তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব -১৭-১৯

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৭

স্যার বারো বছর ধরে আপনি যাদের খুঁজছেন তাদের একজনের খোঁজ পেয়েছি স্যার।

ইয়াদ অবাক হয়ে বললো, Whattt,,,,?

ইয়েস স্যার সে এখন তার গ্রামের বাড়িতে আছে আর আপনি এদেশ থেকে যাওয়ার পরপরই উনি ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলেন। কারণ উনাকেও খুনের চেষ্টা করা হয়েছিলো।

ইয়াদ বিষ্ময়কর কণ্ঠে বললো, বাট হুয়াই ? উনি আমাকে সব জানিয়ে দিয়েছে সেটা তো আমি আর উনি ছাড়া কেউ জানতো না তাহলে কেনো ? আর এদের আচরণেও তো মনে হয় না এরা জানে যে আমি সব সত্যি জেনে গেছি।

জাম্বী অস্থির গলায় বলে, না না স্যার সেজন্য খুন করতে চায়নি। এরা এখনো জানে না আপনি সব জেনে গেছেন। এরা উনাকে খুন করতে চেয়েছিলো যাতে ফিউচারে উনি আপনাকে কিছু বলতে না পারেন।

ইয়াদ গম্ভীর গলায় বললো, ঠিক আছে তুমি সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করো বাট খেয়াল রেখো তুমি আর আমি ছাড়া এই বিষয়ে যেনো কেউ কিছু জানতে না পারে। একবার উনাকে হাতে পেলে বাকি দুজনের হদিসও পাওয়া যাবে।

জাম্বী বললো, ঠিক আছে স্যার।

ফোন রেখে ইয়াদ চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো। আজ বারোটা বছর ধরে তিনজন মানুষকে হন্নে হয়ে খুঁজছে ইয়াদ। একবার তাদের পেয়ে গেলে তার অতীত একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে তার কাছে। মাথায় আঘাত আর এক বছর কোমায় থাকার জন্য তার মন থেকে মুছে গেছে অনেক স্মৃতি। স্বপ্নটাও কখনো স্পষ্ট হয় না চোখের সামনে। এই তিনজনই পারবে তার জীবনের সব রহস্য উদঘাটন করতে। ইয়াদ কল করে রনিতকে কেবিনে আসতে বললো।

আজকের রুটিন কী কী রনিত ?

স্যার আজ তেমন কেনো কাজ নেই যা কাজ সব অফিসের মধ্যেই তবে একবার কনস্ট্রাকশন সাইটে যেতে হবে সব ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা দেখতে।

ইয়াদ বললো, রনিত আমি একটা দরকারী কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি আজ এদিকটা সামলে নাও।

রনিত একটু চিন্তা করে বললো, কিন্তু স্যার অফিসের কোনো কাজ তো নেই ঢাকার বাইরে, যেটা আছে সেটা আরো দশদিন পরে।

ইয়াদ রাগী গলায় বললো, রনিত এখন কী আমার সব কাজের কৈফত তোমাকে দিতে হবে ?

রনিত দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে বললো, সরি স্যার ভুল হয়ে গেছে।

ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার মুখ দিয়ে ঠিক কথা আবার কখন বের হয়। আমি আগামীকাল ঠিক সময়ে অফিস চলে আসবো তুমি এদিকটা দেখো আর হ্যাঁ আমার কথা মিস্টার ডি কে (ইয়াসির) জানতে চাইলে বলবে অফিসের কাজে বাইরে গেছে।

রনিত মাথা নাড়িয়ে বললো, ঠিক আছে স্যার।

ইয়াদ চেয়ারের পেছন থেকে ব্লেজারটা নিয়ে গায়ে পড়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলো। রাস্তায় জাম্বী দাঁড়িয়ে ছিলো তাকেও তুলে নিলো।

ঠিকানা খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না ?

জাম্বী হেঁসে বললো, স্যার আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন জাম্বী কখনো হাফ কাজ করে না। ওখানে আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি আমরা গেলেই বাড়ি দেখিয়ে দেবে।

জাম্বী ড্রাইভ করছে আর ইয়াদ পাশে বসে আছে চিন্তা করছে সামনে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো ময়মনসিংহ শহরে পৌঁছাতে। সেখান থেকে আরো অনেক ভিতরে যেতে হবে। শহরে পৌঁছাতেই তাদের সাথে আরো একটা গাড়ি যোগ হলো। ইয়াদের গাড়ি সেই গাড়িটাকে ফলো করছে কেবল। কিছুক্ষণের মধ্যে শহর ছেড়ে সবুজে ঘেরা গ্রামে প্রবেশ করলো ইয়াদের গাড়ি দুপাশে সবুজ ফসলের ক্ষেত আর মাঝে পিচঢালা রাস্তা। অনেকটা সময় পর একটা ছোট বাজারের মতো জায়গায় গাড়ি এসে থামলে সবাই নেমে পরে। সামনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে হবে তাই সবাই সেদিকে পা বাড়ালো। প্রায় দশ মিনিট হাঁটতেই পুরনো একটা দুতলা বাড়ির সামনে এসে থামলো ইয়াদ। বাড়িটার রঙ উঠে গেছে মাঝে মাঝে শেওলা পরেছে। পশ্চিম আকাশে তখন সূর্যটা হেলে পড়েছে তাই বাড়িটাকে অনেকটা ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। বাড়িটা দেখে ইয়াদ ভ্রু কুঁচকালো এই বাড়িতে কেউ থাকে বলে ইয়াদের মনে হচ্ছে না। তবে কী ভুল জায়গায় এসে পরেছে সেটাই চিন্তা করতে লাগলো।

২১.
ড্রয়িংরুমের ঘড়ির টুং শব্দ বলে দিচ্ছে বারোটা বেজে গেছে। ইমা না শান্তিতে বসতে পারছে আর না শুতে পারছে। এতো রাত হয়ে গেছে ইয়াদের খোঁজ নেই কোনো। চিন্তায় ইমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইয়ানা কল দিয়েছিলো ইয়াদের ফোন বন্ধ, রনিতের ফোন বিজি বলছে এক ঘন্টা আগে থেকে, অফিসে কল দিয়ে জানতে পারে ইয়াদ দুপুরেই বের হয়ে গেছে অফিস থেকে তারপর আর যায়নি অফিসে। ফার্মহাউসের কেয়ারটেকার জানিয়েছে ইয়াদ সেখানে যায়নি মুলত সেই জন্য ইমার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে কোথায় গেলো ইয়াদ ? এমনি সারাদিন ইমা ইয়াদের অতীত জানার ক্লো খুজতে ব্যস্ত ছিলো এখন আবার ইয়াদের চিন্তায় মাথা ব্যাথা শুধু হয়ে গেছে ইমার। একটু আগে ইয়ানা নিজের রুমে চলে গেছে ইমারকে চিন্তা না করতে বলে। ইয়ানা নিজের রুমে বসে আছে তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। আজ ভার্সিটিতে আরমানকে দেখে শুধু ইয়ানা নয় পুরো ভার্সিটি অবাক হয়ে গেছে। কোনো ক্লাসে কাউকে কিছু বলেনি চুপচাপ ক্লাস করিয়ে বের হয়ে গেছে। আজ যতবার আরমানকে দেখেছে ততবারই ইয়ানার কাছে তাকে বিষন্ন লেগেছে। আরমান হয়তো সত্যি ইমাকে ভালোবাসে এমন ভাবনায় ইয়ানার অপরাধবোধ হচ্ছে কেনো জোর করলো ইয়াদকে বিয়ে করার জন্য। ইয়ানার আরমানের জন্য খারাপ লাগছে হয়তো সব সত্যি জানলে খারাপ লাগবে না বরং ঘৃণা করবে আরমানকে।

একটা বাজতে আর দশ মিনিট হয়েছে ঘড়িতে, ইয়াদ গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকলো। নিজেকে আজ অভাগা মনে হচ্ছে ইয়াদের কাছে, রাগের থেকে অনেক বেশি হচ্ছে চাপা কষ্ট। তার জীবনেই এসব কেনো হলো ? তার জীবনটা হতে পারতো বাকি সবার মতো হাসিখুশি আর স্বাভাবিক। হ্যা হতে পারতো যদি তার বাবা মানুষ চিনতে ভুল না করতো তাহলে সব স্বাভাবিক হতো। ইয়াদ নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে মেইন ডোরের তালা খুলে ভেতরে গিয়ে মেইন ডোর লক করে ঘুরতেই ডাইনিং টেবিলে ইমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো।

কপাল কুঁচকে নিজে নিজেই বললো, এই মেয়ের কী ঘুমানোর জায়গার অভাব পরেছে যে ডাইনিং টেবিলে ঘুমিয়ে আছে ?

ইয়াদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মেয়েটার কাছে টেবিলে দু’হাতে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা টানা, মুখের উপর ছোট ছোট চুলগুলো লেপ্টে আছে। নিষ্পাপ মুখটা দেখে মনে হচ্ছে শত মায়া ভড় করেছে ঐ মুখে। ইয়াদ ডাকতে গিয়ে থেমে গেলো তাকিয়ে থাকলো মুখটার দিকে।

ইয়াদ আনমনে বললো, জানি না কেনো তোমাকে বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। তোমার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তুমি কখনোই ঐ মহিলার মতো নিকৃষ্ট হতে পারবে না। কিন্তু মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে বারবার মনটা হেরে গিয়ে মস্তিষ্ক জিতে যায়। মস্তিষ্ক বলে দেয় বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট সহ্য করতে পারবি না ইয়াদ। কাউকে বিশ্বাস করিস না, কখনো না।

ইয়াদ না চাইতেও ইমাকে ডাকতে লাগলো। সকালে ইমাকে এখানে ঘুমাতে দেখলে রুবিনা কবির কী ভাববে সেটা মনে করে।

ইয়াদ কঠিন গলায় বললো, এই মেয়ে উঠো, এটা কী ঘুমানোর জায়গা ?

ইয়াদ কয়েকটা ডাক দিলো কিন্তু ইমার কোনো হুঁশ নেই, সে ঘুমে কাদা। ইয়াদ বাধ্য হয়ে ইমার কাঁধে হালকা ধাক্কা দিলো। ইয়াদের হালকা স্পর্শে ইমা ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠলো। ইয়াদের মনেও অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো। এই পর্যন্ত ইয়াদ যতবার ইমাকে স্পর্শ করেছে প্রচন্ড রেগে করেছে এই প্রথম স্বাভাবিক মস্তিষ্কে স্পর্শ করায় হয়তো এমন শিহরণ খেলে গেলো মনে। পরের বার ধাক্কা দিতে ইয়াদের হাত কাঁপছিলো, যেটা ইয়াদের কাছে অদ্ভুত লেগেছে। স্পর্শ করতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিলো ইয়াদ। টেবিলে থাপ্পড় মারলো একটু জোরে। তাতে ইমা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো আর আশেপাশে তাকাতে লাগলো।

ইয়াদকে দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে বললো, আ,,আপনি ?

ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, হ্যাঁ আমি, এটা কী তোমার ঘুমানো জায়গা ? রুমে ঘুমানোর জায়গার অভাব পরেছে ?

ইমা অস্থির গলায় বললো, আ,,আমি ঘুমচ্ছিলাম না আপনার জন্য ওয়েট করতে করতে কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, আমার জন্য ওয়েট করতে কে বলেছে তোমাকে ?

ইয়াদের কথায় ইমা ইতস্তত হয়ে তাকালো ইয়াদের দিকে কিন্তু ইয়াদকে দেখে তার খারাপ লাগতে শুরু করলো। অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছে আজ ইয়াদকে। মুখটা শুকিয়ে গেছে হয়তো সারাদিনে পেটে কিছু পরেনি।

ইমা ইয়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলো, আপনি সারাদিনে কিছু খেয়েছেন ?

ইমার পাল্টা প্রশ্নে ইয়াদ অবাক না হয়ে পারলো না। এই মেয়ে মুখ দেখেই কীভাবে বুঝে গেলো ইয়াদ সারাদিনে কিছু খায়নি সেটা বুঝতে পারছে না ইয়াদ। ইয়াদের জীবনটা খুব অগোছালো ভাবে চলছে। সকালের ব্রেকফাস্ট যেদিন বাড়ি থেকে করে যায় সেদিন করা হয় নাহলে বাকি থেকে যায়। মাঝে মাঝেই কাজ করতে করতে কখন লান্সের সময় পেড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় ইয়াদের হুঁশ থাকে না। তার রাগের জন্য রনিত মনে করিয়ে দিতেও ভয় পায়। তারপর বাড়ি ফিরে দেখে সবাই ঘুমিয়ে গেছে তাই তার ডিনারটাও করা হয় না বেশির ভাগ সময়। আগে ইয়ানা দু একদিন বসে ছিলো ইয়াদ অনেক রাত করে ফিরে বলে ওকে ওয়েট করতে মানা করে দিয়েছে।

ইয়াদের ভাবনার মাঝেই ইমা বলে উঠলো, আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার জন্য খাবার গরম করে দিচ্ছি।

ইয়াদ কিছু বলার আগেই ইমা কিচেনের দিকে চলে গেলো আর ইয়াদ নিজের রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হলো। বেডে বসতেই আরো বেশী ক্লান্ত লাগছে এখন। তার ইচ্ছে করছে না আবার নিচে গিয়ে খাবার খেতে। ইয়াদ ঠিক করলো নিচে যাবে না তাই শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতেই ইমা খাবারের ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলো।

সাইড টেবিলে ট্রে রেখে ইমা বললো, আপনাকে দেখে বেশি ক্লান্ত লাগছে তাই খাবারটা রুমেই নিয়ে এলাম আপনি খেয়ে তারপর ঘুমান।

সকালে ব্রেকফাস্টের পর আর কিছু পেটে পরেনি তাই প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিলো ইয়াদের। কথা না বাড়িয়ে খাবার নিয়ে খেতে লাগলো ইমা ইয়াদের দিকে একবার তাকিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো যাতে ইয়াদ তাকে দেখে আনইজি ফিল না করে। ইয়াদের পেটটা ভরে এলে তখন ইমার কথা মনে পড়লো আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ইমা নেই। বেলকনির দিকে তাকিয়ে দেখে রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াদের বড্ড ইচ্ছে করছে মেয়েটা খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে কিন্তু নিজের ইগোর জন্য পারছে না। ইয়াদের মনে হচ্ছে সে যদি ইমাকে জিজ্ঞেস করে সে খেয়েছে কিনা তাহলে ইমা মনে করবে ইয়াদ তার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছে। এমন উদ্ভট চিন্তা করে ইয়াদ ইমাকে কিছু বললো না। খাওয়া শেষে ইয়াদ ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে শুয়ে পড়লো। অনেক সময় পার হয়ে গেলে ইমা রুমে এসে দেখে ইয়াদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ইমা খুব করে চাইছিলো ইয়াদ তাকে জিজ্ঞেস করুক সে খেয়েছে কিনা। পরক্ষণে মনে পরলো ইয়াদ তার হাতের খাবার খেয়েছে এতেই সে খুশী। একটু মুচকি হেঁসে ট্রে নিয়ে নিচে চলে গেলো রাখতে। ইমা নিচ থেকে উপরে আসার সময় শশুর শাশুড়ীর রুমের সামনে এসে থমকে গেলো কারণ এতো রাতে ভেতর থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ আসছে। ইমা ভাবলো কারো রুমে আড়ি পেতে কিছু শোনা ঠিক না তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিজের নাম শুনে থমকে গেলো।

রুবিনা কবির রেগে বললো, এই ইমা অনাথ একটা মেয়ে। এমন একটা চালচুলোহীন মেয়েকে তুমি আমার ছেলের জন্য কীভাবে পছন্দ করলে দিসার ?

ইমা বিড়বিড় করে বললো, দিসার কে শশুর মশাইয়ের নাম তো ইয়াসির ?

ইমা অবাক হয়ে আরো কৌতূহল নিয়ে শুনতে লাগলো। আরো বেশী অবাক হলো দিসার হিসাবে যখন তার শশুর মশাইয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো তখন।

দিসার বিরক্ত হয়ে বললো, দিসার দিসার করো না তো রুবিনা দেয়ালেরও কান আছে কেউ শুনতে পেলে সন্দেহ করবে আর তোমার ছেলের জন্য এমন মেয়ে কেনো পছন্দ করেছি সেটা আবার তুমি জিজ্ঞেস করছো ? তোমার বদরাগী ছেলের বাজে ব্যবহার কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে সহ্য করে এখানে পরে থাকবে ? এই মেয়ের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই তাই ইয়াদ ওকে যতোই অত্যাচার করুক সে কোথাও যেতে পারবে না আর আমাদের কাজ হলেই হয়েছে ইয়াদের বউ কে হলো সেটা দিয়ে আমাদের কী প্রয়োজন ? নাকি শেষ সময়ে এসে নিজের ছেলের জন্য তোমার ভালোবাসা উতলে পরছে রুবিনা ?

রুবিনা রেগে বললো, দেখো ইশান আর ইয়াদ তোমার কাছে আলাদা হলেও আমার কাছে এক। কারণ দুজনকেই আমি দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরে প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে জন্ম দিয়েছি।

দিসার মানে কথিত ইয়াসির রেগে বললো, দেখো রুবিনা তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দিও না। তুমি শুধু ইয়াদের বউকে হাতে রাখার চেষ্টা করো তুমি ভালো করেই জানো ঐ মেয়ের সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না।

রুবিনা রেগে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো আর ইয়াসির নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। এদিকে ইমা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে এরা তাকে নিয়ে কোনো জঘন্য খেলা খেলার জন্যই ইয়াদের সাথে বিয়ে দিয়েছে। এদের প্রত্যেকটা কথা রহস্যে মুড়ানো। ইয়াদ আর ইশান ইয়াসির হামিদের কাছে আলাদা হবে কেনো সেটা ইমা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। উনারা দুজনেই তো উনার সন্তান তাহলে এসব কী বলছে ? ইমা হাজারটা চিন্তা নিয়ে রুমে গেলো সে কিছুতেই কোনো হিসাব মিলাতে পারছে না। কী চলছে তার চোখের আড়ালে এই বাড়িতে ?

চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৮

ইয়াদ ঘুম থেকে উঠে বেডে বসতেই সোফায় চোখ গেলো। ইমা বসে আছে চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে। ইয়াদ ভ্রু কুচকে তাকালো ইমার দিকে।

এই মেয়ে তুমি সারারাত না ঘুমিয়ে বসে ছিলে নাকি ?

ইয়াদের কথায় ইমা চমকে উঠলো। সারারাত টেনশনে ঘুমই আসেনি ইমার। মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে কী চলছে এই বাড়িতে ?

ইমা আনমনে বলে উঠলো, বাবা আপনাকে আর ইশান ভাইকে আলাদা চোখে দেখে কেনো ?

ইয়াদ চমকে উঠে বললো, হোয়াট,,, ?

ইমা ব্যস্ত স্বরে বললো, না না কিছু না।

ইমা উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফজরের আযান হয়েছে একটু আগেই। ইয়াদ ইমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে এই মেয়ের কী হলো সেটা বুঝতে পারছে না ইয়াদ। ইমা ওয়াশরুম থেকে বের হলে ইয়াদ গেলো। নামাজ শেষে ইমা চলে গেলো কিচেনের দিকে। আজ থেকে রান্না সেই করবে ঠিক করেছে। এই বাড়িতে তার কাজ করার মতো কিছুই নেই। প্রত্যেকটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা সার্ভেন্ট আছে তবে কোকের রান্না ইমার কাছে হোটেলের খাবারের মতো লাগে, একদম ভালো লাগে না। সকালে অবশ্য ব্রেড, বাটার, ডিমের অমলেট, ফ্রুটস জুস, ফ্রুটস ছাড়া কিছু খেতে দেখে না এদের। ইমার এসব খাবার বিরক্ত লাগে। দু তিন খেয়েই বিরক্ত হয়ে গেছে সারা বছর এরা কীভাবে খায় সেটা ভেবে পায় না ইমা। ইমা ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে শুরু করে দিলো, ইয়াদ এক্সারসাইজ শেষে শাওয়ার নিয়ে রুমে এসে ভ্রু কুঁচকালো, সাইড টেবিলে তার ধোঁয়া উঠা গরম কফি, বেডের ওপর তার প্রয়োজনই সব জিনিস গুছিয়ে রাখা আর কিছুই খুঁজতে হবে না যাওয়ার সময়। ইয়াদ এসব দেখে খুশী হওয়ার বদলে রেগে গেলো।

ইয়াদ রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, কী প্রমাণ করতে চাইছে মেয়েটা, সে আমার স্ত্রী ?

ইমা সব কাজ শেষ করে ইয়াদের আর কিছু লাগবে কিনা দেখার জন্য রুমে এলো। রুমে এসে ইমা অবাক হয়ে গেলো কারণ ইয়াদ তার রাখা কোনো জিনিস ধরেনি। কাবার্ড থেকে অন্যগুলো বের করে পরে নিয়েছে। ইমা বেডে যেভাবে রেখেছিলো সব সেভাবেই আছে।

ইমা অবাক হয়ে বললো, আমি তো সব গুছিয়ে রেখেছি আপনি,,,

ইমা আর কিছু বলার আগেই ইয়াদ ইমাকে এক ঝটকায় কাবার্ডের সাথে চেপে ধরে বললো, কী প্রমাণ করতে চাইছো তুমি ? এসব করে, নিজেকে আমার স্ত্রী প্রমাণ করতে চাইছো ?

ইমা ভয় না পেয়ে নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে বললো, আমার তো কিছু প্রমাণ করার নেই। আপনি মানেন আর না মানেন পবিত্র কালেমা পরে বিয়ে করেছেন আমাকে। আমি আপনার স্ত্রী এটা প্রমাণ করার কিছু নেই। সারা দেশের মানুষ জানে আর সেটা আপনারাই জানিয়েছেন।

ইয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তুমি আমার স্ত্রী সারা দেশের মানুষের কাছে কিন্তু আমার কাছে না। তাই সারা দেশের মানুষের কাছে আমার স্ত্রী হয়ে থাকো আমার কাছে স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করো না সেটা তোমার জন্য ভালো হবে না।

ইমা আবার বললো, আমার সাথে আজ পর্যন্ত কী ভালো হয়েছে সেটা আমি খুঁজে পাই না। আপনি আর কী খারাপ করবেন ?

ইমা নিজের হাতের পুড়া দাগ দেখিয়ে বললো, এতোটা খারাপ করবেন ?

ইয়াদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পেছনে ঘুরে পিঠের শাড়ীর আচল সরিয়ে মারের কালো কালো দাগ দেখিয়ে বললো, না কী এতোটা খারাপ করবেন ?

ইয়াদ ইমার পিঠ দেখে আঁতকে উঠলো। কারণ শাড়ী আর ব্লাউজ ছাড়া শরীরের যতটুকু জায়গা ফাঁকা আছে সব জায়গায় কালো কালো দাগ। দেখে মনে হচ্ছে দাগগুলো বেশ পুরনো আবার কিছু নতুন। ইয়াদ কিছুই বুঝতে পারছে না এই মেয়ের শরীরে এসব দাগ কিসের।

ইমা ধরা গলায় বললো, ছোট ছোট ভুলের পুরষ্কার স্বরূপ এই দাগগুলো উপহার দিয়েছিলো আমার মণি। সবার সামনে যতটা অত্যাচার করতো সবার চোখের আড়ালে করতো তার থেকেও কয়েকগুন বেশি। আপনি আর কী করবেন এর থেকে বেশি করতে চাইলে বড়জোর খুন করতে পারবেন আর তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনার যদি আমাকে খুন করে শান্তি হয় তাহলে আমাকে বলবেন হাঁসি মুখে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে যাবো জীবন দেওয়ার জন্য।

ইয়াদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। মারের দাগগুলো কালো হয়ে গেছে অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ায় দাগগুলো যেতে হয়তো আরো অনেকটা সময় লাগবে। কিন্তু ইয়াদ এটা ভেবে পাচ্ছে না তার থেকেও খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আছে। এটা ভেবে ইয়াদ নিজেই আবার হাঁসলো তাদের থেকে খারাপ মানুষ তো তার চোখের সামনে এই বাড়িতেই বাস করছে এক ছাদের নিচে।

ইয়াদকে চুপ থাকতে দেখে ইমা বললো, কী হলো চুপ করে গেলেন কেনো ?

ইয়াদ নিজের কাজ করতে করতে বললো, তোমার সাথে এমনটা করার কারণ ?

ইমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, জানি না তবে নানু বলতো মণির রাগ ছিলো আমার বাবা মায়ের উপর আর তার প্রতিশোধ আমার উপর নিয়েছে। আর উসিলা স্বরুপ ছিলো আরমান ভাইয়া।

ইয়াদ আরমানের নাম শুনে ইমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। কারণ এই নামে ইমাদের পরিবারে কেউ আছে বলে শুনেনি। বিয়ের সময় কথাকে ছাড়া কাউকে দেখেওনি।

ইয়াদ বললো, আরমান কে ?

ইমা ইয়াদের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ইয়াদ এমনই তাকে সহ্য করতে পারে না এখন যদি আরমানের বিষয়ে সব শুনে সন্দেহ করে ইমাকে। সেই ভয়ে ইমা কিছু বলছে না।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, কী হলো কথা বলছো না কেনো, আরমান কে ?

ইমা আমতা আমতা করে বললো, আমার খালাতো ভাই আরমান ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

ইয়াদ বললো, তো সে কী করেছে ?

ইমা অস্থির হয়ে বললো, ক,,,কিছু না আপনি নিচে আসুন তাড়াতাড়ি, সবাই হয়তো অপেক্ষা করছে।

ইমা শাড়ীর আঁচল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে রুমের বাইরে চলে গেলো ইয়াদ সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ইয়াদের হুঁশ হলো সে এতোক্ষন মেয়েটার সাথে এতো ভালো করে কথা বলেছে আর তার রাগও হয়নি। ইয়াদ যেনো নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রাগটা এখন ইয়াদের একটা রোগে পরিণত হয়েছে। কারো সামান্য কথায়ও সে ভয়ংকর রেগে যায়। তবে কী ইয়াদ তার রোগের মেডিসিন পেয়ে গেলো। ইয়াদ চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে চলে গেলো। নিচে গিয়ে ইয়াদের চোখ চড়কগাছ। টেবিল ভর্তি নানা আইটেমের খাবার সাজানো, প্রতিদিনের মতো বোরিং খাবারগুলো আজ দেখা যাচ্ছে না। ইয়াদের বুঝতে বাকি রইলো না এসব কিছু ইমা করেছে। ইয়াদ রাগে কটমট করে ইমার দিকে তাকালো। সে কেনো এই মুখোশধারী মানুষগুলোর জন্য এতো কষ্ট করে রান্না করেছে সেই রাগে ইয়াদ ফেটে পরছে। এদের পিছনে বাধ্য হয়ে এতো বছর ধরে নিজের দাদার কষ্টের টাকার অন্ন ধ্বংস করছে এটাই তো বেশি।

ইয়াদ না খেয়ে ইমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এখনই রুমে এসো।

কথাটা বলে ইয়াদ কিছু না বলে হনহনিয়ে আবার রুমে চলো গেলো। এদিকে ইয়াদের কথা শুনে ইমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ানা আর ইশান মুচকি মুচকি হাঁসছে আর রুবিনা আর ইয়াসির অবাক হয়ে ইয়াদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে বিষ্ময়, তবে কী তারা খুব তাড়াতাড়ি ইমাকে দিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করতে পারবে সেটা ভাবছে তারা ?

ইয়ানা দু্ষ্টুমি করে বললো, যাও যাও ভাবি তোমাকে ডাকছে তো ভাইয়া ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

ইমা ভয়ে ভয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো কারণ ইমা ভালো করেই জানে ইয়াদ তাকে ভালোবাসার জন্য রুমে ডাকেনি। আবার হয়তো রেগে গেছে কিছু নিয়ে তাই এভাবে ডেকেছে।

ইমা রুমে গিয়ে কাঁপা গলায় বললো, কী হয়েছে ?

ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তোমাকে কিচেনে যেতে করে বলেছে ?

ইমা আমতা আমতা করে বললো, না মানে আমি নিজে থেকেই গিয়েছি।

ইয়াদ আগের ভঙ্গিতে বললো, এই বাড়িতে কোনো কাজে হাত লাগাবে না। প্রত্যেকটা কাজের জন্য সার্ভেন্ট রাখা আছে।

ইমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা আমার কোনো কিছুই কী আপনার ভালো লাগে না ? আমি যায় করি আপনি তাতেই রেগে জান। আমার ভুল কোথায় আমি সেটাই বুঝতে পারছি না এখন পর্যন্ত।

ইয়াদ রহস্যময় হেঁসে বললো, আমাকে বিয়ে করা তোমার সবচেয়ে বড় ভুল, বুঝতে পেরেছো মিসেস ইসমাত আবিয়াত ইমা আর এই ভুলের মাশুল তোমাকে সারা জীবন দিতে হবে।

কথাটা বলে ইয়াদ রুম থেকে বের হয়ে যেতে গেলে ইমা বলে উঠলো, ঠিক আছে আমার ভুলের মাশুল আমি সারাজীবন দিবো তার আগে এটা বলুন বাড়ির কোনো কাজ না করলে কী করবো আমি সারাদিন। আপনি অফিসে থাকেন, আপু ভার্সিটি চলে যায়, মা সারাদিন কোথায় থাকে তাকে,,,,,

ইমা কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই ইয়াদ গাল বেয়ে ধরলো ইমার।

রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বললো, খবরদার ঐ মহিলাকে যেনো আর কখনো আমার সামনে মা ডাকতে না দেখি তোমাকে।

ইমা ঐ অবস্থায় থেকেই বললো, তাহলে কী বলবো, আপনার মতো নাম ধরে ডাকবো ?

ইয়াদ দাঁত কিটমিট করে বললো, দরকার হলে তাই বলবে কিন্তু মা বলবে না।

ইমা ইয়াদের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, ইয়ানা আপু, ইশান ভাই উনারাও তো মা বলে ডাকে তাহলে,,

ইয়াদ বললো, ইশান কী বললো তাতে আমার এক বিন্দু কিছু আসে যায় না। তবে ইয়ানা মা বলা তো দূর, ঘৃণায় ঐ মহিলার দিকে তাকাবেও না আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি হবে।

ইয়াদ ইমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ইমা নিজের গালে হাত বুলাতে লাগলো। ইয়াদের হাত লোহার মতো শক্ত ইমার গাল ব্যাথা হয়ে গেছে।

ইয়াদ হঠাৎ বললো, করার কিছু পাও না তুমি তাই না ? তোমার পড়াশোনা শেষ ? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ফেলেছো ?

ইমা অবাক হয়ে বললো, আমার তো অনার্সই কমপ্লিট হয়নি আবার গ্রাজুয়েশন ?

ইয়াদ বললো, নিজেকে আবরার হামিদ ইয়াদের স্ত্রী দাবি করো অথচ তার সাথে দাঁড়ানোর শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। আবার তুমি কাজ খুঁজছ সারাদিন কী করবে ?

ইমার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো, আমাকে পড়তে দিবেন ?

ইয়াদ গম্ভীর গলায় বললো, কেউ বলবে আবরার হামিদ ইয়াদের স্ত্রী আন্ডারগ্রাজুয়েট সেটা আমারই অপমানজনক তাই ইয়ানার সাথে ভার্সিটি চলে যেও আজ থেকে।

ইয়াদ চলে গেলে ইমাও সাথে গেলো। খাবার খেয়ে সবাই ইমার রান্নার প্রশংসা করলো। ইয়াদ কিছু না বলে চুপচাপ খেয়েছে শুধু। খাওয়া শেষে যে যার কাজে চলে গেলো।

২২.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো অনেকগুলো দিন। ইয়াদ আর ইমার সম্পর্কের তেমন একটা উন্নতি হয়নি। তবে ইয়াদ ইমার সাথে কথা বলে প্রয়োজন মতো, রেগে গেলে আবার আগের মতোই গলা চেপে ধরে বা হাত মুচড়ে ধরে। ইমা অবশ্য প্রচুর বিরক্ত করে ইয়াদকে। ইয়াদের রাগকে ভয় পেলেও ইয়াদের কপাল কুঁচকে তাকানো খুব ভালো লাগে ইমার। নিজের অজান্তে কখন ইয়াদকে এতেটা ভালোবেসে ফেলেছে ইমা বুঝতেই পারেনি। ইয়ানার সাথে রেগুলার ভার্সিটি যায় ইমা তবে আরমানকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলে, মন দিয়ে পড়াশোনা করে। ইয়াদকে মাঝে মাঝে বাঁধ্য করে তাকে পড়াশোনায় সাহায্য করতে, হঠাৎ করে ইমার সাথে ইয়াদের এমন নরমাল ব্যবহার করারও একটা কারণ আছে। যেটা হয়তো সঠিক সময়ে জানতে পারবে ইমা। এদিকে রহস্য উদঘাটনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ইমা কিন্তু যখনই মনে হয় সব রহস্য উদঘাটনের একদম নিকটে তখনই এমন কিছু সামনে আসে যাতে আবার সব এলোমেলো হয়ে যায়। ইমার সন্দেহের তালিকায় আছে ইয়াসির হামিদ। ইমার মনে হয় এই একজন ব্যাক্তি সব রহস্যের মূল কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছু খুঁজে পায় না ইমা। এদিকে ইশান প্রতিনিয়ত কথাকে বিরক্ত করার নতুন ওয়ে খুঁজে চলেছে। কথা ইমার সাথে কয়েকবার দেখা করতে এসেছিলো কলেজ থেকে ফেরার সময়, প্রত্যেক বারই ইশানের জালাতন সহ্য করতে হয়েছে তাকে।

ইমা বেডে বসে নিজের পড়া দেখছিলো আর ইয়াদ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে।

ইমার পুরোনো মডেলের ফোনটা বেজে উঠলে ইমা বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো, আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন ?

ইয়াদ ইমাকে ফোন রিসিভ করতে দেখে একবার ঘুরে তাকালো ইমার দিকে। ইমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে ইয়াদের আনইজি লাগে নিজের খোলস থেকে বের হতে পারে না চেষ্টা করেও। তাই যতটা প্রয়োজন ততটাই কথা বলে। ফোনে ওপাশের কথা শুনে ইমা মা বলে চিৎকার করে উঠলো। হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো। ইমা পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

ইয়াদ দ্রুত পায়ে ইমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে, এভাবে পাগলের মতো কাঁদছো কেনো তুমি ?

ইমা কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার মা,,,,

বাকিটা বলার আগেই আবার কাঁদতে লাগলো, ইয়াদ বিরক্ত হয়ে ইমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ইমার ফোনটা নিজের কানে নিলো।

হ্যালো কে বলছেন ?

ভেজা গলায় কথা বললো, ভাইয়া আমি কথা।

ইয়াদ কথাকে চেনে কয়েকবার বাসায় এসেছিলো আর বিয়েতেও পরিচয় দিয়েছিলো।

ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, কী হয়েছে কথা ? ইমা এভাবে কাঁদছে কেনো কী বলেছো ?

উত্তরে কথা যা বললো তাতে ইয়াদ বরফের মতো জমে গেলো। অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ইমার দিকে।

ইমা ইয়াদের শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি মায়ের কাছে যাবো প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন। আপনি যা বলবেন তাই শুনবো। আপনাকে কখনো বিরক্ত করবো না। একদম চুপচাপ থাকবো একটা কথাও বলবো না আর কখনো। তবু আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলুন দয়া করে।

আজ কেনো যেনো ইয়াদের খুব কষ্ট হতে লাগলো ইমার কান্না দেখে। বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতে লাগলো। ইমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, কান্না করো না প্লিজ, আমি নিয়ে যাবো তোমাকে এখনই।

চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৯

হসপিটালের বারান্দায় বসে আছে ইয়াদ তার পাশেই ইমা থম মেরে বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। ইয়াদ তাকিয়ে আছে ইমার দিকে, আজ বড্ড অসহায় লাগছে ইমাকে। তাহেরার চেকআপ করে ডাক্তার বের হলে ইমা দৌড়ে যায় তার কাছে।

আ,,আমার মা কেমন আছে ডক্টর ?

ডক্টর হতাশ গলায় বলে, উনার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। আমি উনাকে আরো অনেক আগে জানিয়েছিলাম উনার কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে তখন অপারেশন করে কিডনি চেঞ্জ করলে হয়তো বেচে যেতেন। কিন্তু উনি তারপর আর আমার সাথে কোনো যোগাযোগই করেননি। এখন কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার কারণে আরো অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে উনার শরীরে। অপারেশন করলেও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ১০০% এর মধ্যে ১% এরও কম। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশনের ব্যবস্থা করছি।

ডক্টর চলে যেতেই ইমা থপ করে মাটিতে বসে পরে ইয়াদ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইমাকে ধরতেই ইমা উল্টো ঘুরে ইয়াদকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে।

সব আমার জন্য হয়েছে, আমি যদি মাকে অবহেলা না করতাম তাহলে মা কখনো এমন করতো না। আমার জন্য নিজের যত্ন নেয়নি মা।

ইয়াদ ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, হুসস কান্না করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি অভিজ্ঞ ডক্টরদের আনার ব্যবস্থা করেছি। তারা এসে অপারেশন করলেই তোমার মা একদম ঠিক হয়ে যাবে আর কিডনির ব্যবস্থাও হয়ে গেছে তাই চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে।

ইমা ফ্লোরে বসে ইয়াদের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো তারপর ভাঙা গলায় বললো, আমি একবার মায়ের সাথে দেখা করতে চাই প্লিজ একবার মায়ের সাথে দেখার করার সুযোগ করে দিন প্লিজ প্লিজ।

ইয়াদ বললো, কিন্তু উনার তো এখন জ্ঞান নেই।

ইমা আগের মতো বললো, আমি শুরু মাকে দেখবো একবার জড়িয়ে ধরবো।

ইয়াদ ইমাকে ধরে উঠিয়ে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো তারপর বললো, তুমি এখানে বসো আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করছি।

তাহের এতোক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিলো। তাহের তার মাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে বাবা বাসায় ছিলো না। হঠাৎ মাকে ডাকতে ডাকতে রুমে গিয়ে দেখে মা সেন্সলেস হয়ে পরে আছে তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছে। ইমা তাহেরকে ছোটবেলা থেকে দেখতে পারে না তাই তাহের ইমার থেকে দূরেই থাকে। ইমার থেকে চার বছরের ছোট তাহের।

ইমার পাশে গিয়ে বসে বলে, আপু,,,,,

কারো ডাকে ইমা পাশে তাকিয়ে তাহেরকে দেখতে পায়। আজ কেনো যেনো তাহেরকে বড্ড আপন মনে হচ্ছে ইমার কাছে। না চাইতেও ইমা ভাই বলে তাহেরকে জড়িয়ে ধরলো।

ধরা গলায় বললো, তুই থাকতে মা এমন কীভাবে করলো তাহের ?

তাহের কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা আমাদের কিছুই বুঝতে দেয়নি আপু। মা তোমাকে খুব ভালোবাসে আপু, খুব ভালোবাসে। তোমার ছোটবেলার জামাকাপড় আঁকড়ে প্রায় কাঁদতে দেখতাম মাকে। বিড়বিড় করে বলতো আমাকে মাফ করে দে ইমা, আমাকে মাফ করে দে।

ইমা এসব শুনে আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার মা তাকে কতো ভালোবাসে আর সে সবসময় মাকে অপমান করে গেছে। নিজের মা বলে স্বীকার করেনি কখনো।

তাহের ইমার থেকে সরে ইমার হাত ধরে বললো, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি আপু কিন্তু তুমি রাগ করবে ভেবে তোমার সামনে আসি না। তোমার বিয়ের দিন আমি গিয়েছিলাম তোমাকে দেখতে লাল পরীর মতো লাগছিলো তোমাকে। কিন্তু তোমার সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি। মা ও জানে না আমি গিয়েছিলাম তোমার বিয়েতে। আমি নানু বাড়িতে আর মণিদের বাড়িতে যেতাম শুধু তোমার জন্য। আপু আমরা এক বাবার সন্তান না হলেও এক মায়ের সন্তান তো। তাহলে তুমি কেনো আমাকে নিজের ভাই মনে করো না। বিশ্বাস করো আপু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আপু খুব।

কথাগুলো শেষ করে তাহের কাঁদতে লাগলো। তাহেরের কথার কী উত্তর দেবে ইমা তার জানা নেই। ইমা তখন ছোট ছিলো বুঝতে পারতো না তার মা’য়ের আবার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাহেরের জন্ম হয়। ইমার বয়স তখন কেবল চার বছর। ছোট ইমা মনে করতো তাহেরের জন্যই তার মা তাকে ভালোবাসে না। সুযোগ পেলেই মারতো তাহেরকে। তাই বাধ্য হয়ে ইমাকে ইমার নানা বাড়ি রাখে তাহেরা। কিন্তু বড় হয়ে যখন ইমা বুঝতে শেখে তাহেরের বাবা তার বাবা নয় সে আর ও-বাড়িতে পা রাখেনি কখনো।
ইমার আর তাহেরের কান্নার মাঝেই ইয়াদ এসে উপস্থিত হয়। ইমা আর তাহেরের মাঝে ইয়াদ নিজেকে আর ইশানকে দেখতে পাচ্ছে। ওদের সম্পর্কটা এক ধরণের হলেও মাঝে পার্থক্য আছে অনেক। ইয়াদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ইমার পাশে এসে দাঁড়ালো তাতে ইমা চোখ তুলে তাকালো ইয়াদের দিকে।

ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, ডক্টর একজনকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে তবে কান্নাকাটি করা যাবে না।

ইমা ইয়াদের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাহেরের দিকে তাকায়। তাহের ইশারায় যেতে বলে মায়ের কাছে। ইমা উঠে পা বাড়ায় কেবিনের দিকে। ভেতরে গিয়ে ইমা দেখতে পেলো নিজের মাকে। অদ্ভুত ব্যাপার তাহেরাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে না অসুস্থ বরং শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো এক যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে ইমা তার মাকে মা বলে ডাকে না। বুকের মাঝে অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখেছিলো যা আজ একাই ভেঙে গুড়িয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে মায়ের এই অবস্থা দেখে। ইমা মায়ের পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে পড়ে। কাঁপা হাতে মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।

ধীর গলায় বলে, কেনো এমন করলে মা ? কেনো তোমার অসুখের কথা কাউকে জানতে দিলে না মা কেনো ? একবার আমার কথা মনে পড়লো না ? বাবা তো বুঝ হওয়ার আগেই ছেড়ে চলে গেছে আজ তুমিও আমার সাথে এমন করলে। আমি তো অভিমান করেছিলাম শুধু তার এতবড় শাস্তি তুমি কীভাবে দিতে পারো মা ?

ইমা থেমে থেমে বলছে আর কাঁদছে। ইমার চোখের পানি তাহেরার হাতে পড়তেই পিটপিট করে তাকায় তাহেরা। পাশে মেয়েকে দেখে খুশিতে চোখ চকচক করে উঠে তার।

ভাঙা গলায় বললো, ইমা।

ইমা মায়ের গলা শুনে চমকে তাকায় মায়ের দিকে, তাহেরাকে তাকাতে দেখে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে দেয়। এতদিন খা খা করতে থাকা বুকটা শান্তি পায় তাহেরার। ইমাও আজ এক যুগ পর নিজের মায়ের মা মা গন্ধ পেলো আবার।

তাহেরা আগের মতো ভাঙা গলায় বলে, কী হয়েছে কাঁদছিস কেনো ?

ইমা অভিযোগের স্বরে বলে, তোমার অসুখের কথা কেনো কাউকে বলোনি মা ?

তাহেরা জোর করে হেঁসে বলে, তোর বাবাকে এখনো আগের মতোই ভালোবাসি রে মা। তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে হারাতে চাইনি। তৌহিদুর (তাহেরার বর্তমান স্বামী) অনেক ভালো মানুষ তবে আমি তাকে কখনো মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। ভুলতে পারিনি তোর বাবাকে তাই তার থেকে দূরে দূরে থেকেছি। তিনি তোকেও অনেক ভালোবাসে বারবার তোকে নিতে পাঠিয়েছে কিন্তু তুই তো আমাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নিতি তাই কখনো বলার সাহস হতো না আমার সাথে ও-বাড়িটায় যেতে। যেবার তৌহিদুর নিজেই তোকে আনতে গেলো তুই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলি সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলো। পারলে একবার মাফ চেয়ে নিস তার কাছে।

ইমা শব্দ করে কেঁদে উঠে বললো, আমাকে মাফ করে দাও মা মাফ করে দাও। এভাবে আমাকে এতিম করে যেও না তুমি।

ইমা শুব্দ করে কেঁদে উঠায় নার্স এগিয়ে এসে জোর করে ইমাকে বাইরে বের করে দিলো। ইমা বাইরে এসে দেখে তৌহিদুর রহমান দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসে আছে। আরমান, কথা আর মণিও এসেছে। মণিকে দেখতেই ইমার চোখে রক্ত উঠে গেলো। এই মহিলার জন্য ইমা তার মায়ের থেকে দূরে সরে গেছে। বুঝতে শেখার পর থেকে মায়ের নামে বিষ ঢেলে গেছে ইমার কানে। সেসব শুনে পাহাড় সামান অভিমান জমেছিলো ইমার মনে। তাই আজ তার মায়ের এমন দশা।

ইমা ছাহেরা বেগমের দিকে তেড়ে গিয়ে বললো, আপনি কেনো এসেছেন এখানে ? শান্তি হয়েছে আমার মাকে এই অবস্থায় দেখে। আজ শুধু আপনার জন্য আমার মায়ের এমন অবস্থা। আপনি আমার মাকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিয়েছেন।

আরমান রেগে বললো, ইমা এটা কী ধরনের অসভ্যতামি ? তুই মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলছিস ?

ইমা রেগে দিগুণ তেজে বললো, একদম চুপ মিস্টার আরমান মাহমুদ। ভাববেন না আপনার রাগ দেখে আমি ভয়ে গুটিয়ে যাবো। এখন আমি আপনার বা আপনার বাবার টাকায় খাইও না পড়িও না তাই আমার সাথে গলা নামিয়ে কথা বলুন মিস্টার আরমান।

ইমা এক হাতে চোখের পানি মুছছে আর এসব বলছে। তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই আর সবচেয়ে অবাক হয়েছে আরমান। যে মেয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেতো না সে মেয়ে আজ তার সাথে এভাবে কথা বলছে ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না আরমানের।

ইয়াদ ইমার কাছে গিয়ে বললো, ইমা শান্ত হও সব ঠিক হয়ে যাবে।

ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিলো আর বললো, কিছু ঠিক হবে না। আপনি জানেন না এই মহিলার জন্য আমি প্রতিনিয়ত আমার মাকে দূরে ঢেলে দিয়েছি আর তাতে আমার মা ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে দিনের পর দিন।

ইমা কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে পরে যেতে নিলে আরমান ধরার জন্য আগাতেই ইয়াদ খপ করে ধরে নেয়। ইয়াদের বুকে মাথা এলিয়ে দেয় ইমা আর তাতে ইয়াদ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দৃশ্যটা দেখে আরমানের মনে তীরের মতো আঘাত করলো। নিজেকে ধীক্কার দিতে লাগলো এতোদিন পর ইমার সাথে কথা বললো তাও সে রেগে কথা বললো তার সাথে। ইয়াদ একটা কেবিন বুক করে ইমাকে শুইয়ে দিলো। অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে সেন্সলেস হয়ে গেছে তাই এখন ঘুমের মেডিসিন আর স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ইয়াদ ইমাকে রেখে ইমার মায়ের অপারেশনের জন্য নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলো। রনিতও চলে এসেছে ইয়াদের ফোন পেয়ে সব বড় বড় ডক্টরদের সাথে যোগাযোগ করছে ইয়াদ নিজেই। চার ঘণ্টা পর তাহেরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় তার একটু পরই ইমার ঘুম ভেঙে যায় নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে। মায়ের কথা মনে পরতেই ইমা হাতের ক্যানেলা টেনে ছিঁড়ে বাইরে বের হয়ে যায়। ইয়াদ অপারেশন থিয়েটারের বাইরে চেয়ারে আসে আছে মাথা নিচু করে।

ইমা ইয়াদের কাছে গিয়ে ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে বলে, আ,,,আমার মা কোথায়,,, আমার মা ?

ইয়াদ ইয়ার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে হাত থেকে কলকলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ইয়াদ ইমার হাত চেপে ধরে ধমক দিয়ে বলে, পাগল হয়ে গেছো তুমি ? ক্যানেলা খুলছো কীভাবে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

ইয়াদের কথা ইমার কানে যাচ্ছে না সে বারবার জিজ্ঞেস করছে আমার মা কোথায়। ইয়াদ জোরে ধমক দিয়ে চুপ করায় ইমাকে। নার্স ডেকে এনে হাতে ওয়ান টাইম টেপ লাগিয়ে দেয়। তারপর ইমাকে উঠিয়ে পাশে বসিয়ে দেয়। দূরে দাড়িয়ে সবটা নিরব চোখে দেখছে আরমান বুকটা পুড়ছে তার খুব খারাপের ভাবে।

ইয়াদ অপারেশন থিয়েটারের দিকে দেখিয়ে বলে, অপারেশন চলছে তারপর তোমার মা একদম ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না।

ইমার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো, আমার মা সত্যি ঠিক হয়ে যাবে ?

ইয়াদ ইশারায় হ্যাঁ বুঝালে ইমা আবার বলে, মা একবার ঠিক হয়ে গেলে আর কখনো রাগ করবো না, কখনো না। সবসময় মায়ের খেয়াল রাখবো বাবাকে মিস করতেই দিবো না। তাই মা আমাকে রেখে বাবার কাছে যেতে চাইবে না।

ইমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইয়াদ। ইমাকে এখন একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো লাগছে। দূর থেকে তৌহিদুরও তাকিয়ে আছে ইমার দিকে। ইমা আর তাহেরকে কখনো আলাদা চোখে দেখেনি তৌহিদুর রহমান। বলতে গেলে সবসময় ইমাকে বেশি ভালোবেসেছে। তাহেরাকে বিয়ের আগে দেখেছিলো তৌহিদুর, ভালো লেগে যায় তাকে। তাই বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাহেরার বাড়িতে। তৌহিদুর সরকারি চাকরি করে তাই তাহেরার বাবা মানা করার সুযোগ পায়নি কিন্তু বিয়ের আগেই তাহেরা পালিয়ে গেলো ইমরুলের সাথে। অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিলো তৌহিদুর তাই আর বিয়েও করেনি। তার কয় বছর পর তাহেরার সাথে আবার দেখা হয় তবে তাহেরার কোলে ছিলো ছোট পরী ইমা। ইমরুলের মৃত্যুর কথা শুনে অনেক খারাপ লেগেছিলো তৌহিদুরের। সবচেয়ে খারাপ লাগে ইমার দিকে তাকালে। বাবা কী জিনিস বুঝার আগেই মেয়েটা বাবা হারালো। মূলত ইমার কথা চিন্তা করেই তাহেরাকে বিয়ে করতে চায় তৌহিদুর আর তাছাড়া তাহেরাকেও সে আগে থেকেই ভালোবাসতো। সবাই রাজি হলেও তাহেরা রাজি হয় না বিয়েতে। এভাবে কেটে যায় এক বছর তারপর কী হয়েছিলো তৌহিদুর জানে না হঠাৎ করেই তাহেরা রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। বিয়েটাও হয়ে যায় কিন্তু তাহেরা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তৌহিদুর কে। তৌহিদুর ভেবেছিলো একটা বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাহেরের জন্মের পর তাহেরকে মেনে নিলেও তৌহিদুরকে মানতে পারে না তাহেরা। মাঝে ইমাকে দূরে পাঠাতে হয়। অনেক চেষ্টা করেও তৌহিদুর তাহেরার মনে জায়গা করতে পারেনি। তাই একসময় হাল ছেড়ে দেয় তৌহিদুর কারণ সম্পর্কটা ভালোবাসা না হলেও সে কখনো #তিক্ততার_সম্পর্ক বানাতে চাইনি। তাহেরাকে নিজের মতো থাকতে দিয়েছে কিন্তু তার প্রাপ্য হিসাবে তাহেরা তাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে চাইবে ভাবতে পারেনি তৌহিদুর। আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে কেনো তাহেরাকে নিজের মতো চলতে দিয়েছিলো। আজ সে না হতে পেরেছে তাহেরার স্বামী আর না হতে পেরেছে ইমার বাবা। তাহেরার সাথে সম্পর্কটা তিক্ততার হতে না দিলেও ইমার সাথে তার সম্পর্কটা যে তিক্ততায় ডুবে গেছে সেটা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিলো তৌহিদুর।

তাহেরের বয়স পাঁচ বছর হতেই তৌহিদুর তাহেরাকে বলেছিলো, মেয়েটা আর কতদিন অন্যের বাড়িতে থাকবে আমার এতবড় বাড়ি থাকতে ? তুমি ইমাকে বাড়ি নিয়ে এসো মেয়েটাও এখন বড় হচ্ছে অন্যের বাড়িতে থাকা ভালো দেখায় না।

তাহেরা কী বলবে ভেবে পায় না। কারণ সে অনেকবার গিয়েছে ইমাকে আনতে কিন্তু ছোট ইমা তাকে এভাবে বলতে পারে কল্পনাও করেনি তাহেরা। তাই রাগ করে বললো, আমি যেতে পারবো না আপনার মেয়েকে আনার দরকার হলে নিজে জান।

সত্যি গিয়েছিলো সে ইমাকে আনতে কিন্তু ইমা তাকে যা বলেছিলো তাতে সে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি। আর কখনো যায়নি ইমার সামনে সে। তৌহিদুর অতীতে বিচরণ করছিলো পাশেই বসে আছে তাহের।

তাহের চমকে উঠে বললো, আব্বু ডক্টর বের হয়েছে।

তাহেরের কথায় সবাই তাকালো অপারেশন থিয়েটারের দিকে। মুখ কালো করে বের হয়ে এসেছে ডক্টর। ডক্টরের মলিন মুখ দেখে কলিজা কেঁপে উঠলো ইমা তাহের আর তৌহিদুরের।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here