি পরিয়ে দেবে।’
আপু বলল, ‘ রেস্ট নিয়ে খাবার খা। তারপর আস্তে আস্তে দিয়ে ফেল।’
‘ আমি পারবো না। তুমি চলে আসো। আমাকে মেহেদী পরিয়ে দাও।’
‘ বাচ্চাদের মতো করিস কেন। আমি কি করে আসবো। আমি ঈদের তিনদিন পর আস্তে পারবো।এর আগে আসা সম্ভব না।’
‘ কেন?’
‘ নানা শশুরবাড়ি দাওয়াত সেখানে তারপর ফুফু শাশুড়ির বাড়ি।’
‘ আজব। আমরা কি কিছুই না তোমাদের আমাদের বাড়ি সবার পর কেন আসবে। এটা কেমন নিয়ে ওখানে কি পরে যাওয়া যাবে না। তুমি কালকেই বিকেলে চলে আসবা। ‘
‘ পারবো না রে। আমার হাতে কিছু নাই। এখন আমি তাদের বাড়ির বউ তাদের সিদ্ধান্তের উপর আমি কথা বলতে পারবো না। তাদের কথাই আমাকে মানতে হবে আমি মানতে বাধ্য।’
‘ তোমার কোন মতামতের দরকার নাই। এটা কেমন নিয়ম। আমি তো কখনো এমনটা মানবো না। আমি সবার আগে আমার বাবার কাছে আসবো তারপর বাকি সব।’
‘ এটা করলে অশান্তি হবে। এখন বুঝবি না। শশুর বাড়ি একবার যাও তারপর বুঝবি। ‘
‘ এমন করলে আমি শশুর বাড়ি কোনদিন যাব না। ‘
‘ স্পর্শ কে ছাড়া থাকতে পারবি?’
‘ উনাকে ঘর জামাই করে রাখবো!’
‘ দুষ্টু বোন আমার।’
.
রাত ঠিক বারোটার সময় আমি স্পর্শকে কল করলাম। তিনি রিসিভ করলো তিনবারের বেলায়।
আমি কোন কথা না বলে আগে ‘ঈদ মোবারক’ বললাম। অনেক জোরে বলেছি।
এপাশে স্পর্শ কান থেকে ফোন সরিয়ে রেখেছে। কারণ আমি অনেক জোরে বলেছি তার কানে লেগেছে।
শান্ত হতেই স্পর্শ বলল,’ এতো জোরে কেউ বলে আমার কান মনে হয় ফেটে গেল।’
আমি আনন্দিত কন্ঠে বললাম, ‘ আমি আগে আপনাকে ঈদ মোবারক বলেছি।’
স্পর্শ বলল, ‘ এতো তাড়াহুড়ো না করলে ও আমি তোমার আগে বলতাম না। তোমাকে আগে বলার সুযোগ দিতামই।’
আমি কপাল কুঁচকে বললাম, ‘ কেন?’
‘ কারণ আমি চাই তুমি সব কিছুতে ফার্স্ট থাকো!’ স্পর্শ নির্লিপ্ত গলায় বলল।
আমি চুপ করে ফোন কানে ধরে স্পর্শের কথা শুনছি। ওইভাবেই কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই।#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা
বিকেলে স্পর্শ এলো মাংস নিয়ে। এপাশে থেকে আব্বু ও গেছিল দিতে তারপর আপুর বাসায় গেছে। স্পর্শের সাথে সীফা এসেছে। স্পর্শ শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে।এটা আমরাই দিয়েছি। খুব মানিয়েছে। সীফা এসে আমাকে বলল শাড়ি পরতে। স্পর্শ নাকি তাই বলেছে। আমার গলা শুকিয়ে আসে শাড়ি পরার কথা শুনলেই। আজো তাই হলো। কিন্তু সীফা শাড়ি পড়াতে দক্ষ সেই হাতে শাশুড়ি মার পছন্দ করা মেরুন রঙের শাড়িটা পরিয়ে দিল। এখন আমায় ওদের সাথে ওই বাসায় যেতে হবে। স্পর্শ বাইরে বসে আছে আম্মু তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে আমার শাড়ি পড়া হতেই সীফা কেও ধাক্কিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। আম্মু দুজনে খাওয়াচ্ছে। আমি সাজগোজ করতে লাগলাম।
স্পর্শ কে দেখলাম খাবারের সামনে অসহায়ভাবে বসে আছে। তিনি আর খেতে পারছে না বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আম্মু তো তা মানছে না জামাইকে পেয়েছে তো আর কি লাগে তিনি স্পর্শের প্লেট ভরে ফেলছে। আমি গিয়ে আম্মুকে থামালাম। স্পর্শ প্লেটের খাবার আর গিলতে পারলো না। আমি তাকে হাত ধুয়ে উঠতে বললাম। আর মাকে বললাম,
‘ তুমি তো দেখি খাইয়েই মেরে ফেলবে।’
মা লজ্জা পেল একটু। আমার কথায় না স্পর্শকে এমন নাকানিচোবানি খেতে দেখে।
লজ্জা আমতা আমতা করতে লাগলো স্পর্শের সামনে।
তিনজন এই বাসায় চলে এলাম। বিকেলের সময় টা এই বাসায় ই কাটলো। আরেকটা জিনিস ঠিক হলো দুইদিন পর একটা ফ্যামিলি ট্যুরে যাওয়া হবে। আমাদের বাড়ির সবাই স্পর্শ দের বাড়ির সবাই, আর আপুদের বাড়ির আপী ভাইয়া। এই ট্যুরের কথা শুনে আমার আনন্দের সীমা রইল না। বেড়াতে যেতে কে না পছন্দ করে আমিও করি। আর তা যদি হয় আপন মানুষদের সাথে তাহলে তো কথাই নাই।
বাড়িতে এসে আব্বু এসেছে দেখলাম। তাদের কথাটা বললাম। তারা রাজী না বলল আমরাই যাব তারা যাবে না। আমি স্পর্শ কে ফোন করে জানিয়ে দিলাম সব। স্পর্শ বলল,
‘ ডোন্ট ওয়ারি। আমি সবাইকে রাজি করিয়ে নিয়েই যাব টেনশন করো না।’
‘ আচ্ছা।’
.
আপুরা তিন দিনের আগে ফ্রি হতে পারেনি।তাই আমাদের তিনদিন পরেই ট্যুরে যাওয়ার বন্দোবস্ত হলো। আমার আব্বু আম্মু কে রাজি করাতে স্পর্শের অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। অবশেষে সফল হয়েছে। তাই তো আজ তিনদিন পর আমরা সবাই হৈ হল্লা করতে করতে বেড়াতে যাচ্ছি। আমরা সবাই যাব স্পর্শের নানু বাড়ি সিলেট। এত দূরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার নানা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাগল করে দিচ্ছে। কারো সময় ও সুযোগের অভাবে আর যাওয়া হয়নি। এবার ট্যুরে যাওয়ার কথা শুনতে সেখানে যাওয়ার কথা বলছে। বেড়ানো ও হবে তাদের দাওয়াত রক্ষা করা হবে এজন্য সেখানেই যাচ্ছি সবাই।
আব্বু আম্মু আর আমার শশুর শাশুড়ি এক গাড়িতে। আপু ভাইয়া আর আমি স্পর্শ এক গাড়িতে। মোহিনী ভাবি ভাইয়া আর সীফা এক গাড়িতে।
স্পর্শ ড্রাইভ করছে আমি পাশে বসা। পেছনে আপু আর মাহিন ভাইয়া। আমরা চারজনেই টুকটাক কথা বলেছি। আপু তার শশুর বাড়ি, ননদ, নানা শশুরবাড়ি সবার গল্প করছে।
আমি তাই মনোযোগ সহকারে শুনছি। আপু আর আম্মু আমাকে এখানে আসার আগে পইপই করে বলেছে আমি যেন খুব ভদ্র হয়ে থাকি। আর কথা যেন কম বলি। সবার সাথে ভদ্রতার সাথে কথা বলি আর বুঝে শুনে যেন বলি। আমিও মাথা নেড়েছি।
অর্ধেক রাস্তা আসতেই মাহিন ভাই আর আপু সামনে এলো জোর করে আমাদের পেছনে পাঠিয়ে। কারণ স্পর্শ একা সম্পুর্ণ রাস্তা ড্রাইভ করলে অনেক ক্লান্ত হয়ে যাবে। তাই ভাইয়া করছে এখন।
পেছনে আসতেই স্পর্শ খপ করে আমার হাত ধরে হাতের পিঠে একটা চুমু খেল আমি বিস্মিত নয়নে স্পর্শের দিকে তাকালাম। স্পর্শ হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেই চোখ বন্ধ করে আছে সিটে। আমি ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে করতে সামনে তাকালাম আপুরা আমাদের ধ্যানে নাই। আমি নিচু স্বরে স্পর্শ কে বললাম,
‘ হাত ছাড়ুন।’
স্পর্শ আমার কথার প্রতি উত্তর করল না। অন্য কথা বলল, ‘ আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখো। যেতে আমাদের আরো অনেক সময় লাগবে। একটু ঘুমাও তাহলে মনে হবে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।’
আমি বড় বড় চোখ করে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কি সব বলছে। সামনে আপু আর ভাই আছে তাড়াতাড়ি কি ভুলে গেছে নাকি।
‘ আপুদের সামনে আপনি এসব কি বলছেন? তাদের সামনে আমি আপনার এত কাছাকাছি থাকবো। তারা কি ভাববে? আপনার লজ্জা লাগছে না।’
স্পর্শ বন্ধ চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল সরাসরি এবার। তারপর বলল,
‘ কি ভাববে? আমরা যে হাসবেন্ড ওয়াইফ সেটা কি ভুলে গেছো? কাছাকাছি থাকলেই কি? আমাদের সম্পর্কে বৈধতা আছে! আর আমি জাস্ট আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে বলেছি। চুমু খেতে বলিনি যে লজ্জা পাবো।’
স্পর্শের এমন লাগাম ছাড়া কথা শুনে আমি চুপ করে গেলাম। আপু আর ভাইয়া নিজেদের মত কথা বলছে আমাদের দিকে তাদের খেয়াল নাই। স্পর্শের কাছে হার মেনে আমাকে তার কাঁধে মাথা রাখতেই হলো।
অনেকক্ষণ জার্নিতে আমার চোখে ঘুম তাড়াতাড়ি নেমে এলো।
সবার আগে এই বাসায় আমরা পৌছালাম। আমার ঘুম ভেঙে গেছে এখানে আসার আধা ঘণ্টা আগেই। আমি ঘুম থেকে চোখ মেলে দেখেছি স্পর্শ জাগ্রত। তিনি আমার ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ মেলে তার চোখের গভীরতা দেখে থতমত খেয়ে গেলাম।
স্পর্শ আমার চোখের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, ‘ ঘুম ভেঙেছে আপনার তাহলে। সম্পূর্ণ রাস্তা শেষ করেই আপনার ঘুম ভাঙলো।’
আমি স্পর্শের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে সরে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরের দৃষ্টি ফেলে বললাম ঘুমঘুম কন্ঠ,
‘আমরা কি চলে এসেছি আর কতদূর!’
‘তাকিয়ে থাকো আর পাঁচ মিনিট তাই পুরনো কালের দুতালা বাড়ি দেখতে পাবা। সেটাই তোমার মামা শ্বশুর বাড়ি!’
‘ সত্যি এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম!’অবাক গলায় বললাম কারণ আমার মনে হচ্ছে আমি এইমাত্র ঘুমিয়েছি এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম এমনটাই মনে হচ্ছে।
‘জি না ম্যাডাম। আপনি পাক্কা তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছেন।’
আমি অবাক স্বরে বললাম, ‘ এত সময়! আমার তো মনে হচ্ছে এইমাত্র ঘুমালাম!’
‘ভালো। চলে এসেছে ওই দেখো!’
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো না এটা আদিম কালের। মডেল আদিম কালের হলেও চকচকে একদম।পুরনো বাড়ি এটা দেখলে কেও বলবে না শুধু ডিজাইন টাই পুরোনো। এত সুন্দর করে যত্ন করে রেখেছে এটা যে পুরনো বাড়ি বুঝার উপায় নাই। চকচকে রঙ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাজাদের বাড়ি মনে হচ্ছে!
আমরা সবার আগেই পৌঁছেছি তাই সবার আগে ভেতরে গেলাম আমরাই। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। আদ বয়স্ক একটা লোক আমাদের দেখে স্পর্শ মনে হয় চিনতে পারল আমাদের তিনজনকে তো আর চিনবে না। চিনতে পেরে ভেতরে চলে গেল।একটু পরে একদল লোক বেরিয়ে এল চিৎকার-চেচামেচি করতে করতে সেখানে একজন বয়স্ক মহিলা স্পর্শ কে জাপ্টে ধরলো স্পর্শ তাকে নানু বলেছে। এটাই স্পর্শ এর নানু আমি তাকে চিনি তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। আরো অনেক ছেলেমেয়ে ছোট বাচ্চা অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। মোটামুটি সবাইকে আমি চিনি। স্পর্শের মামা দুই জন, মামি দুই জন আর তাদের ছেলে মেয়ে পাঁচজন।সবার সাথে আমার আগেই সাক্ষাৎ হয়েছে শুধু এই বাসায় আসা হয় নাই। আমি মামা মামী দের কে সালাম দিয়ে তাদের সাথে দুই একটা কথা বললাম। নানু স্পর্শকের ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সালাম দেয়ার সুযোগ পেলাম না তিনি খুবই মিশুক। স্পর্শের মামাতো পাঁচ বোন। এক মামার দুই মেয়ে এক মামার তিন মেয়ে। তাদের দুজনের একজনেরও ছেলে নাই।
স্পর্শের চার মামাতো বোনই খুব ভালো শুধু একজন বাদে।সেও ভালো কিন্তু সে নাকি আগেই স্পর্শ কে পছন্দ করত মনে মনে নাকি স্পর্শের বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। তাই আমার সাথে স্পর্শের বিয়ে হয়েছে। আমাকে ভালোবেসে! এসব জানার পর থেকে নাকি তার মন ভেঙেছে! তাই সে এই একটা কারনে আমাকে সহ্য করতে পারে না! কিন্তু আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে নি। কিন্তু সে একটা কারণেই আমার সাথে মিশতে পারে না দূরে থাকে। আমি জারার দিকে অসহায় মুখ করে তাকালাম। জারা এক দৃষ্টিতে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পর্শে তার ছোট মামাতো বোন ফারজানা ও মাইশার সাথে কথা বলছে ওদের চকলেটের দুইটা বক্স দিল।
সবার সাথে আমরা ভিতরে গিয়ে বসলাম তখনই বাবা-মা মোহিনী ভাবীরা সবাই চলে এলো। সবাই ক্লান্ত তাই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে যে যার জন্য ঠিক করে রাখা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাস্তা আমি ঘুমিয়ে এসেছি তাই আমার চোখে ঘুম নাই। আমাকে আর স্পর্শকে এক রুমে থাকতে দেওয়া হলো।স্পর্শ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝলাম না। তিনি আমার সাথে ঘুমিয়েছেন তাহলে তিনি আবার এখন ঘুমাচ্ছে কেন? অদ্ভুত আমি একাই জেগে থাকবো। এই বাসার সবার সাথে আগে কথা হলেও একটু ইতস্ত বোধ করি সবার সাথে কথা বলতে। যতই হোক মামা শ্বশুর বাড়ি। শ্বশুরবাড়ি নামটা আসলে কেমন যেন নিজে গুটিয়ে যায়। চঞ্চল ফিলিংসটা ভেতর থেকে ঘুমিয়ে যায়।আবার এটা আমার বাড়ি আমার নানু বাড়ি থাকতো তাহলে আমি কিছুতেই আমার শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকতে পারতাম না। লাফালাফি চঞ্চলতা তো আমার রক্তে রক্তে মিশে আছে। কিন্তু নিজের শ্বশুরবাড়ি গেলে আর এখানে এসে আমি একদম শান্ত স্বভাবের ভদ্র হয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছি না।সেই মুহূর্তে যারা এসে আমার হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেল । আমি বিস্মিত হয়ে জারার দিকে তাকিয়ে আছি। জারা আমার থেকে এ ক্লাস নিচে পড়ে এজন্য আমি নাম ধরে সম্মোধন করি। জারা আমার ছোট থাকলেও আমাকে নাম ধরে ডাকে ভাবি বলে না। ওকে যেদিন আমি প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি আমাকে ভাবি বলোনা কেন? আমি যে তোমার ভাবি হই আর তুমি তো আমার বয়সে বড় না তাহলে আমাকে এভাবে বলতে সমস্যা কি? সেদিন অকপটে বলে দিয়েছিল,
‘তুমি সম্পর্কে আমার ভাবি হলেও আমি তোমাকে ভাবি কোনদিন বলব না!আর তোমাকে যে আমি ভাবি বলি না সেটা কেউ জানবেও না! কারণ আমি কখনো কারো সামনে তোমার কথাতে কথাই বলব না। তোমাকে চিনি না এমন করেই থাকবো।’
‘অদ্ভুত মেয়ে!’
#চলবে….
#চলবে……