চিরসখা পর্ব -০৯

#চিরসখা(৯)

মেধা বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো দুপুরের আগে। আসাদের মা ‘কোথায় যাও’ জানতে চাইলে বললো, বোনের বাচ্চার জন্মদিন উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা আছে। নিউমার্কেট থেকে বাচ্চার জন্য কাপড়, খেলনা কিনে রুপার বাবুর কথা মনে হলো। এক বাচ্চার জন্য কিনে অন্য বাচ্চার জন্য না নিলে ভালো দেখাবে না। মেধা আন্দাজ করে সাইজ মত প্যান্ট, জুতা নেয়। এদিকে ঘুরতে এলে হিরকের সাথে লাচ্ছি খাওয়া হতো। ঠান্ডার ভেতর লাচ্ছি খাবে না। কফি খাওয়া যায়৷ মেধা তাড়াহুড়োয় বেরোতে গিয়ে হাতে কিছু পরেনি। এক ডজন কাঁচের চুড়ি হাতে গলিয়ে রিনিঝিনি শব্দ শোনে। আসাদ মুক্তোর গয়না পছন্দ করে। হিরক ভালোবাসে হাত ভরা কাঁচের চুড়ি। একদিন মেধার হাতে চুড়ি ওয়ালী ঠেলে চুড়ি ঢোকাতে গিয়ে হাত কেটে ফেলায় হিরক পারে তো সব চুড়ি ভেঙে দেয়। ডিসপেনসারিতে মেধাকে নিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করিয়ে সেই দুপুর বেলা, হিরক সবার সামনে মেধাকে ভাত মেখে খাওয়ালো। মেধার ক্ষুধা পাচ্ছে। কিন্তু, সময় ঠিক রেখে ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে হবে। মেধা রিকশা নেয়। হিরক মেসেজ করেছে, ‘ক্যাফেটেরিয়ায় সব টেবিল ভর্তি। মেধা যেন ওদের পুরনো খাওয়ার হোটেলে চলে আসে।’ মেসেজ দেখে মুছে ফেলে মেধা। আজকের পর হিরকের নাম্বার ব্লক করে দেবে। কোন সম্পর্ক রাখবে না। ফেসবুক থেকে ও সরাবে। আসাদের সাথে এখন যেমন চলছে, মেধা ভালো থাকার চেষ্টা করবে।

বিশ্রী যানজট ঠেলে মেধা যখন পৌছালো তখন হিরকের মেজাজের বারোটা বেজেছে। মেধার জন্য দুপুরে হিরক না খেয়ে অফিস থেকে বেরিয়ছে। দূর থেকে হিরককে দেখে মেধা জমে গেলো। হিরকের মুখটা এত শুকিয়ে গেছে কেনো। মেধার অস্থির লাগে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দেয়। মেধার কেয়ারিং আচরণ দেখে হিরক তার বিরক্তি চেপে ফেলে। ভালো লাগা নিয়ে মেধাকে আপাদমস্তক দেখতে থাকে। প্রেমিকের চোখে প্রেমিকার প্রতি জেগে ওঠা মুগ্ধতা নজর এড়ায় না মেধার। একটু শীত শীত লাগছে। হিরক ওর ব্লেজার মেধার গায়ে জড়িয়ে দেবার সময় ঠোঁট দিয়ে মেধার গালে হালকা স্পর্শ করে। এবার খুব কেঁপে ওঠে মেধা। তখনি শীতের হাওয়া বইছে। হিরক বোঝে না, মেধা কেন কাঁপলো। ঠান্ডায় নাকি তার ছোঁয়ায়। তবে, ভালো লাগে। অনুভূতিরা মরে যায়নি তাহলে।

মিষ্টি গোলাপী রঙের ভেতর সাদা সুতার জামদানী কাজ করা শাড়ি পরেছে মেধা। চুল ছেড়ে হালকা লিপস্টিক, চোখের ওপর আইলাইনার দিয়েছে। হাতে কাঁচের চুড়ি। হিরকের মনে হলো, ওরা আগের দিনগুলোয় ফিরেছে। মেধা ওর অফিস শেষে হিরকের সাথে দেখা করতে এসেছে। এই মেধা তার খুব পরিচিত আপনজন। হিরকের হার্টবিট বাড়ে। কাপলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। মেধা জেনেবুঝে এমন সাজলো, তার জন্য।
–এখানে খাবে।
–অল্প, ক্ষুধা মরে গেছে।
–এক প্লেট চাওমিন নেই, সাথে এগ রোল।
–পুরনো সব বাদ দিয়ে নতুন অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়েছি। তুমি চাওমিন খাও৷ আমি ভাত খাবো।
হিরক খাবারের বিল মিটাতে যায়। মেধা হাত ধুতে ওঠে। হাত ধোয়ার বেসিনের পাশে কাঁচের দেয়াল ঘেরা পর্দা টানা দুটো কেবিন। আগে হিরক আর মেধা এখানে বসতো। মেধাকে কেবিনের দিকে আনমনা হয়ে দেখতে দেখে হিরক বোঝে, ও এখনো অতীত রোমন্থন করে। এই বিষয়টা কাজে লাগাতে হবে।
–তোমার সাথে অনেক কথা বলবো।
–কথাই বলতে এসেছি, বলো।
–তুমি কাঁদবে না তো আবার।
মেধা একটু অস্থির হয়ে ওঠে। সে কাঁদবে কি না তার গ্যারান্টি নেই। হিরককে দেখে তার সত্যি কান্না পেয়েছে। ছেলেটা কেমন অসহায়ের মতো বসে ছিলো। তার জন্য এখনো হিরক অপেক্ষা করে ভেবে ভালো লেগেছে।
–অনেক বদলে গেছো।
–মানে।
–তাকাচ্ছো না আমার দিকে।
–কই, দেখছি তো।
— উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছো।
–যা বলবে বলো। আমার তাড়া আছে।
হিরক দেখে মেধার অনামিকায় ভারী স্বর্ণের আংটি।এঙ্গেজমেন্টের হবে হয়তো। বিয়ে শাদী সিরিয়াস ভাবে না নিলে কেউ আংটি পরে থাকে না। তবু, হিরক আশা ছাড়বে না। মেধার চিবুকে ধরে মুখ ঘোরায় হিরক। সাহস করে আচমকা প্রশ্ন করে,
–তুমি স্বামীর সাথে সুখী, মেধা?
–ও আমাকে কেয়ার করে।
–তুমি মন থেকে আমার জায়গায় স্বামীকে বসিয়েছো।
মেধা এবার নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। ধরে রাখা কাঠিন্য ভেঙে কেঁদে ফেলে। হিরক সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। মেধার হাত ধরে কেবিনের ভেতর চলে যায়। হোটেল বয় খাবার দিয়ে গেলে হিরক ভাত মেখে মেধার মুখের সামনে তুলে ধরে। মেধা হাত তুলে ওকে থামায়।
–নাটক করবে না হিরক।
–তোমাকে ভালোবাসাটা যদি নাটক মনে হয়, তাহলে নাটক। মনে করো, তোমাকে খাইয়ে দিলাম, এটা নাটকের অংশ। নায়ক নায়িকাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে।
–আমি উঠব।
–খেয়ে যাও। রাস্তায় মাথা ঘুরে পরবে।
–পরবো না।
–তোমার হিমোগ্লোবিন কম। ঠিক করে খাও না মনে হয়।
মেধা একটু চেপে বসে। হিরক এত কিছু এখনো মনে রাখে। তাহলে সই কে। কেনো সইকে ওর জীবনে আনলো। বাচ্চার মা বানালো। হিরক আবার মেধার মুখে খাবার দিতে যায়। এবার মেধা না করে না। মেধাকে খাওয়ানোর ফাঁকে হিরক নিজে খাবার চেষ্টা করে। মেধা চামুচে করে এগরোল কেটে হিরককে খাওয়ায়। আগের দিন গুলো যদি ফিরে আসতো। মেধার চোখে আবার পানি জমছে। হিরক এবার মেধার চোখ মুছিয়ে দেয়।
–বারবার গায়ে হাত দিও না।
–তুমি কথাটা বলতে পারলে মেধা।
–সইকে রেখে এসে আমাকে দরদ দেখাচ্ছো। তোমার একটা বাচ্চা আছে।
–ওসব বলতেই হবে।
–আমি ভুলতে পারি না। দেখো, আমাদের দেখা হওয়ার কথা না আমি ওকে জানাতে পারব, না তুমি সইকে বলতে পারবে। আমরা দুজনেই এখন ম্যারিড। আমার মনে হয়, আর কখনো দেখা না হলে ভালো হয়।
–আমাকে ভুলে তুমি থাকতে পারবে না।
–পারব, তুমি বিরক্ত না করলেই পারব।
মেধার হাত মুঠোয় নিলো হিরক। মেধা ছাড়াতে চাইলে হিরক ছাড়লো না। আরো শক্ত করে চেপে ধরে আঙুলে চুমু খেলে। মেধা এবার টেবিল খামচে ধরে।
–নিয়মিত না হোক, মাসে একবার যদি তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, তুমি আসবে না মেধা? আমি বিয়ে করতে চাইনি। আম্মা এভাবে কিরা কসম দিয়ে আল্লাহ খোদা টানলো। সইকে আগে চেইন দিয়ে আশীর্বাদ করে ফেলে ছিলো আম্মা। মফস্বলের দিক, বোঝই তো। একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙলে খুব সমস্যা হয়।
–আমি উঠি, হাতটা ছাড়ো৷
হিরক মেধার হাত ছাড়লো না। বরং উঠে এসে মেধার পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হিরকের খোঁচা খোঁচা দাড়ির আঘাত ওর ভালো লাগে। এই সর্বনাশা ভালো লাগা জাগিয়ে তোলা যাবে না। মেধাকে গালে হাত বোলাতে দেখে হিরক বুঝে ফেলে। এবার মেধার ঘাড়ে গাল ঘষে ওর স্তনে হাত বোলায়। মেধা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, পারে না। আসাদের সাথে শারিরীক মুহূর্ত গুলো মাপা। ওর চাহিদা ঠিক প্রকাশ করতে বাধে। এই আহ্বান উপেক্ষা করতে পারার মানসিক জোর মেধার নেই। হিরকের পুরুষালী ঠোঁটের কাছে সে হার মেনেছে৷ কিছু সময় পর মেধা জোর করে নিজেকে ছাড়ায়। সে কি করছিলো? আসাদের সাথে গতকাল রাতে তার সম্পর্ক হয়েছে। এমন নয় সে শারিরীক ভাবে চাহিদাগ্রস্থ। হিরক তার প্রাক্তন। হিরককে সে ঘৃনা করতে চায়।
–কাছে এসো মেধা।
–সব শেষ করে দিলে। আবারো তুমি আমার সব শেষ করে দিলে।
–কিছু শেষ হয়নি। বরং একটা নতুন পথ চলা শুরু হলো। তোমার আমার সম্পর্কের ভেতর দুটো ভুল মানুষ চলে এসেছে মেধা। এদের তুমি তাড়াতে পারবে না। এরা নিজ থেকে বিদেয় হবে না। তুমি আমি এমন করে নিজেদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখব মেধা৷ প্রেম পবিত্র, ভালোবাসা অবিনশ্বর। আমাদের এই ভালোবাসাকে তুমি নষ্ট করো না মেধা।
মেধা প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। ও আবার কাঁদতে শুরু করেছে।
–আমার তোমার যৌথ ইচ্ছায় যা হবার হয়েছে৷ আমাদের কোন পাপ হয়নি মেধা।
–তুমি আবার আমাকে ঠকাবে। সব শেষ করে দেবে। সংসারটা করতে দাও আমাকে৷ নতুন করে পিছুটান জাগিও না।
হিরক কিছু না বলে চুপ করে রইলো। মেধার জন্য কেনা শাড়ি হাতে দিয়ে কপালে চুমু খায়। একটা সেল্ফি সহ মেধার কয়েকটা সিঙ্গেল ছবি তোলে হিরক। মেধার চোখ মুছিয়ে ওর পাশে বসে মাথায় হাত বোলায়। মেধার মনে হয়, হিরক একটু ও বদলে যায়নি। বাড়ি ফেরার পুরোটা পথ মেধা কাঁদলো। ঘরে ঢোকার সময় ওর ফুলে যাওয়া নাক মুখ দেখে আসাদের মা বিশ্রী ভাবে নাক সিঁটকালেন। ‘ধামা মেয়ে, মায়ের বাসায় গিয়ে ঝগড়াঝাটি করে চেহারা বানিয়ে ফিরেছে। আসাদের কপালে শেষমেষ শনি জুটলো ‘।

অনেকটা সময় চলে গেলে মেধা অন্ধকার ঘরে বাতি জ্বালায়। হিরকের দেয়া শাড়ি আলমারিতে তোলে। গোসল শেষে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ায়। এই ঠোঁট এই স্তন, এই শরীরে হিরকের স্পর্শ মাখা ছিলো। একটানা জলের ধারায় তারা ধুয়ে মুছে চলে গেছে নর্দমায়। মেধাও ঐ নর্দমার গলিত বর্জ্য, কীট সদৃশ প্রাণী। বিবাহিত নারী হয়ে অন্য আরেক বিবাহিত পুরুষের সাথে যে মহিলা দেখা করে নিজের শরীর বিলাতে পারে, সে কীটের ও অধম। সে বে শ্যা। মেধা হিরকের নম্বর মুছে দেয়। ব্লকলিস্টেড করলেও ফোন আসবে৷ আসাদ জানতে পারলে কি হবে? মেধা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। আয়নার সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকে মেধা। প্রতিবিম্বের মানুষটাকে ওর জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

ফুরফুরে মেজাজে হিরক বাসায় ঢুকলো। বাবু প্রামে খেলছে। বাসার নিচে খেলনা বিক্রি হচ্ছে দেখে বাবুর জন্য বল এনেছে হিরক। সই খুশী হবে দেখলে। উঁকি দিয়ে দেখলো, সই চা বানাচ্ছে। গোসলে যাবার আগে সরিষার তেল গরম করতে রান্নাঘরে ঢুকলো হিরক। সই এখনো নাস্তা বানাচ্ছে। ফুলকপির পাকোড়া হিরক পছন্দ করে। কড়াইয়ে এক গাদা তেল দেখে মেজাজ গরম হলো হিরকের।
–বাপের হোটেল এটা, গাদা গাদা তেল নষ্ট করো।
–ভাজা শেষে তেল ছেঁকে রাখবো। তোমার জন্য বানালাম।
–বানাবার আগে জেনে নিবে। রুমে আসো, ঘাড় ম্যাসাজ করে দাও।
সই চুলো নিভিয়ে দেয়। ওর মন খারাপ হয়ে গেছে। হিরক খাবে না, কথাটা ভালো করে বলা যেতো। বাপের খোঁটা দিলো কেন। হিরক শুয়ে শুয়ে মেধার ছবি দেখ ছিলো। সই ঢোকায় রেগে গেলো।
–ঠাস ঠাস আসো যাও। হিটার চালিয়ে রেখেছি।
–তুমি ডাকলে না!
–ডেকেছি কাজে। রঙ করতে না।
–এভাবে কথা বলছো কেনো।
–ঘাড় খুব ব্যাথা করছে, সরি। ম্যাসাজ করো। দরজা ভিড়াও।
সই হেসে ফেলে। কোথাও ব্যাথা করলে হিরক একদম ছোট বাচ্চা হয়ে যায়। হালকা গরম সরিষার তেল স্বামীর ঘাড়ে আলতো হাতে ঘষে লাগায় সই৷ হিরকের শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। এত ঠান্ডা হাত পা ব্যাথা করবেই৷ সইয়ের ম্যাসাজে হিরকের ঘুম ঘুম লাগে। একসময় ঘুমিয়ে পরে হিরক। সই ম্যাসাজ বন্ধ করে হিরকের গায়ে কাঁথা দেয়। ওদের ভালো রাখতে হিরক কত খাটুনি খাটে। ইশ, ও যদি ঘরের খরচে কিছু হলেও দিতে পারতো। আগামীকাল ননদ সহ শাশুড়ী আসবেন। মন দিয়ে ওনার সেবা করবে সই। হিরকের মন ভালো হবে। শাশুড়ী এলে ওনার মাধ্যমে হিরকের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করবে এবার। মনে মনে জোরালো কিছু যুক্তি ঠিক করে। সন্তানের জন্য একটা নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ গড়তে দু’জনের রোজগার দরকার। আনমনে হিরকের গায়ে হাত বোলায় সই। হিরক বদরাগী হলেও স্বামীকে ও খুব ভালোবাসে। এমন স্বামী সবার কপালে জোটে না। শত ঝড় ঝাপটা আসুক, হিরককে সই কখনো ছেড়ে যাবে না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here