চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ২৪

0
590

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ২৪

🍂🍂🍂

🍂শ্রেয়ার বিয়ের দিন🍂

~এতো দেরি লাগে? এই সত্যি করে বলুন তো আপনার বন্ধু আমার বান্ধবীদের কিডন্যাপ করেনি তো?

চন্দ্র ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুভ্রতার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

~আমার বন্ধুকে দেখে কি তোমার মেয়ে পাচারকারী মনে হয়?

শুভ্রতা কোমরে হাত ঠেকিয়ে রাস্তার দিকে উকিঝুকি দিতে দিতে বললো,

~শুধু কি আপনার বন্ধুকে দেখলে মেয়ে পাচারকারী মনে হয় নাকি? আপনাকে দেখলেও তো বাচ্চা চোর মনে হয়। চন্দ্র দ্যা বাচ্চা চোর।

চন্দ্র বাইক থেকে লাফ দিয়ে নামলো। চেঁচিয়ে বললো,

~হোয়াট রাবিশ! বাচ্চা চোর? আমাকে?

দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে নিজের দিকে চেয়ে বলল,

~কোন এঙ্গেল থেকে?

শুভ্রতা ঘুরে চন্দ্রের দিকে চেয়ে বললো,

~পা থেকে মাথা পর্যন্ত, এই আপনাকে দেখলেই বাচ্চা চোর মনে হয়।

~আমার মতো ভদ্র ছেলের গায়ে এতো বড় অপবাদ দিতে পারলে শুভ্রতা? কষ্ট লাগলো না? জাতির মেয়েরা এই অপবাদ মানবে না দেখো। তোমার বাড়িতে ইট ছুঁড়ে মারবে ওরা।

শুভ্রতা অবাক হলো। ভ্রু কুচকে বললো,

~কেনো! কেনো! জাতির মেয়েরা মানবে না কেনো? আর আমার বাড়ি ইটই বা ছুড়ে মারবে কেনো?

চন্দ্র একটু ভাব নিয়ে নিজের শার্ট ঝেড়ে বললো,

~হেহ! তুমি তাদের ক্রাশকে বাচ্চা চোর বলবে আর তারা তোমাকে ছেড়ে দিবে?

~মেয়েদের তো এ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তাই না!
~অবশ্যই নেই।

~আপনি এতো কথা বলেন কি করে চন্দ্র ভাই!

চন্দ্র শুভ্রতার দিকে খানিকটা ঝুঁকে চোখ মুখ কুচকে তাকালো,

~আরেকবার ভাই বললে ডিরেক্ট তোমার বাপের যা সম্পত্তি আছে হাতিয়ে নিবো বলে দিচ্ছি।

~কিহ! কেনো?
~কেনো মানে? ভাই ডাকলে তো তোমার বাবার সম্পত্তিতে অধিকার আছে না আমার!
~আচ্ছা ডাকবো না আপনাকে ভাই। এবার খুশি?

চন্দ্র ফট করে জবাব দিলো, “অবশ্যই খুশি”

~কিন্তু ভাই না বললে ডাকবো কি বলে?
~তুমি তো আমার বউ হওনি এখনও যে হ্যা গো, ওগো, শুনছো বলে ডাকবে। তাই আপাতত আমার আকীকা দেওয়া নামেই ডেকো “আহনাফ চন্দ্র”। সকলে আহনাফ ডাকলেও তুমি চন্দ্র ডেকো। তোমার মুখে এই ডাকটা শুনতে বেশ লাগে।

কথা শেষেই ফট করে শুভ্রতার গাল টেনে দিয়ে ডান গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আগের ন্যায় বাইকে উঠে বসলো। ভাবখানা এমন যেনো সে কিছুই করেনি। শুভ্রতা অবাকতা কাটিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরণ্য ওরা চলে এলো। শুভ্রতা চেয়েও এদের মাঝে কিছু বললো না। চন্দ্র শুভ্রতার দিকে চেয়ে সকলের অগোচরে চোখ মেরে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো। অন্য দিকে শুভ্রতা গালে হাত রেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো চন্দ্রের হাসিমাখা মুখের পানে।

🍂শ্রেয়ার বিয়ের পরের দিন🍂

ক্লাস শেষে মাঠে এসে দাড়াতেই শুভ্রতার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। ফোনটা কানে ধরলে মুহুর্তেই মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। নুরদের ক্যান্টিনে যেতে বলে সে অন্যদিকে চলে গেলো। তিলোত্তমা চিন্তিত হয়ে শুভ্রতার পিছন পিছন দৌড় লাগালো।

~এভাবে কোথায় গেলো ওরা? (নুর)

~তোরা ক্যান্টিনে যা, আমি দেখে আসছি।

বলেই রূপা চলে গেলো শুভ্রতাদের কাছে। শুভ্রতাদের কাছে যেতেই রূপা দেখলো শুভ্রতা ফোনে কারো সাথে বেশি গম্ভীর হয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। সে পেছন ঘুরে একবার দেখলো নুররা এখনও দাড়িয়ে আছে কি না। এরপর তিলোত্তমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কথা শেষে কল কাটতেই তিলোত্তমা প্রশ্ন ছুড়লো,

~কি হয়েছে?

শুভ্রতা মৌন রইলো। ভ্রু দ্বয় কুচকে মাটির দিকে চেয়ে কিছু একটা ভেবে মন ভুলানো হাসি দিয়ে বললো,

~কিছু না।
~তবে ওমন গম্ভীর হয়ে ছিলি যে? (রূপা)
~জীবনে দেখেছিস কেউ আমাকে কল দিয়েছে আর আমি খুশি হয়ে নাচছি?

শুভ্রতার এমন ত্যাড়া কথা রূপা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। পরক্ষনেই রাগে তার গা রি রি করে উঠলো। কখনোই শুভ্রতার থেকে সোজা উত্তর পায়নি সে। সোজা উত্তর ওর থেকে আশা করাও বোকামি। সে হন হন করে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেলো। তিলোত্তমাকে আসতে বলে শুভ্রতা বিস্তর এক হাসি দিয়ে ছুট লাগালো রুপার পেছনে। শুভ্রতা জানে রুপার সাথে তার চিন্তাধারা তেমন মিলে না। শুভ্রতা কিছু বললেই সে রেগে যায় তবুও যে কেনো শুভ্রতা ওকে যেচে রাগিয়ে দেয় তা তিলোত্তমা বুঝে না। শুভ্রতার আর রুপার ঝগড়া দেখতে দেখতে তিলোত্তমা ওদের পিছনে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। তখনই তার ফোনে কল এলো। অচেনা নাম্বার। ধরবে না ধরবে না বলতে বলতেই সে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কারো পরিচিত ব্যস্ত কণ্ঠ,

~তিলোত্তমা! শুভ্রতার বাসায় শ্রেয়ার মা যাচ্ছে। আমরা ওকেও জানিয়েছি। অরণ্য আর আহনাফ ভাইয়া দুজনেই অটিতে আছেন আজ। আমিও ঢাকার বাহিরে এসেছি সকালেই। ভাইয়াদের অপারেশন কখন শেষ হয় জানি না। আমি যথাসম্ভব দ্রুত ফিরে আসছি ঢাকায়। আপনি প্লীজ ওকে বাসায় যেতে দিবেন না এখন।

কল কেটে দিলো মাহতাব। তিলোত্তমা গভীর চিন্তায় পড়লো। শুভ্রতাকে চেনে সে। ভয় পেয়ে পিছু হটার মেয়ে সে নয়। ঘাড় ত্যাড়ামি করে হলেও সে বাড়ি যাবেই।

~কিরে? চল!

রুপার কথায় সন্ধি ফিরে পেলো তিলোত্তমা। শুভ্রতা ক্যান্টিনে চলে গেছে। তিলোত্তমা এখনও না যাওয়ায় আবারো রুপা এসেছে। তিলোত্তমা চিন্তিত হয়ে রুপাকে সব বললো। দ্রুত ক্যান্টিনের দিকে দৌড়ে গেলো দুজনে। যেকোনো ভাবেই শুভ্রতাকে আটকাতে হবে। নয়তো দেখা যাবে সত্যিই নির্ভয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি চলে গেছে।
________________________________

শুভ্রতা ক্যান্টিনে আসতেই রিদিতা জানতে চাইলো,

~কিরে? কই গিয়েছিলি?

শুভ্রতা চেয়ার টেনে বসে জবাব দিলো,
~খুঁজতে
~কি খুঁজতে? (রিদিতা)
~তোর জন্য মোটা, টাকলা, ভুঁড়ি ওয়ালা বিসিএস ক্যাডার পাত্র। অনেক দিন হলো বিয়ের দাওয়াত পাই না। শ্রেয়ার টা পেয়েছিলাম কিন্তু দাওয়াত আর খাওয়া হলো না। তাই ঠিক করেছি তোকেই জোর করে বিয়ে দিবো। (শুভ্রতা)
~তোর মাথায় যতসব উল্টা পাল্টা বুদ্ধি। তুই বরং নিজেই বিয়ে কর গিয়ে।

শুভ্রতা কথা বাড়ালো না। ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,
~বাড়ি যাবি না নাকি আজ? আমি কিন্তু যাচ্ছি।

~আরে হ্যা! আমার বাসায় আজ মেহমান আসার কথা ছিলো। আমি যাই। (নুর)

রিদিতা, নুর, উপমা চলে গেলে তিলোত্তমা শুভ্রতাকে ইশারায় থাকতে বললো। তিলোত্তমা তটস্থ স্বরে বললো,

~চুপচাপ আমার বাড়ি চল। নিজে যেচে বাঘের সামনে গিয়ে কাবাডি-কাবাডি বলার মানে হয় না।
~চল। (শুভ্রতা)
শুভ্রতার কথায় যেনো কলিজায় পানি এলো তিলোত্তমার। যাক! এবার তবে আর ঝামেলায় পড়ার ভয় নেই। কিন্তু ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই শুভ্রতা একটা রিকশা ডেকে রিকশা চালককে নিজ বাড়ির ঠিকানা বলায় তিলোত্তমা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। এ তো চোখের সামনেই মীরজাফরের মত পল্টি নিয়ে নিলো। তিলোত্তমার মনে হলো সে যেনো আজ নবাব সিরাজ উদ্দৌলার মনের দুঃখটা বেশ ভালো ভাবেই অনুভব করতে পারছে।

~কিরে? জলদি উঠ!

শুভ্রতার গলার স্বরের তারিফ প্রায় সব সময়ই করে সবাই। কিন্তু আজ যেনো এই মধুর স্বরেই তাকে ভয়ংকর কিছু বলছে। শুভ্রতার ডাকে তিলোত্তমা হকচকিয়ে তাকালো। দেখলো রুপাও ইতিমধ্যে শুভ্রতার সাথে রিকশায় চড়ে বসেছে। এখন শুধু তার বসার অপেক্ষা। শুভ্রতা আবার তাড়া দিয়ে বললো,

~দাড়িয়ে আছিস কেন বাল! উঠ জলদি!

তিলোত্তমা চুপ করে চেয়েই রইলো। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে রুপার উদ্দেশ্যে বললো,

~ও না বললো যাবে না? এখন যাচ্ছে কেনো? নেমে আয়, আমরা যাচ্ছি না।

রুপা চোখ পিটপিট করে তিলোত্তমার দিকে তাকালো। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,

~ও কখন বললো যে ও যাবে না? ওই তো বললো “চল”। আর তুইও তো মাথা দুলালি।

তিলোত্তমার উদাস চোখে তাকালো রুপার দিকে। বলতে চাইলো “শুভ্রতার কথার মানে ভালোই বুঝতে শিখেছিস দেখছি!” কিন্তু বললো না, বলতে ইচ্ছে করলো না। শুভ্রতা এবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো,

~তিলো! তুই কি উঠবি নাকি তোকে রেখেই চলে যাবো?

বুক কাপছে তিলোত্তমার, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, হাতও কাপছে। ভয়ের বসে কোথাও আল্লাহর পেয়ারা না হয়ে যায় সে। শুভ্রতাকে একা ছাড়বে না সে। এমনিও শুভ্রতা যা জেদি! মরে গেলেও হয়তো দেখা যাবে তার ভুতকেই টেনে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। তার থেকে ভালো জীবিত অবস্থায় ই যাওয়া যাক!
___________________________________

শ্রুতির চোখে মুখে অসম্ভব রাগ বিদ্যমান। চোখ দ্বারাই যেনো শুভ্রতাদের প্রতি ঘৃনা প্রকাশ করছেন তিনি। ওদেরকে দেখে শ্রুতি সোফা থেকে উঠে দাড়ালো। শ্রেয়ান ওদের দেখতেই ওদের সামনে গিয়ে বললো,
~আমি আসতে মানা করেছিলাম না! এলে কেনো?

শ্রুতি সোফার কাছে দাড়িয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। সে মনে মনে ভেবেই রেখেছেন আজ হয়তো উমা শুভ্রতাকে থাপ্পড় মারবেনই। উমা এসে শুভ্রতাকে প্রশ্ন করলো,

~সারাদিনে কিছু খেয়েছিস?

শুভ্রতা উপর নিচে মাথা দোলাতেই উমা বললেন,

~আমি আমার ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছি। তোদের ঝামেলা শেষ হলে রেনুকে বলিস। তোদের খাবার বেড়ে দিবে।

শুভ্রতা মুচকি হেসে বলল,
~আচ্ছা।

তিলোত্তমা আর রুপা হা করে শুভ্রতার মায়ের দিকে চেয়ে আছে। মেয়ে এতো বড় এক কান্ড ঘটাতে সাহায্য করেছে, বাড়িতে বিচার পর্যন্ত এসেছে আর তার মধ্যে এই নিয়ে কোনো হেলদোলই নেই। সে কিনা যাচ্ছে ভাতঘুম দিতে! উমা যেতেই শুভ্রতা ঘাড় কাত করে রেনুর দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে বললো,

~এসব কি রেনু আপা? বাড়িতে মেহমান আসলে যে নাস্তা দিতে হয় তা ভুলে গেছো?

রেনু জিভ কামড় দিয়ে বললো,

~ভুইলা গেছিলাম। এক্ষনি বানাইয়া লইয়া আইতাছি আপামনি। আপনি রাগ কইরেন না।

সে রান্নাঘরে চলে গেলো নাস্তা তৈরি করতে। শুভ্রতা হেলেদুলে সোফায় গিয়ে বসতেই শ্রুতি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,

~তুই! তোরা আমার মেয়েকে পালিয়ে যেতে বলেছিস তাই না? তোরাই ওকে এসব শিখিয়েছিস!

~প্রথম কথা ঠিক আছে পরেরটা ভুল। শ্রেয়াকে পালাতে সাহায্য করেছি তবে পালাতে শিখাইনি। আপনার মেয়ে আর আপনার মেয়ের জামাই নিজেরাই এসব ডিসিশন নিয়েছে। আমরা শুধু এক্সিকিউট করতে হেল্প করেছি এই আর কি…

শ্রুতি শুভ্রতার কথা বিশ্বাস করলো না। তিনি আরো জোর দিয়ে বললেন,

~আমার মেয়ে কখনোই নিজ থেকে এমন ডিসিশন নিতে পারে না। ও কখনোই এসব করবে না।
তিলোত্তমা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

~তো আপনার কি মনে হয় আমরা গিয়ে আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছি? এতে আমাদের লাভ কি? আমরা কি কাজী অফিস খুলে বসেছি নাকি যে ওদের বিয়ে পড়াতে পারলে আমাদের লাভ হবে? আমরা যাইনি আপনার মেয়ের কাছে। বরং আপনার মেয়ে নিজেই শুভ্রতাকে কল করে মিনতি করেছে যেনো আমরা ওকে পালাতে সাহায্য করি। তাই না রে শুভ্রতা?

শুভ্রতা অবাক হয়ে তাকালো। জবাবে প্রথমে মাথা না বোধকে নাড়াতে নিলে যখন তিলোত্তমা চোখ গরম করে তাকালো সাথে সাথেই শুভ্রতা দ্রুত উপর নিচে মাথা ঝাঁকালো,

~হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। একদম সত্যি, এত বড় সত্যি ইহজনমেও আর দুটো বলেনি তিলোত্তমা।

শুভ্রতা মাথায় জোর দিয়ে মনে করতে চাইলো যে শ্রেয়া তাকে কবে ফোন দিলো? শুভ্রতা কপালে আঙ্গুল ঘষে বিড়বিড় করে বললো,

~দিনে দুপুরে এই ঠাডা পড়া মিথ্যা কথাটা বললো কি করে এই মেয়ে! এমন জোর দিয়ে আদৌ কোনো সত্যবাদী মানুষও সত্য বলেছে কিনা সন্দেহ।

শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই রুপা ওকে খোঁচা দিয়ে বললো,
~কিরে তোকে শ্রেয়া ফোন করেছিলো তিলোত্তমাকে বললি আর আমাদের বললি না যে?

শুভ্রতা বাকা চোখে সামনে বসা মানবীর দিকে তাকালো। বলতে চাইলো,

~আফা গো! তোমারে কি বলতাম? শ্রেয়া যে আমারে কল দিছে তা তো আমি নিজেরেও বলি নাই। এই তিলোত্তমা কেমনে জানলো তা ভাবনার বিষয়।

কিন্তু আপাতত এই কথাগুলো মনের কোনো এক কোণে দমিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

~আপাতত বকবক বন্ধ করে ঝগড়া দেখায় মনোযোগ দে। তিলোত্তমা আফা ঝগড়ার ময়দানে নামছে। রেনু আপাকে বল নাস্তার সাথে পপকর্নও দিয়ে যেতে। খালি মুখে ঝগড়া দেখে মজা নাই।

শুভ্রতা আরেকটু আরাম করে বসলো। রুপা হতাশার শ্বাস ফেলে শ্রুতি আর তিলোত্তমার কথা কাটাকাটিতে মনোযোগ দেওয়া বেশি জরুরি মনে করলো। শুভ্রতাকে সে আদৌ কোনো ঝামেলায় প্যারা নিতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। অন্যদিকে তিলোত্তমা বাকা হেসে বললো,

~দেখলেন তো! আমরা আপনার মেয়েকে পালিয়ে যেতে বলি নি। আপনার মেয়ে আর মেয়ের জামাই আমাদের অনুরোধ করেছে বলে আমরা করেছি।

শ্রুতি রেগে তিলোত্তমার দিকে এক কদম বাড়াতেই শুভ্রতা এসে তার সামনে দাড়ালো।

~ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। আপনারা জানার পরও কেনো ওদের আলাদা করতে চাইলেন? মেয়ের ভালো লাগা, মন্দ লাগা কি আপনাদের কাছে ম্যাটার করে না? (শুভ্রতা)

শ্রুতি তেজপুর্ণ কণ্ঠে বললো,

~আমার মেয়ের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেটা কি তোরা ঠিক করবি? আমরা ওর বাবা মা, ওর জন্যে কি আমরা খারাপ ছেলে ঠিক করবো নাকি! আমরা যা বলবো তাই ওর জন্য ঠিক। তোদের আমি চাইলেই জেলে পাঠাতে পারি, জানিস তোরা!

~কিন্তু সব সময় যে বাবা মা ই ঠিক হবে এমন তো কথা নেই। অনেক সময় সন্তানের মনের কথাও তো চিন্তা করা উচিত। যা আপনি করেন নি। উল্টো ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলেন। আর রইলো জেলের কথা! ও প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মেয়ে। ও যাকে ইচ্ছা তাকেই বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু সেই অধিকার আপনারা ওকে দেননি। তো খেয়াল রাখবেন আমাদের নামে কেস করতে গিয়ে উল্টো নিজে যেনো কেস না খান।

শ্রুতি রাগে ফেটে পড়লেন। টেবিলের ওপর থেকে একটা ছুরি নিয়ে শুভ্রতার গলায় চেপে ধরে কম্পিত গলায় বললেন,

~তোর কারণেই ও পালাতে পেরেছে। মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় সব আত্মীয়দের কাছে এতো অপমান হয়েছি শুধু মাত্র তোর জন্য। তোকে… তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো।

শ্রেয়ান সহ সকলেই আঁতকে উঠলো। শুভ্রতা শ্রুতির হাত ধরে হৃদয়ের ওপর ছুরিটা ঠেকিয়ে অত্রস্ত কণ্ঠে শুধালো,

~ঠিক এই জায়গায় মারবেন। এমন ভাবে মারবেন যেনো এক স্ট্যাবেই টাটা বায় বায় হয়ে যাই। নিন মারুন!

শুভ্রতার এমন আচরণে শ্রুতি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলো। শ্রেয়ান, তিলোত্তমা, রুপা শ্রুতির হাত থেকে ছুরি ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। শ্রুতি নিজেও শুভ্রতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলেন। কিন্তু শুভ্রতা ছাড়ছেই না। উল্টো হাতের ছুরিটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলছে,

~কি হলো? ভয় পাচ্ছেন কেনো? মারুন না! মারুন! মারুন!

ধস্তাধস্তিতে আচমকাই শুভ্রতার গালে ঝট করে এক চর লাগিয়ে দিলেন শ্রুতি। শুভ্রতা ছিটকে সোফায় গিয়ে পড়লো। তিলোত্তমা আর রুপা ছুটে শুভ্রতার কাছে আসলো। অসম্ভব রেগে গেছে তারা। শুভ্রতা ইশারায় ওদের ঠান্ডা হতে বললো। সে উপহাস করে শ্রুতিকে বললো,

~মুরগির কলিজা নিয়ে আমি কিছুই করি না আন্টি।

শ্রুতিকে চুপ দেখে শুভ্রতা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,

~আপনার ছেলের সাথে তো এই ব্যাপারে অলরেডী কথা হয়েছে আপনার। তবে এখানে এসে এতো নাটক করার মানে কি? মমতার কারণে নিজের ছেলে মেয়েকে কিছু বলতে পারছেন না। তার জিদ এখানে এসে ঝাড়ছেন তাই না?

শ্রুতি ধপ করে শুভ্রতার সামনের সোফায় বসে পড়লো। কান্না করছেন। কান্না ভেজা গলায় বললেন,

~তোর সাহায্য ছাড়া ও কখনোই বাড়ি থেকে বের হতে পারতো না শুভ্রতা। কেনো করলি ওকে সাহায্য?

শুভ্রতার জবাবের অপেক্ষা করলেন না তিনি। আবারো বললেন,

বন্ধুত্বের টানে? যেই বন্ধুত্ত্ব নিয়ে এত বড়াই করিস তুই, তোর যেই বন্ধুমহলের সাহায্য নিয়ে আমার মেয়েকে পালাতে সাহায্য করেছিস! এই বন্ধুরা চিরদিন তোর সাথে থাকবে না শুভ্রতা। তোর সব থেকে কাছের বন্ধু তোকে কাদিয়ে রেখে যাবে। একা করে যাবে তোকে। মেয়ে পালিয়ে গেছে বলে যেই অপমান আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। আমার স্বামী আমার দোষ না থাকাতেও আমাকে দোষী বলেছে। একদিন দেখবি তোকেও তোর এই বন্ধুরাই বিনা দোষে সাজা দিয়ে যাবে।

এক দমেই কথাগুলো বলে থামলেন শ্রুতি। চারিদিকে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। হটাৎ শুভ্রতা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে জানতে চাইলো,
~অভিশাপ দিলেন নাকি?

এমন গুরুগম্ভীর মুহূর্তে শুভ্রতার হাসি দেখে শ্রুতি সহ উপস্থিত সকলেই যেনো বোকা বনে গেলো। তিলোত্তমা শ্রুতিকে কিছু বলতে নিলেও থামিয়ে দিলো শুভ্রতা। সকলকে অবাক করে দিয়ে শুভ্রতা এসে শ্রুতির পায়ের কাছে আরাম করে বসলো। তার ডান হাতটি টেনে নিজের মাথায় রাখলো। ঠোঁটে চওড়া এক হাসির রেখা টেনে অকপটে, নিঃসংকোচে, নির্মল কণ্ঠে বলে উঠে,

~তবে তাই ঠিক। আমি একে অভিশাপ নয় বরং দোয়া হিসেবে নিচ্ছি। আমি কখনোই চাইবো না আমার দুঃসময়ে আমার কাছের মানুষগুলো আমাকে দেখে কষ্ট পাক। আপনার এই দোয়া কবুল হলে আমার বিন্দু মাত্র আফসোস নেই, বরং আমি খুশি হবো। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আছে আমার, তিনি তার বান্দাকে কখনোই সম্পূর্ণ একা করবেন না। বান্দা না থাকলেও আমার পাশে সর্বদা আমার আল্লাহ থাকবেন ইন শাহ্ আল্লাহ।

শুভ্রতার সচ্ছ, শীতল চোখের চাহনিতে শ্রুতির মন গলে না। নিজের হাত সরিয়ে নিতেই শুভ্রতা ফের বললো,

~দেখবেন! ভবিষ্যতে মেয়ের জামাইকে দেখে খুশি হয়ে আবার এই দোয়া উঠিয়ে নিবেন না যেনো।

বলেই ফিক করে হেসে দিল শুভ্রতা। অবাক হয়ে শুভ্রতার কর্মকাণ্ড দেখলো সবাই। শ্রুতির কথা শুনে তো তাদেরই রাগে গা রি রি করছে আর ও নিজেই কিনা খুশিতে আত্নহারা হয়ে বসে আছে! এই মেয়ে এতো অদ্ভুত কেনো?

শ্রুতি হন হন করে চলে গেলেন। শ্রেয়ান করুন চোখে একবার ওদের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে “সরি” বলেই মায়ের পেছন দৌড় লাগালো। শুভ্রতাকে দেখে তার রীতিমতো চন্দ্রের কথা মনে পড়ে গেছে। সে ভেবেছিল চন্দ্র এভাবে ওর মাকে শান্ত করবে। শুভ্রতা খুব রাগী স্বভাবের শুনেছিলো সে। শুভ্রতা থাকলে তুলকালাম ঝগড়া বেধে যাবে হয়তো মায়ের সাথে তাই সে শুভ্রতাকে আসতে মানা করছিল। কিন্তু শুভ্রতার এমন শান্ত আচরণ তার ভাবনায়ও ছিল না।

শ্রুতি যেতেই রুপা আর তিলোত্তমা স্বস্তির শ্বাস ফেলে সোফায় বসলো। অন্যদিকে শুভ্রতা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে টিভি দেখছে। এখানে যে এতক্ষণ এত কিছু হলো তাতে যেনো তার মধ্যে কোনোরূপ ভাবান্তরই হয়নি। দুজন মানুষ যে তার দিকে হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে তা যেনো টের পেয়েও টের পেলো না সে। অরণ্য, চন্দ্র, আহাদ, শ্রেয়া আর মাহতাব ঝড়ের বেগে বাড়িতে প্রবেশ করলো। শ্রুতি, শ্রেয়ান কাউকেই দেখতে না পেয়ে প্রচন্ড অবাকও হলো। ওরা কোথায় গেলো জিজ্ঞেস করতেই শুভ্রতা টিভির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে ওদের জবাব দিলো,

~বাংলা ছবির পুলিশের মত ঝামেলা শেষে উদয় হয়েছেন আপনারা।

তখনই রেনু নাস্তা নিয়ে এসে বললো,

~আয়হায়! মেহমান গেছেগা? আমি যে এত গুলা নাস্তা আনলাম?

~এতগুলো মানুষ চোখে পড়ছে না রেনু আপা? আমরা খাবো। তুমি বসো আমাদের সাথে।

শুভ্রতা পুনরায় টিভি দেখায় মনোযোগ দিয়ে কফি খেতে লাগলো। শুভ্রতার এমন আচরণে তিলোত্তমার অসম্ভব রাগ হচ্ছে। রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

~তখন ছুরিটা নিজ দিকে টানার কি প্রয়োজন ছিল? যদি সত্যিই আঘাত করে বসতো তখন?

~ওটা বাটার নাইফ ছিল।

শুভ্রতার জবাবে ঝট করে মাটিতে পড়ে থাকা ছুরিটার দিকে তাকালো রুপা আর তিলোত্তমা। বাটার নাইফ দিয়ে খুন করতে যাচ্ছিলো? সিরিয়াসলি? ভয়ের বশে ছুরির দিকে কারোই মনোযোগ দেওয়া হয়নি। দিলে হয়তো এত প্যানিক হতো না ওরা। অকারণে এত রিয়েক্ট করার জন্য এই মুহূর্তে নিজেদের পাবনার সিনিয়র পাগল ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না তাদের।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here