ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ২৩

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব-২৩

সাব্বিরের সাথে যেদিন আমার বিয়ে হয়েছিলো সেদিনও এতোটা কস্ট পাইনি যতটা আজকে পেয়েছি।
আপনজনদের থেকে সব কিছু সহ্য করা যায় শুধুমাত্র বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া।
সাব্বির এটা করতে পারলো!!!
ফয়সাল যদি পারে তাহলে সাব্বিরের আর কি দোষ।
আনমনেই হেসে উঠলাম আমি।
ম্যাম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন!!!
-তুমি ঠিক আছো মেহের?
-জি ম্যাম। আমি ঠিক না থাকলে কে আর থাকবে বলেন। ম্যাম আমি কি দেখতে সুন্দর?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ম্যাম আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। বোঝার চেষ্টা করলেন যে আমি সিরিয়াসলি এই প্রশ্নটা করেছি না।
“ম্যাম বলেন না প্লিজ”??
-আমাদের সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তুমি খুব সুন্দরী সেটা বলা যাবে না যেহেতু তুমি ফর্সা নও, মোটামুটি দেখতে। কিন্তু সমাজের মানুষ যেটা কখনও বলবে না সেটা হলো তোমার স্নিগ্ধতা।
-এ্যাঁ….। এমন কথা কখনোও শুনিনাই ম্যাম।
-এসব কথা বয়ফ্রেন্ড ছাড়া কেউ বলবেও না তোমাকে। কেনো ফয়সাল তোমাকে এই টাইপ কিছু বলেনি কখনোও?
– স্নিগ্ধতা নিয়ে তো কিছু বলেনি।
-আরে গাধি, আমিতো তোমাকে বিষয়টা ক্লিয়ার করতে চেয়েছি।
শোনো, তোমার ফেসের দিকে তাকালে সবার আগে কি দৃষ্টিগোচর হয় জানো?
তোমার থুতনির খাজ। এইরকম খুব রেয়ার। তোমার চোখে অনেক মায়া আছে। সবথেকে বড় কথা তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে। এর জন্যেই তো তোমাকে আমার দেবরের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো ফয়সালের জন্যে তখন রাজি হলে না।
-ইশ, ঠিকই বলছিলেন ম্যাম। বিয়েটা করে ফেললেই ভালো ছিলো। তাইলে এই ফয়সাল আর সাব্বির, কোনোটারই ঝামেলা থাকতো না।
হঠাৎ করেই মনে হলো ম্যামের রুমের দরজার পর্দাটা নড়ে ওঠলো।
ভয় হলো খুব। পাশেই তো ফয়সালের রুম।
ম্যাম আমি তাহলে এখন যাই?
-ঠিক আছে। ভালো থেকো আর কালকে সব নিয়ে আব এসো।

ফোনের দিকে তাকিয়ে ম্যামের রুম থেকে বের হয়ে দুই কদম এগুতেই কেউ হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলো!!
টাল সামলাতে না পেরে কারো গায়ের উপর পরলাম।
চেহারা না দেখেও শুধু স্মেল নিয়েও বলতে পারি কে এটা!!
আগে এই স্মেলটার কারণে বার বার আমি ওর সাথে গা ঘেঁষে বসতে চাইতাম।
কি করবো বুঝে ওঠার আগেই জোড় করে ওর চেয়ারে বসিয়ে দিলো। তারপর ওর রুমের দরজাটা আস্তে করে আটকে দিয়ে আর একটা চেয়ার টেনে আমার সামনে বসলো।
এই দিনটার স্বপ্ন কতো যে দেখেছিলাম!!!
আমি হুট হাট ওর চ্যাম্বারে এসে ওর একদম সামনে টেবিলে বসে রোমান্স করবো!!
আজকে সব সুযোগই আছে শুধু কাছের মানুষ দূরে চলে গিয়েছে। যে দুরত্ব মাপার কোনো স্কেল নেই।

আমার দুহাত শক্ত করে ধরে প্রায় ফিসফিস করে ফয়সাল বলতে শুরু করলো।
-সাব্বিরের সাথে কথা হয়েছে আমার। তোমাদের ডিভোর্সের পর আমি আর তুমি বিয়ে করবো। আমি জানি তুমি এখনো ভার্জিন। সো কোনো সমস্যা হবে না।
-আমি ভার্জিন সে জন্যেই কোনো সমস্যা নেই? যদি
ভার্জিন না হতাম তাহলে কি করতে? আর তুমি এমন ফিসফিস করে কেনো কথা বলছো?
-ফালতু কথা বলবে না মেহের। সাব্বির আমাকে বলেছে তুমি ভার্জিন। সে তোমার সাথে কিছু করেনি। আর খুব তারাতাড়ি তোমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর তুমি কোথায় যাওয়ার কথা বলছো?
মনে মনে যে ভয়টা পেয়েছিলাম সেটাই হয়েছে।
-লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের কথা শুনতে লজ্জা করে না তোমার? এই হাত এমন করে শক্ত করে যদি বিয়ের পরের দিনও ধরতে আমি তোমাকে মাফ করে দিতাম।
কিন্তু তুমি করলে? ফোনটাও অফ করে রেখেছিলে।
তোমার বাসার মানুষগুলো এরকম কেনো? আমাকে থাকতে দিলে কি হতো?
-এক জিনিস নিয়ে বার বার কথা বলবে না। যেটা চলে গেছে সেটা নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না। এখন নতুন করে জীবন শুরু করবো সেটাই ফাইনাল।
– যতক্ষন তোমার সাথে রিলেশন ছিলো, ততোক্ষন তোমার কথা শুনতে আমি বাধ্য ছিলাম, কিন্তু এখন না। এখন আর একটা উল্টো পালটা কথা বললে আমি চিৎকার করবো।
-মেহের প্লিজ!!! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আর কখনো এমন হবে না।
-আবার হবে না মানে কি? তোমার সাথে আমার কথা বলতেও আমার ঘৃণা করে। কেনো ঘৃনা করি জানতে চাও না তুমি?
কিছুক্ষণের জন্য ফয়সাল স্তব্ধ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

-সাব্বিরের সাথে কতোদিনের খাতির তোমার? ও যে তোমার আত্নীয় হয় জানতাম না তো!!!
কি ডিল হয়েছিলো তোমাদের? গার্লফ্রেন্ড আর ভার্সিটির টিচার এক্সচেঞ্জ?
হেসে জিজ্ঞেস করলাম, সাব্বির আমার সাথে কিছু করেনি তাই না?
হিজাব টা তুলে ঘাড়ের দাগ গুলো দেখিয়ে বললাম, তাহলে আমার এইগুলো কি!!!
আস্তে করে আমার হাতটা ও ছেড়ে দিলো।
সবশেষ ওর দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করলাম আমি।
এর পরের কথাগুলো ওর কি হবে সেটাও আমি জানি।
রিলেশনে থাকার সময় ওর সবথেকে বড় প্রব্লেম ছিলো কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে আজেবাজে সন্দেহ করতো।
এখনও মনে আছে, আমাদের থার্ড এনিভার্সারির দিন ও খুব ঠান্ডা মাথায় বলেছিলো আমি যে টিউশন করিয়ে ওকে টাকা দিতাম ঐ স্টুডেন্টের বাবার সাথে আমার নাকি কিছু আছে!!!!
কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ হয়তো এমন বলতে পারে না।

রাগের জন্যে ফয়সালের কপালের দুপাশের শিরা ঢিপঢিপ করছে।
-তোর তো আমার সাথে থাকার সময়ই অন্যজনের সাথে রিলেশন ছিলো। এ আর নতুন কি!!! এমনি এমনি তো আর ছাড়িনি তোকে। ঐ ম্যামের সাথে তোর কিসের এতো খাতির আমি বুঝি না মনে করিস????
বেশি ভালোবাসতাম তাই ভাবছিলাম যা হইছে হোক, আবার সব নতুন করে শুরু করবো।
কিন্তু তুই?
আমি বাদ দিয়ে দুনিয়ার সব মানুষের সাথে শুয়ে বেরাইছস।
আরও কতো গালি!!!!!
চুপচাপ কিছুক্ষন শোনার পর ও থামতেই বললাম
-শেষ হয়েছে বলা? নাকি আরও বাকি আছে?
-কি ভাবছিস, এতো সহজে সব পেয়ে যাবি?
হুমহ, সাব্বির তোকে সত্যিই ডিভোর্স দিবে।
-দিলে দিক, তাতে তোমার কি? আমার যা খুশি তাই করবো।
বলেই ওর পাশ কেটে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।
পিছন থেকে শুনতে পেলাম
“কোন নাগরের সাথে যে কই যাবি, দাড়া সাব্বিরকে বলতেছি আমি।”
শুনে শুধু একটা মুচকি হাসি দিলাম।

রাতে ম্যামকে একটা কল দিলাম ।
-ম্যাম একটা দরকার ছিলো। আপনি কি ফ্রী আছেন?
-হুম বলো।
-ম্যাম কুয়ালালামপুর থেকে সিডনি কি ডিরেক্ট ফ্লাইট পাওয়া যাবে?
-কুয়ালালামপুর থেকে কেনো?
-ম্যাম আসলে আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো আমি আমার আব্বু আম্মুকে নিয়ে দেশের বাইরে বেরাতে যাবো। এখন নিজের আব্বু আম্মু তো নাই, কিন্তু আমার শশুর শাশুড়ী আমাকে বাবা মায়ের মতোই আদর করে। তাই উনাদের নিয়ে একটু অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে মালয়শিয়াতে যেতে চাচ্ছিলাম আর কি।
দেন ওখান থেকে সিডনি ফ্লাইটে চলে যাবো।
-হুম বুঝলাম। ব্যাবস্থা করা যাবে কিন্তু তাদের তো কিছু ডকুমেন্টস লাগবে।
-ম্যাম তাহলে আমি এখন রাতের বাসে চলে যাই কালকে রাতে সব নিয়ে ব্যাক করবো?
-ঠিক আছে। সাবধানে যেও, তোমার সময় খুব কম না হলে বলতাম দিনে যাও।
-ইটস অকে ম্যাম।
ফোন রেখে তারাতাড়ি রেডি হয়ে বের হলাম।

সকাল ৯টায় দরজা খুলে ফুপি আমাকে দেখে সেকি খুশি!!
-হুম বুঝি বুঝি সব বুঝি। বুড়ো বয়সে এইসব প্রেম দেখা লাগবে এখন!!
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম ফুপির দিকে।
-কিসের প্রেম??
-কেনো এই আজকে সাব্বিরের জন্মদিন আর তুই কিছু না জানিয়ে চলে আসছিস সারপ্রাইজ দিতে!!
একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললাম ঠিকই বলছো। তোমাদের জন্যেও একটা সারপ্রাইজ আছে!!
-কি আমরা দাদাদাদি হবো!!
-ধুর, বলার মুডটাই দিলা শেষ করে
বলেই উপরে চলে গেলাম।
কিন্তু সাব্বিরতো নেই রুমে। কই গেলো এই টাইমে!!
বিছানায় একটা কাগজ দেখতে পেয়ে হাতে নিলাম।

আমাদের ডিভোর্স প্যাপার!!!!!
জন্মদিনে আমাকেই উল্টো গিফট দিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here