চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫৫

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫৫

🍂🍂🍂

ব্যস্ত সময় কাটানোর পর মাত্রই বাড়ি ফিরলো অরণ্য। ঘরে এসে বসতেই দরজায় কেউ অনবরত ধাক্কা দিতে লাগলো। একনাগারে এতবার দরজা ধাক্কা দেওয়ায় অতিষ্ট হয়ে দরজা খুলতেই এক লাফে ঘরে প্রবেশ করলো শুভ্রতা। তার পাশেই রহস্যময়ী হেঁসে দাড়িয়ে আছে চন্দ্র। অরণ্য হকচকিয়ে তাকালো বোনের দিকে। অরণ্যের হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে শুভ্রতা ছটফটে গলায় বললো,
~সুখবর আছে ভাইয়া। আজ আমি অনেক খুশি।

হটাৎ এমন ঘুরানোতে অরণ্যের মাথা ঘুরতে লাগলো। সে চেঁচিয়ে উঠলো,
~বুড়ি! বুড়ি থাম! মাথা ঘুরাচ্ছে। হয়েছে টা কি?

শুভ্রতা থামলো। চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। এতটাই খুশি যেনো বিশ্বজয় করেছে। অরণ্য নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় নিলো। শুভ্রতা ফের অরণ্যের হাত ধরে দুলতে লাগলো। আমোদিত সুরে বলল,
~উপ’র এনগেজমেন্ট এর তারিখ ঠিক হয়েছে।
~তো?

শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষনেই অরণ্যের মাথা ঝাকিয়ে বললো,
~জঙ্গলের কিছুই মনে থাকে না। আরে বাবা উপ তো ঝাড়বাতির কাজিন। ওর এনগেজমেন্টে তো অবশ্যই আসবে সে।

শুভ্রতার মুখে নুরের কথা শুনা মাত্রই অরণ্যের মুখ অন্ধকার হয়ে এলো। যেনো শ্রাবণ মাসের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। মেয়েটা নুরের জন্য এত পাগল কেনো তা তার বুঝে আসে না। যে মানুষটা প্রতিনিয়ত তাকে ইগনোর করে যাচ্ছে। সে তার পেছনেই ছুটছে বেপরোয়াভাবে। সে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে জোরপূর্বক নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,
~বুড়ি, আমি মাত্র বাড়ি ফিরেছি। খুব ক্লান্ত। আহনাফও তো মাত্রই ফিরেছে। ওকে নিয়ে ঘরে যা।
~তুই ওর সাথে দেখা করবি না ভাইয়া?

অরণ্য অসহায় চোখে চন্দ্রের দিকে তাকালো। চন্দ্র সেই চাহনি বুঝে শুভ্রতাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইলো। শুভ্রতা ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো। তার এক ভুলে সব শেষ। নিজে হারালো বন্ধুত্ব, ভাই হারালো তার ভালোবাসা। ঘরে ফিরে মনমরা হয়ে বসে রইলো শুভ্রতা। চন্দ্র চেষ্টা করলো তার মন ভালো করার। তবে শুভ্রতার সেদিকে মন নেই। সে চুপ করে খাটের এক কোণে বসে রইলো। হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো চন্দ্র। মিনিট দুয়েকের মাঝেই ফিরলো অরণ্যকে নিয়ে। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝা গেলো এক প্রকার টেনে হেঁচড়েই নিয়ে এসেছে তাকে। অরণ্য বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়াতে চাইলে চন্দ্র ধমক দিয়ে বললো,
~শালা! তুই আমার বউ এর ভাই না হলে না এতক্ষণ এ দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতাম। তোর জন্যে আমার বউ এর মন খারাপ।

অরণ্য সরু চোখে তাকাতেই চোখমুখ গম্ভীর করে তাকালো চন্দ্র। ভাবখানা এমন যেনো বউ এর মন ভালো না হলে সত্যিই অরণ্যকে গায়েব করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না সে।

~হালালজাদা বউ এর চক্করে এত বছরের বন্ধুত্ব ভুলে গেলো!

বিড়বিড় করতে করতে শুভ্রতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অরণ্য। শুভ্রতার কান টেনে বললো,
~সমস্যা কি? মুখ কালো কেন?

শুভ্রতা চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। কান ছাড়ানোর চেষ্টা করে এক প্রকার চেঁচিয়ে উঠে বললো,
~জঙ্গল ভাইয়া ব্যাথা লাগছে। কান ছাড়!

অরণ্য তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিয়ে বললো,
~রেগে আছিস নাকি?

শুভ্রতা জবাব দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিতেই অরণ্য তার পাশে বসলো।

~ভাইকে বলবি না?

শুভ্রতা অভিমানী চোখে অরণ্যের দিকে তাকালো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রের দিকে তাকালো এক পলকের জন্য। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
~আমার জন্য নুরকে ছেড়ে দিস না ভাইয়া। ওর কোনো দোষ নেই। সে তোকে ভালোবাসে বলেই রাগে অভিমানে এমন করেছে।

~ও কি করেছে আর বলেছে তুই কিছুই জানিস না বুড়ি।

~জানি, সব জানি। সে আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসেনি। আমার অসুস্থতাকে বাহানা ভেবে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে, আমার মৃত্যু কামনা করেছে। এই টুকুই তো?

অরণ্য চমকে মাথা তুলে তাকালো। শুভ্রতা যে এই ব্যাপারে জানে তা জানা ছিল না তার। শুভ্রতার জানার কথাও না। যখন নুর এসব বলেছে তখন শুভ্রতা আইসিইউ তে ছিলো। জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি স্থানে। শুভ্রতা শান্ত গলায় বললো,
~আমার চন্দ্রের কাছে কাউকে এভাবে দেখলে আমি নির্ঘাত তার প্রাণ নিতাম। সে জায়গায় নুর তো শুধু মাত্র আমার মৃত্যু কামনা করেছে। সে যা করেছে তোকে হারানোর ভয়ে, দুঃখে করেছে। ও তো বরাবরই মাথা গরম স্বভাবের। রাগ মাথায় চড়লে দিন দুনিয়ার খবর থাকে না। আগুনের সাথে যদি আমরাও আগুন হই তবে তো ঝামেলা মিটবে না ভাইয়া। ঝামেলা মিটাতে হলে আমাদের আগুনের সামনে পানি হতে হবে। তবেই না সব সমস্যার সমাধান হবে।

অরণ্য চুপ করে বসে রইলো। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। কি করা উচিৎ আর কি উচিত না কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তার সুন্দর গুছানো জীবনটা হুট করেই কেমন অগোছালো হয়ে গেলো। শুভ্রতা ঠোঁট কামড়ে বসে আছে। চেষ্টা করলো অরণ্যের অভিব্যক্তি বুঝার। চেষ্টা করেও বুঝতে পারলো না অরণ্য তার কথা বুঝেছে কি না। শুভ্রতা চন্দ্রের দিকে চেয়ে ভ্রু নাঁচালে চন্দ্র মৃদু হাসলো। চন্দ্রকে হাসতে দেখে শুভ্রতা ভেংচি কাটলো। শুভ্রতাকে ক্ষেপতে দেখে চন্দ্র এসে অরণ্যের কাছে বসলো। অরণ্যের কাঁধে হাত রেখে বলল,
~দেখ ভাই নুর ছাড়া অন্য মেয়েকে তুই বিয়ে করতে পারবি না, আর না ভালোবাসতে পারবি। এভাবে বেঁকে থাকলে তোর সারাজীবন সিঙ্গেল থাকা লাগবে। আর যদি মনে করিস তুই মুভ অন করবি। তবে মানা নেই, কর তুই মুভ অন। কিন্তু কথা হলো তোর দ্বারা তো কোনো মেয়ে পটবে না। নুর যে কিভাবে পটেছে সেটা ভেবেই মাঝে মাঝে ডিপ্রেসড হয়ে যাই আমি। একটা মেয়ের চয়েজ এতো খারাপ হয় কি করে? যাই হোক, যেহেতু অন্য মেয়ে তুই পটাতে পারবি না তাই তুই ওর রাগ ভাঙ্গানোরই চেষ্টা কর। হোয়াট ছে?

অরণ্য আর শুভ্রতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চন্দ্রের দিকে তাকালো। মানুষটা কি তাকে উৎসাহ করলো নাকি উল্টা ডিপ্রেশনে পাঠানোর পাঁয়তারা করছে তা নিয়েই বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলো ওরা। অরণ্য বিরক্ত হয়ে চন্দ্রের মাথায় এক চাটি মেরে বললো,
~শালা! মোটিভেট করতে না পারলে অপমান করস কেন? মেয়ে পটাতে জানি না মানে কি?

~তুই পারিস? তবে নুরকে পটিয়ে দেখা।

~কথার জালে আমাকে ফাঁসাতে চাস? তোকে আমি ছোট থেকে চিনি। একদম হারে হারে চিনি।

~রগে রগে চেনা বাকি এখনও। বেশি কথা না বলে নুরের রাগ ভাঙ্গা। শালা প্রেমিকাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার চক্করে ব্রেকআপ করে বসে আছে। হাদারাম! যা বের হ ঘর থেকে, আমার বউ এর সাথে এখন প্রেম করবো আমি। এই শালা খালি ডিস্টার্ব করে।

শুভ্রতার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। অরণ্য অবিশ্বাস্য চোখে চন্দ্রের দিকে তাকালো। এই ছেলে নিজেই কিছুক্ষণ আগে তাকে টেনে নিয়ে এসেছে। এখন বলছে সে ডিস্টার্ব করছে। অরণ্য রাগে গিজগিজ করতে করতে ঘর থেকে বের হলো। তবে যাওয়ার আগে চন্দ্রকে লাথি মেরে যেতে ভুললো না। সে যেতেই চন্দ্র চেঁচিয়ে উঠলো,
~হালালজাদা! দোয়া করি বাসর ঘরে তোর বউ ভেগে যাক! তোর ছেলে মেয়ে টাকলা পয়দা হোক!

অরণ্য আবারো তেড়ে এলো চন্দ্রের কাছে। পুনরায় চন্দ্রের পায়ে লাথি মেরে বললো,
~আগে বদদোয়া দিতে শিখ বেক্কল। বদদোয়ার নামে আজগুবি কথা বলে যতসব!

চন্দ্র পাল্টা অরণ্যকে এক লাথি দিয়ে বললো,
~তুই শিখালেই তো পারিস। ঝগড়াখোর বেটা!

অরণ্য পা ডলতে ডলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। হালকা স্বরে বললো,
~খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! বকা দেওয়ার ট্রেনিং দিবো তাও নিজেকেই বকা দেওয়ার জন্য।
________________________________

উপমার এনগেজমেন্ট এর অনুষ্ঠান এর জন্য রেডি হয়ে অরণ্যের ঘরের দরজার সামনে পায়চারি করছে শুভ্রতা। চন্দ্র আর মাহতাব সমানে অরণ্যের ঘরের দরজা ধাক্কাচ্ছে। মাহতাবের পাশে তিলোত্তমা গা ছাড়া ভাব নিয়ে আপেল খাচ্ছে। শুভ্রতার শরীরটা আজ তেমন ভালো নেই। বারবারই কেশে উঠছে। সে উগ্র মেজাজে তিলোত্তমার হাত থেকে আপেল ছিনিয়ে নিয়ে বললো,
~খাওয়া রেখে ওদের মিল কিভাবে দিবো সেটা ভাব।

তিলোত্তমা ছো মেরে শুভ্রতার হাত থেকে আপেল নিয়ে আরেক কামড় বসিয়ে বললো,
~কতবার বলেছি নুর রিলেটেড কোনো কিছুতে আমাকে জড়াবি না!

শুভ্রতা তপ্ত শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
~কি করলে এই ঝামেলার শেষ হবে বলতো? কবে সব আগের মত হবে?
~আর কখনোই না। সে আশা ছেড়ে দে।

শুভ্রতা ক্ষুব্ধ চোখে কয়েক পল তিলোত্তমার দিকে চেয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিলোত্তমার মতোই দেয়ালে দেলান দিয়ে তিলোত্তমার হাত থেকে আপেল কেড়ে নিয়ে তাতে কামড় বসালো। বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,
~হবে হবে সব ঠিক হবে। আই চ্যালেঞ্জ।

~আচ্ছা? কবে হবে ঠিক?

~হবে একদিন। সে নিজে এখানে আসবে। ঐযে আমার ঘরটা! তার পাশের ঘরেই থাকবে। তোর সাথেও আগের মতো কথা বলবে।

~ইন ইউর ড্রিমস।

শুভ্রতা গা দুলিয়ে হাসলো। শুভ্রতার এই হাসিতে তিলোত্তমার গা পিত্তি যেনো জ্বলে গেলো। সে রাগে গিজগিজ করতে করতে চন্দ্র আর মাহতাবকে সরিয়ে দাড়ালো। দরজায় স্বজোরে করাঘাত করে বললো,
~সমস্যা কি অরণ্য ভাই? না গেলে বলুন আমরা চলে যাই। অযথা এতগুলো মানুষকে দরজার কাছে দাড় করিয়ে রাখার মানে হয়? ওকে মানাতে যেতে চাইছেন না আবার মুভ অন ও করছেন না। সহ্যেরও একটা সীমা থাকে। এমন ফাইজলামি শুরু করেছেন কেনো সবাই?

তিলোত্তমার রাগ দেখে ভড়কে গেলো চন্দ্র আর মাহতাব। শুভ্রতা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসছে আর আপেল খাচ্ছে। তিলোত্তমাকে রাগিয়ে সে যেনো ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। শুভ্রতার হাসি দেখে তিলোত্তমা পুনরায় মুখ খুলতেই তৎক্ষণাৎ দরজা খুললো অরণ্য। শুভ্রতার হাসি আরো চওড়া হলো। তিলোত্তমা রাগে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। এতকথা এক সাথে বলে হাঁপিয়ে গেছে সে। অরণ্যের চোখে মুখে ভয়ের আভাস। সে ভীতু কন্ঠে বলল,
~বইন তুই যা, আমি ৫ মিনিটে রেডি হয়ে আসছি। তাও তুই রাগিস না। শুভ্রতারে যেই থাপ্পড় দিছিলি আমার এখনও মনে আছে।

তিলোত্তমা কপট রাগ দেখিয়ে ধুপধাপ করে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো। শুভ্রতা ওদের দিকে চেয়ে এক হাসি দিয়ে ছুট লাগালো তিলোত্তমার পেছনে।

~জলদি এসো তোমরা। তিলো, দাঁড়া আমি আসছি…

ওরা যেতেই মাহতাব কপালের ঘাম মুছে বললো,
~আমি তো জানতামই না আমার বউ এতো রাগী।
~বাঘিনীর বান্ধবী তো আর হরিণ হবে না।

চন্দ্রের কথায় সহমত পোষণ করলো মাহতাব। উৎকণ্ঠা হয়ে বললো,
~তোমার কি মনে হয় আজ নুর আর অরণ্যের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে?
~তাই আশা করছি।
~~~
চলবে~

(কেমন আছেন সবাই? কমেন্ট করে জানাবেন আমার লেখা কেমন লাগছে। আর হ্যা, মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here