#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫৮
🍂🍂🍂
আজ জুম্মার দিন। ঘন্টা খানেক আগেই আযান শুনেছে শুভ্রতা। কিছুক্ষণের মাঝেই চন্দ্র আসবে তার সাথে দেখা করতে। তার ঠিক সামনে বসেই প্লেট হাতে ভাত মাখছেন চিত্রা। তার কোনো কথাতেই কোনোরূপ ভাবান্তর দেখাচ্ছেন না তিনি। আপাতত তাকে ভাত খাওয়ানোই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। শুভ্রতার ঘ্যানর ঘ্যানর তার মধ্যে কোনোরূপ প্রভাব ফেলছে না। শুভ্রতা আবারো বললো,
~ও চিত্রা মা, তুমি তোমার ছেলেকে বুঝাও না। আমার ভালো লাগে না এখানে থাকতে। ৪ মাস যাবত এখানে আছি। এক রুমে কতক্ষন এক ভাবে থাকা যায় বলো। এমন বন্দী থাকতে ভালো লাগে না।
~তোর ভালোর জন্যই তো তোকে এখানে রাখছে শুভ্রতা। বাচ্চাদের মতো প্রতিবার এক জেদ কেনো করিস বল তো?
~কচু ভালো করছে। এখানে কি ভালো আছে? সুস্থ হয়ে গেছি আমি? ক্যান্সার ভালো হয়ে গেছে?
চিত্রা একটু মৌন রইলো। আলতো হেসে বলল,
~তুই নিজেই কেনো ওকে বলছিস না?
শুভ্রতার চোখে উদাস ভাব ফুটে উঠলো,
~সে কি আর আগের চন্দ্র আছে? আমার ইচ্ছার কোনো দাম আছে তার কাছে?
চিত্রা মলিন হাসলেন। বলার মত কিছুই পেলেন না। সত্যিই তো তার ছেলেটা দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তন হওয়ার কারণটাও তো কারো অজানা নয়। শুভ্রতাকে হারানোর ভয়ই তাকে দিন দিন এমন করে তুলছে। এক লোকমা ভাত শুভ্রতার মুখের সামনে ধরলে শুভ্রতা মুখ ফিরিয়ে নিলো। চিত্রা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে পুনরায় আদুরে গলায় বলল,
~তুমি একটু ওনাকে বুঝাও না চিত্রা মা। হাসপাতালের এই এক রুমে পড়ে আছি কত মাস ধরে। এমন যদি হতো এই ট্রিটমেন্টে আমি সুস্থ হবো তাও বুঝতাম। কিন্তু আমার তো মৃত্যু নিশ্চিত। আমার ভালো লাগে না এখানে। দম বন্ধ লাগে। মৃত্যুর আগে একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই, প্লীজ চিত্রা মা।
~শুভ্রতা!
চন্দ্রের গলায় কেঁপে উঠলো শুভ্রতা। শুভ্রতার চোখের দিকে চেয়ে থমকে গেলো সে। তার রাগী চাহনী দেখতেই অভিমানীর চোখে জমা হলো অশ্রুকণা। সে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রের দিকে। শুভ্রতা চিত্রার হাতের প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে অভিমানী কন্ঠে বলল,
~খাবো না তোমাদের খাবার। এখানে থেকে ট্রিটমেন্ট নিয়ে বেশি সময় বেচেঁ থাকার থেকে ভালো আমি জলদি মৃত্যুবরণ করি। অসহ্য লাগছে এই জীবন এখন। এভাবে বদ্ধ ঘরে থাকার চেয়ে ভালো আমি মায়ের কাছে চলে যাই।
বলতে বলতেই চোখ হতে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। কান খাড়া করতেই শুনতে পেলো চন্দ্র শব্দ করে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। শুভ্রতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। গত ৪ মাস ধরে সে এই ঘরে আছে। বাহিরের দুনিয়া তার দেখা হয়না বহুদিন। যে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতো সে। সেই আকাশটাও চোখের দেখা দেখতে পায়না আজ ৪ মাস। ৪ মাস ধরে সে প্রকৃতিতে মন ভরে শ্বাস নেয় না। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়া হয় না, দুপুরের তপ্ত রোদ গায়ে মাখানো হয় না, সন্ধ্যার শীতল বাতাস গায়ে মাখানো হয় না। এ তো বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মতো তার কাছে। বেঁচে থাকা আর না থাকা তার কাছে তেমন কোনো তফাৎ রাখে না। একা এক ঘরে সারাদিন থাকা তার কাছে বিরক্তিকর। চন্দ্র তাকে এক মিনিটের জন্যেও ঘরের বাইরে যেতে দেয় না। সে বাইরে যাওয়ার জেদ করলেও বেশ কঠোর ভাবে মানা করে দেয় তাকে। মাঝে মাঝে এই চন্দ্রকে দেখলে সে বেশ অবাক হয়। এই চন্দ্রকে সে চিনে উঠতে পারে না। সেই চঞ্চল, হাসি খুশি চন্দ্রটা হুট করেই কেমন গম্ভীর আর দাম্ভিক হয়ে উঠলো তা সে বুঝতেই পারলো না। আগে চন্দ্র চাইতো তার শুভ্রতা বাঁচুক, হাসি খুশি থাকুক। আর এখন? সে শুধু চায় শুভ্রতা বাঁচুক, তার সাথে থাকুক, বেশি বেশি সময় থাকুক। তাকে বাঁচিয়ে রাখাটাই যেনো চন্দ্রের এক মাত্র লক্ষ্য। তার কষ্টটা যেনো তার চোখেই পড়ে না।
______________________________
সন্ধ্যায় অরণ্য এলো শুভ্রতার সাথে দেখা করতে। শুভ্রতা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অরণ্য এসে বোনের মাথায় হাত রাখতেই ঘুম ছুটে গেলো তার। সে চোখ খুলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কতক্ষন। এরপর উঠে বসলো।
~কেমন আছিস?
~ভালো।
ছোট্ট এক জবাব দিয়ে চুপ করে গেলো শুভ্রতা।
~দুপুরে খেয়েছিস?
শুভ্রতা জবাব দিলো। মৌনতা পালন করলো দুজনেই। শুভ্রতা হাতটা অরণ্যের দিকে এগিয়ে দিলো।
~ক্যানেলাটা খুলে দাও তো। ভালো লাগছে না।
~বিকেলেই নাকি দিয়েছে? থাকুক।
শুভ্রতা আগের ন্যায় হাত বাড়িয়ে বসে রইলো। অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত থেকে ক্যানেলা খুলে দিলো। ক্যানেলা খুলতেই শুভ্রতা হাত ঝাড়া দিলো। হাতটা কেমন শিরশির করছে।
~আজ গাড়ি নিয়ে এসেছো?
অরণ্য মাথা ঝাঁকালো। হতাশ চোখে তাকালো শুভ্রতা।
~মানিব্যাগটা দাও।
~কেনো?
মানিব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো অরণ্য। শুভ্রতা মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা নিয়ে বললো,
~বাড়ি গেলে দিয়ে দিবো। প্রয়োজন আছে।
~কি কাজে লাগবে এখানে? আর টাকা ফেরত দেওয়া লাগবে না।
শুভ্রতা বিপরীতে কোনো কথা বললো না। উঠে সোফার উপর থেকে চন্দ্রের শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। জুতা পড়তে পড়তে প্রশ্ন করলো,
~তুমি কি এখন বাড়ি যাবে না?
অরণ্য মাথা দোলালো।
~কোথায় যাস তুই? তোর বাহিরে যাওয়া নিষেধ।
শুভ্রতা দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলে পিছন ফিরে তাকালো।
~মরার আগে একটু শান্তি চাই।
~শুভ্রতা, শোন, ও শুনলে ভীষণ রেগে যাবে।
অরণ্য এসে হাত ধরে আটকালো তাকে। শুভ্রতা শান্ত ভাবে হাত ছাড়িয়ে নিলো। মুচকি হেসে জবাব দিলো,
~আমি তার বন্দিনী ছিলাম না। ভালোবাসা ছিলাম অরণ্য ভাই।
হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো শুভ্রতা। অরণ্য আগের জায়গায় এসে বসলো। কল লাগালো অনুরাধাকে।
.
~শুভ্রতা কোথায়?
শুভ্রতাকে না পেয়ে গর্জে উঠলো চন্দ্র। অরণ্য বেশ শান্ত চোখে চাইলো চন্দ্রের দিকে। বোন তার রাগ করে বেরিয়েছে তা নিয়ে তার মধ্যে কোনো চিন্তার রেশ মাত্র পাওয়া গেলো না।
~আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি অরণ্য। আমার বউ কোথায়?
অরণ্য শান্ত গলায় জবাব শুধালো,
~জানিস চন্দ্র? যে পাখি ডানা মেলে আকাশে উড়তে, প্রকৃতিতে মিশে থাকতে ভালোবাসে তাকে খাঁচায় বন্দী করলে সে বেশিদিন বাঁচে না।
চন্দ্রের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফুটে উঠলো। সে তাকাতেই অরণ্য মুখ ফিরিয়ে নিলো।
~মন মরে গেলে মানুষের নিকট জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। এটা অবশ্যই তোর অজানা নয়? যাকে তুই বাঁচানোর জন্য দীর্ঘ কত মাস যাবৎ পাগলের মতো খেঁটে যাচ্ছিস তাকেই তুই প্রাণ খুলে বাঁচতে দিচ্ছিস না। এই চার দেয়ালের মাঝে আটকে রেখেছিস। তোর কি মনে হয়? এই চার দেয়াল আজরাইলকে আটকাতে পারবে? এই চার দেয়াল তার মৃত্যু ঠেকাতে পারবে? পারলে বল, আমি অরণ্য নিজে ওকে খুঁজে এনে এই চার দেয়ালের মাঝে ছুঁড়ে ফেলবো।
~অরণ্য!
~তুই কি নিজেও দেখতে পারছিস না? বুঝতে পারছিস না নিজের পরিবর্তন? এই জন্যে আমি আমার বোনকে তোর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আহনাফ?
~অরণ্য তুই ভালো মতো জানিস আমি কেনো…
~জানি, খুব ভালো জানি। কিন্তু তুই শুধু তার দেহটাকে বাঁচানোর প্রয়াস করছিস আহনাফ, তাকে না। মানুষটা আবারো হাসতে ভুলে যাচ্ছে। ফুপির মৃত্যুর পর মেয়েটা নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রেখেছিল। তুই নিজে গিয়ে তাকে সেই বদ্ধ দুনিয়া থেকে বের করেছিস। তাকে আবারো প্রাণবন্ত হয়ে উৎসাহ দিয়েছিস। যেই মেয়েটা আবারো বাঁচতে শিখলো, তুই পুনরায় ওকে বদ্ধ ঘরে ফেরত টেনে নিয়ে এলি। মেয়েটা এমনিও মরে যাবে আহনাফ। ফর গড সেক, অন্তত তুই ওকে আর কষ্ট দিস না। এই কষ্ট ও সহ্য করতে পারবে না।
অরণ্যের কথায় চন্দ্র মৌন রইলো। কোনো কথা বললো না। নির্বোধ চোখে চেয়ে রইলো শুভ্রতার খালি বেডের দিকে। অরণ্য বন্ধুর মনের হাল বুঝলো একটু। কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল,
~ফুপির বাড়ি যা। সেখানেই আছে হয়তো। শুনলাম সারাদিনে কিছুই খায়নি সে।
চন্দ্রের চিন্তা বাড়লো। তৎক্ষণাৎ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
~~~
চলবে?