চিরসখা পর্ব -১২ ও শেষ

#চিরসখা (১২)

স্বামীকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে আসার এক মাসের ভেতর মেধার রুটিন বদলেছে। শ্বশুড় বাড়িতে তার মন বসেনি। লাইভ এসিটেন্টের কাজ ঝোঁকের বশে করতে গিয়ে বেশ অপ্রিতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পরে। হিরকের সাথে বনানীতে দেখা করে ঐ বাসায় পৌছে দেখে মহিলার স্বামী উপকরন নিয়ে অপেক্ষায় আছে। মেধা কাপড় পাল্টে লাইভ চালাতে গেলে লোকটা মানা করে। নিজের ফোনে প্রোডাক্টসের ছবি তুলে পেজে ছবি গুলো আপ্লোড করতে দেয়। মেধা ছবি আপ্লোড করে প্রডাক্ট ডিটেইলস ও দাম লেখে। লোকটা ওকে চা নিতে ডাকলে মেধা বসে চা খায়। টুকটাক কথা বলতে বলতে লোকটা গায়ে হাত দিলে মেধা বাসা থেকে চলে আসে। রাতে মহিলাকে জানালে উল্টো ওকে দোষারোপ করে পাওনা টাকা না দিয়ে ব্লক করে। আসাদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করলে আসাদ ওকে খুব বকা দেয়। এখানে নতুন চাকরিতে সিনিয়র বসের ব্যবহার তার ভালো লাগে৷ ভদ্রলোক খুব ফর্মাল, দেখতে হ্যান্ডসাম। ওনার লেখা কবিতার বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাসায় দাওয়াত পেলো অফিসের সবাই। মেধা ভদ্রলোকের বউকে দেখে অবাক। পরমা সুন্দরী মহিলা৷ দুই বাচ্চার মা, ঝরঝরে শরীর। বউ-বাচ্চাকে নিয়ে ভদ্রলোকের পিকচার পারফেক্ট ফ্যামেলি। অনুষ্ঠান ঘুরে ঘুরে মহিলা সবার খাবারের তদারকি করছিলেন। পরে জানলো, সেই লোক অফিসের এক মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত শোয়। মেয়েটার ফোনে ওদের ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে বিশ্বাস করে মেধা৷ বাসায় এসে মেধা খুব আপসেট হয়ে পরে। সংসার -সন্তান রেখে অন্য মেয়েকে নিয়ে ফুর্তি করছে। বউটার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়। ভাবতে গিয়ে সইয়ের কথা মনে পরে মেধার। হিরকের সাথে ও এমন একটা সম্পর্কে আছে। সেদিন হিরকের স্পর্শে ওর শরীর জেগে উঠে ছিলো। হিরকের মেস হলে নিজেদের সামলে রাখতে পারতো না। মেধার ভেতরের কষ্ট লীন হয়ে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। এমন হবার কথা ছিলো না৷ সই এসে হিরকের জীবনে জুড়েছে।৷ হিরক ওকে ভালোবাসতো, এখনো বাসে৷ মেধার জীবন মাঝখানে দুটো নৌকায় দুলছে। হিরক যদি ওর বউ বাচ্চা ছেড়ে মেধাকে বিয়ে করে। কয়েক বছর পর বাচ্চা তার বাবার কাছে আসবে৷ মেধা ঠেকাতে পারবে না। হিরক আর তার মধ্যে একছত্র ভালোবাসা থাকবে না। সইকে তালাক দিলে ও হিরক বাচ্চার মাকে ভুলতে পারবে কি? মেধা হিরককে নিয়ে দূরে চলে গেলেও রক্তের টান থাকবে। হুট করে ওর চোখের সামনে কালো পর্দা নামে। প্রায়ই ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। অফিসে গোপনে চোখের পানি মোছে। কাজে ভুল হয়। কলিগ সহ সিনিয়র জুনিয়র আড়ালে ওকে নিয়ে হাসে। এই চাকরীটা হয়ত থাকবে না। মেধা বোঝে কিছু করতে পারে না। নিজেকে ব্যর্থ মানুষ মনে হয়। এক বুক শূন্যতা নিয়ে ঘুমোতে যায়। ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে মেধা বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। হিরকের মেসেজ আসলে ওর ভালো লাগে। লম্বা সময় গল্প করলে মন খুশী হয়। সাধারন জীবন যাপন করে দিনের শেষে আবারো হতাশা কামড়ে ধরে। ওর জন্য সব এলোমেলো হয়ে যাবে।

আসাদের বুকে মাথা রেখে এসব ভাবছিলো মেধা। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আসাদ ওকে তৈরী হতে বলে। ডাক্তারের কাছে যাওয়া শুরু করেছে মেধা। কয়েকটা সেশন চলে গেছে। নিজেকে নিয়ে ভোগা ভয়ানক পাপবোধ থেকে মুক্তি মেলেনি।
–চলো, আমি রেডি।
–গায়ে কি দিয়েছো এটা?
মেধা পুরনো ইস্ত্রী ছাড়া একটা শর্ট ফতুয়া পরেছে। জায়গায় জায়গায় রঙ জ্বলে গেছে। প্লাজ্জোর নিচে সুতো বের হওয়া। পায়ে স্পঞ্জ। আসাদ চোখ মুখ সরু করে মেধাকে দেখে। মুখ প্রসাধনহীন। ঠোঁট ফেটে আছে, চুল আঁচড়ায়নি। অগোছালো স্ত্রীকে দেখে আসাদের বুকের মধ্যে এলোমেলো লাগে। আলনা থেকে একটা সালোয়ার কামিজ তুলে নেয়।
–পাল্টে নাও।
–এভাবেই যাই।
–মনে হচ্ছে বাসার কাজের বুয়াকে নিয়ে বের হচ্ছি।
–আমি কি ওর চে’ বেশী কিছু।
–বাজে কথা বলো না। আসো চেঞ্জ করে দেই৷
মেধা হাত তুলে মানা করে। আসাদ কোন বাধা মানতে নারাজ। দ্রুত মেধার ড্রেসাপ বদলে দেয়। মুখ নামিয়ে চোখ বুঁজে রাখে মেধা৷ এই লোকটার সাথে ওর সম্পর্ক অল্প সময়ের। ‘বিয়ে’ হয়েছে বলে এত খেয়াল রাখতে হবে কেন মেধার। আসাদের জোরালো কথায় মেধা চোখে কাজল পরে, ঠোঁট রাঙায়। আলতো হাতে স্ত্রীর চুল আঁচড়ে সাইডে প্রজাপতি ক্লিক আটকায় আসাদ৷ মেধাকে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে আসে।
–এখন মনে হচ্ছে আমার ‘বউ’।
–যাবো?
–যাবো, তার আগে নিজেকে দেখো। কোন মেধা সুন্দর? এই মেধা, নাকি আগের পঁচা মেধা।
–এই মেধা।
–আমি এই মেধাকে ভালোবাসি। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো মেধা। আমার জন্য হলেও রেখো।
মেধা সিটবেল্ট বাঁধে। হিরককে দেয়া সময় গিয়ে।অনেক ছুটির দিন চলে গেছে৷ আজ বুধবার, কাল পেরিয়ে পরশু আরেক শুক্রবার। মেধাকে নামিয়ে আসাদ বাহিরে বসে থাকে। দিন দিন মেধা কেমন প্রাণহীন হয়ে পরছে। আগের সেই রাগ নেই। অহেতুক ক্রোধ নিয়ে আক্রমন করা ভুলে গেছে। অভিমানে গাল ফুলিয়ে আদরের জন্য শরীর মেলে ধরা বউকে ও মিস করে।
–কথা বলেছো?
–হুম, বেশী না।
–এখন ভালো লাগছে।
–হা। চা খাবো।
–ডিনার টাইম এখন।
–আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে।
আসাদ মেধাকে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। ডাক্তার ওকে নিজের মতো থাকতে দিতে বলেছে। গতমাসে আসাদের সাথে কথা কাটাকাটি করে আবারো সুইসাইডের এটেম্প্ট নিয়ে ছিলো মেধা। বিষয়টার জন্য আসাদ নিজেকে দায়ী করে। মেধার অতীত স্বীকার করে ও বিয়ে করেছে। স্ত্রীর মনের শীতলতার মাঝে ডুবে গভীরতার সন্ধানে ভালোবাসা দিয়েছে আসাদ। প্রাথমিক দিন গুলোয় নিজের রাগকে কমিয়ে আনা উচিত ছিলো। এটা আসাদের দূর্বলতা, ও অনুধাবন করে। ছোট ফুল গাছ মাটিতে পুঁতলে তাকে সময় দিতে হয়। রোজ নিয়ম করে গাছের গোড়ায় পানি ও পর্যাপ্ত সার লাগে। এখানে আস্ত মানুষের জীবন নিয়ে কথা।

শ্বশুড় বাড়িতে এসে রাতে শাওয়ার নেয় আসাদ। মেধাকে ডেকে কথা বললে ভালো লাগতো। রাতের খাবারে আয়েজনে ও মাকে সাহায্য করছে। আজকে এখানে থাকবে আসাদ। মেধার ফোন বেজে ওঠে। আসাদ দেখে ‘হিরক’। ফোন কেটে ম্যাসেঞ্জার সহ গ্যালারী ঘেটে বেড়ায়৷ স্নেহ ও নিয়মিত জীবন যাপনে ভেবেছে মেধা সামনে এগোবে। নাহ, ভুল ছিলো। চোয়াল শক্ত করে বিছানায় ফোন ছুঁড়ে ফেলে বাসা থেকে বের হয়ে যায় আসাদ। মেধা দৌড়ে এসে ফোন তুলে দেখে হিরকের সাথে ওর তোলা সেল্ফি ওপেন হয়ে আছে। নিচে হিরকের পাঠানো ফুটনোট ‘তোমাকে চুমু খেতে চাই, সোনা’। মেঝেতে ফোন আছড়ে ভেঙে বিছানার চাদর খামচে ধরে কাঁদে মেধা।

–হিরক, ওঠো না।
–উঠব। সবাই রেডি?
–আমি রেডি হবো।
–তাহলে হও। সব ফাউল কাজ শেষ হলে ডাকবা।
সই হিরকের মাথার চুলে বিলি কাটে। বাবু হিরকের পাশে ঘুরে খেলছে। বাবা ভক্ত বাচ্চা। হিরক চোখ খুলে সইকে দেখে বিরক্ত হয়। মেধার সাথে কথা বলার সুযোগ হচ্ছে না। বাসায় বোন- বোন জামাই এসেছে। অফিসে কাজের প্রেশারে মুখ তোলা দায়। মেধাকে নিয়ে ল ইয়ারের কাছে যেতে চেয়ে ছিলো। হিরক মেধাকে খুশী করতে যাবে। সই আজকে বাইরে খেতে যাবার প্লান করে বোন জামাইকে বললো। ওরা আগামীকাল চলে যাবে। হিরকের মাথায় গ্যাঞ্জাম লাগে। সব মরা এক সাথে পুড়তে এই দিনের জন্য বসে ছিলো।
–আম্মা ওদের সাথে কালকে যাবে?
— ওনাকে পাঠানোর দরকার নেই।
সই স্বামীর মুখে মুখে উত্তর দিয়ে বোঝে হিরক রেগে গেছে। সইয়ের আচরণে হিরক অবাক হলে ও কিছু বলে না। সামনে আরো বড় ঘটনা ঘটবে। সইকে হাতে রাখা দরকার। হিরক স্ত্রীর কোমড়ে, স্তনে আদর করে ঠোঁটের চারপাশে চুমু খেতে থাকে। ‘বাবু আছে তো’ বলে সই হেসে উঠে যায়। ওর স্বামীটা পাগল। এই রাগ করে, আবার এই ভালোবাসে। হিরক শুয়ে শুয়ে হিসেব করে। ভালো একটা দিন দেখে সইকে বাসা বদলানোর কথা বলবে ভেবে ছিলো। আজকে বলা যায়। আত্মীয়দের সামনে বললে সই মানা করবে না। আম্মাকে সবসময়ের জন্য থাকতে বললে আম্মা ও খুশী। হিরকের মন ফুরফুরে লাগে। হোটেলে টেবিল বুক করা আছে। সই ম্যানেজারের সাথে কথা বলে। হিরক বাবুকে কোলে নিয়ে ফোনে ব্যস্ত। ননদ খুব খুশী। হোটেলের রিসিপশনের সামনে বড় করে ছবি তোলার জায়গা সাজানো। দূরে দূরে বড় সোফা রাখা। ওখানে বসে বিদেশীরা স্যান্ক্স -কফি খাচ্ছে। আজকে সইয়ের মন খুব ভালো। জীবনে প্রথম নিজের রোজগারে সবাইকে খাওয়াবে। ব্যবসার কথা হিরককে কেমন করে বলবে ভেবে সই ভয় পায়। হোটেল ঘুরে ছবি তুলে সোফায় বসে সই। ‘ইশ, কি আরাম’, সই সোফায় হেলান দিয়ে নিজের সেল্ফি তোলে। সুন্দর একটা ছবি ফেসবুকে দেবার জন্য সব ছবি দেখতে থাকে সই। একটা ছবিতে মেধাকে দেখে ওর দম আটকে আসে। এই মেয়েটা এখানে কি করতে এসেছে। সইয়ের কান্না পায়। হিরক এই মেয়েটার সাথে সম্পর্ক রাখে এখনো? এ জন্য আলাদা থাকে। অন্য রুমে সময় কাটায়। ফোন ধরতে দেয় না? নাকি সবটা কাকতালীয়। মেধা এখানে এমনি এসেছে। সবার সাথে খেতে বসে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেও কেমন যেন অশান্তি লাগতে থাকে সইয়ের।

সইয়ের প্লেটে খাবার তুলে দেয় হিরক। বাবু কাঁদছে। সইকে খেতে বলে বাচ্চা কোলে নিয়ে দোল দেয় হিরক। বাবু খিলখিল করে হেসে হিরকের নাকে মুখে আচড়ে, কামড়ে চুমু দেয়। সই হিরককে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছে। ছোট্ট শিশুর হাসিতে হোটেলের ঐ পাশ কলকল করে। অন্য টেবিলের লোকজন হাসি মুখে ওদের পরিবারকে খেয়াল করে। সুন্দর পারিবারিক মুহূর্ত। পুরো পরিবার একসাথে হাসছে৷ সইয়ের খুব ভালো লাগে এবার। মেধা মেয়েটা দেখুক, হিরক ওকে ভুলে কত ভালো আছে।

দূরের টেবিলে বসে মেধা হিরকের হাসিখুশি পরিবার দেখে। হিরক হোটেলের ঠিকানা দিয়ে বিকেলে আসতে বলে ছিলো। মেধা আগে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আসাদের আম্মা ফোন করে ছিলেন। ওনার ছেলের তীব্র জ্বর এসছে। জ্বরের ঘোরে একবার মেধাকে ডাকছে, আবার চলে যেতে বলছে। ওদের ভেতর কোন ঝগড়া হয়েছে জানতে চাইছিলেন। মেধার খারাপ লাগতে থাকে। সংসার ওকে দিয়ে হবে না জেনেও আসাদ তাকে ভালোবাসে। ওকে সুখী করার চেষ্টা করে। ওর কোন দিকে আগানো উচিত। সামনের টেবিলে বসা ঐ সুখী সুন্দর পারিবারিক বন্ধনে আটকে থাকা পুরুষের দিকে? ও এগিয়ে গেলে এই সংসারটা ভাঙবে। বাচ্চা বাবা হারা হবে। সইয়ের অভিশাপ লাগবে। সবার তাচ্ছিল্য সয়ে উল্টো আত্মীয় -অনাত্মীয়দের থেকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে মেধাকে। হিরক পুরুষ মানুষ। ও প্যান্ট খুলে রাস্তায় দাঁড়ালেও লোকে তাকাবে না। এই সংসার ভাঙার সমস্ত দোষ সমাজ মেধাকে দেবে।

নিজের পারিবারিক মুহূর্তের সাথে মেধাকে পরিচয় করানোর ইচ্ছে হিরকের নেই। মেধাকে বিকেলে সময় দেয়া হয়েছে। মেয়েটা আগে এসে এসবের মধ্যে পরলো। হিরক মেধাকে দেখেছে। মেধাকেই ভালোবাসতো হিরক। তবে, নতুন নতুন নারী শরীরের আসক্তি ও কাটাতে পারতো না। সইকে বিয়ে করে কিছুদিন মেতে ছিলো। বাচ্চা হবার সময় চার মাস বউয়ের সঙ্গ পায়নি। তখন সময় কাটালো পাশের বাড়ির কলেজে পড়ুয়া মেয়ের সাথে। মেয়ে প্রেম করছে টের পেয়ে বাপ মা গ্রামে পাঠিয়ে দিলো। হিরকের সাথে প্রেম শেষ। ততদিনে বাবু হয়েছে। সই ঝামেলা মুক্ত। এর ভেতর মেধা নক দিলো। মেধার সাথে সিলেটে কাটানো সময় ভোলা যায় না। সেই শরীরী উদ্দাম ভাবতেই হিরক মেধার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে। তবে বাচ্চার জন্য খারাপ লাগে। সইকে বাসা বদলানোর কথা বলতে উশখুশ করে হিরক।

মেধার মাথা ঝিমঝিম করছে। একসময় ভাবতো, হিরকের কাছে ফিরতে পারলে সব সমস্যা মিটবে। হয় তো এমন কত পৃথিবীতে। মানুষ ভুল করে, জীবন কাটায়, তারপর যে যার ভালোবাসার কাছে ফিরে এসে সুখী হয়। কিন্তু, হিরক কোন কিছু হারাবে না। যা ক্ষতি হবার তার হবে। হিরক তাকে আদৌ কোনদিন ভালোবাসেনি। এর জন্যে সে আসাদের মতো মানুষকে কষ্ট দিয়েছে৷ মেধা উঠে দাঁড়ায়। হিরকের এই দ্বিচারণ তার অসহ্য লাগছে৷ সবচে’ বেশী অসহ্য লাগছে নিজেকে। এত গাধা সে। ওর শরীর দুমড়ে মুচড়ে কান্না আসছে। বাজে ভাবে ঠকে গেছে মেধা। ওর ভাগ্যে তাই ছিলো। ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে জানা হিরকের সাথে বিয়ে হলে এতদিনে কবরে চলে যেতো মেধা। আসাদের জন্য পাওয়া মৃত্যুর আগের দ্বিতীয় জীবনেও বোকামী করতে চলছিলো।

বাসায় এসে মেধা ব্যাগ গোছায়। বড়বোন কিছু বলতে এলে মেধা তাকে চমকে দিয়ে গলা জড়িয়ে কাঁদে। বড় বোন কিছু বুঝতে পারে না। তার এই বোনটা ছোট থেকে চাপা। অল্পতে কষ্ট পেয়ে বিশাল আকার ধারণ করে মনের ওপর বোঝা বানায়। বোনকে ‘সরি ‘বলে মেধা। হিরকের ফোন আসলে অনিচ্ছা নিয়ে জোর করে বারান্দায় গিয়ে ফোন ধরে মেধা।
–কোথায় তুমি। রিসিপশনের সামনে আসো। আরে, বোনের জন্মদিন ছিলো। ওরা খাওয়ালো। বোন জামাই আছে, মানা করতে পারিনি।
–তোমাকে অল্প কিছু কথা বলি, হিরক।
–অল্প কেনো, সোনা। অনেক বলবে। বিকলেটা নষ্ট করতে চাই না। চলে আসো। আচ্ছা, তুমি কোথায় বলো। আমি আসছি।
–বাসায়।
–বাসায় চলে গেছো? কেনো?
–আমি তোমার সাথে সম্পর্ক রাখব না হিরক।
–ইমশোনাল হয়ো না মেধা। ঠিকাছে, রেখো না। আজকে শুধু আসো।

হিরক জানে, মেধা একবার আসলেই হবে। ওকে আপন করে কাছে টানলে, হিরককে ফেরানো অসম্ভব।
–আর কখনো আসবো না হিরক। কোন দিন না। তুমিও আমাকে ফোন করবে না ।
–মেধা, আমার ভুল হয়েছে। সইকে আমি ভালোবাসি না। তুমি যা দেখেছো সব সাজানো নাটক। আম্মা ছিলো, সবার সামনে অভিনয় করতে হয়। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না মেধা।
–নাটক তোমার করতে হবে না হিরক। তোমার ভুল হয়েছে। শোধরাও। আমারো ভুল হয়েছে৷ তোমাকে আমি নক করেছি। দেখা করেছি। আমাদের ভেতর যতটুকু শারিরীক কাছে আসা হয়েছে, সব ভুল। ওগুলো তুমি মনে করবে না। আমি ও।
–মেধা, আমরা লইয়ারের কাছে যাই। ওনার কথা শুনি। তারপর তুমি বাসায় গিয়ে সিদ্ধান্ত নিও। প্লিজ, আসো। আমি বাইক নিয়ে আসতেছি৷

মেধার উত্তরের অপেক্ষা না করে হিরক ফোন কাটে। এত সহজে তার জাল কেটে মেধা বেরিয়ে যেতে পারে না। সব মেয়ে মেধার মতো আবেগী নয়। অনেক হিসেব কষে রিলেশন করে। প্রেমিকের কাছে চাহিদার অন্ত থাকে না। মেধা একদম অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে জানে। তাই, ওকে সহজে পটানো যায়৷ হিরক বাইক স্টার্ট করে স্পিড তোলে। হোটেলের এখানে তিন রাস্তার মোড়। সিগন্যাল পরেছে। ট্রাফিককে ফাঁকি দিয়ে হিরক বাইক টানে। অন্যদিকে বিশাল গাড়ির গতি রোধ করতে দেরী হয়ে গেছে ততক্ষনে। বাইক সহ রাস্তার ফুটপাতে আছড়ে পরে হিরক। গলগল রক্তের স্রোত ছোটে। লোকজন ছুটে আসার আগে হিরকের শরীর তড়পায়। ওর চোখে বাবুর ছবি ভাসে। এভাবে ও মানুষ চলে যায়!

হিরককে ফোন, ফেসবুক সব কিছু থেকে ব্লক করে মেধা। আশ্চর্য! আসাদকে ও সহ্য করতে পারতো না। এখন তার জন্য বুকের ভেতর টাটাচ্ছে। বাহিরে বেরিয়ে মেধা আকাশের দিকে তাকায়। এত বিশালতা নিয়ে মাথার ওপর কত মানুষের দুঃখ ও সুখ দেখছেন বিধাতা। শ্বাশুড়ী মেধাকে দেখে রেগে যান। মেধা নিঃশব্দে আসাদের মাথার কাছে বসে। ওর শরীর তীব্র জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে চৌচির। মেধা মুখ নামিয়ে নীচু স্বরে আসাদকে ডাকে। রক্তিম চোখ খুলে মেধাকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে আসাদ। মেধা সকালের অপেক্ষা করে। এই রাত কেটে গিয়ে আগামীর ভোর দুজনের জীবনে নতুন কিছু এনে দেবে তার বিশ্বাস। আসাদের মাথা কোলে তুলে মেধা আবারো জানালা দিয়ে আকাশ দেখে। ওখানে হাজার তারা ঝিলমিল করছে।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here