চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ২৩

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ২৩

🍂🍂🍂

~এই শুভ্রতা!

অরণ্যের ডাকে শুভ্রতা সন্দিহান চোখে তাকালো। দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হলেও এই লোক তার নাম ধরে ডাকার নয়। আর আজ সে ই কিনা নাম ধরে ডাকছে! ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না। শুভ্রতার অবাকের মাত্র আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো যখন অরণ্য শুভ্রতার দিকে এক বক্স চকোলেট এগিয়ে দিলো। শুভ্রতা এবার বলেই ফেললো,

~অকারণে গিফট্ দেওয়ার মানে কি? গিফট্ নাকি কোনো ঘুষ এটা? আমি কিন্তু ঘুষ টুশ খাই না। আগেই বলে দিচ্ছি।

শুভ্রতার কথায় অরণ্য মুখ বাকা করে বললো,

~ঘুষ কেনো হবে? আমি কি তোকে বিনা কারণে গিফট্ দেই না?

শুভ্রতা নিঃসংকোচে না বোধকে মাথা নাড়ালো। অরণ্য ভ্রুদ্বয় কুচকে চেয়ে রইলো বোনের দিকে। এই মেয়ে যে ভীষণ চতুর। কিভাবে ধরে ফেললো! অরণ্য কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

~তুই কি নিবি নাকি না?

শুভ্রতা ছোঁ মেরে অরণ্যের হাত থেকে চকোলেটটা নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। অরণ্য জানতে চাইলো,

~এমন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি দেখছিস?

~ কালকে তো মারামারি করলাম। জিদের বশে আবার আমাকে টপকে দেওয়ার প্ল্যান করেননি তো? সত্যি করে বলেন তো অরণ্য ভাইয়া চকোলেট এ বিষ টিশ নেই তো?

অরণ্য হা করে চেয়ে রইলো শুভ্রতার মুখশ্রীর দিকে। শুভ্রতা ফের বলে উঠে,

~আমি আগেই বলে দিচ্ছি। এই চকোলেট খেয়ে যদি আমি আল্লাহর পেয়ারা হয়ে যাই তাহলে ভুত হয়ে এসে আপনার ঘাড় মটকাবো।

অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়ের সাথে এখন তর্ক করা যাবে না। পরে হিতে বিপরীত হবে। রেগে গেলে কাজের জায়গায় বাঁশ ধরিয়ে দিতে পারে এই মেয়ে। অরণ্য শুভ্রতার সামনে চেয়ার টেনে চুপ করে বসে রইল। শুভ্রতা একটুখানি চকোলেট ভেঙে অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিলো। অরণ্য মানা করলেও জোর করে খাওয়ালো। অরণ্য খাওয়ার সময় শুভ্রতা মনোযোগ দিয়ে অরণ্যর দিকে চেয়ে রইলো। শুভ্রতাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে অরণ্য ভ্রু নাচালো। শুভ্রতা মাথা নেড়ে কিছু না বুঝালো। অরণ্য খাওয়ার পরও কয়েক মিনিট অরণ্যের দিকে এক ধ্যানে চেয়েই রইলো। অরণ্য কপাল কুঁচকে শুভ্রতার দিকে একবার চেয়ে পানির গ্লাস হাতে নিলো। পানি মুখে নিতেই শুভ্রতার কথা কর্ণপাত হলো,

~জঙ্গল মরেনি তার মানে বিষ নেই। এখন তবে খেতে পারবো।

শুভ্রতার কথা শুনে এদিকে অরণ্যের কাশতে কাশতে অবস্থা কাহিল। এই মেয়ে কিনা এই কারণে এত যত্ন করে চকোলেট খেতে দিয়েছিলো! আর কই সে ভাবলো ভাই কে ছাড়া খেতে দুঃখ লাগছে বলে বোন তাকে চকোলেট দিয়েছে। অরণ্যকে করুন চোখে চেয়ে থাকতে দেখে এবার শুভ্রতা ভ্রু নাচালো। হুট করেই বলে উঠলো,

~নুরের নম্বর লাগবে নাকি নুরের বাবার? না মানে প্রেম করবেন নাকি সোজা শ্বশুরকে রাজি করাবেন?

অরণ্যের এবার মাথা ঘুরে এলো। অবাক হয়ে বললো,

~তুই জানিস আমি কি জন্য এসেছি?

~চোরের চাহনী দেখলেই বুঝা যায় এটা চোর নাকি ভদ্রলোক।

~তুই কি অপমান করলি নাকি প্রশংসা?

~আপনি কি চোর?

অরণ্য মাথা হ্যা ঝাকাতে নিয়ে আবারো না বোধকে নাড়িয়ে বললো,

~একদমই না। আমি চোর কেনো হবো? আমি ভদ্রলোক।

শুভ্রতা কুটিল হাসলো। বললো,

~তাহলে হয়তো প্রশংসা করেছি।

অরণ্য ঠোঁট বাকালো। মুখ খানা অন্যদিকে ঘুরিয়ে শুভ্রতার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,

~নুরের ফোন নম্বর দে!

অনেক সময় ব্যতীত হওয়ার পরও যখন দেখলো শুভ্রতা ফোন নিচ্ছে না অরণ্য পুনরায় কপাল কুঁচকে তাকালো।

~নম্বর দিচ্ছিস না কেনো?

~আমাকে কি মেয়ে খুজে দেওয়ার এজেন্সি মনে হয়? আমি কেনো প্রেম করতে সাহায্য করবো? আমি কি কখনো আপনার কোনো বন্ধুর দিকে নজর দিয়েছি? আপনি কেনো আমার বান্ধবীর দিকে নজর দিলেন?

~বলছিস তো এমন ভাবে যেনো তোর ২/৪ টা বান্ধবীর ওপর আগে কুনজর দিয়েছি? আমি আমার ভবিষ্যৎ বউয়ের নম্বর চেয়েছি। ভালো বোন আর ভালো ননদের মত নম্বর দিবি তাতে এত বকবকের কি আছে?

~আমি বকবক করি তাই না? আগে যাও দিতাম এখন তাও দিবো না। ভাগেন এখান থেকে!

~দে না শুভ্রতা! বোন আমার! তুই না কত ভালো।

~আপনার হবু বউয়ের নম্বর আপনি খুঁজে বের করুন গিয়ে। এমনিতে তো একটা বন্ধু আছে তার আর তার বাবার শক্তির দাপট দেখান। আমার বন্ধু এই করতে পারে, সেই করতে পারে। এখন ওই বন্ধুকে বলুন গিয়ে নম্বর খুজে দিতে।

~তোর আমার বন্ধুর সাথে কি শত্রুতা রে? সুযোগ পেলেই বেচারাকে নিয়ে এমন কথা শুনাস কেনো?

~ওই লোক বেচারা? আপনার বন্ধুর বাবা রাজনীতি করে না? আমার রাজনীতি অপছন্দ। এমনিও ওনারা উল্টা পাল্টা কাজ করতে পারলে আমার বলতে কি দোষ? বাবার সাথে সাথে নির্ঘাত ছেলেও হয়েছে উচ্চ পদের বাদর?

~ওরা যে খারাপ তোকে কে বললো? তুই আমার বোন দেখে রে! নাহলে এতক্ষণে তোকে আর এই বাড়িতে খুজে পাওয়া যেতো না।

শুভ্রতা মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
~আসছে আবারো বন্ধুর পাওয়ারের ভয় দেখাতে। আমি জানি, সব রাজনীতিবিদই খারাপ। এখন ভাগেন এদিক থেকে। আমি ঘুমাবো।

~নম্বর টা দে না!

~মামীকে কল দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি তার থেকেই নিবেন।

~তোর মত ইতর আমি আর একটা দেখি নাই।

অরণ্য হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই শুভ্রতা মুচকি হাসলো। এত সহজে কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য থাকে না। একটু ঘুরিয়ে তবেই দুজনকে এক করবে সে।
_________________________________

~এই মেয়ে! তুমি আমার আর আমার বাবার নামে কি বলেছো?

কারো বাজখাই কণ্ঠ কর্ণপাত হতেই শুভ্রতার পা থেমে গেলো। পেছন ঘুরে দেখলো চন্দ্র দাড়িয়ে আছে। গায়ে সাদা শার্ট, চুলগুলো হালকা ভেজা, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চন্দ্রের চোখ জোড়া সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় লাগে শুভ্রতার কাছে। চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এখনও চেয়ে আছে শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা মুখ ফিরিয়ে নিলো। অসভ্যের মত ছেলেদের দিকে তাকানো উচিত নয়। সচরাচর কেউ শুভ্রতার দিকে চেয়ে থাকলে সেও ওই মানুষটার দিকে এক ধ্যানে চেয়ে থাকে এতে ওই মানুষটা নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এভাবে কাউকে অস্বস্তিতে ফেলে শুভ্রতা বেশ মজা পেতো। তবে শুভ্রতার আজ চন্দ্রের দিকে তাকালেই অদ্ভুত অনুভব হচ্ছে। সে তার দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক ঘুরাতে লাগলো। শুভ্রতার চোখ থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই চন্দ্র আবারো বলে উঠলো,

~কি প্রশ্ন করেছি আমি?

শুভ্রতা এবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একটু সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন ছুড়ে,

~কে আপনার বাবা? আর আপনার বাবার ব্যাপারে আমি কেনো কিছু বলতে যাবো? পাগল নাকি!

~বাহ! আমার বাবাকে না চিনেই আমার বন্ধুর কাছে তার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলো? “আশহাব মাহবুব” আমার বাবা।

~আশহাব মাহবুব? এই ব্যক্তি আবার কে?

~হোয়াট রাবিশ! নিজ শহরের এমপি কেই দেখছি চেনো না! তা না জেনেই আবোল তাবোল বলতে গেলে কেনো শুনি?

শুভ্রতার এবার রাগ লাগলো। চন্দ্রের সাথেই দেখা হয়েছে এই নিয়ে তিনবার। এই লোকের বন্ধু আর বাবাকে কই পাবে ও? যাকে চেনেই না তার কাছে নাকি সে আবোল তাবোল বলে এসেছে। আর এই শহরের এমপি? সে তো জানেই না সেই শহরের বর্তমান এমপি কে। নুর ঠিকই বলে, সে নিজ দুনিয়ায় সদা মত্ত থাকে। নিজ শহরের এমপি কে তাই তার অজানা। শুভ্রতা রাগে, দুঃখে দাতে দাত চেপে বললো,

~দেখুন মশাই! আমি আপনার বাবা আর আপনার বন্ধু কাউকেই চিনি না। কার না কার দোষ আমার মত ভদ্র, শান্তশিষ্ট মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। এত বড় অপবাদ আমি সইবো না।

~ওমাহ! এখন দেখি নিজের ভাই অরণ্যকেই চিনতে পারছো না।

~অরণ্য ভাইয়াকে চিনতে পারছি না মানে?

~আমি অরণ্যের বেস্ট ফ্রেন্ড যার নাম নিয়ে তুমি উঠতে বসতে অরণ্যকে টন্ট করো।

শুভ্রতা জিভ কাটলো। মনে মনে অরণ্যকে গালি দিতে লাগলো। এই বেটা কি মেয়ে নাকি? সব কথা কেনো বন্ধুকে বলা লাগবে? আচ্ছা তার মানে এত বছর ধরে যে সে অরণ্যকে তার বন্ধু আর তার বাবার নাম নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলেছে সেই সব কথাও কি চন্দ্রকে বলে দিয়েছে? ইন্নালিল্লাহ! এইসব যদি সত্যিই চন্দ্রকে বলে থাকে তবে বোধ হয় এই জনমে তার আর বাড়ি ফেরা হবে না। কাল তার লাশ* বুড়িগঙ্গায় ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যাবে। অরণ্যকে একবার সামনে পেলেই হলো। আচ্ছা মতো ধোলাই* দিবে তাকে। যদি মরে* যায় তবে ভুত হয়ে এসে হলেও মেরে” যাবে। বেটা খবিশ! ছোট বোনকে এভাবে ফাঁসিয়ে দিলো!

~এখন বলো কাল রাতে আমার আর আমার বাবার ব্যাপারে কি বলেছিলে? আমি আর আমার বাবা উচ্চ পদের বাঁদর?

শুভ্রতা ঠোঁট কামড়ে এদিক ওদিক তাকালো। যদি দৌড়ে পালাতে পারে। হাতে থাকা ছাতাটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে করুন দৃষ্টিতে চন্দ্রের দিকে তাকালো। মিন মিন করে কিছু একটা বলতে চাইলো তবে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। চন্দ্র ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে আছে। জোরে এক ধমক দিয়ে বললো,

~জবাব দাও এখন!

চন্দ্রের ধমকে শুভ্রতা যেনো কেপে উঠলো।ভীতু কণ্ঠে বললো,

~চন্দ্র ভাইয়া! রাগ করবেন না আমি বুঝতেই পারিনি যে আপনি ওই জঙ্গল মানে অরণ্য ভাইয়ার ফ্রেন্ড। আর হ্যা! আমাকে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দেওয়ার চিন্তা ভুলেও করবেন না। এই পৃথিবীতে এমনিই আমার মত ভদ্র শান্তশিষ্ট মেয়ে আর একটা নেই। আমার মরে যাওয়া আর ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়া এক সমান। গেলে আর ফিরে আসবো না। পৃথিবী থেকে আমাকে বহিষ্কৃত করলে পৃথিবীর কত বড় একটা ক্ষতি হবে আপনার ধারণা আছে? নেই তো! আমি জানতাম আপনার ধারণা নেই। এখন জানলেন তো? এত সুন্দর কথা জানানোর কারণে আপনার উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া। থাক লাগবে না। আমি আবার অনেক বড় মনের, বুঝলেন? এবার আমি যাই হ্যা। ভালো থাকবেন।

~কই যাও?

~জামাই বাড়ি…
~হোয়াট?!

~ভার…ভার্সিটি, ভার্সিটি যাই। কেনো? আপনি কি শুনেছিলেন?

শুভ্রতার প্রশ্নের জবাব চন্দ্র দিলো না। চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,

~দেখতে তো এই টুকুন পিচ্চি। তা এতো তিড়িং বিড়িং করো কেনো?

শুভ্রতা তেতে উঠলো। সে নাহয় চন্দ্রের মত এত বেশি লম্বা নয় তাই বলে কি এভাবে পিচ্চি বলে অপমান করবে! তার বয়স কি অজানা নাকি চন্দ্রের? ভাবতেই খেয়াল এলো সে অরণ্যের থেকে গুনে গুনে ৬ বছরের ছোট। সেই হিসেবে সে চন্দ্রের থেকেও ৬/৭ বছরের ছোট। তবুও সে পিচ্চি নয়। শুভ্রতা প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,

~আমি মোটেও পিচ্চি না চন্দ্র ভাইয়া।

~বুঝলাম। চলো আমি ভার্সিটি দিয়ে আসি।
~তার প্রয়োজন নেই।
~কেনো?
~আমার বেশি প্যারা ভালো লাগে না। তাই আপনার সাথে যাচ্ছি না আমি।
~আমার সাথে গেলে কিসের প্যারা আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলবো নাকি?

শুভ্রতা বিরক্তিতে চ শব্দ করে বললো,

~ধরুন আমাদের ভার্সিটির একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করে। ভবিষ্যতে সে যদি আমি আমার হবু বর হয়? আপনার সাথে দেখলে তো আমায় ভুল বুঝবে। আপনার কারণে আমার সিঙ্গেল ই দুনিয়া ছাড়া লাগবে। তাই আপনার সাথে একদমই যাওয়া সম্ভব না।

চন্দ্রর মুখ ভঙ্গি পাল্টালো। হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই থমথমে, গম্ভীর ভাব ধারণ করলো। শুভ্রতার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

~কথা বলার আগে কি একবারও ভাবো না যে তুমি কি বলছো?

শুভ্রতা চোখ পিটপিট করে চাইলো। চন্দ্রর রাগ করার ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো তার কাছে। শুভ্রতার মতে এখন সে রাগের মত কোনো কথা বলেনি।
_________________________________

রিকশা ভার্সিটির সামনে থামতেই নেমে দাড়ালো শুভ্রতা। কোনোমতে চন্দ্রকে ফাঁকি দিয়ে আসতে পেরেছে। এই ছেলেকে নিয়ে এসে ঝামেলায় তো তারই পড়তে হতো। লোকটা দেখতে অসম্ভব আকর্ষণীয়। হিংসে করছে না। তবে তার সাথে এলে ভার্সিটির মেয়েরা তাকে চেপে ধরতো চন্দ্রের সাথে লাইন করিয়ে দেওয়ার জন্য। এসব প্যারা তার অপছন্দ। তাই কোনোমতে চন্দ্রের থেকে পালিয়ে আসা। এতসব ভাবনার মাঝেই শুভ্রতা টের পেলো বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। সে দ্রুত ছাতা খুলে মাথায় ধরতেই সামনের দিকে চেয়ে তার কপাল কুচকে আসে। চোখ ডলে ভালো মত তাকাতেই তার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মন, মস্তিষ্ক যেনো চিৎকার করে বলছে “এই দৃশ্য দেখার আগে আমার মৃত্যু হলো না কেনো?”। তার দৃষ্টি এক চলমান রিকশার দিকে। যাতে তার বাবা আবসার আর অপরিচিত এক মহিলা বসা। বসাতে তার সমস্যা নেই। সে ভেবে নিতো বাবার অফিসের কেউ হয়। কিন্তু তার বাবা তো মহিলাটাকে এক হাতে জড়িয়ে বসে আছে, হেসে কথা বলছে। মহিলাটাও আবসারের সাথে লেপ্টে বসে আছে। এসবের মানে বোঝাটা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের জন্য অতোটা কঠিন নয়। শুভ্রতার পা যেনো অসার হয়ে আসছে। চোখ দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়তেই সে দ্রুত তা মুছে নিলো। “এত জলদি জাজ করা মোটেও ঠিক নয় শুভ্রতা। নিজের বাবার প্রতি কি তোর বিশ্বাস এই টুকুই?” নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো শুভ্রতা। মন থেকে কেউ যেনো বলে উঠলো,
~তবে কি এই দৃশ্যটাকে দেখেও না দেখার মত করে থাকবি?

শুভ্রতার এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ইচ্ছে হলো না। সে পা বাড়ালো। পেছন ঘুরতেই দেখতে পেলো একটা মেয়ে, ছোট একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার বয়স হয়তো তার মতই হবে। এদিকটায় কোনো ছাউনী নেই। সে তার বাচ্চাকে ওড়না দিয়ে ঢেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শুভ্রতা এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। গায়ে বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা পড়ছে না দেখে মেয়েটা উপরের দিকে তাকালো। ছাতা দেখতে পেয়ে সে পিছে ঘুরে তাকায়। শুভ্রতার দৃষ্টি তার বাচ্চার চোখের দিকে। বাচ্চাটা ঠোঁট উল্টে শুভ্রতার দিকেই চেয়ে আছে। কি মায়াভরা সেই চাহনী! ডাগর ডাগর চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে। শুভ্রতা হাসলো। বাচ্চাটার গালে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

~নাম কি ওর?
~দিশা…

শুভ্রতা দিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
~এখানেই থাকেন?

দিশার মা মাথা নাড়লেন। জবাব দিলো,

~পাশের বস্তিতে থাকি। এদিকে ভিক্ষা করতে আইছিলাম।

শুভ্রতা এক পলক তার দিকে তাকালেন। ছাতাটা তার দিকে এগিয়ে বললো,
~এটা একটু ধরবেন?

দিশার মা একটু সংকোচ বোধ করলেন হয়তো। শুভ্রতা তাড়া দিলো না। তার ছাতা ধরার জন্য দাড়িয়ে রইলো আগের ন্যায়। সে ছাতাটা নিতেই শুভ্রতা বিস্তর এক হাসি দিলো। কাধের ব্যাগ টা নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে কিছু ঘাটাঘাটি করতে করতে বলে,

~আমি শুভ্রতা

চোখের ইশারায় ভার্সিটি দেখিয়ে বললো,

~এই ভার্সিটিতেই পড়ি।

শুভ্রতার পরিচয় দেওয়ার কারণ তিনি হয়তো বুঝলেন না। অবুঝ চোখে চেয়ে রইলেন শুভ্রতার মুখের পানে। শুভ্রতা ব্যাগ থেকে বের করা টাকাটা দিশার ছোট হাতে গুজে দিয়ে বললো,

ও দেখতে মাশাল্লাহ খুব সুন্দর। ঠিক তার নামের মতই। আপনার মতই দেখতে হয়েছে।

দিশার মা সৌজন্যমূলক হাসি দিলেন। শুভ্রতা তাদের দিকে চেয়েই এক পা দু পা করে ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে এলো। ঘুরে গেটের দিকে যেতে নিলেই দিশার মা ডাকলেন,

~আপনার ছাতাটা?

শুভ্রতা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালো। আলতো হেসে বললো,

~এটাও দিশার।

বলেই মাথায় হাত দিয়ে ছুট লাগালো ভার্সিটির ভেতর। দিশার মা বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুভ্রতার যাওয়ার পানে। বৃষ্টির সময়ের দোয়া নাকি কবুল হয়। তাই সে মনে মনে অসংখ্য দোয়াও করলো। সেখানেই দাড়িয়ে রইলো অনেক সময়।
.
দুরে গাড়ির ভেতর থেকে সবটা দেখলো চন্দ্র। ওকে ফাঁকি দিয়ে আসায় ভীষণ রেগে গিয়েছিল। কিন্তু শুভ্রতার কাজে এখন তার মন যেনো আনন্দে আর অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে উঠলো। আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললো,

~আমি ভুল কাউকে ভালোবাসিনি। সে যেনো নামেই নয়, মনের দিক থেকেও শুভ্রতায় ঘেরা।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here