চিরসখা পর্ব -০২

#চিরসখা (২)

ভেজা টাওয়েল বিছানায় রাখা পছন্দ করে না আসাদ। গোসলের পর টাওয়েল সহ অন্তর্বাস পর্যন্ত বারান্দায় মেলে দেয়। মেধা এদিকে উল্টো। চুল শুকিয়ে হাতে মুখে ক্রিম দেয়া শেষ হলে এক কাপ চা বা কফি নিয়ে বারান্দায় গিয়ে কাপড় মেলা ওর ছোটবেলার অভ্যেস। আসাদ প্রথমে দেখে মুখে কিছু বলতো না। ঘুরতে এসে সরাসরি স্ত্রীকে আদেশ করে বসলো।
–তোয়ালে রাখার সুনির্দিষ্ট জায়গা আছে মেধা। এত সময় নিয়ে বাকি কাজ না সেরে এটা রোদে মেলে করতে পারো।
–অনেক দিনের অভ্যাস বদলাতে পারব না।
–অন্যের সাথে থাকতে হলে তার পছন্দ-অপছন্দ দেখতে হয়।
–তুমি জানো আমি ডার্ক চকলেট পছন্দ করি না। খাওয়া বন্ধ করেছো।
–গুড, তুলনা শুরু করছো। ওটা তোমাকে বদার করার কথা নয়। কিন্তু, এই অসঙ্গতিটা আমাকে পীড়া দেয়। বিছানা ভিজে থাকে। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা ছত্রাক জন্মের আদর্শ স্থান।

আসাদ কফিতে সুগার কিউব মেশায়। মেধার জন্য একটা, তার জন্যে ব্লাক কফি। দুধ-চা একটা বাজে খাবার। চা বা কফি লিকার খেতে হয়। আসল স্বাদ পাওয়া যায়। কফিতে চুমুক দিয়ে মন ভালো লাগে মেধার। সঠিক অনুপাতে সব উপাদান আছে। বিকেলের জন্য পিচ কালারের সাদাবাহার স্যুট পরে চুল ব্লো ডাই করে ছেড়ে রাখে। পায়ে হিল গলাতে গেলে আসাদ মানা করে।
–কোলাপুরী পরে নাও। ড্রেস কোড আছে। বিচে যাবে, হিলে হাঁটতে পারবে না।
–ড্রেস কোডের বিষয় আমি বুঝি। হিল পরতে ইচ্ছে করছে।
–তুমি একা বেড়াতে এলে বিকিনি বাদে সব পরে ঘুরো মেধা। আমার সাথে যখন থাকো, টপ টু বটম সামঞ্জস্য রেখে চলবে। ইটস আ রিকোয়েস্ট, নট অর্ডার, বাট ট্রাই টু ফলো।

আসাদ ক্যাজুশাল ডিপ নেক কোর্তাকাটিং শার্টের সাথে ঢোলা প্যান্ট পরেছে। মেধা আড়চোখে আসাদের বুকের পশম দেখে। লোকটার সর্বাঙ্গে অভিজাত ছাপ। ঘুমিয়ে গেলে ও জায়গা মেপে শোয়। মেধা এলোমেলো, মেধা অগোছালো। নিউ কাপলদের জন্য বিকেলে রিসোর্ট থেকে ফটোশ্যুটের ব্যবস্থা করেছে। চিকসে হালকা গোল্ডেন শেড বোলায় মেধা। আসাদ পারফিউম দিতে এসে স্ত্রীর দুলের ঝুলে দোলা দেয়। ভালো লাগে, মুখে প্রকাশ করে না। আসাদের বাসায় ওর মা-বোন আছে। ছোট ভাই রাশাদ বিয়ে করে বউ সহ থাকে। মেধার পরিবারের সাথে আসাদের পরিবার বিয়ের পর মিশে গেছে। আসাদের মা মেধার মায়ের জন্য বকুল কাথা আনিয়ে দিয়েছেন। মেধার মা বেয়াইনকে দিয়েছেন কাঁসার ময়ূর। আসাদের ছোট ভাইয়ের বউ রুপা মেধার সাথে শুরুতে খুব না মিশলেও সম্পর্ক এখন সাধারন। আসাদ বিয়ের পরদিন মাকে ডেকে বলেছে, মেধার কাছ থেকে ঘরোয়া বউয়ের আচরণ আশা করার দরকার নেই। মেধা মন থেকে কিছু করতে চাইলে করবে।
আসাদের মা ছেলের কথা শুনেছেন। ছেলে থাকবে তার বউয়ের সাথে। তারা দুই জন সুখী হলে তিনি খুশী। মেধা বা রুপা কাউকে তিনি পা টেপাতে বা রান্নাঘর সামলাতে আনেননি। তার রান্নাঘরের মালিকানা একার। উল্টো ওখানে কারো মাতব্বরি তিনি পছন্দ করেন না।

রুপাকে আসাদের মা দুপুরে খাবার পর ডাকলেন। ছেলে ঘুম দিয়ে রুপা চোখ ডলতে ডলতে দাঁড়ালো। তিন মাসের ছেলে রাতে ঘুমোয় না। ভরপেটে খেয়ে এখন গড়িয়ে নেবার সময়ে কথা বলতো তার ভালো লাগছে না। আসাদের মা রুপাকে একটা জামদানী শাড়ি হাতে দিলেন। রুপা উল্টে পাল্টে শাড়ি দেখে রেখে দিলো। বাচ্চা হবার পর তার পেট হয়েছে তিমি মাছের মতো। এখন শাড়ি পরা আরেক হুজ্জুত।
–মেধাকে বেশী মাথায় তুলবে না। সে এসেছে আসাদের পছন্দে। ঘরের কাজ করায় আসাদের প্রবল আপত্তি। তুমি তেমন মেয়ে নও।
–আলগা পিরিত সরি মা, এত খাতির করে কে। ছোট বাচ্চা নিয়ে সারাদিনে ফাঁকে ফাঁকে পড়তে বসি। রাশাদ সন্ধ্যায় নাস্তার বায়না করে। ওনার সাথে কথা বলার সময় কই।

মেধা ঘর থেকে সব শুনলো। একবার ভাবলো এগিয়ে গিয়ে জবাব দেবে। পরে ভাবলো, না থাক। সময় তার উচিত ছবক দিতে জানে। এমনিতে ছোট করে বিয়ের অনুষ্ঠান করায় দু’পক্ষের আত্মীয় স্বজনেরা ভালো ভাবে নেয়নি। মেধার মাকে সুযোগ পেলে কথা শোনানের চেষ্টা করে।

আসাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো মেধা। আসাদ ওর দিকে এগিয়ে এসে গলায় স্টাড চেইন পরায়। শেষ মাথায় মুক্তো পেঁচিয়ে একটা সোনালী তার সাপের মতো উঠে এসেছে।
–পছন্দ হয়েছে?
–সুন্দর।
–বিয়েতে গহনা বাছার সময় ছিলো না।
–আমি গহনার জন্য বিয়ে করিনি।
–জানি, তোমার বাসার সবাই কেমন আছে। মাকে ফোন করেছি। আসাদ এবার পারফিউম স্প্রে করে। কলারের কাছে ডিউ ঘষে নেয়। মেধার আবার হিরকের কথা মনে হয়। মেসের বিছানায় মেধা শুয়ে শুয়ে হিরকের তৈরী হওয়া দেখতো। পাঞ্জাবীর হাতায় এমন করে ডিউ ঘষত হিরক। সই কি ওর ডিও দেয়া পছন্দ করে। সঙ্গম মুহূর্তে হিরকের বুকে ডিউর ঘ্রাণ কেমন লাগে সইয়ের!
–আমার মাকে ফোন দিয়েছো?
–না, ভুলে গেছি।
–ছোট খাটো বিষয় গুলো ভুলে যাওয়া বলে না, বলে উদাসীনতা।
–তোমার মায়ের বিষয়ে আমি উদাসীন, তাই বলতে চাইছো।
–আম্মা ওনার গহনা ভাগ করে দেবেন। ভিডিও কলে কথা বলে দেখে নিও।
–রুপাকে দিয়ে দিক।
–কথা বলতে দোষ কোথায়। অনাগ্রহ আম্মাকে দেখিও।
–সরি, ইন্টারেস্ট পাচ্ছি না।

পাতলা সোনালী রিমের চশমা কপালে তুলে মেধার গলার একপাশে আঙুল বোলায় আসাদ। ওকে দেখতে দারুণ আকর্ষণীয় লাগছে। মেধা স্বামীর চোখে চোখ রাখে। মেয়েরা এমন স্মার্ট ছেলের প্রতি দ্রুত দুর্বল হয়ে পরে। আসাদের উচ্চতা মেধার মাথা ছাড়িয়ে এক হাত। পারফেক্টলি স্বামীর বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরা যায়। অন্য কোন মেয়ে হলে এমন সুযোগ বারবার চাইতো। মেধার কেবল ভালো লাগছে না।
— কখনো আম্মাকে অসম্মান করবে না। তোমার পরিবারকে আমি যেমন শ্রদ্ধা করি, প্রায়োরিটি দেই। তুমিও সমান দিও। ভুল করেও আম্মাকে কটু কথা বলবে না।
–হুকুম দিচ্ছো না হুমকি।
–তুমি যেভাবে নিতে চাও।
–ঠোঁটকাটা মেয়ে বিয়ে করে এখন লাগাম টানছো। এমন কথা ছিলো না।
–লাগাম টানিনি, শুধু ভদ্র ব্যবহার চাইছি। শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষ তার অনতিক্রম্য সীমা জানে।
মেধা আসাদের মাকে ফোন করে। উনি এ সময় ঘুমোন। তারপরেও উঠে মেধার ফোন দেখলে খুশী হবেন। মেধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এভাবে কাউকে তোয়াজ করতে তার ভালো লাগে না। আসাদের কথা ও কাজে ফারাক নেই। স্ত্রীকে সে কেয়ার করে। মেধার মন পরে আছে হিরকের কাছে। ওটা ফেরত আনার পাকাপোক্ত কোন ব্যবস্থা জানা থাকলে ভালো হয়। ফটোশ্যুটের জন্য বিচের সামনে রাখা জোড়া সাম্পানের কাছে যায় ওরা। লাল, নীল কালো রঙে রাঙানো সাম্পানের কোনায় লাফিয়ে ওঠে ফটোগ্রাফার। সহকারীকে নিয়ে আসাদ এবং মেধাকে শট বোঝায়। টাইটানিক পোজ তৈরী করে পেছনে আকাশ, সমুদ্র ও ডুবন্ত রক্তিম সূর্যকে রেখে কয়েকটা স্ন্যাপ নেবে। চাইলে পোজ বদলাতে পারে ওরা। আসাদ হো হো করে হেসে দেয়। এসব রোমান্টিকতা চর্চা করার সময় নেই।
— ইউনিক কিছু পোজ ক্রিয়েট করুন।
–নিউলি ম্যারিড কাপলের জন্য এই পোজ এক্সিলেন্ট স্যার।
–ক্রিয়েটিভটি নেই। সবাই যা করে তাই করতে চাচ্ছি না।
–স্যার কালকে আরেকটা সেশন রাখি। নতুন সেটাপে।
–নাহ, যা করার আজকে, এখনি।
–এত তাড়া কিসের তোমার।
–এক বিষয়ে বারবার সময় দেয়া মানে তা নষ্ট করা। কনসার্ট শুরু হবে।
–ভীড়, ঠেলাঠেলি ভালো লাগে না।
–পৌছে দেখো। পুরনোকে ভুলতে না পারলে তোমার লস।

বালিয়াড়ি ধরে মেধার হাত মুঠোয় নিয়ে আসাদ আগায়। খুব দ্রুত আলো নিভে আসছে। সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাসে এলোমেলো জলকনাদের আগুপিছু পা ছোঁয়া খেলার মাঝে মেধার হঠাৎ ঘুম পায়৷ কোন কিছুতে আগ্রহ না পাওয়া কি এক ধরনের রোগ?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here