#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৯
পিটপিট করে তাকালো ইমা, বুঝতে পারছে না সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো নিজের রুমের বেডে শুয়ে আছে।
এতোটা কেয়ারলেস কেনো তুমি ?
কথাটা ইমার কানে গেলে সেদিকে তাকিয়ে ইয়াদকে দেখতে পায়, সোফায় বসে আছে ইয়াদ৷ ইমা ধীরে ধীরে উঠে বসলো।
ইয়াদ আবার বললো, আমি যদি ঠিক সময়ে পিছনে না দেখতাম তাহলে কফির কাপের মতো তোমার মাথাটাও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত নিচে পরে।
ইমা মনে করার চেষ্টা করলো তখনকার কথা। ইয়াদ দু’পা এগিয়ে ইমার দিকে ঘুরে তাকাতেই ইমা পা পিছলে পরে যেতে নেয়। কিন্তু ইয়াদ খপ করে ধরে ফেলে ইমার হাতটা। ইয়াদের বুকে এসে পরে ইমা আর অনুভব করতে পারে ইয়াদের অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া হার্টবিট। ইয়াদ নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ইমাকে পিছলে যেতে দেখে। ইয়াদের বুকে পরে ইমা ভয়ে সেন্সলেস হয়ে যায়।
ইমা নিজের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি এখানে কীভাবে এলাম ?
ইয়াদ বিরক্ত গলায় বললো, উড়ে উড়ে এসেছো ।
ইমা বোকার মতো ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে, মানে, আমি কীভাবে উড়ে আসবো ?
ইয়াদ বিড়বিড় করে বলে, ইডিয়ট একটা।
ইমা ভ্রু কুঁচকে বলে, কী বলছেন বিড়বিড় করে ?
ইয়াদ রাগ দেখিয়ে বলে, আজ থেকে তোমার ছাদে যাওয়া বন্ধ আর কখনো ছাদে পা রাখবে না। তোমার জন্য এই পাশের রেলিং দেওয়া মিনি ছাঁদটাই ঠিক আছে।
ইমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ইয়াদ রুম থেকে বের হয়ে গেলো আবার একটু পরই ফিরে এলো। ইমা কিছু বললো না, বেডে বসে রইলো। ইয়াদ রুমে এসে সোফায় বসতেই সার্ভেন্ট নক করলো দরজায়। ইয়াদ আসার অনুমতি দিলে ব্রেকফাস্ট নিয়ে রুমে ঢুকলো।
ইমা তা দেখে বললো, উপরে আনার কী প্রয়োজন ছিলো ? আপনি তো আজ সুস্থ আছেন।
ইয়াদ কিছু না বলে বিরক্তি নিয়ে তাকালো ইমার দিকে তাই ইমা চুপ করে গেলো।
সার্ভেন্ট চলে গেলে ইয়াদ বলে, কথা বাদ দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও সবার ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেছে অনেক আগেই।
ইমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো নয়টা বেজে গেছে আর এবাড়িতে আটটায় সবাই ব্রেকফাস্ট করে, যার যার মতো বের হয়ে যায়। ইয়াদ ইমার জন্য অপেক্ষা না করে খেতে শুরু করলো। তাতে ইমার অভিমান হলেও কিছু বললো না চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ করে ইয়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হতে লাগলো।
ইমা তা দেখে বললো, আপনি রেডি হচ্ছেন কেনো ? কোথায় যাবেন আপনি ?
ইয়াদ নিজের কাজ করতে করতেই বললো, আমি কাউকে কৈফত দেওয়া পছন্দ করি না, কথাটা আবার মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে কেনো ?
ইমা খাবারের প্লেটটা সাইড টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন, এখনই কোথায় যাবেন আবার ?
ইয়াদ আনমনে বললো, অনেক কাজ জমে আছে, আমার বসে থাকলে চলবে না।
ইমা ভ্রু কুঁচকে বললো, কীসের কাজ ? সুস্থ হলে সারাদিন কাজ করিয়েন আমি কিছু বলবো না কিন্তু এখন কোথাও যেতে দিবো না।
ইয়াদ ইমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইমা ডাকতে থাকলেও ইয়াদ সেদিকে কোনো রিয়াকশন না দিয়ে চলে গেলো। ইমা নাক ফুলিয়ে বেডে বসে পড়লো।
বিড়বিড় করে বললো, এই লোক জীবনেও আমার কথা শুনবে না, বদ লোক একটা। আবার অসুস্থ হলে, আমি একদম রুমের বাইরে ফেলে দিয়ে আসবো একে।
ইমা আবার নিজের মাথা গাট্টা মেরে বললো, ইমা তুই আসলেই একটা ইডিয়ট। এই পিঁপড়ার মতো শরীর নিয়ে ঐ হাতিকে রুম থেকে বাইরে ফেলে আসবি ? না নাহ আমি কী সব আবোল তাবোল বলছি। আল্লাহ তুমি উনাকে হেফাজতে রেখো সবসময়।
ইমা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এখন ভার্সিটি যাওয়ার সময়ও নেই, লেট হয়ে যাবে। ব্রেকফাস্টের ট্রে নিচে রেখে রুমে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে রুমটা স্ক্যান করে নিলো। সব এলোমেলো হয়ে গেছে শাড়ীর আচল কোমরে গুঁজে গোছানোর কাজে লেগে পড়লো।
৩০.
ক্লাসে বসে কলম আঙ্গুলে ঘুরিয়ে যাচ্ছে কথা কিন্তু স্যারের দিকে মনোযোগ একটুও নেই। সকালে বাসা থেকে বের হতেই ইশানের গাড়ি এসে থামে কথার সামনে। কথা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইশানের দিকে। গাড়ির ভেতরে সানগ্লাস পরার কারণ খুঁজে পায় না কথা। হোয়াইট টিশার্টের উপর ব্ল্যাক শার্ট পড়ে সবগুলো বোতাম খুলে রেখে, চোখে সানগ্লাস দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কথা ইশানকে ইগনোর করে সামনের দিকে পা বাড়ালো। ইশানও ধীর গতিতে কথার সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ি এগোতে লাগলো। অনেকটা পথ হাঁটার পরও ইশানের কোনো পরিবর্তন হলো না দেখে কথা থেমে গেলো।
বিরক্ত হয়ে ইশানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা নিচু হয়ে বললো, কী সমস্যা আপনার, আমার সাথে এভাবে পিছু পিছু আসছেন কেনো ?
ইশান এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, আমাকে বলছেন ?
কথার রাগ মাথায় চড়ে গেলো ইশানের কথা শুনে তবু চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে রাগ কন্ট্রোল করে বললো, এখানে আপনি ছাড়া অন্যকেউ আছে ?
ইশান আশেপাশে তাকিয়ে বললো, নাহ তা তো নেই কিন্তু আমি তো আপনার পিছু নিচ্ছি না। আপনি যাচ্ছেন ফুটপাত দিয়ে আর আমি রাস্তা দিয়ে। আর এটা সরকারি রাস্তা সবাই যেতে পারে।
ইশানের উত্তরে প্রচন্ড রাগ লাগছে কথার তবু শান্ত স্বরে বললো, দেখুন আমি যা বলার গতকালই বলে দিয়েছি, এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না দয়া করে।
ইশান অবাক হয়ে বললো, আমি কী আপনাকে কিছু বলেছি ?
কথা বিরক্ত হয়ে বললো, আমি কিন্তু ইয়াদ ভাইয়ার কাছে সব বলে দেবো।
ইশানের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। ফট করে দরজা খুলতেই কথা সরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকালো ইশানের দিকে।
ইশান গাড়ি থেকে নেমে খপ করে কথার হাত ধরে বললো, এই প্লিজ, তুমি ভাইয়াকে বলে দাও না। তুমি ভাইয়াকে বললে ভাইয়া আমাদের বিয়ে দিয়ে দেবে। আসলে আমি ভাইয়াকে ভয় পায় খুব, তাই বলতে পারবো না। তুমি বললে কাজটা সহজ হয়ে যাবে আমার জন্য।
কথা ঝটকা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, আপনি পাগল হয়ে গেছেন পাবনার টিকেট কেটে সেখানে চলে যান।
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, তুমি সাথে গেলে আমি পাবনা যেতেও রাজি আছি।
কথা বিরক্ত হয়ে বললো, ডিসকাস্টিং লোক একটা।
কথা হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো, একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। ইশান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে নিজের গাড়িতে উঠে পরে।
টেবিলে থাপ্পড় মারার শব্দে চমকে উঠলো কথা। সামনে তাকিয়ে দেখে মোটা ফ্রেমের চশমার উপর দিকে গোল গোল চোখ করে টকলা স্যার তার দিকে তাকিয়ে আছে। কথা আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো নিজের সিট থেকে।
টাকলা স্যার কর্কশ গলায় বললাম, তোমার মনোযোগ কোথায় কথা ? আমি কতবার ডেকেছি তোমাকে ?
কথা ভয়ে ভয়ে বললো, সরি স্যার ভুল হয়ে গেছে।
স্যার বিরক্ত হয়ে বললো, প্রথমবারের মতো মাফ করে দিলাম কিন্তু তুমি দিনদিন ক্লাসে যেভাবে অমনোযোগী হয়ে পরছো নিজের পজিশন ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
কথা মাথা নিচু করে বললো, সরি স্যার আর হবে না এমন।
স্যার গম্ভীর গলায় বললো, ঠিক আছে বসো আর ক্লাসে মনোযোগ দাও।
কথা ধপ করে বসে পড়লো সীটে। মনে মনে কয়েকটা বাজে গালি দিলো ইশানকে আর বললো, সব হয়েছে বদমাশ লোকটার জন্য।
কথা নিজের চিন্তা থেকে ইশানকে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিলো।
এদিকে ইশান ভার্সিটি ক্যাম্পাসে বসে আছে ফ্রেন্ডদের সাথে। সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর ইশান কথার ভাবনায় মুচকি মুচকি হাঁসছে। কথার এই ঝাঁঝালো আচরণই ইশানের বেশি ভালো লাগে। গায়ে পড়া মেয়েদের একদমই সহ্য হয় না ইশানের। কথা একদম ইশানের মনের মতো, যেমনটা ইশান চায়। কথা হয়তো একদিন ঠিক বুঝতে পারবে পৃথিবীতে সবাই বাইরের সৌন্দর্য নয়, কেউ কেউ মনের সৌন্দর্যটাও খুঁজে।
,,,,,,
আপনি বলেছেন আমার দাদা-দাদি আর ফুপি ছিলো কিন্তু তাদের কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই কেনো ডক্টর আতিক ?
ইয়াদের সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো ইয়াদ। ডক্টর আতিক ইয়াদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কিন্তু সেই হাসির মানে ইয়াদ বুঝতে পারছে না।
ইয়াদ নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে আবার বললো, আপনি আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে সব বললেও আমার দাদা-দাদি আর ফুপির কথা স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি। যদি তারা থেকেই থাকতো তাহলে এখন কোথায় আছে তারা ?
আতিক ফ্লোরে দৃষ্টি রেখে বললো, তোমার ফুপির নাম ছিলো তাফসিয়া হামিদ তবে সবাই তাকে কলি বলে ডাকতো, দেখতে ছিলো গোলাপের কলির মতো। তোমার পরিবার সম্পর্কে আমার এতোকিছু জানার কারণ তোমাকে আগেই বলেছি৷ আমি আর তোমার বাবা একসাথে স্কুল কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছি। তোমার ফুপি ছিলো তোমার বাবার প্রায় দশ বছরের ছোট তাই তোমার বাবা আর দাদার চোখের মণি ছিলো সে, যদিও তার একটা বিশেষ কারণও ছিলো। কলি তোমার বাবার দশ বছরের ছোট হলেও আমার আট বছরের ছোট ছিলো। এখন প্রশ্ন করতে পারো আমি তোমার বাবার দুই বছরের ছোট হলে একসাথে পড়লাম কী করে ?
ইয়াদ মাথা নাড়িয়ে বললো, হুম।
আতিক এবার ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ইয়াসির ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি উদাসীন ছিলো যার জন্য দুই বছর পিছিয়ে পড়ে। ইয়াসির নিজের কল্পনার জগৎ নিয়ে থাকতে পছন্দ করতো। তোমাদের যে এতোবড় বিজনেস দেখছো সেখানে ইয়াসিরের একবেলার পরিশ্রমও নেই।
ইয়াদ অবাক হয়ে বললো, তাহলে এতোবড় বিজনেস,,,?
আতিক ইয়াদের কথা শেষ করার আগেই বললো, তোমার দাদা সামলাতো, এটা তোমাদের পূর্বপুরুষদের ব্যবসা ছিলো। তাদের প্রত্যেকের যেনো রক্তে মিশে ছিলো বিজনেস কিন্তু ইয়াসির তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তৈরি হয়। স্কুল লাইফ থেকে লেখালেখি শুরু করেছিলো ইয়াসির।
ইয়াদ বুঝতে না পেরে বললো, মানে ?
আতিক উঠে দাঁড়িয়ে সামনের বুকশেলফের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, তোমার বাবা কবি টাইপের মানুষ ছিলো। তার কয়েকটা কবিতার বইও বের হয়েছিলো সেই সময়। তোমাদের সোসাইটির সাথে একদম অপরিচিত ছিলো ইয়াসির। সবাই জানতো তাফসির হামিদের (ইয়াদের দাদা) একটা ছেলে আছে তবে তাকে খুব কম মানুষ চিনতো।
ইয়াদ কোনো কথা না বলে মনোযোগ গিয়ে শুনছে আতিকের কথা।
আতিক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ইয়াসিরের কথা আরেকদিন বলবো আজ কলির কথা জানতে চেয়েছো তার কথাই বলছি। পৃথিবীর প্রায় সব ছেলেই কখনো না কখনো বন্ধুর ছোটবোনের প্রেমে পড়ে। কথাটা কোথাও শুনেছিলাম কিন্তু তার প্রমাণ পাই যখন আমিও পড়েছিলাম কলির প্রেমে।
আতিকের শেষের কথায় ইয়াদ চমকে তাকালো আতিকের দিকে। আতিক তা খেয়াল করে মুচকি হাঁসলো। ইয়াদ বুঝতে পারে না এই লোকটা সিরিয়াস মুডেও কীভাবে মুচকি হাসে।
ইয়াদের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে আতিক আবার বলে, ইয়াসির আমার বড় হলেও ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা গভীর হয়ে গিয়েছিলো পরিচয় হওয়ার মাত্র দু-মাসের মধ্যে। মাঝে মাঝেই তোমাদের বাসায় যাওয়া হতো আমার তবে কখনো কলিকে দেখিনি আমি। এসএসসি পরীক্ষার শেষে অবসর সময় প্রায় সারাদিন থাকতাম তোমাদের বাড়িতে। একদিন ইয়াসিরের রুমে শুয়ে ছিলাম আমি আর ইয়াসির ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচ্ছিলো। ও রেডি হয়ে গেলেই বাইরে যাবো এমন প্ল্যান ছিলো আমাদের। বেডে শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিলাম তখনই একটা বাচ্চা মেয়ে রুমে ঢুকে বলে ভাইয়া আমার মাটির পুতুলটা ভেঙে গেছে আমার এখনই সেইম একটা পুতুল চাই। কথাটা আজও আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারি। আমি তাকিয়ে থমকে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য। সাদা ফ্রক পড়া, মাথায় সাদা ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা দশ বছর বয়সী একটা মেয়ে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার কথা শুনে মনে হচ্ছিলো তার বয়স মাত্র তিন চার বছর হবে। আমার বয়স তখন সবে আঠার। প্রেমে পড়ার বয়স বলা চলে, তাই পড়েও গেলাম সাদা ফ্রক পড়া বাচ্চা মেয়েটার প্রেমে। পরে ইয়াসিরের থেকে জানতে পারলাম কলি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বয়সের তুলনায় তার মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটছেনা। তাই তাকে বাইরের দুনিয়া থেকে আড়ালে রাখে তার পরিবার।
এতটুকু বলে থামলো আতিক। ইয়াদ কখনো কল্পনাও করেনি তার জানার বাইরে তার পরিবারের এতো কথা লুকিয়ে আছে, তবে সবই রহস্যে ঘেরা। ইয়াদ যখনই ভাবে হয়তো সব রহস্যের সমাধান সে পেয়ে গেছে তখনই নতুন রহস্য তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেদিন ডক্টর আতিকের খোঁজেই ময়মনসিংহ গিয়েছিলো ইয়াদ, কারণ আতিকের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। সেখানে গিয়ে পেয়েও যায় আতিককে আর সাথে নিয়ে এসে নিরাপদ জায়গায় রাখে আতিককে। এখন সেখানেই বসে আছে ইয়াদ। আতিক তাকে অনেক কথায় বলছে আবার অনেকটা বলছে না। ইয়াদের জানামতে তার দাদা-দাদি মারা গেছে অনেক আগে তবে কখনো শুনেনি আর ফুপি সম্পর্কে। সেটা আতিকের থেকেই জেনেছে সেদিন। এখন ইয়াদের প্রশ্ন কোথায় আছে তার ফুপি।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩০
ইয়াদ নিজের চিন্তায় বিভোর তখনই আতিক আবার বলে উঠলো, কলির সম্পর্কে সেদিন সত্যিটা জানতে পেরে এক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। অজানা কারণে খুব কষ্ট হচ্ছিলো বুকের ভেতরটায়। সেদিনের পর কলিকে আর আমার থেকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়নি। সময় এগোতে থাকে নিজের গতিতে আর কলির প্রতি আমার অনুভূতিগুলো বাড়তে থাকে, কিন্তু একসময় ধরা পরে যাই ইয়াসিরের কাছে। ও সেদিন রাগ করেনি বরং বুঝিয়েছিলো কলির সাথে আমি সুখি হতে পারবো না। কিন্তু আমি ইয়াসিরের কোনো কথা শুনতে নারাজ। ইয়াসির সুযোগ বুঝে সবটা জানায় নিজের বাবাকে। তাফসির সাহেব কোনো রিয়াকশন করেননি তখন কিন্তু পরে জানান তিনি কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। তাফসির হামিদের সব থাকলেও মনে শান্তি ছিলো না,,, একমাত্র ছেলেটা সব কিছুতেই উদাসীন আবার অপর দিকে মেয়েটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। মেয়েটার একটা গতি হবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি। তবে আমার বাবা-মাকে রাজি করানো সহজ ছিলো না, অনেক কষ্টে তাদের মানাতে হয়েছিলো। শেষমেশ ঠিক হলো আমার মেডিকেল পড়া শেষ হলে আর কলির আঠারো বছর হলে বিয়ে হবে। ডাক্তারি পড়ার জন্য আমি চলে যাই ইউকে কিন্তু যখন ফিরে আসলাম তখন সব এলোমেলো হয়ে গেছে। একটা ঝড় সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে।
ইয়াদ খেয়াল করলো আতিকের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। ইয়াদ কাঁপা গলায় বললো, তাহলে ফুপি এখন কোথায় ?
আতিক শান্ত গলায় বললো, নেই।
ইয়াদ চমকে উঠে বললো, নেই মানে ?
আতিক ফ্লোরে বসে পড়লো ধপ করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো, সেদিন তোমার বাবা একটা খুন হয়নি, তার সাথে তার পুরো পরিবার খুন হয়েছিলো তোমার মা আর ডি কের হাতে।
ইয়াদ সোফায় থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। ইয়াদের মনে হচ্ছে সে শূন্যে ভাসছে, মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে নিজের কাছে।
ইয়াদ কাঁপা গলায় বললো, কী বলছেন এসব ?
আতিক উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বললো, ঠিক শুনেছো তুমি। তোমার মা আর ডি কে শুধু তোমার বাবার খুনি নয়। তোমার বাবা, দাদা-দাদী, ফুপি আর তোমার দাদার পি.এ ইমরুলের খুনি এই দুটো মানুষ রুপি নরপিশাচ।
ইয়াদ ধপ করে বসে পড়লো সোফায় শরীরটা কাঁপছে তার। এতোদিন জেনেছিলো শুধু তার বাবাকে খুন করেছে তারপর জানলো ইমার বাবাকেও খুন করেছে আর এখন আরো তিন জন মানুষ ? ইয়াদের ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে,,, এতো জঘন্য একজন মানুষের পেটে কেনো জন্ম নিতে হলো তার ? উত্তরটা হয়তো আল্লাহ তাআ’লা ভালো জানেন।
আতিক কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার কলিকে কোনো মারলো বলো তো ? ওকে আমার কাছে দিয়ে দিতো আমি ওকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতাম। আমার কলিটা তো বলতেও পারতো না তার বাবা-মাকে তার সামনে কে খুন করেছে। তাহলে কেনো মারলো আমার কলিকে ? যে মেয়েটার ছবি বুকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কবে তাকে প্রাণ ভরে দেখবো সামনে থেকে কিন্তু তাকে শেষবারের মতো দেখার ভাগ্য আমার হয়নি। মৃত্যুর সময় আমার কলি কতোটা কষ্ট পেয়েছে।
আতিক কাঁদছে আর ইয়াদ সোফায় বসে আছে মাথা নিচু করে। আতিককে কী সান্ত্বনা দিবে, ইয়াদের নিজের চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে।
আতিক নিজের চোখ মুছে বললো, সেদিন তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলো নিজেদের স্বার্থে। নাহলে তোমাকে মারতেও হয়তো হাত কাঁপতো না তাদের কারো। যে সম্পত্তির জন্য এতো কিছু করলো শেষে জানতে পারে ইয়াসিরের সাইন নিয়ে তাদের কোনো লাভই হয়নি। কারণ ইয়াসিরের নামে কোনো প্রোপার্টি ছিলোই না। ইয়াসিরের উদাসীনতার জন্য তোমার দাদা তার বেশির ভাগ প্রোপার্টি তোমার নামে করে দিয়েছিলো তোমার জন্মের পর পরই আর বাকিটা কলির নামে। উইলে উল্লেখ ছিলো একটা সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে কোনো কারণে কলি মারা গেলে তার নামের সব প্রোপার্টি বিভিন্ন এতিমখানার নামে চলে যাবে। আর কলির মৃত্যুর পর হয়েছেও সেটাই। তোমার নামের প্রোপার্টি তোমার আঠারো বছর হওয়ার আগে পর্যন্ত তোমার অভিভাবক দেখাশোনা করবে। তবে তোমার আঠারো বছর হলে তোমার প্রোপার্টি তুমি বুঝে নিতে পারবে কিন্তু বিক্রি করতে পারবে না। বিক্রি করতে বা কাউকে দিলেও পারবে না। এই দুটোর জন্য বিয়ের পর তোমার স্ত্রীর সিগনেচার লাগবে বিক্রি করতে বা কারো নামে উইল করে দিতে। আর তোমার ক্ষেত্রেও কোনো সন্তান জন্মের পূর্বে কোনো কারণে মৃত্যু হলে সব বিভিন্ন চ্যারিটির হাতে চলে যাবে। তবে তুমি আর তোমার স্ত্রী একসাথে মিলে বিক্রি বা কারো নামে উইল করে দিতে চাইলে সেটা করতে পারবে৷
ইয়াদ অবাক হয়ে শুনছে আতিকের কথা। তার দাদা এতো প্যাচ কেনো লাগিয়ে রেখেছে বুঝতে পারছে না। নাকি তাফসির হামিদ রুবিনা সম্পর্কে আগেই জেনে গিয়েছিলো বলে এতো প্ল্যান করে সব সাজিয়ে রেখেছিলো। যাতে ইয়াসির, কলি বা ইয়াদের ক্ষতি করে কারো লাভ নয় বরং লস হয়। ইয়াদ বুঝতে পারলো তার দাদা খুব তীক্ষ্ণ বৃদ্ধির অধিকারী ছিলেন। কাছেরটা না ভেবে দূরেরটা ভাবতো সবসময়।
ইয়াদ শান্ত ভাবে বললো, আপনি এতোকিছু কীভাবে জানলেন ? আপনি তো তখন ইউকে ছিলেন যখন এসব ঘটেছিলো।
আতিক নিজের চোখ মুছে ফ্লোর থেকে উঠে সোফায় ভালো করে বসলেন আর তারপর বললো, আমি যখন ফিরে আসি তখন এসব ঘটে যাওয়ার প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেছে। দেশে ফিরে ছুটে যাই হামিদ মঞ্জিলে কিন্তু সেখানে তালাবদ্ধ গেইট ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। গেইটের বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল এ বাড়িতে মানুষের পা পড়ে না কয়েক মাস পেড়িয়ে গেছে। আমি পাগল হয়ে যাই কলির চিন্তায়। কাকে জিজ্ঞেস করবো ভেবে কুল কিনারা পাই না। হঠাৎ আমার মনে পরে অফিসের কথা তাই দেড়ি না করে তোমাদের অফিসের পথ ধরি। অফিসে গিয়ে জানতে পারি তিন’মাস আগে তাফসির হামিদ আর তার স্ত্রী কন্যা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমার দুনিয়া থমকে গিয়েছিলো, মনে হচ্ছিল কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমার কলি আর এই পৃথিবীতে নেই সেটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ি। চোখে মুখে পানির ছিটা পড়তেই জ্ঞান ফিরে আমার। কোনো রিয়াকশন ছাড়া উঠে বসে জানতে চাই তোমার বাবার কথা। উত্তরে শুনতে পাই সে মিটিং রুমে, অফিসের মিটিং করছে, তার বাবার মৃত্যুর পর সেই নাকি বিজনেসের হাল ধরেছে। এতো শক খাওয়ার পর আরো একটা শক। যে ছেলে জীবনে অফিসে পা রাখেনি সে নাকি পুরো বিজনেসটা সামলাচ্ছে। অবাক হলেও পরে ভাবলাম হয়তো পরিস্থিতি এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। ওয়েটিং রুমে বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আর নিজের চোখের পানি মুছতে লাগলাম দু’হাতে।
এতটুকু বলে আতিক থাকলো। গলা শুকিয়ে গেছে তার। উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিল থেকে পর পর দু-গ্লাস পানি ঢকঢকে পান করে নিলো। ইয়াদের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। রাগ, ঘৃণা, কষ্ট আর প্রতিশোধের নেশায় একটা মিশ্র অনুভতি হচ্ছে ইয়াদের। আতিক পানি পান করে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো।
কিছু সময় চুপ থেকে আতিক আবার বললো, ইয়াসিরকে দেখে আমি যতটা না অবাক হয়েছিলাম তার থেকেও বেশী অবাক হই তার কথা শুনে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমি কে আর কাকে চাই ? প্রথমে ভেবেছিলাম অনেকগুলো বছর পর দেখেছে তাই হয়তো চিনতে পারছে না।কিন্তু যখন আমার নাম শুনেও চিনতে না পারলো তখন আমার সন্দেহ হয়। কিছু না বলে চলে আসি অফিস থেকে। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছিলাম না কী হচ্ছে এসব। দুদিন পর এখানকার একটা নামকরা প্রাইভেট হসপিটালে আমার জয়েন করার কথা ছিলো। দুদিন হন্যে হয়ে নিজের মনের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছি কিন্তু ফলাফল শূন্য অন্যদিকে কলির শূন্যতা আমাকে গ্রাস করছিলো একটু একটু করে। হতাশ হয়ে হসপিটালে জয়েন করি কিন্তু সেখানে যা দেখতে পাই তাতে কী রিয়াকশন দেওয়া উচিত সেটাও ভুলে গিয়েছিলাম।
ইয়াদ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে আতিকের দিকে। এতগুলো দিন অনেক চেষ্টা করেও তার থেকে বেশি কিছু জানতে পারেনি ইয়াদ। যখন যতটুকু বলার ইচ্ছে হয়েছে ততটুকু বলেছে। আর ইয়াদ চাইলেও উনার উপর জোর করতে পারেনি। কারণ কোনো কারণে উনার মানসিক অবস্থার অনেকটা অবনতি ঘটেছে সেটা জানতে পেরেছিলো ইয়াদ৷ জোর করলে উনার ক্ষতি হতে পারে আর ইয়াদের কাছে এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উনি তাই কখনো জোর করেনি। যতটুকু বলেছে ততটুকুই শুনে গেছে। মানসিক অবনতির কারণ তখন বুঝতে না পারলেও এখন ভালো করেই বুঝতে পারছে ইয়াদ। তার ফুপিকে যে এই মানুষটা পাগলের মতো ভালোবাসতো তার প্রামণ এতবছর পরও উনার হাউমাউ করে করা কান্নাটা। আজ নিজের ইচ্ছে তে উনি সব বলছে দেখে ইয়াদ চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। তার সবটা জানা খুব দরকার ছিলো।
ইয়াদ অস্থির গলায় বললো, কী দেখতে পান হসপিটালে গিয়ে ?
আতিক কিছু সময় চুপ থেকে বললো, আমার মাথা ব্যাথা করছে এখন আর কিছু বলতে পারবো না। আমার কলিকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
ইয়াদ বুঝতে পারলো উনার উপর বেশি চাপ পরে গেছে আজ, তাই আর কিছু বললো না। উনাকে ঘুমাতে বলে বের হয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। ইয়াদ প্রতিদিন এখানে আসে যদি কিছু জানতে পারে সেই আশায়। আজ অনেক কিছু জানতে পেরেছে সে, তবে আরো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে মনে। তার উত্তর একমাত্র আতিক হোসাইন দিতে পারেন।ইয়াদ ড্রাইভ করে অফিসের দিকে যাচ্ছে, রেগে নেই তবে মনে মনে ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিলো।
বিড়বিড় করে বললো, আবরার হামিদ ইয়াদ অনেককে হসপিটালে পাঠালেও এখনো কাউকে কবরে পাঠায়নি। কবরে পাঠানোটা শুরু আর শেষ হয়তো মিসেস এন্ড মিস্টার কবির দিয়েই হবে।
ইয়াদ ভেবেছিলো সব প্রমাণ জোগাড় করে এদের আইনের হাতে তোলে দেবে কিন্তু এসব জানার পর সেটা কখনোই করবে না। ইয়াদ এদের নিজের হাতে একটু একটু করে শাস্তি দেবে। কতগুলো জীবন কেড়ে নিয়েছে এরা। কেনো শুধুমাত্র কিছু প্রোপার্টির জন্য ? ইয়াদের বাবার খুন তার চোখের সামনে হয়েছে বলে কিছুটা মনে আছে কিন্তু দাদা-দাদী বা ফুপির কোনো স্মৃতি তার মস্তিষ্কে নেই।আজ রুবিনা কবিরের উপর ঘৃণাটা কয়েক গুন বেড়ে গেলো ইয়াদের।
৩০.
ডি কে বিরক্ত হয়ে সোফায় বসে আছে আর রুবিনা বেডে। ডি কের বিরক্তির কারণ রুবিনাকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছে সেটাও সে করতে পারছে না।
দিসার বিরক্ত হয়ে বললো, তোমার এই একটা কাজ করতে আর কতদিন লাগবে বলতে পারো ?
রুবিনা দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললো, ঐ মেয়ের আশেপাশে গেলেই বিরক্ত লাগে আমার। ওর সাথে মিশে সিগনেচার জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব না, আমি আগেই বলেছি।
দিসার রেগে বললো, হাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কেউ কাজগুলো করে দিয়ে যাবে না। বিদেশ থেকে ফেরার পর তোমার ছেলে যেদিন থেকে অফিসে জয়েন করেছে সামান্য কিছু করতে গেলেও তার অনুমতি নিতে হয় আমাকে। এসব আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। ইয়াদের সিগনেচার জোগাড় করা আরো কঠিন কারণ সে প্রত্যেকটা বিষয়ে অতিরিক্ত পরিমাণের সচেতন। তোমার মতো মাথা মোটা মহিলা আর ইয়াসিরের মতো গাধার ছেলে এমন চালাক কী করে হলো বুঝতে পারি না আমি। এই কোনোভাবে ইয়াদ আমার ছেলে নয়তো ?
রুবিনা রেগে বললো, ইয়াদ যখন জন্ম নেয় তখন তুমি জেলে পঁচে মরছো দু’বছর ধরে। তাহলে ও তোমার ছেলে হলো কীভাবে ?
ডি কে চিন্তা করে বললো, তাহলে ওর এতো তীক্ষ্ণ চিন্তা ভাবনা কী করে হলো ?
রুবিনা ভাবলেশহীন ভাবে বললো, ইয়াদের দাদার সামনে তোমার চালাকি কিছুই না। দেখো না, এমন প্যাঁচ লাগিয়ে রেখেছে এতোবছর ধরে খুলতে পারছি না। ইয়াদ ওর দাদার মতো হয়েছে।
ডি কে বিরক্ত হয়ে বললো, তবু তো বুড়োটার গুষ্টি শুদ্ধো বিনাশ আমিই করলাম। এখন শুধু ইয়াদ আর ইয়ানা বাকি রয়ে গেছে।
ডি কের কথা শুনে চমকে উঠলো রুবিনা ব্যস্ত গলায় বললো, এটা কী বলছো ? তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে ইয়াদ বা ইয়ানাকে তুমি প্রাণে মারবে না। ইয়াদকে প্যারালাইজড করে রাখবে আর ইয়ানাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।
ডি কে থতমত খেয়ে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই করবো একবার শুধু সব হাতে পেয়ে যাই।
কথাটা শেষ করে ডি কে রহস্যময় ভাবে হাসলো যা রুবিনার নজরে এলো না। ডি কে রুবিনাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে লাগলো ইমার থেকে কীভাবে সিগনেচার নিতে হবে।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩১
মনে হচ্ছে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিয়েছে চারপাশ। দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কিছু কানে আসছে না। ইমা মিনি ছাঁদে বসে গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে। চিন্তা আর বিষন্নতা ইমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে। ঘড়িতে রাত দুটো বেজে বিশ মিনিট ইয়াদের এখনো কোনো খবর নেই। ইয়াদ রাত করে বাসায় ফিরলেও কখনো এতো রাত করে না। ইমা অনেকবার ইয়াদের নাম্বারে ট্রাই করেছে কিন্তু সুইচ অফ বলছে। আজ ইয়ানাকেও কিছু জানাতে পারেনি কারণ ইয়ানা ভার্সিটি থেকে এসে আর রুম থেকেই বের হয়নি কী হয়েছে তাও বলেনি। ইমার চোখ লেগে এসেছিলো ডাইনিং টেবিলে বসে থেকে। রাত একটায় ঘড়ির টুং শব্দে ঘুম ছুটে যায়, তখন খেয়াল করে দেখে ইয়াদ আসেনি। আবার কল দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু বারবার ওপাশ থেকে একজন ভদ্র মহিলার বলা দুঃখীত আওয়াজটাই কানে আসে। ইমা ডাইনিং টেবিল থেকে রুমের মিনি ছাঁদে এসে বসেছে তাও এক ঘন্টার অধিক সময় চলে গেছে। ইয়াদ সকালে বের হয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ নেই। রনিত জানিয়েছে ইয়াদ রাত নয়টার দিকে অফিস থেকে বের হয়ে গেছে। ইমার অজান্তে চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, হে খোদা তুমি কী আমার ভাগ্যে একটু সুখ লিখতে পারতে না ? আমার ভাগ্যে তিক্ততা ছাড়া আর কিছু কী দেওয়ার মতো ছিলো না ?
ইমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দিতে লাগলো। অন্যদিকে ইয়ানার চোখ মুখ ফোলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরমান আর তার কলিগ মিস নিরার সেই দৃশ্য। ম্যাথ প্রবলেমের বাহানা বানিয়ে আরমানের কাছে যাওয়ার জন্য কেবিনের সামনে গেলে ভেতর থেকে মিস নিরার আওয়াজ পেয়ে ইয়ানার পা থমকে যায়। ইয়ানা দরজা নক না করে ধীর পায়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানলাটা খোলাই ছিলো তাই ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে অসুবিধা হয়নি ইয়ানার। মিস নিরা ভার্সিটিতে নতুন জয়েন করেছে টিচার হিসাবে, মাত্র কয়মাস আগেই। আরমানের সামনে হাটু মুড়ে বসে আছে আর হাতে এক গুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে। ইয়ানা চমকে উঠলো ভেতরের দৃশ্য দেখে। ইয়ানার মনে আরমানের প্রতি ভালো লাগাটা ভালোবাসায় রুপ নিয়েছে অনেক আগেই সেটা ইয়ানা ঠিক বুঝতে পেরেছে। তাই তো নানা অজুহাতে চেষ্টা করেছে আরমানের কাছে যাওয়ার, তার সাথে কথা বলার। ইয়ানা নিজেকে সামলে নিলো এই দৃশ্য দেখেও কারণ তার বিশ্বাস আরমান কখনো একসেপ্ট করবে না। কিন্তু পরক্ষণে ইয়ানার প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে আরমান নিরার হাতের ফুলগুলো নিজের হাতে নিলো আর ফুলগুলোর ঘ্রাণ নিয়ে মুচকি হাঁসলো। ইয়ানার অজান্তে দুচোখ ভড়ে উঠলো নোনা জলে। আরমান কিছু বলার আগেই নিরা উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো আরমানকে। ইয়ানার পক্ষে এর থেকে বেশি দেখা সম্ভব হলো না। ঘুরে দাঁড়ালো উল্টো দিকে আর হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আর এক মুহূর্ত দেড়ি না করে বের হয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে। বাসায় এসে নিজের রুমে গিয়ে আর বের হয়নি। ইমা অনেকবার নক করেছে কিন্তু ইয়ানা দরজা খুলেনি। ইমা ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে। বাকি দিনটা কেঁদে কাটিয়েছে, রাত গভীর হওয়ার সাথে ইয়ানার বুকের ভেতরটা আরো ভারী হয়ে আসছে।
৩১.
গেইটে গাড়ির আলো পড়তেই ইমা চোখ মুছে নিলো আর ভালো করে লক্ষ্য করলো ইয়াদের গাড়ি ঢুকছে। ইমা দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালো। ইয়াদের কাছে চাবি থাকে সবসময় তাই নক না করে দরজা খোলে ভেতরে ঢুকলো। ইমা ড্রয়িংরুমে পা ফেলতেই চমকে উঠলো। ইয়াদ এলোমেলো পা ফেলে রুমের দিকেই আসছে। ইয়াদকে দেখে যে কেউ বলতে পারবে সে ড্রিংক করেছে। ইমার পা যেনো জমে গেছে নাড়াতে পারছে না জায়গা থেকে। বিয়ের এতোদিনে ইমা একটা সিগারেট খেতে দেখেনি ইয়াদকে। প্রচন্ড রেগে গেলে মিনি ছাঁদে ঝুলানো পাঞ্চিং ব্যাগে পাগলের মতো পাঞ্চ করতে দেখেছে। তবে আজ ইয়াদ ড্রিংক করেছে সেটা কীভাবে স্বাভাবিক ভাবে নিবে ইমা ? কী হয়েছে ইয়াদের কোনো এমন করেছে তার উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ইমা। ইয়াদকে হোচট খেয়ে পরে যেতে দেখে ইমা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দ্রুত গিয়ে ধরে ফেললো, ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট একটা হাসি দিলো। মদের বিশ্রি গন্ধে ইমার পেটের সব বের হয়ে আসার উপক্রম তবু ধরে রইলো ইয়াদকে। কখনো ড্রিংক না করার কারণে একটুতেই নেশা হয়ে গেছে পুরো। অন্যসময় হলে ইমা হয়তো মন্ত্র মুগ্ধের মতো ইয়াদের হাসিটা উপভোগ করতো কারণ ইয়াদকে এই প্রথম হাসতে দেখলো ইমা তবু এই অবস্থায়। ইমা চোখ সরিয়ে নিলো ইয়াদের থেকে। ইয়াদকে ধরে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে নিয়ে বেডে কাছে যেতেই ইয়াদ বেডের কার্নিশে ধাক্কা খেয়ে ইমাকে নিয়ে বেডে পড়ে গেলো। ইয়াদ নিচে পড়লো আর ইমা ইয়াদের উপরে। ইমার মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেছে অনেক আগেই, চুলগুলোতে মুখ ঢেকে গেছে, ইয়াদ নিজের হাতে চুলগুলো সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো।
নেশাগ্রস্ত গলায় বললো, তুমি না অনেক সুন্দর, একদম সদ্য ফোঁটা নীল পদ্মের মতো। ইচ্ছে করে দুচোখ ভরে দেখতে থাকি।
ইয়াদের গলায় এমন কথা শুনে ইমার কান গরম হয়ে উঠলো। ইমা যদিও জানে ইয়াদ এসব নিজের সজ্ঞানে বলছে না আর কোনোদিন বলবে কিনা তাও জানা নেই। তবু ইমাকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিচ্ছে ইয়াদের কথাগুলো। ইমা বুঝে উঠতে পারছে না তার কী করা উচিত। ইয়াদ দু’হাতে ইমার কোমর জড়িয়ে ধরলো ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের স্পর্শে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এটা ঠিক হচ্ছে না ইয়াদ এখন নিজের মধ্যে নেই। ইমা ইয়াদের হাত ছাড়িয়ে উঠতে গেলে ইয়াদ ইমার হাত টেনে আবার নিজের উপর ফেলে দেয়।
ইয়াদ কাঁপা গলায় বললো, আমার মাও খুব সুন্দর আর সেই সৌন্দর্যের মায়াজালে আঁটকে গিয়েছিলো আমার বাবা। কিন্তু আমি সেই ভুল কখনো করবো না। এই পৃথিবীতে আবার আমার মতো নতুন কোনো ইয়াদের আগমন হতে দিবো না। তুমিও আমার মায়ের মতো ধোঁকা দিবে তাই না ইমা, বলো না ?
ইমা চমকে উঠলো ইয়াদের কথায়, কী বলছে এসব ইয়াদ ? ইমা কিছুই বুঝতে পারছে না।
ইমা কাঁপা গলায় বললো, কী বলছেন আপনি এসব ?
ইয়াদ অসহায় গলায় বললো, বলো না ইমা তুমিও আমার মায়ের মতো ধোঁকা দিবে ? ধ্বংস করে দিবে আমার সাজানো পৃথিবীটা। যেমনটা আমার মা করেছে তুমিও করবে ?
ইমা স্তব্ধ হয়ে গেছে ইয়াদের কথা শুনে। ইমা জানে ইয়াদের মা কতটা জঘন্য একজন মানুষ আর সেই ছবিগুলো তার প্রমাণ কিন্তু ইয়াদ কীভাবে ভাবলো ইমাও তার মায়ের মতো হতে পারে। ইমা নিজের বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
ইমার উত্তর না পেয়ে ইয়াদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। ইমাকে নিজের উপর থেকে বিছানায় ফেলে ইমার গলা চেপে ধরলো ইমা কিছু বুঝে উঠার আগেই।
ইয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, কথা বলছিস না কেনো তুই ? আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর কেনো দিচ্ছিস না ? আমার কথা কানে যাচ্ছে না তোর ? তুইও করবি ঐ জঘন্য মহিলার মতো ? তুইও তো ঐ মহিলার মতো মায়াবী আর না চাইতেও আমি আমার বাবার মতো একই ভুল করে ফেলেছি। আমিও আটকা পড়ে গেছি তোর ঐ মায়াবী চোখের মায়াজালে।
ইমার দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে চোখদুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। কিছু বলার মতো শক্তিও পাচ্ছে না ইয়াদ এতো জোরে চেপে ধরেছে। ইমা কিছু বলার আগেই ইয়াদ নিজেই ইমার গলা ছেড়ে ইমার গালে হাত রাখলো। ইমা ছাড়া পেয়ে কাশতে লাগলো আর হাসফাস করতে লাগলো।
ইয়াদ ইমার চোখ নিজের হাতে মুছে দিয়ে বললো, কষ্ট হচ্ছে, এই তোমার কষ্ট হচ্ছে ? জানো আমারও কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, আমার জীবনটা এমন কেনো হলো জানতে ইচ্ছে করে। কেনো আমার মা আর পাঁচটা মায়ের মতো হলো না ? চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে আমার বাবা আমাকে বলছে ইয়াদ তোর মা খুনি, আমাকে আর আমার পুরো পরিবারটাকে খুন করেছে তোর মা।
ইমা অসহায় চোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াদের চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে আর তা দেখে ইমার বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। ইমার হয়তো রাগ করা উচিত ইয়াদের ব্যবহারে কিন্তু ইমার রাগ হচ্ছে না বরং ইয়াদের জন্য কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই পাথরের মতো মানুষটার ভেতরে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে ইমা। ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে উঠে বেড ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়লো। দুহাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইমা দ্রুত উঠে এসে ইয়াদের সামনে বসলো।
ইয়াদের মুখটা নিজের হাতের আঁজলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, কী হয়েছে আপনার, আপনি এমন করছেন কেনো ? আমাকে বলুন কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার ?
ইয়াদ আবার ইমার দুগাল ধরে বললো, তুমি আমাকে কখনো ধোঁকা দিও না প্লিজ। আমি আর নিতে পারছি না মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
“মরে যেতে ইচ্ছে করছে” কথা শুনে ইমার বুকটা ধক করে উঠলো। ইয়াদকে কাঁদতে দেখে এমনিতেই কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে ইমার। একটু কষ্টে এমন করে কাঁদার মতো মানুষ ইয়াদ নয় সেটা ইমা ভালো করেই জানে। ইমা একটু উঁচু হয়ে ইয়াদের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি কখনো আপনাকে ধোঁকা দেবো না, আপনি শান্ত হন দয়া করে।
ইমা ফ্লোরে বসে আছে আর ইয়াদ ইমার বুকে মাথা রেখে ফ্লোরে শুয়ে আছে শান্ত হয়ে। ইমা এতোক্ষণে খেয়াল করলো ইয়ারে হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে আবার রক্ত জমাটও বেঁধে আছে অনেকটা জায়গায়, পুরো হাতে রক্ত শুকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছুতে পাঞ্চ করার জন্য হাত কেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে থেমে গিয়েছিলো এখন আবার কোনো আঘাত লেগে বের হচ্ছে। ইমা ইয়াদের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আবার কেঁদে দিলো। ইয়াদ ইমার বুকে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে তাই ইমা সরতেও পারছে না ব্যান্ডেজ আনার জন্য। আশেপাশে তাকিয়ে বেড়ে নিজের একটা ওড়না দেখতে পেলো, সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পেঁচিয়ে দিলো ইয়াদের হাতে তারপর ওড়নার ওপর দিয়ে কিস করে আবার কাঁদতে লাগলো। ইয়াদ ঘুমিয়ে পড়েছে ইমার বুকে আর ইমা ইয়াদের মাথাটা দু-হাতে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। ইয়াদের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না ইমার আর নিজের কষ্টের কথা ভুলে গেছে ইয়াদকে দেখে।
সারাদিন অফিসে ছটফট করেছে ইয়াদ, নিজেকে আটকাতে পারেনি তখন। অফিস থেকে বের হয়ে আবার ছুটে গিয়েছিলো আতিকের কাছে বাকিটা শুনতে। পুরোটা শুনে ইয়াদের বুকটা জ্বলতে শুরু করে। কিছুতেই নিজেকে সামলে উঠতে পারে না। আতিকের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গাড়ির কাঁচে সজোরে পাঞ্চ করে। কাঁচ ভাঙার সাথে হাত কেটে রক্ত বের হতে থাকে সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে হাই স্প্রিডে ড্রাইভ করতে শুরু করে। ফাঁকা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদে কিছুটা সময়। কিন্তু কিছুতেই বুকের ভারী ভাবটা কমে না। ছুটে যায় নাইট ক্লাবের দিকে যেখানে সে আগে কখনো পা রাখেনি আর ভবিষ্যতে রাখবে কিনা তাও জানে না। অনেক সময় নিজের সাথে যুদ্ধ করে গলায় ঢেলে দেয় এলকোহল নামক তিক্ত পানীয়। বুকের কষ্টটা কমলো কিনা ইয়াদ বুঝতে পারলো না তবে খেয়ে নিলো আরো কিছুটা। একসময় বের হয়ে আসে ক্লাব থেকে এলোমেলো পায় গাড়ির কাছে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পরেও যায় দুবার। এলোমেলো গাড়ি চালিয়ে বাসায় পৌঁছায় কোনো মতে।
৩২.
ভোরের আলো ফোটতে শুরু করেছে বাইরে, পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। ইমা এখনো ফ্লোরে বসে আছে সেভাবেই। ইয়াদ ইমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে৷ ইমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটার দিকে। বাকি রাতটা ইমা এভাবেই পার করেছে। ইমা ভাবছে ইয়াদ কী কখনো সজ্ঞানে এভাবে তার কোলে মাথা রাখবে ? পরক্ষণে ভাবলো ইয়াদের দোষ কোথায় যদি সে মেয়েদের সহ্য করতে না পারে ? একটা ছেলে মেয়েদের সম্মান করতে শেখে তার মায়ের থেকে। মেয়ের বিশ্বাস করতে শেখে তার মাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার পর। একটা ছেলে নিজের মাকে দিয়ে সমস্ত মেয়ে জাতিকে চিনতে, জানতে শিখবে সেটাই স্বাভাবিক। একজন সন্তানের প্রথম শিক্ষক তার মা। তাহলে ইয়াদের দোষ কোথায় যদি মেয়েদের বিশ্বাস না করে। কারণ ইয়াদ জেনেছে যার চোখ দিয়ে তার দুনিয়া চেনার কথা সেই মানুষটাই জঘণ্য। তাহলে কীভাবে বিশ্বাস করবে বাকি মানুষগুলোকে ? ইমা ইয়াদের কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
বিড়বিড় করে বললো, আমি কখনো পারবো না আপনার জীবনের অতীতের কষ্টগুলো মুছে দিতে। তবে এটুকু বিশ্বাস অবশ্যই অর্জন করবো সব মানুষ এক হয় না। কখনো ধোঁকা দেওয়া তো দূর হাজার কষ্ট দিলেও আপনার দিকে অভিযোগ নিয়ে তাকাবো না।
ইয়াদের ঘুম ভেঙে গেছে আগেই তবে চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না, মাথাটা ভারী লাগছে। সে বুঝতেও পারেনি সে কোথায় শুয়ে আছে আর বোঝার চেষ্টাও করেনি৷ ইমা ইয়াদের কপালে কিস করতেই ইয়াদের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। ইমা বিড়বিড় করে কথাগুলো বললেও ইয়াদের কথাগুলো শুনতে প্রবলেম হলো না ইমার এতো কাছে থাকার জন্য। চোখ বন্ধ অবস্থায় ইয়াদ অনুভব করতে পারলো সে কোথায় আছে। ইমার কথাগুলো শুনতেই চোখের কোণ বেয়ে পানির কণা গাড়িয়ে গেলো। সবটা মনে না পড়লেও রাতের অনেক কথা আবছা মনে পরে গেলো। ইমা ইয়াদের চোখের কোণের পানি ঠিকই খেয়াল করলো। হাতের আঁজল পেতে পানির কণাটা হাতের তালুতে নিলো।
মুচকি হেঁসে বললো, ছেলেদের চোখের পানি মুক্তার চেয়েও অনেক বেশি দামী হয়। মুক্তা তো গভীর সাগরের অতলে ঝিনুকের মাঝে লুকিয়ে থাকে আর ছেলের চোখের পানি মনের ঠিক কতটা গভীরে লুকানো থাকে সেটা হয়তো কেউ কখনো খুঁজে বের করতে পারবে না। মুক্তা তো খোঁজলেই পাওয়া যায়।
ইয়াদ মনে মনে বললো, তোমাকে আর প্রমাণ করতে হবে না সব মানুষ এক হয় না। তার প্রমাণ তুমি প্রথম থেকেই দিয়ে এসেছো। গতরাতে তোমার সাথে যে বিহেভটা করেছি জানি না তার জন্য সরাসরি কখনো ক্ষমা চাইতে পারবো কিনা। তাই মনে মনে চেয়ে নিলাম। যে জঘন্য মানুষগুলোর জন্য তোমার মতো নিষ্পাপকে ভুল বুঝতে বাধ্য হয়েছিলাম তাদের শাস্তি দেওয়ার সময় হয়ে গেছে ইমা, কঠিন শাস্তি।
ইয়াদের ইচ্ছে করছে না ইমার কোল থেকে নিজের মাথা সরিয়ে নিতে। মনে হচ্ছে অনেক বছর পর একটা শান্তির জায়গা খুঁজে পেয়েছে। সেখানে থাকলে কোন কষ্ট তাকে ছুঁতে পারবে না। সারারাত বসে থাকার জন্য ইমার পিঠ ব্যাথা করছে। ইমা নড়াচড়া করতেই ইয়াদ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো, চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। ইয়াদ অপলক তাকিয়ে আছে ইমার চোখদুটোর দিকে। ইমাও থমকে গেছে ইয়াদের ঘুমঘুম চোখে তাকানো দেখে। তবে মনে মনে ভয় পাচ্ছে, ইয়াদ কী রিয়াকশন দেবে নিজেকে ইমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে দেখে ? ইয়াদের চোখ গেলো ইমার গলার দিকে, ফর্সা গলায় ইয়াদের হাতের ছাপের কালো দাগ পরে গেছে। ইয়াদের বুকটা কেঁপে উঠলো ইমার গলা দেখে, মেয়েটাকে কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবে নিজেও কষ্ট পেলো।
ইমা কাঁপা গলায় বললো, আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার জন্য লেবুর পানি নিয়ে আসছি, খেয়ে নিলে ভালো লাগবে।
ইয়াদ ইমার কথায় কর্ণপাত না করে আগের মতোই ইমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমা ইতস্তত বোধ করছে ইয়াদের এমন দৃষ্টি দেখে।
ইয়াদ আনমনে বললো, সামনে যে ঝড়টা আসছে, পারবে তো আমার হাতটা শক্ত করে ধরে পাশে থাকতে, নাকি ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে ?
ইমা ইয়াদের মুখে এমন কথা শুনে একটু বেশি অবাক হলো, কারণ এখন যে ইয়াদ নেশায় নেই সেটা বুঝাই যাচ্ছে। তাহলে এমন কথার মানে কী ?
ইমা চিন্তিত হয়ে বললো, কী হয়েছে আপনার, কী বলছেন এসব ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, হয়নি তবে হবে।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩২
ইমা বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বললো, কী হবে ?
ইয়াদ আর কিছু না বলে উঠে বসলো তারপর ইমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেঁসে বললো, সেটা খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবে। তবে যাই হবে তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখো।
ইয়াদ ইমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ইমা সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। কেনো যেনো ইমার ভয় করতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে যেটা হতে চলেছে সেটা ভালো কিছু হবে না বরং খুব খারাপ হবে। ইয়াদের হঠাৎ এমন শান্ত হয়ে যাওয়া বিশাল কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে। ইমা আর ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে না থেকে উঠে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তবে মাথা থেকে চিন্তাটা কিছুতেই গেলো না। ইয়াদ শাওয়ার ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যা করার আজই করতে হবে নাহলে দেরি হয়ে যাবে। ইয়াদ শাওয়ার নিয়ে বের হলো টাওয়েল পড়ে, কিছু নিয়ে যায়নি ওয়াশরুম যাওয়ার সময় তাই বাঁধ্য হয়ে টাওয়েল পড়ে বের হতে হলো। ইয়াদ বিষন্ন মন নিয়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে। ইমা লেবুর পানি নিয়ে রুমে এসে দেখে ইয়াদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে, কোমরে একটা টাওয়েল জড়ানো। ইয়াদের দিকে তাকিয়ে সেদিনের মতো ইমার হাতে থাকা গ্লাসটা কাঁপতে লাগলো, এতে উপরে ঢেকে দেওয়া ঢাকনা আর গ্লাসে ঠকঠক শব্দ তৈরী হতে লাগলো। ইয়াদ অদ্ভুত শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ইমা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। ইয়াদ ধীর পায়ে ইমার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো আর তাতে ইমার কাঁপা-কাঁপি অনেক বেড়ে গেলো। ইয়াদ ইমার হাত থেকে লেবুর পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। ইমার দৃষ্টি ইয়াদের মসৃণ বুকে বিন্দু বিন্দু পানির দিকে। ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাঁসলো।
আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ইয়ানা কী উঠেছে ?
ইয়াদের মুখে ইয়ানার কথা শুনে ইমার বুকটা ধক করে উঠলো। ইয়াদের চিন্তায় ইয়ানার কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। এখন ইয়াদকে যদি বলে ইয়ানা গতকাল দুপুর থেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে নিজেকে, তাহলে ইয়াদ তাকে কী করবে কে জানে ?
ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, কী হলো কথা বলছো না কেনো ?
ইমা আমতা আমতা করে বললো, ইয়ে মানে ?
ইয়াদ সিরিয়াস হয়ে বললো, ইমা কী হয়েছে স্পষ্ট করে বলো ?
ইমা কাঁপা গলায় বললো, ইয়ানা আপু গতকাল দুপুরে ভার্সিটি থেকে এসে রুমে গেছে আর বের হয়নি। আমি অনেক ডেকেছি দরজাও খুলেনি।
ইয়াদ চমকে উঠে বললো, হোয়াট,,,,? ইয়ানা গতকাল দুপুর থেকে রুমে বসে আছে আর তুমি এখন আমাকে জানাচ্ছো ?
ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আপনার ফোন অফ ছিলো আমি কীভাবে জানাতাম ?
ইয়াদ রেগে বললো, আমার ফোন রাতে অফ ছিলো দুপুরে নয় ইডিয়ট। তুমি তখনই আমাকে জানাওনি কেনো ?
ইমা ভয় পেয়ে গেলো ইয়াদের রাগ দেখে তবু ধীর গলায় বললো, আপু দুপুরে বলেছিলো ক্লান্ত লাগছে ঘুমাবো, ডিস্টার্ব করো না। কিন্তু আর খুলবে না সেটা আমি জানবো কীভাবে ? আর যখন আপনাকে জানাতে যাবো তখন আপনার ফোন অফ হয়ে গিয়েছিলো।
ইয়াদ ইমাকে আর কিছু না বলে দ্রুত চেঞ্জ করে ইয়ানার রুমের দিকে দৌড় লাগালো। দরজায় জোরে জোরে নক করে ইয়ানাকে ডাকতে লাগলো। অনেক সময় ডাকার পরও যখন সাড়া পেলো না, ইয়াদের ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো। বোনটার কিছু হলে ইয়াদ বাঁচতে পারবে না। দরজা ভাঙার সীদ্ধান্ত নিতেই ইয়ানা দরজা খোলে দিলো।
ইয়াদ ইয়ানার দু’কাধ ধরে রাগী গলায় বললো, কী হয়েছে দরজা খুলছিলি না কেনো ? জানিস কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ? কী হয়েছে তোর ?
ইয়াদ এতগুলো প্রশ্ন শেষে ইয়ানার দিকে খেয়াল করলো। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ইয়াদের কলিজা কেঁপে উঠলো। চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে ফোলে আছে।
ইয়াদ ইয়ানার মুখটা দু’হাতে ধরে বললো, কী অবস্থা করেছিস নিজের ? কী হয়েছে বোন, আমাকেও বলবি না ?
ইয়ানা শান্ত গলায় বললো, ভাইয়া গতকাল মাথা ব্যাথা করছিলো তাই ভার্সিটি থেকে এসে শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙে অনেক রাতে তারপরে আর ঘুমাতে পারিনি তাই এমন দেখাচ্ছে। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো তাই আর কী শুনতে পাইনি ডাকছিলে।
ইয়ানার কথার সাথে মুখের অবস্থার মিল পেলো না ইয়াদ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারা রাতে এক ফোঁটা ঘুমায়নি ইয়ানা।
তবু কথা বাড়ালো না ইয়াদ ইয়ানার মাথায় হাত রেখে বললো, ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে এক জায়গায় নিয়ে যাবো তোকে।
ইয়ানা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, কোথায় ?
ইয়াদ মলিন হেঁসে বললো, গেলেই দেখতে পাবি আর ইশানকেও বল ও আমাদের সাথে যাবে।
ইয়ানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ইয়াদ চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। ইমা ইয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো সেও চলে গেলো ইয়াদের পিছু পিছু।
ইমা রুমে ঢুকে পেছন থেকে বললো, কোথায় যাবেন ?
ইয়াদ রেডি হতে হতে বললো, গেলেই দেখতে পাবে। আজ আমার জীবনের আরো একটা অধ্যায় তোমাদের সামনে আসবে। রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি করে।
৩২.
ইয়াদের কথায় সবাই ব্রেকফাস্ট করে নিলো তবে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ইয়াসির বা রুবিনার কোনো দেখা মিললো না। এটা নতুন কিছু নয় তাই কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। খাওয়া শেষে সবাই একসাথে বের হলো। ইয়াদ ড্রাইভ করছে আর ইমা তার পাশে বসে আছে, পিছনের সীটে ইশান আর ইয়ানা।
আশেপাশে তাকিয়ে ইয়ানা বললো, ভাইয়া এটা কোথাকার রাস্তা ?
ইয়াদ উত্তরে কিছু বললো না চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো। উত্তর না পেয়ে ইয়ানাও চুপ করে গেলো। প্রায় জঙ্গলে ঘেরা একটা পুরানো বাড়ির সামনে ইয়াদ গাড়ি থামালো। আশেপাশে তাকিয়ে সবার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। সকাল বেলায় মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
ইয়ানা আর ইমা তো ভয়ে রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে।
ইয়ানা ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললো, ভাইয়া তুমি আমাদের ভূতের বাড়ি কেনো নিয়ে এসেছো ?
ইয়াদ কিছু না বলে সামনে আগাতে লাগলো আর তার পিছু পিছু সবাই। পায়ের নিচে শুঁকনো পাতার শব্দেও গা শিউরে উঠছে বারবার। ইশানের পায়ের নিচে একটা গাছের শুকনো ডাল পরলে মট করে ভেঙে গেলো। ইমা চিৎকার করে ইয়াদের হাত আঁকড়ে ধরে ফেললো আর ইয়ানা ভয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। ইয়াদ সেদিকে নজর না দিয়ে সামনের একটা গোডাউনের মতো জায়গার দিকে এগিয়ে গেলো। ইশান ইয়ানাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে যাওয়ার ইশারা করলো। ইয়াদ সামনে যেতেই ভেতর থেকে দরজা খোলে গেলো। ইয়াদের হাত ধরে ইমাও ভেতরে ঢুকে পড়লো আর পেছন পেছন ইশান আর ইয়ানা। ভেতরে গিয়ে অবাক হলো কারণ ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছে না এটা পুরনো গোডাউন তবে সামনে তাকিয়ে ইমা, ইয়ানা আর ইশানের পা থমকে গেলো ইয়াদ ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে পড়লো।
ইশান চমকে উঠে বললো, এসব কী ভাইয়া ? বাবা-মাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে কারা ?
ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, আমি।
তিনজনই চমকে তাকালো ইয়াদের দিকে আর ইয়ানা অবাক হয়ে বললো, কিন্তু কেনো ?
ইয়াদ আগের ভঙ্গিতে বললো, উনাদের পাপের হিসাব দেওয়ার সময় হয়েছে তাই।
ইশান এবার রেগে বললো, ভাইয়া এসব কী হচ্ছে ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
ইয়াদ ইশানের দিকে তাকিয়ে বললো, একটু অপেক্ষা কর সব বুঝতে পারবি।
ইয়াদ ইশারা করতেই জাম্বী গিয়ে রুবিনা আর ডি কের মুখের টেপ খুলে দিলো।
ডি কে রেগে চিৎকার করে বললো, এসব কী ধরনের বেয়াদবি ইয়াদ ?
ইয়াদ দিগুণ তেজী গলায় বললো, গলা নামিয়ে কথা বলুন মিস্টার দিসার কবির ওরফে ডি কে।
ইয়াদের মুখে দিসার কবির নাম শুনে মনে হয় আকাশ থেকে পড়লো রুবিনা আর দিসার।
কাঁপা গলায় দিসার বললো, কীসের ডি কে আর কে দিসার ? ইয়াদ তোমার মাথা ঠিক আছে ? আমি তোমার বাবা ইয়াসির হামিদ।
ইয়াদ একটা চেয়ার টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসলো আর তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, নিজের নামই ভুলো গেছেন মিস্টার দিসার কবির। তা অবশ্য ভুলবারই কথা, এতোগুলা বছর ধরে ইয়াসির হামিদের মুখোশ যে পরে আছেন। তবে মিস্টার দিসার আপনি ভুলে গেছেন সামান্য একটা প্লাস্টিক সার্জারি করে কারো মুখোশ লাগানো গেলেও কখনো সেই মানুষটা হয়ে উঠা যায় না।
ইশান অবাক হয়ে বললো, ভাইয়া তোমার মাথা ঠিক আছে তো নাকি ? কী সব বলে যাচ্ছো পাগলের মতো ?
ইয়াদ ইয়ানা আর ইশানের উদ্দেশ্য বললো, তোদের আজ এমন কিছু সত্যি জানাতে এখানে আনা হয়েছে যার কিছুটা আমি আজ থেকে বারো বছর আগেই জেনেছিলাম। পুরোটা আমাকে তখন জানানো হয়নি কারণ বয়স কম ছিলো সামলে উঠতে পারবো না। কিন্তু যতটুকু জেনেছিলাম সেটাও সামলে উঠতে পারিনি আর তার ফল স্বরুপ তোদের সামনের এই রোবটের মতো আচরণ করা আবরার হামিদ ইয়াদ। যে সেই বারো বছর আগে হাসতে ভুলে গেছে, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভুলে গেছে। তবে সব সত্যি জানার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর বাকিটাও জানা হয়ে গেছে আমার। এবার জানার পালা তোদের আর ইমা তোমারও আজ কিছু জানার আছে তাই কোনো প্রশ্ন না করে শুধু দেখতে থাকো। তো মিস্টার দিসার আমরা কোথায় ছিলাম ? আপনি নিজের নাম তো ভুলে গেছেন দেখুন তো এই মানুষটাকে চিনতে পারেন কি না ?
ইয়াদ ইশারা করতেই আতিক প্রবেশ করলো রুমে তাকে দেখে দিসারের ভ্রু কুঁচকে গেলো কারণ সে চিনতে পারছে না আতিককে।
দিসার বিরক্তি নিয়ে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, কে এটা ?
ইয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, চিনতে পারলেন না তো, চেনার কথাও নয়। কারণ উনি ইয়াসির হামিদের প্রাণ প্রিয় বন্ধু, দিসার কবিরের নয়। উনার আরো একটা পরিচয় আছে, উনি ইয়াসির হামিদের আদরের বোনের হবু স্বামী ছিলেন। যে বোনকে মাথায় আঘাতের পর আঘাত দিয়ে আপনি নিজ হাতে খুন করেছেন। আর উনাকেও খুন করতে চেয়েছিলেন তবে সেটা না চিনেই।
দিসার এবার চমকে উঠলো ইয়াদের কথায়, কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়তে লাগলো। ইয়াদ তা দেখে মুচকি হাঁসলো আর বললো, কোনো ব্যাপার না পরের জনকে আপনি অবশ্যই চিনতে পারবেন।
ইয়াদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এক ভদ্রলোক রুমে প্রবেশ করলো তাকে দেখে দিসার আর রুবিনার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম হলো।
দিসার উত্তেজিত গলায় বললো, কামরুল তুই ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, যাক চিনতে পেরেছেন তাহলে নিজেদের পার্টনারকে।
রুবিনা কথা বলতে ভুলে গেছে। এতো বছর পর তাদের সত্যিটা এভাবে সামনে আসবে কখনো ভাবেনি তারা কেউ। দুজনের বুঝতে বাকি রইলো না আর কিছুই অজানা নেই ইয়াদের।
দিসার রেগে বললো, কামরুল তুই আমার থেকে এতগুলো টাকা নিয়ে বলেছিলি জীবনে আর কোনোদিন আমাদের সামনে আসবি না আর সত্যিটা কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না।
ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না মিস্টার দিসার। আজ হোক বা কাল, সত্যিটা সামনে আসবেই।
দিসার এবার শয়তানি হেঁসে বললো, তো এতোকিছু জেনে গেছো আর এটা জানোনি আমি কে আর কী ?
ইয়াদ বাঁকা হেঁসে বললো, এতোটা সময় নিয়েছি কোনো কাঁচা কাজ করতে নয় মিস্টার দিসার কবির ওরফে ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া ডি কে। আচ্ছা আপনার কানে কী একবারও আঘাত করেনি আমি আপনাকে কতোবার ডি কে বলে ডেকেছি, তবু বুঝতে পারেননি আমি কোনো ডি কে বলছি আপনাকে। এই মাথা নিয়ে এতকিছু কীভাবে করলেন বলুন তো ?
ইয়াদের কথায় দিসারের মুখ হা হয়ে গেলো, সবসময় ডি কে নামে সবাইকে সাড়া দিতে দিতে তার খেয়ালই হয়নি ইয়াদ তাকে ডি কে ডেকেছে।
ইশান অবাক হয়ে বললো, মাফিয়া ?
ইয়ানা থম মেরে দাড়িয়ে আছে, কী হচ্ছে সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইমা কিছুটা জানতো বলে তেমন রিয়াকশন দিচ্ছে না বরং পুরোটা জানার চেষ্টা করছে। রুবিনা হা করে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে।
ইয়াদ ইশানের প্রশ্নে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ইয়েস মাফিয়া, ড্রাগস সাপ্লাই, নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র পাচার এমন আরো অনেক মহান কাজের লিডার উনি। জানেন তো মিস্টার ডি কে, আমি চাইলে আরো বারো বছর আগেই প্রশ্ন তুলতে পারতাম আমার বাবার খুনের, যেদিন এই সত্যিটা জেনেছিলাম। কিন্তু তখন কিছুতেই পেরে উঠতাম না আপনার সাথে৷ আমি চাইলে ডিএনএ টেস্টের সাহায্যে প্রমাণ করতে পারতাম আপনি আপনার বাবা নন। তবে এতে আপনার লস হতো না বরং আমার লস হতো। টাকার জোরে প্রমাণ করে দিতেন আপনি ইয়াসির হামিদ আর আমি ইয়াসির হামিদের সন্তান আবরার হামিদ ইয়াদ নই। তাই ফিরে গিয়েছিলাম নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলতে আর আজ দেখুন আপনার ক্ষমতা আমার সামনে শূন্য।
ইয়ানা আর না পেরে ইয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ভাইয়া তুমি কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হচ্ছে এসব, উনি আমাদের বাবা।
ইয়াদ ইয়ানার দুগালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, ইয়ানা উনি আমাদের বাবা নন। আমাদের বাবা তো তোর জন্মের আগেই খুন হয়ে গেছে এই নরপশুদের হাতে।
ইয়াদ চোখ মুছে জাম্বীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই বড় পর্দায় একটার পর একটা সেই ছবিগুলো ভাসতে লাগলো। ইয়ানা দু কদম পিছিয়ে গেলো সাথে ইশান। ইয়ানা আর ইশান চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে রুবিনা আর দিসারের দিকে তাকালো। রুবিনা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেললেও অনুশোচনার কোনো চিহ্ন দেখা গেলো না দিসারের চেহারায়।
ইয়ানা বললো, আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না ভাইয়া এই ছবিগুলো,,,,
ইয়াদ দিসারের দিকে তাকিয়ে বললো, তো মিস্টার ডি কে বুঝানোর দ্বায়িত্বটা আপনি নিবেন না কি আমাকেই বলতে হবে।
দিসার রেগে চিৎকার করে বললো, হ্যাঁ আমরা খুন করেছি ইয়াসির হামিদ আর তার পুরো পরিবারকে।
ইয়ানা পরে যেতে নিলে ইমা ইয়ানাকে সামলে নেয় আর ইয়াদ তাকিয়ে আছে তার মা নামক মানুষটার দিকে। আজ কেনো চোখ তুলে নিজের সন্তানদের দিকে তাকাতে পারছে না। এখনো তো পুরোটা জানে না ইয়ানা আর ইশান। পুরোটা জানলে মা নামক মানুষটার মুখ দেখবে তো আর কোনোদিন ? দিসারের পরিণতি ইয়াদের ঠিক করা হয়ে গেছে কিন্তু রুবিনার কী শাস্তি দেবে সেটা ঠিক করতে পারছে না। সৎ মা তো নয়, নিজের আপন মা, যার গর্ভে দশ মাস দশদিন আশ্রয় পেয়ে এই পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এ তো সেই মা যার এক ফোঁটা দুধের দাম দেওয়ার মতো সামর্থ্য আল্লাহ পৃথিবীর কোনো সন্তানকে দান করেনি। কথাগুলো ভাবতেই ইয়াদের চোখ ভড়ে উঠলো পানিতে। পরক্ষণে চোখের সামনে ভেসে উঠলো দম আটকে আসা বাবার একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করা সেই দৃশ্য।
ইয়াদ রুবিনার সামনে গিয়ে বললো, একটু মায়া হয়নি তার জন্য যার সাথে ছয়টা বছর সংসার করছেন ? একটু মায়া হয়নি যার সাথে ছয় ছয়টা বছর ভালোবাসার অভিনয় করে গেছেন, অভিনয় করতে করতে ভালো না বাসলেও, তার জন্য একটু মায়ারও জন্ম হয়নি আপনার মনে ? একটুও হাত কাঁপেনি যার সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করে পৃথিবী দেখিয়েছেন তার শ্বাসরুদ্ধ করতে।
কথাগুলো বলতে বলতে ইয়াদের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো তবু ইয়াদ থামলো না। আবার বললো, একটু কষ্ট হয়নি যারা নিজের বাবা-মায়ের মতো আপনাকে আগলে নিয়েছিলো তাদের মৃত্যুর পরিকল্পনায় সামিল হতে। আপনার পরিবার তো আপনাকে আবর্জনা মনে করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো আর সেখানে ঐ মানুষগুলো আপনাকে আপন করে কাছে টেনে নিয়েছিলো। কষ্ট হয়নি তাদের ধোঁকা দিতে, একটু বিবেকও বাঁধেনি আপনার ?
রুবিনা কিছু বলছে না মাথা নিচু করে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে। ইয়ানা অপলক তাকিয়ে আছে মা আর ভাইয়ের দিকে। এখনো সে অনেক কিছুই বুঝতে পারেনি আর ইশানও। তাদের মনে অনেক অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছে ক্রমাগত।
ইশান ভাঙা গলায় বললো, ভাইয়া আমি,,,
ইয়াদ ইশানের দিকে না তাকিয়ে উত্তরে বললো, একটু অপেক্ষা কর একে একে সব প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাবি।
চলবে,,,,
চলবে,,,,,,
চলবে,,,,