ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১৩

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১৩

পাক্কা ৬ ঘন্টা ধরে আমি আর বাসার কাজের জন্যে রাখা খালা মিলে ভাইয়ার ঘর দুইটা পরিস্কার করছি। তার পরেও একটা ভোটকা গন্ধ নাকে লাগছে। আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন এই ছেলে এইটার ভেতর কিভাবে ছিলো এতোদিন!!! নাহ এতো বছর!!

বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমের প্রতিটা জিনিস নতুন করে সাজিয়েছি। সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে তো। ইউটিউব দেখে দেখে অনেক প্ল্যান মাথায় কিলবিল করছে। কিন্তু রুম পরিস্কার করতে গিয়ে সব ভুলে গিয়েছি।

দুপুরে খাটাইশ সাব্বির বাদে সবাই মিলে একসাথে খেয়েছি। কতদিন পর!! আব্বুর মুখ থেকে হাসি যাচ্ছেই না!! আম্মু শুধু খাওয়া বাদ দিয়ে একটু পর পর আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন। শেষ মেশ ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলছে, মা আমরা ওয়েট করছি তুমি একেবারে সব কান্না শেষ করো। খাওয়ার সময় তোমার নাকের ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ ভালো লাগছে না।

“মেহের”…ভাইয়ার চিৎকার শুনে লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে ভাইয়ার রুমে গেলাম।
-জি ভাইয়া কিছু বলবা?
খুব কনফিডেনটলি উত্তর দেয়ার ট্রাই করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো মেও মেও করে!!
রাগের জন্যে ভাইয়া কথা বলতেসে না। ইশারা দিয়ে মেহনাজ আপুর ছবি গুলো কোথায় জিজ্ঞেস করলো।
এই প্রশ্নটার জন্যেই ওয়েট করছিলাম।
-ছবি দিয়ে কি হবে?
-ছবি দিয়ে কি হবে মানে? তুই আমার পারমিশন ছাড়া সরিয়েছিস কেনো?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললাম, সারা রুমে আপুর ছবি দিয়ে তুমি কাকে প্রুফ করতে চাও যে কতোটা ভালোবাসো তুমি আপুকে? বাইরের টানানো ছবি দিয়ে কি আসে যায়। এসব দিয়ে বাইরের মানুষকে বোঝানোর কি খুব দরকার বলো তো ভাইয়া। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষটা এমন এক জায়গায় থাকে যেখানে মানুষ কেনো দুনিয়ার কোনো কিছু তার প্রতি আমার ভালোবাসাকে ছুতেও পারবে না । যেখানে থাকার দরকার সেখানে থাকলেই তো হলো। যখন খুব বেশি মনে পরবে অন্ধকার রাতে বেলকনিতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে তাকে ফিল করার চেষ্টা করবে, দেখবে সে তোমার সামনে এই চার ফ্রেমের ছবির থেকেও জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। ভালোবাসার পূর্ণতা না পেলেই কি ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়? এতো সস্তা? ভালোবাসি এটা মুখেও বলতে হয়না, কানেও শুনতে হয় না, একজনের মনের টান আরেকজন ঠিকই বুঝতে পারে।

ভাইয়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছু না বলে রুমের বাইরে চলে এসে আগে বুকের মধ্যে একটা ফু দিলাম। আল্লাহ!!! যে ভয় পাইছিলাম। আমি তো ভালোই অভিনয় করতে পারি। সাব্বির ডিভোর্স দেয়ার পরে অভিনয়ে নাম লিখানোর আইডিয়াটা খারাপ না।

রুমের বেলকনিতে এসে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কাউন্সিলিং সাইকোলজিতে মাস্টার্স করা ফ্রেন্ডকে ফোন দিলাম।
-দোস্ত আর এমন কিছু করতে বলিস না প্লিজ!! আর একটুর জন্যে কান্নাকাটি শুরু করে দেই নাই।
উৎস হাসতে হাসতে বললো, বান্ধবি এতোই সহজ যদি হতো তাহলে কি আর দুনিয়াতে মানুষ ডিপ্রেশনে সুইসাইড করতো? ভাইয়া যে আরও খারাপ কিছু করে নাই সেটাই বেশি।
-হুম। কিন্তু দোস্ত এইরকম ভয়াবহ কিছু করতে বলিস না প্লিজ। এইরকম বেশি ব্রিলিয়ান্ট গুলারই এইরকম হয়।
-তুই একবার ভাব যদি উনি পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করতো তাহলে কতদূর যেতে পারতো?? আমারা বুয়েটে পরিক্ষা দেয়ার চান্স পাই না আর এই লোক বুয়েটের এডমিশন টেষ্টে ফার্স্ট হয়েও পড়লো না।
-সবই প্রেম পিরিতির দোষ। আচ্ছা এরপর কি করবো বল।
আরও কিছু ইনস্ট্রাকশন নিয়ে ফোন রাখলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে ভিষণ চমকে উঠলাম!! সাব্বির কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি!! ভাগ্যিস রিশাদ ভাইয়া আসে নাই।
-কি ডিভোর্সের পরে কিভাবে সংসার করবি তার প্ল্যান করতেছিস?
কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে আবার মুখোমুখি দাড় করালো আমাকে। হাতে খুব জোড়ে মোচড় দিলো!! ব্যথায় চোখে পানি চলে আসছে।
কোন সাউন্ড না করে ব্যথা দাতে দাত চেপে সহ্য করলাম।
-খুব ভাব বাড়ছে তোর তাই না? কথার উত্তর দিস না কেনো? এমন বেইজ্জতি করবো জীবনে কারোর সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারবি না।
-আচ্ছা বলে হাত ছাড়িয়ে চলে গেলাম রুম থেকে।

হাত বরফ দিয়ে ঘসছি। রক্ত জমে কালচে লাল হয়ে গিয়েছে। সাব্বির জানে না যে কাউকে উত্তর দেয়ার জন্যে সবসময় মুখে দিতে হয় না। কোন কিছু না বলে চুপ করে ইগ্নোর করাটা যে কতো বড় অসস্তির ব্যাপার সেটা মনে করে মনে মনে হাসছি।
ইশ আমার লাইফটাও যদি কেউ এসে রিশাদ ভাইয়ার মতো চ্যাঞ্জ করে দিত।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
-কি হইছে মেহের?
আম্মুর প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম। চিন্তা করতে করতে খেয়ালই ছিলো না আম্মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
-কিছু না আম্মা। গরম পানি পরেছে হাতে। কফি বানাইতে গিয়েছিলাম।
-ইশ দেখছো!! একদম তো কালচে হয়ে গিয়েছে। আয় আমার সাথে বলতে বলতে আমাদের রুমে আমাকে টেনে নিয়ে এলো।
আম্মুর মতো ভালোবাসা পেয়ে কান্না আসতেসে খুব। দাত মুখ খিচে খুব কস্টে চেপে রাখছি।

-সাব্বির দেখতো ওর হাতটা। গরম পানি পড়ে কি অবস্থা হয়েছে। খালি সারাদিন এটা ওটা করে বেরায়। একটুও বসে থাকতে পারে না মেয়েটা।

সাব্বির আমার হাতটা দেখে কিছুই বললো না।
কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর চোখে মুখে আমার থেকে বেশি কস্টের ছাপ আর আকুলতা।
হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগানোর সময় এমন আলতো করে টাচ করছে যেনো ব্যথাটা সেই পাচ্ছে।
হ্লারপুত ব্যথা দেয়ার সময় মনে ছিলো না তোর? মনে মনে আরও কয়েকটা কঠিন গালি দিলাম।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও মনে হলো এরকম সাইলেন্ট ভালোবাসার স্ফুরণের জন্যে আমি হাতে আরও ব্যথা পেতে রাজি আছি!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here