তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব -৩৭+৩৮+৩৯+৪০

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩৭

বৃষ্টি যেনো আজ থামার নামই নিচ্ছে না। চারদিকে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে আকাশ। বিরতি দিয়ে দিয়ে বৃষ্টি ঝরে পরছে। জানলা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ইমা, বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ইয়াদ আজ সাইটে গেছে কনস্ট্রাকশনের কাজ কতদূর এগিয়েছে সেটা নিজে দেখার জন্য। ইমা টেনশনে আছে যদি কোনোমতে বৃষ্টিতে ভেজে তাহলে ইয়াদের কী অবস্থা হবে ? বিকেলেই ফোনে জানিয়েছিলো ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। ফোন অফ পেলো যাতে ইমা চিন্তা না করে। তাতে কী আর চিন্তা থেমে থাকে ? ইমা ভেবে পাচ্ছে না এই বৃষ্টির দিনেই কেনো যেতে হবে সেখানে।

আসবো ভাবি ?

ইমা দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আপু আসো।

ইয়ানা রুমে ঢুকে বললো, ভাবি তুমি খেয়ে নাও, ভাইয়া আসলে পরে খেয়ে নিবে।

ইয়ানা জানে ইমা ইয়াদকে রেখে খাবে না তবু প্রতিদিন খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করতে আসে।

না আপু তোমরা খেয়ে নাও, আমি উনার সাথে খেয়ে নিবো।

ইয়ানা আর কিছু না বলে মুচকি হেঁসে বের হয়ে গেলো। ইয়ানার আর কোনো চিন্তা নেই নিজের ভাইয়াকে নিয়ে। তার খেয়াল রাখার মানুষ ইয়ানা নিজেই খোঁজে দিয়েছে। ইয়ানা ডিনার করে রুমে গিয়ে দেখে তার ফোনটা বেজে চলেছে বিরতিহীন ভাবে। হাতে নিয়ে দেখলো রেহানের নাম্বার। কোনো রিয়াকশন ছাড়াই রিসিভ করে কানে ধরলো।

ডিনার করেছো ?

ইয়ানা ছোট করে উত্তর দিলো, হুম।

গুড এবার চুপচাপ ঘুমিয়ে যাও। একদম ফোন ঘাটবে না এখন, বুঝতে পেরেছো ?

ইয়ানা এবারও আগের মতো উত্তর দিলো, হুম।

গুড গার্ল, এবার ফটাফট ঘুমাও, গুড নাইট।

গুড নাইট।

ইয়ানা ফোন কেটে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেদিনের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে ইয়ানা এখনো নিজের সিদ্ধান্ত কাউকে জানায়নি। তবে রেহান প্রতিদিন তিন বার ফোন করে ইয়ানার খোঁজ খবর নেয় আর ইয়ানা শুধু হুম আর নাতে উত্তর দেয়। ইয়ানা ফোন রিসিভ না করলে দিতেই থাকে কিন্তু অনেকবার ফোন দেওয়ার পর যখন ইয়ানা রিসিভ করে তখন একবার জিজ্ঞেসও করে না এতো লেট কেনো হলো রিসিভ করতে। আগে রেহানের সাথে যতটা ফ্রি ছিলো এখন তার থেকে কয়েকগুণ বেশি আনইজি ফিল করে কথা বলতে। সেদিনের পর রেহান ইয়ানাকে বিয়ে নিয়ে কিছুই বলেনি আর না কাউকে বলতে দিয়েছে। তবে ইয়ানা এখন আরমানের থেকে হয়তো রেহানকে নিয়ে বেশি চিন্তা ভাবনা করে। ফোনটা পাশে রেখে ধপাস করে শুয়ে পড়লো ইয়ানা।

৩৬.
ডান হাতে মাথার ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বাসার ভেতরে ঢুকলো ইয়াদ। ইমা ডাইনিং টেবিলে বসে ছিলো গালে হাত দিয়ে। ইয়াদকে দেখে উঠে দ্রুত এগিয়ে এলো ইয়াদের দিকে।

ব্যস্ত গলায় বললো, একি আপনি ভিজলেন কীভাবে ?

ইয়াদ দুষ্টুমি করে বললো, বাইরে লেবুর জুস পরছে আকাশ থেকে সেগুলো দিয়েই ভিজে গেছি।

ইমা এগিয়ে গিয়ে নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে ইয়াদের মাথার চুল মুছিয়ে দিতে দিতে বললো, কী দরকার ছিলো এই বৃষ্টির মধ্যে সেখানে যাওয়ার ? অন্যদিন গেলে কী হতো ?

ইয়াদের মুখে কথা নেই। সে ব্যস্ত কপাল কুঁচকে তার মাথার চুল মুছিয়ে দিতে দিতে শাসন করতে থাকা মেয়েটাকে দেখতে। কতটা চিন্তিত তাকে নিয়ে, এটুকুতেই এতটা অস্থির হয়ে গেছে।

ইমা বিরক্তি নিয়ে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, কী হলো আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আপনাকে ? এমনভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে নতুন কোনো প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন শো করা হচ্ছে আমার মুখে।

ইমা তখনো ইয়াদের চুল মুছতে ব্যস্ত আর ইয়াদ আমতা আমতা করে বললো, কী জিজ্ঞেস করেছো ?

ইমা আবারও বললো, আজ না গিয়ে অন্যদিন গেলেও তো হতো।

ইয়াদ ইমার দিকে দৃষ্টি রেখে বললো, কিছু প্রবলেম হয়েছিলো তাই যাওয়াটা প্রয়োজন ছিলো।

ইমা সরে গিয়ে বললো, ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।

ইমার সরে যাওয়া ইয়াদের ভালো লাগলো না। ইয়াদের ইচ্ছে করছিলো ইমার কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নেওয়ার কিন্তু কোথাও একটা জড়তা কাজ করছে। অনেক সময় চলে গেছে দূরত্ব বজায় রাখতে রাখতে, এখন সহজেই সেটা পরিবর্তন করতে পারছে না। ইমা কিচেনের দিকে চলে গেলে আর ইয়াদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

সিঁড়ির কাছে পা রাখতেই ইমা কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে চেচিয়ে বললো, একদম শাওয়ার নিবেন না বলে দিলাম। শুধু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিবেন।

ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, ইমা সারাদিন অফিসে কাজ করেছি আর বাইরেও গিয়েছিলাম এখন শাওয়ার না নিলে ভালো লাগবে না।

ইমা কড়া গলায় বললো, সকালে শাওয়ার নিয়েছেন তো, কতবার নিতে হয় শাওয়ার ? আর অফিসে ছিলেন তো কী হয়েছে ? এমনভাবে বলছেন, যেনো অফিসে আপনি কুড়াল দিয়ে কাঠ কেটে এসেছেন। এসি রুমে বসে কাজ করে আবার শাওয়ার নিতে হয় ? চুপচাপ গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসুন। এমনই বৃষ্টিতে মাথা ভিজিয়ে এসেছেন এখন আবার শাওয়ার নিয়ে জ্বর বাঁধানোর ধান্দা ?

ইয়াদের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, কেনো সে অসুস্থ হয়েছিলো ? এই মেয়ে এখন তাকে দিনে একবারের বেশি শাওয়ার নিতে দেয় না। বৃষ্টি থাকতে পারে তো রুমে বসিয়ে রাখে, ব্লাংকেট দিয়ে মুড়িয়ে। ইমাটা দিন দিন ওভার সেনসিটিভ হয়ে যাচ্ছে ইয়াদের বিষয়ে। ইয়াদ জানে এখন যদি ইমার বারণ করা সত্ত্বেও সে শাওয়ার নেয় তাহলে সারারাত ইমার বকবক শুনতে হবে। তাই রুমে গিয়ে শুধু হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে দিলো। নিচে এসে দেখলো ইমা এখনো কিচেনে আছে। ইয়াদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো কিচেনের দিকে। ইমা ইলিশ মাছ ভাঁজছে কোমরে শাড়ীর আঁচল গুজে দিয়ে, একপাশের মেদ বিহীন পেটটা দৃশ্যমান, চুলগুলো হাত খোঁপা করা তার জন্য ঘাড়ের দিকটাও দৃশ্যমান। ইয়াদের এখন খুব ইচ্ছে করছে ইমার খোলা পেটে হাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু ইয়াদের পা আঁটকে আছে সে এগুতে পারছে না। ইমার হঠাৎ মনে হলো তার পেছনে কেউ আছে আর তাই ফট করে ঘুরে তাকালো।

ইয়াদকে দেখে অবাক হয়ে বললো, আরে আপনি এখানে কী করছেন ? আপনি গিয়ে বসুন আমি এখনই আসছি। সব সাজিয়ে দিয়েছি এখন শুরু মাছটা হয়ে গেলেই কমপ্লিট।

ইয়াদ থতমত খেয়েও নিজেকে সামলে নিলো, তুমি এখন মাছ ভাজছো কেনো ?

ইলিশ মাছ গরম গরম ভাজা ভালো লাগে তাই এখনই ভেজে দিচ্ছি। আগে করে রাখলে খেয়ে তৃপ্তি পেতেন না।

ওহ্,,,, তো আর কতক্ষণ ওয়েট করতে হবে ? পেটে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে ক্ষুধায়।

ইমা পেছন ঘুরে কোমরে হাত দিয়ে নাক ফুলিয়ে বললো, লেট করে বাসায় আসার সময় ক্ষুধা কোথায় থাকে ? বাড়ি আসলে তখন এক মিনিট সহ্য হয় না।

ইয়াদ ঢোক গিলে বললো, ঠিক আছে তুমি আসো আমি গিয়ে বসছি।

ইয়াদ মানে মানে কেটে পড়লো ইমার সামনে থেকে আরো কিছু শোনানোর আগেই। চেয়ার টেনে বসে পরলো ইয়াদ, সামনে খাবার সাজানো। ভুনা খিচুড়ি, গরুর মাংস কশা, মুরগির মাংস ঝোল, সালাত আর দেখতে দেখতে ইমা ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো।

প্লেটে খাবার দিয়ে বললো, যেটা ভালো লাগে খান।

ইয়াদ কোনটা দিয়ে খাবে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি মানেই আলাদা স্বাদ। ইয়াদ খেতে গিয়ে থেমে গেলো।

কী হলো না খেয়ে বসে রইলেন কেনো ?

ইয়াদ পাশে বসে থাকা ইমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো, তুমি খেয়েছো কিছু ?

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, খেয়ে নিবো আপনার পরে, আপনি আগে খান তো।

ইয়াদ এখনো সহজভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে না। তবে আজ ইয়াদের অন্যকিছু ইচ্ছে করছে কিন্তু কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

আমতা আমতা করে বললো, পরে না আজ তুমিও আমার সাথেই খেয়ে নাও।

ইমা বেশ অবাক হলো ইয়াদের কথা শুনে সাথে খুশিও। নিজের অনুভূতি আড়াল করে বললো, আপনি খেয়ে নিন চুপচাপ।

ইয়াদ কথা না বাড়িয়ে এক চামচ খাবার ইমার সামনে ধরলো। এবার বিস্ময়ে চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম ইমার। ইয়াদ তাকে নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিতে চাইছে ? ইমা নিজের হাতে নিজেই একটা চিমটি কাটলো। না স্বপ্ন না, সে ঠিকই দেখছে।

কী হলো হা না করে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছো কেনো এভাবে ?

না মানে আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি সেটা চিন্তা করছি আর কী ?

বাজে না বকে হা করো চুপচাপ।

ইমা কথা না বাড়িয়ে খাবারটা মুখে নিলো। ইয়াদ নিজেও খেতে লাগলো আর ইমাকেও খাওয়াতে লাগলো। তবে ইমা পুরোটা সময় ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো ইয়াদের দিকে। এতে ইয়াদের অস্বস্তি হলেও ইমাকে বুঝতে দেয়নি।

আচ্ছা আপনি এর আগে কখনো কাউকে খাইয়ে দিয়েছেন ?

ইয়াদ একটু চমকালো ইমার প্রশ্নে, তবে সেটা ইমা বুঝতে পারার আগেই উত্তর দিলো, হ্যাঁ।

ইয়াদের মুখে হ্যাঁ শুনে ইমার খাবার গলায় আঁটকে হেঁচকি উঠে গেলো। ইয়াদ ব্যস্ত হয়ে ইমাকে পানি খাইয়ে দিয়ে মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

ধমক দিয়ে বললো, সাবধানে খেতে পারো না একটু, এখন ঠিক লাগছে ?

ইমার মুখ মলিন হয়ে আছে ইয়াদের হ্যাঁ শুনে। ইয়াদের কথার উত্তর দিচ্ছে না। ইয়াদ তা খেয়াল করে মনে মনে হাসলো।

ইয়াদ ইমাকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বললো, ইয়ানা অনেক সময় আমার উপর রাগ করে না খেয়ে বসে থাকতো। তখন ওর রাগ ভাঙিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিতাম।

ইমা বড়বড় চোখ না তাকালো ইয়াদের দিকে তা দেখে ইয়াদ মুচকি হেঁসে উঠে চলে গেলো। ইমাও মুচকি হাঁসলো ইয়াদের দিকে তাকিয়ে। নিজের মাথায় একটা চাটি মেরে টেবিল গুছাতে লাগলো, সে কী কী ভেবেছিলো। ইমার বিশ্বাসই হচ্ছে না আজ ইয়াদ তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে। ইমা সব গুছিয়ে রুমে চলে গেলো খুশি মনে। ইয়াদ বেডে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করেছে মনোযোগ দিয়ে।

সারাদিন অফিসে কী করেন, বাসায় এসেও কাজ করতে হয় ?

অফিসে বসে হট হট নাইকাদের আইটেম সং দেখি, তাই বাসায় এসে কাজ করতে হয়।

ইয়াদের কথা শুনে ইমা রাগে ফুসফুস করতে লাগলো। দুম করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে লাগলো। ইমা রাগে চুল আঁচড়ানোর বদলে টেনে টেনে ছিঁড়ছে।

চুলের উপর রাগ না ঝেড়ে যার উপর রাগ উঠেছে তার উপর ঝাড়লেই পারো। শুধু শুধু নিরীহ চুলের উপর কেনো অত্যাচার করছো ?

ইমা রাগে ফুসফুস করতে করতে বললো, আমার চুলের সাথে আমার যা ইচ্ছা তাই করবো, তাতে আপনার কী হ্যাঁ ?

ইয়াদ হাসি মুখে বললো, আমার অনেক কিছু। সেটা তুমি বুঝতে পারলে চুলগুলোর উপর অত্যাচার না করে যত্নে রাখতে।

ইমা ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইয়াদের দিকে। ইয়াদ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রেখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ইমা রেগে বললে, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো, অফিসে গিয়ে হট হট মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকুন।

ইয়াদ মুচকি হেঁসে উঠে ইমার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ইমার হাত থেকে হেয়ার ব্রাশটা নিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে লাগলো। ইমার মুখটা হা হয়ে গেলো ইয়াদের কাজে।

ইয়াদ দুষ্টুমি করে বললো, খাবার খাওয়াতে আসিনি এমন হা করে বসে আছো। চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে বসো।

ইমা কয়েকবার চোখ পিটপিট করে বললো, এই দেখুন না, আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। কী সব ভুলভাল দেখছি সেই কখন থেকে।

ইয়াদ কিছুই বললো না চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলো। ইয়াদ বেশ ইনজয় করছে ইমার এমন রিয়াকশন দেখে। আগে জানলে এমনটা আরো অনেক আগেই করতো ইয়াদ। ইমার হা করে তাকিয়ে আয়নায় ইয়াদের প্রতিচ্ছবি দেখছে। ইয়াদ সুন্দর করে বেনি করে দিলো। ইয়াদ বেনিটা ইমার হাতে দিলে ইমার হা আরো কয়েকগুণ বড় হয়ে গেলো।

অবাকের চরম পর্যায়ে গিয়ে বললো, আপনি এতো সুন্দর বেনি কীভাবে করতে জানেন ?

ইয়াদ আবার পেছনে গিয়ে বেডে বসে বললো, ইয়ানা স্কুলে পড়ার সময় আমিই বেনি করে দিতাম ওর চুলে। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে আর নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে শিখে যায়। এখন এই বেনি নিয়ে গবেষণা না করে ঘুমাতে এসো অনেক রাত হয়ে গেছে।

ইয়াদ আর ইমা এখন এক বেডেই ঘুমায় মাঝে কোলবালিশ দিয়ে। এতোটুকুই উন্নতি হয়েছে তাদের সম্পর্কের।

ইমার হঠাৎ অন্য কথা মাথায় এলো আর আমতা আমতা করে বললো, আপনাকে একটা কথা বলতে চাইছি কিছুদিন ধরে।

ইয়াদ ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে বললো, কী কথা বলো ?

ইমা শাড়ীর আঁচল আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো, আমি একবার গ্রামে যেতে চাই। মায়ের কবরটা একবার দূর থেকে দেখতে চাই।

ইয়াদের হাত থেমে গেলো ইমার কথা শুনে। মা শব্দটা শুনেই মনে পরে গেলো রুবিনার কথা। দুদিন আগেই দিসারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ইয়াদ ইশানকে যেতে বলেছিলো কিন্তু ইশান স্পষ্ট বলেছে, সে ঐ লোকের কেউ হয় না। মনিকাও দিসারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আর দিয়ার দিসারকে নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। সে তার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। লাশ কেউ না নেওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দিসারের খবর জানার সময় রুবিনার খরবও জেনেছে। রুবিনার অবস্থা আগের থেকে একটু ভালো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে তারও ফাঁসি কার্যকর করা হবে খুব তাড়াতাড়ি। ভাবতেই বুক ছিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো ইয়াদের।

কী হলো, কী এতো ভেবে যাচ্ছেন ? যেতে দিবেন একটু, আমি কথাকে সাথে নিয়ে চলে যাবো।

ইয়াদ নির্বিকার গলায় বললো, না।

চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩৮

ইয়াদ নির্বিকার গলায় বললো, না।

ইমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ইয়াদের দিকে আর কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, কিন্তু কেনো ?

ইয়াদ কাজ করতে করতে বললো, কথাকে নিয়ে যেতে হবে কেনো ? আমি নিয়ে যাবো তোমাকে আর দু-তিনদিন পর।

ইমা অবাক হয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো, কীহ্ ?

ইয়াদ কানে হাত দিয়ে বললো, ইশ এভাবে কেউ চিৎকার করে ? এখনই কানের বারোটা বেজে যেতো আমার।

ইমা ইয়াদের কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো, সত্যি যাবেন আপনি ?

ইয়াদ ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে মুচকি হেঁসে বললো, হুম তবে শর্ত আছে।

ইমার মুখ মলিন হয়ে গেলো শর্তের কথা শুনে, থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো, কী শর্ত ?

ইয়াদ ল্যাপটপ রেখে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, সকালে নিয়ে যাবো আবার সন্ধ্যায় চলে আসবো। একদম থাকার বায়না করবে না।

ইমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আমার ভাগ্য সবার মতো নয়। কার কাছে থাকবো ? থাকার মতো কেউ তো নেই আমার। অন্য সবার মতো রাগ করে বাবার বাড়ি যাওয়ার হুমকিও কখনো দিতে পারবো না আপনাকে। সেই ভাগ্যই আমার নেই।

কথা বলতে বলতে ইমার গলা ধরা এলো। ইয়াদ মাথা নিচু করে ফেলেছে ইমার কথা শুনে। পরক্ষণে উঠে গিয়ে ইমার সামনে দাঁড়ালো আর ইমার মাথা পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ইয়াদ জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে ইমা ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

ইয়াদ শান্ত গলায় বললো, হুশ একদম কাঁদবে না। তোমার আমি আছি আর আমার তুমি আসো। আমিও তো শশুর বাড়ির জামাই আদর পাবো না, তাই বলে কী কাঁদছি নাকি ?

ইয়াদের কথা শুনে ইমা কান্নার মাঝেই ফিক করে হেঁসে দিলো তা দেখে ইয়াদ স্বস্তি পেলো। ইমাকে ছেড়ে দুগালে হাত রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলি নিয়ে চোখ মুছে দিলো আলতো করে।

তবে তুমি চাইলে রাগ করে ফার্মহাউসে চলে যেতে পারো তারপর আমি গিয়ে তোমার রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে আসবো।

ইমা ভ্রু কুঁচকে ইয়াদের দিকে তাকালো। এই হয়তো একমাত্র ব্যক্তি হবে, যে নিজের বউকে বলে দিচ্ছে রাগ করে কোথায় যাবে। ইমার তাকানো দেখে ইয়াদ বোকার মতো হাসলো। হাসিটা তীরের মতো বিঁধল ইমার মনে। ইয়াদকে হাঁসলে আরো কয়েকগুণ বেশি সুন্দর লাগে দেখতে।

ইমা হঠাৎ বলে উঠলো, আপনি একদম হাসবেন না কারো সামনে।

ইয়াদ অবাক হয়ে বলে উঠলো, কেনো, আমার হাসি কী খুব বাজে দেখতে লাগে ?

ইমা মুখ কুঁচকে বললো, ঠিক বলেছেন, আপনি হাসলে মনে হয়ে,,,

কী মনে হয় ?

ইমা আমতা আমতা করে বললো, কিছু না, হাসবেন না কারো সামনে। শুধু আমার সামনে হাসবেন।

ইয়াদ কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ইমার দিকে। ইমা এদিক ওদিক তাকিয়ে দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করলো। তা দেখে ইয়াদ হা হা করে হাসতে লাগলো। ইমা এবার মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো ইয়াদের দিকে।

ইয়াদ হাসি বন্ধ করে বললো, এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে না গিয়ে শুয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে।

ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো আর ইমা সেদিক কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বেডে চলে গেলো। ইয়াদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইমার পাশে শুয়ে পরলো মাঝে কোলবালিশ রেখে।

ইমা হতাশ গলায় বললো, আমি তো কথাকে বলেছি যেদিন যাই সেদিন এখানে চলে আসতে।

ইয়াদ ঘুরে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক আছে এতে প্রবলেম কোথায় ? ইয়ানা একা থাকবে বাসায়, ওর সাথে থাকবে সারাদিন।

ইমা খুশি হয়ে বললো, এটা তো ভেবেই দেখিনি।

এখন আর ভাবতে হবে না ঘুমাও চুপচাপ।

ইয়াদ হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিলের লাইট অফ করে দিলো আর এখন শুধু ডিম লাইট জ্বলছে। ইয়াদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো কিন্তু ইমা বারবার এবার ওপাশ করছে।

ইয়াদ চোখ বন্ধ করেই বললো, কী হলো ইঁদুরের মতো নড়াচড়া করছো কেনো ?

ইমা মলিন গলায় বললো, ঘুম আসছে না।

ইয়াদ কিছু না বলে উঠে কোলবালিশ সরিয়ে হেলান দিয়ে বেডে বসলো ইমার কাছে গিয়ে। ইমা বড় বড় চোখ করে তাকালো ইয়াদের দিকে। ইয়াদ ইমাকে একটু কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইমা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে।

চোখ বড় বড় করার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি না, চোখ বন্ধ করে ঘুমাও।

ইমা ইয়াদের ধমক শুনে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইয়াদ তা দেখে মুচকি হেঁসে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অনেকটা সময় পর ইয়াদ খেয়াল করলো ইমা ঘুমিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইমার ঘুমন্ত মুখের দিকে। হঠাৎ ইয়াদের মনে অদ্ভুত ইচ্ছে জাগলো আর সে নিজেকে আটকাতে পারলো না ইচ্ছেটা পূরণ করা থেকে। ইমার কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। একসময় সেও ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো। ফজরের আযান কানে আসতেই ইমার ঘুম ভেঙে গেলো। নড়াচড়া করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে ধীরে ধীরে চোখ খোলে তাকালো। চোখ খোলে ইমা অবাক হয়ে গেলো। ইয়াদের বুকে শুয়ে আছে সে আর ইয়াদ তাকে দু’হাতে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে আছে। হঠাৎ লজ্জা ঘিরে ধরলো ইমাকে। ইয়াদের সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে ভাবতেই গা শিউরে উঠে গালদুটো রক্ত লাল রং ধারণ করলো। নিজেকে না ছাড়িয়ে ইয়াদের বুকে আবার মুখ লুকালো সে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ইমার মনে। এই প্রথম ইয়াদের এতো কাছে এসেছে ইমা। আযানের ধ্বনি তীব্র হলে মনে হলো তার উঠে যাওয়া উচিত কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ইয়াদের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলো না তাই ধীরে ধীরে ডাকতে লাগলো ইয়াদকে।

এই যে শুনছেন আযান হয়েছে, উঠুন।

ইমার ডাকে ইয়াদ তো উঠলোই না উল্টো আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ইমাকে। ইমা এবার পড়লো মহা বিপদে। উপায় না পেয়ে ইয়াদের বুকে টুস করে চিমটি কেটে দিলো। ইয়াদ আহ্ বলে ছোট করে চিৎকার করে চোখ খুলে ফেললো। ইমা ইয়াদের বুক থেকে মাথা উঁচু করে ইয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, এটা কী হলো ?

ইমা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললো, আযান হয়েছে সেই কখন, নামাজ পড়বো না আমি ?

তো পড়ো গিয়ে, আমাকে কেনো চিমটি কাটছো, আমি কী তোমাকে ধরে রেখেছি ?

নিজের দিকে ভালো করে তাকান তাহলেই বুঝতে পারবেন কেনো চিমটি কেটেছি।

ইয়াদ ভালো করে খেয়াল করতেই ইমাকে ছেড়ে দিলো। একবার মাথা চুলকে উল্টো ফিরে শুয়ে পড়লো আবার।

আবার ঘুমানোর জন্য শুয়ে রইলেন কেনো ? উঠে মসজিদে জান তাড়াতাড়ি। আপনি আগে ওযু করে এসে মসজিদে যান আমি পরে করছি।

ইয়াদ তাও না উঠলে ইমা তার হাত ধরে টানতে লাগলো৷ ইমার যে শক্তি সে কী আর এই হাতিকে টেনে তুলতে পারবে। ইয়াদ তা দেখে দুষ্টু হেঁসে উঠে বসলো।

এই শক্তি নিয়ে আমাকে তুলতে আসছে, জল ফড়িং একটা।

ইয়াদের কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো ইমা। ইয়াদ মুচকি হেঁসে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ইয়াদ মসজিদের জন্য বের হয়ে গেলে ইমা রুমেই নামাজ পড়ে নিলো। ইয়াদ এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মসজিদে গিয়ে আদায় করে আর ইশানও। ফজরে দু’ভাই একসাথে মসজিদ যায় আর মসজিদ থেকে এসে এক্সারসাইজ করে ইয়াদ আর ইশান একসাথেই। ইমা ব্রেকফাস্ট রেডি করে সাথে ইয়ানা হেল্প করে। ইয়ানা ভার্সিটি যায় না অনেকদিন হলো। ভেবেছে শুধু এক্সাম দিবে সময় মতো। সামনেই এক্সাম তাই আজ ভার্সিটি যাবে ঠিক করেছে। সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। ইশান ভার্সিটি চলে গেলো, আর ইয়াদ অফিসে যাওয়ার সময় ইমাকে সাথে নিয়ে গেলো ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে বলে। ইয়ানার ক্লাস পরে তাই সে একটু পরে যাবে।

৩৭.
ইয়াদ ড্রাইভ করছে আর ইমা পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কথা নেই, চুপচাপ বসে আছে দু’জনেই। আজই প্রথম ইয়াদ ইমাকে ভার্সিটি পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। ইয়াদ একটু পর পর ইমার দিকে তাকাচ্ছে তবে ইমা একবারও ইয়াদের দিকে তাকাচ্ছে না। সকালের কথা মনে পরলেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে।

নিরবতা ভেঙে ইয়াদ বললো, আজ কতদিন পর ভার্সিটি যাচ্ছো ?

ইমা বাইরের দিকে তাকিয়েই বললো, হিসার করিনি আর ভার্সিটি না গেলেই বা কী হয় ?

কী হয় মানে ? ক্লাস না করলে পরীক্ষায় পাশ করবে কীভাবে ?

পড়াশোনা করে কী করবো ? বিয়ে হয়ে গেছে এখন মন দিয়ে ঘর সংসার করবো ? আপনার জন্য এই পড়াশোনা করতে হচ্ছে।

ইয়াদ অবাক হয়ে বললো, তোমার নিজের কোনো স্বপ্ন নেই ?

ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ ছিলো, ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু ভাগ্যের দোষে সাইন্সে পড়তে পারলাম না। এখন এসব পড়াশোনার কোনো ইচ্ছে নেই। চাকরি করবো না তো পড়াশোনা করে কী করবো ?

তুমি চাইলে জব করতে পারো তবে আমাদের অফিসের কেবল মাত্র একটা পোস্ট ?

কোন পোস্টে ?

আবরার হামিদ ইয়াদের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েন করতে পারেন। সবসময় আমার চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করবে।

ইমা মুখ ভেংচি কেটে বললো, লাগবে না আপনার জব আমার, আমি বাসায়ই ঠিক আছি। অনার্স শেষ করে আর পড়বোই না আমি।

সে দেখা যাবে এখন নামো তোমার ভার্সিটি চলে এসেছে। ক্লাস শেষ হলে অপেক্ষা করো আমি এসে নিয়ে যাবো।

ইমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ইমা নেমে যেতেই ইয়াদ চলে গেলো। ইমা ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে ইয়ানা রেডি হয়ে এসে, ফোনের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। ড্রাইভারকে যেতে বললেও গাড়ি চালাচ্ছে না দেখে বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।

রেহান ভাইয়া তুমি এখানে ?

রেহান মুচকি হেঁসে বললো, আজকের জন্য তোমার ড্রাইভার আমি।

ডাক্তারি ছেড়ে আপনি আবার ড্রাইভার হলেন কবে থেকে ?

তোমার যখন যেটা প্রয়োজন হবে আমি সেটাই হয়ে যাবো। এখন তুমি বলো তোমার এই আপনি আর তুমির জগাখিচুরি কবে বন্ধ হবে ?

এতো বছরে যেহেতু বন্ধ হয়নি আর ভবিষ্যতে বন্ধ হবে বলে মনে হয় না।

তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। এখন তাড়াতাড়ি সামনে এসে বসো।

কেনো, আজ না আপনি আমার ড্রাইভার তাহলে আমি সামনে যাবো কেনো ?

ঠিক আছে না আসতে চাইলে এসো না। তাহলে এক কাজ করো ড্রাইভারের ড্রেসটা নিয়ে এসো সেটা পরে নেই। নাহলে এতো হ্যান্ডসাম মানুষকে কেউ ড্রাইভার মনে করবে না।

থাক ড্রাইভারের ড্রেস আনতে হবে না আমিই বরং সামনে এসে বসছি।

ইয়ানা কথা না বাড়িয়ে সামনের সীটে এসে বসলো আর রেহান মুচকি হেঁসে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।

আজ ভার্সিটি যেতে হবে না। অনেক দিন একসাথে ঘুরাঘুরি করা হয় না আজ সারাদিন ঘুরবো।

কিন্তু আমি তো অনেকদিন হলো ভার্সিটি যাই না।

রেহান সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার বউয়ের এতো পড়াশোনা না জানলেও চলবে।

বউ শব্দটা শুনে চমকে ইয়ানা পাশে তাকালো, রেহানের ঠোটের কোণে তখনো হাসি ঝুলে আছে আর ইয়ানার মনে দু-টানা।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩৯

নির্জন রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে ইয়ানা আর রেহান। ইয়ানার দৃষ্টি সামনে থাকলেও রেহানের দৃষ্টি ইয়ানার দিকে। রাস্তাটা একটু বেশি নির্জন, দুপাশে লম্বা লম্বা গাছ মাঝে পিচঢালা কালো কুচকুচে রাস্তা। বেশ কিছু সময় পরপর একটা দুটো গাড়ি শাঁ করে চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। রেহানের গাড়ি রেখে অনেকটা পথ হেঁটে চলে এসেছে তারা।

ইয়ানা, কাউকে ভালোবাসো তুমি ?

হঠাৎ রেহানের এমন কথা শুনে ইয়ানা থমকে দাঁড়ালো। তবে কী রেহান বুঝে গেলো ইয়ানা অন্যকাউকে ভালোবাসে। কিন্তু ইয়ানা তো সেটা কাউকে জানাতে চায় না। রেহান ইয়ানাকে থমকে যেতে দেখে বাঁকা হাসলো।

কী চাও সেটা বুঝতে শেখো ইয়ানা ? মরীচিকার পিছনে ছুটে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করো না। জানো তো, আমাদের জীবন বড্ড বেশি ছোট আবার অনেক বড়। জীবনটা তোমার কাছে ছোট মনে হবে নাকি বড়, সেটা তোমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। জীবনটা যদি সুখের হয়, তাহলে মনে হবে খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো সময়গুলো। আর যদি কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দুঃখগুলো দু’হাতে আপন করে নাও, তাহলে মনে হবে জীবনের সময়টা থেমে আছে সামনে আগাতেই চাইছে না। জীবনটা তোমার, তাই সিদ্ধান্তটাও তোমাকেই নিতে হবে।

ইয়ানা আবার চলতে শুরু করে বললো, আপনার কেনো মনে হলো আমি কাউকে ভালোবাসি ?

রেহান সামনে তাকিয়ে কষ্ট চেপে হাসি মুখে বললো, ইয়ানা একটা দুটো দিন নয় অনেকগুলো বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষের না বলা কথাগুলো যদি তার চোখের ভাষায় বুঝতে না পারি, তাহলে কেমন ভালবাসলাম বলো ?

ইয়ানা চুপ করে গেলো রেহানের কথা শুনে। রেহানের বলা সাধারণ কথাগুলো ইয়ানার মনে নাড়া দিয়ে উঠলো।

ইয়ানা তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আর ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন কোনো আইন নেই। ভালোবাসাটা মনের ব্যাপার আর ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সবসময় মন আর ভাগ্য সাথ দেয় না। তোমার সিদ্ধান্ত যাই হোক আমি বিনাবাক্যে মেনে নিবো। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু ভেবে নিও। এই সিদ্ধান্তটার উপর তোমার পরবর্তী পুরো জীবনটার সুখ দুঃখ নির্ভর করছে। তবে তোমার সিদ্ধান্তটা যদি আমার পক্ষে হয় আমি কোনোদিন তোমার কাছে জানতে চাইবো না তুমি কাকে ভালোবেসেছিলে। তবে বলতে চাইলে বাধা দিবো না। আর যদি আমার বিপক্ষে হয় বিনা বাক্যে তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবো।

ইয়ানা উত্তরে কিছুই বললো না। রেহানও চুপ করে হাঁটতে লাগলো। রেহানের খুব ইচ্ছে করছে ইয়ানার হাতটা ধরে হাঁটতে কিন্তু সেই অধিকার সে এখনো পায়নি আর কোনোদিন পাবে কিনা সেটাও জানে না সে। আরো বেশ কিছু সময় হাঁটার পর উল্টো ফিরে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। গাড়ির কাছে আসলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো দুজনেই। রাস্তায় রেহান ইয়ানাকে আইসক্রিম, ফুসকা, চকলেট আরো অনেক কিছু খাওয়ালো। তারপর বাসায় নামিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো। রাতে ইয়াদ বাসায় ফিরলে ইয়ানা নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো ইয়াদকে। অনেক ভেবে দেখেছে ইয়ানা, আর নিজের বাকি জীবনটা কেমন হবে সেটাও ঠিক করে নিয়েছে। সত্যি তো ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে এমন কোনো আইন তো নেই।

৩৮.
আরমানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা। আরমান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে আর ইয়ানার দৃষ্টি ফ্লোরে সীমাবদ্ধ।

এতোদিন ভার্সিটি আসোনি কেনো ?

ইয়ানা মলিন গলায় বললো, শুধু এক্সাম দিবো আর ক্লাস করবো না।

আরমান ভ্রু কুঁচকে বললো, কেনো ক্লাস করবে না কেনো ?

ইয়ানা নিজের ব্যাগ থেকে বিয়ের কার্ড বের করে আরমানের দিকে এগিয়ে দিলো। আরমান কিছু সময় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে কার্ডটা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলো। কনের জায়গায় ইয়ানার নাম থেকে অবিশ্বাসের চোখে ইয়ানার দিকে তাকালো। ইয়ানার আচরণে আরমানের মনে হয়েছিলো মেয়েটা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ বিয়ের কার্ড হাতে ধরিয়ে দেওয়ায় একটু বেশি অবাক হলো আরমান। তবে সাথে সাথে নিজেকে সামলে কঠিন রুপ ধারণ করলো।

বিয়ে কী পৃথিবীতে তোমার প্রথম হচ্ছে ? আরো অনেক মেয়ে আছে বিয়ের পর পড়াশোনা করছে, জবও করছে।

পড়াশোনা বাদ দিবো তা তো বলিনি স্যার ? ঠিক সময়ে এক্সাম দিয়ে যাবো। আর মাস্টার্সে এসে কেউই রেগুলার ক্লাস করে না খুব একটা। সে যাই হোক স্যার, বিয়েতে চলে আসবেন কিন্তু।

আরমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইয়ানা বের হয়ে আসলো। মূলত বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিলো আরমানকে আর ফ্রেন্ডদের। আরমানকে দিতে গেলে জেরার মুখে পরতে হয়। আরমান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইয়ানার যাওয়ার পথে আর ইয়ানা চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। আরমানকে নিজের বিয়ের কার্ড দিয়ে এলো সে, ভাবতেই বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ইয়ানার। হ্যাঁ সে রেহানকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার মনে তাকে নিয়ে ভালোবাসা তো দূর কোনো ভালোলাগার ফিলিংসটাও নেই তার সাথে জীবন জড়ানোর চাইতে, যে তাকে বুক ভড়া ভালোবাসায় আগলে রাখবে তাকে বেছে নেওয়া ঠিক মনে করেছে ইয়ানা। ইয়ানার চিন্তার মাঝেই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রেহানের নাম্বার। চোখের পানি মুছে গলাটা স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। রেহানের সাথে আজ শপিংয়ে যাবে, বিয়ের বেশি দিন বাকি নেই আর।

৩৯.
গ্রামের মেঠো রাস্তা দিয়ে ইয়াদের গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে হেলেদুলে। রাস্তার করুন অবস্থায় ঝাঁকিতে ইয়াদ ইমার অবস্থাও করুন। বৃষ্টির জন্য রাস্তা আরো বেশী খারাপ হয়ে গেছে। ইয়ানার বিয়ের পনেরো দিন বাকি তাই ইয়াদ ইমাকে গ্রামে নিয়ে এসেছে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পরেছে এখন বাজে বেলা দশটা। আজ অবশ্য বৃষ্টি নেই, সকাল বেলাতেই সূর্যি মামা নিজের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।

গাড়ির জানলা দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে ইমা বললো, আর কতক্ষণ লাগবে ?

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, এখানে থেকেছো তুমি, কত সময় লাগবে তুমি ভালো জানো আর এখন জিজ্ঞেস করছো আমাকে ?

ইমা মলিন হেঁসে বললো, বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে এখান থেকে চলে গেছি। অনেক কিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে এখন। লাস্ট যখন এসেছিলাম তখন কী আর এসব হুঁশ ছিলো ?

ইয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো। আরো বেশ কিছুটা সময় পর কাংখিত জায়গায় পৌঁছে গেলো তারা। টিনের বাউন্ডারি দেওয়া বাড়িটায় টিনের গেইট। গাড়ি থেকে নেমে ইয়াদ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো কেউ আছে কিনা।

ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে টিনের গেইটে শব্দ করে বললো, কেউ আছেন ?

ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো, কেডায় ডাকে, কারে চাই ?

এক মাঝারি বয়সী মহিলা গেইট খুলে বাইরে এলো, দেখে অনেকটা ইমার মণির বয়সী লাগছে। মহিলা বাইরে এসে ইমাকে দেখে চুপ মেরে গেলো আর ভালো করে পরখ করতে লাগলো ইমাকে। এদিকে ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে। মলিন একটা সুতি শাড়ী তার গায়ে।

ইমা একটু গলা পরিষ্কার করে বললো, আমরা একটু ভেতরে যেতাম।

মহিলা গাল ভড়া হাসি দিয়ে বললো, তোমার বাড়িতে তুমি যাওয়ার জন্য, আমার অনুমতি কেনো নিচ্ছো মা ?

মহিলার কথা শুনে ইমা আর ইয়াদ দুজনেই অবাক হয়ে গেলো। মহিলা তার সাথে যেতে বললে ইয়াদ আর ইমা তাকে অনুসরণ করে সামনে আগাতে লাগলো।

ইমা কৌতুহল নিয়ে বললো, আপনি আমাকে চেনেন ?

মহিলা হেসে বললো, ওমা মা বাড়ির মেয়েকে চিনবো না, এটা কেমন কথা ?

কিন্তু আপনি তো আমাকে আগে দেখেননি।

মহিলা হাসি মুখে বললো, আমি জুলেখা বেগম। এই বাড়িতেই থাকি আমি আর আমার উনি। তাই এই বাড়ির সবকিছুই আমরা জানি। তৌহিদুর ভাই বলে গিয়েছেন আপনি কখনো আসলে যাতে আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি না থাকে আপনার।

ইমা অবাক হয়ে বললো, উনি কীভাবে জানলেন আমরা এখানে আসবো ?

তা তো বলতে পারবো না, তবে তৌহিদুর ভাই মাঝে মাঝেই এখানে আসে আর আপনার কথা বলে যায়। এই তো দুদিন আগেও এসেছিলো তখনও বলে গেছেন। আপনারা চলুন হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন।

আমি মায়ের কাছে যাবো একটু।

বাড়ি থেকে একটু দূরে কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে ইমার মার আর নানুকে। ইমার বাবা আর নানার কবরও এই একই কবরস্থানে। ইয়াদ ইমার মায়ের কবরটা চেনে তাই ইমাকে নিয়ে বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। একটু হেঁটে পৌঁছে গেলো কবরস্থানে। ইমা ভেতরে গেলো না বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো কবরটার দিকে। অনায়াসে তাহেরার কবরটা আলাদা করা যায় কারণ কবরটা বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে আর কবরের উপর অসংখ্য বেলি ফুল ফুটে আছে। দেখে মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে কেউ পরিষ্কার করে। নাহলে জঙ্গলে ঢেকে যেতো এই কয়েক মাসে। তাহেরার পাশেই ইমার নানুর কবরটাও আছে। ইমা ইমরুলের কবর চেনে না তাই দেখতে পারলো না, আর চিনিয়ে দেওয়ার মতো কেউও বেঁচে নেই এখন। ইয়াদ ভেতরে গিয়ে কবর জিয়ারত করলো আর ইমা বাইরে থেকে। ইমার চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে আজ আবার ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে কবরটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু পারছে না। তাই বাইরে দাঁড়িয়েই অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। কবর জিয়ারত শেষে ইমা আসতে চাইছিলো না তাই জোর করে ইয়াদ নিয়ে এলো। বাড়িতে এসে ইয়াদ আর ইমার চোখ কপালে। এইটুকু সময়ের মধ্যে জুলেখা বেগম অনেক ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এখনো লান্সের সময় হয়নি তাই ইয়াদ আর ইমা হালকা খাবার খেয়ে জুলেখার দেখানো রুমে গেলো রেস্ট নিতে। সেখানে গিয়ে ইমা বুঝতে পারলো জুলেখা বেগম কীভাবে তাকে চিনতে পারছে। এই রুমে তৌহিদুর, তাহেরা, ইমা আর তাহের সবারই অনেক ছবি আছে। ইমা রুমটা ভালো করে দেখে বেডে শুয়ে পড়লো আর ইয়াদ উল্টো দিকের বারান্দায় গিয়ে বসলো। দখিনা বাতাস এসে গায়ে লাগছে তার, ঠিক করেছে একটু রেস্ট নিয়ে আবার ফিরে যাবে। অনেক সময় পর রুমে এসে দেখে ইমা ঘুমিয়ে আছে, দুপুরের গরমে ফ্যানের বাতাসেও বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে ইমার সারা মুখে। যা ইমার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে অনেক গুণ। বাইরে প্রচুর রোদ, তাই ইয়াদও গিয়ে ইমার পাশে শুয়ে পড়লো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। গরমে ইমার ঘুম ভেঙে গেলে পাশে তাকিয়ে চমকে গেলো। ইয়াদ ঘুমিয়ে আছে চুপটি করে তবে ঘেমে অবস্থা খারাপ। ইমা সারা রুমে চোখ বুলিয়ে ড্রেসিং টেবিলের পাশে হাত-পা দেখতে পেয়ে উঠে গিয়ে নিয়ে আসলো আর ইয়াদকে বাতাস করতে লাগলো। অনেকটা পথ ড্রাইভ করেছে তাই হয়তো ইয়াদ ক্লান্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ বাইরে তৌহিদুর আর তাহেরের গলা শুনে চমকে উঠলো ইমা।

৪০.
ভার্সিটি শেষে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলো ইশান। ইয়ানা আজ বাসায় একা তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। গাড়ি পার্ক করে এসে কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাইরে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর দরজা খোলে গেলে সামনে তাকিয়ে বুকটা ধক করে উঠলো ইশানের। তার সামনে কথা দাড়িয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে। আগের থেকেও আরো বেশী মায়াবতী হয়ে গেছে সে।

ইশান জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো, কেমন আছেন মিস কথা ?

আলহামদুলিল্লাহ ভালোই ছিলাম এতোক্ষণ, তবে এখন আর হয়তো ভালো থাকা হবে না।

ইশান ভেতরে এসে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বললো, নিশ্চিন্ত থাকুন কেউ বিরক্ত করবে না আজ।

কথা বেশ অবাক হলো ইশানের আচরণে। আগের ইশান আর এই ইশানের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। কথা যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ইশানের এতো পরিবর্তন ? কথার মনে প্রশ্ন আসছে ইশান সত্যি তাকে ভালোবাসতো নাকি,,,,?
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪০

কথা মেইন ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে ইশানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে খেলছে হাজারো প্রশ্ন।

কী হলো কথা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?

কথার উত্তর না পেয়ে ইয়ানা কথার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালে ইশানকে নিজের রুমে চলে যেতে দেখলো আর তা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।

কথা ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এদিকে আসো।

ইয়ানা গলা উঁচু করে কথাটা বললে কথা ঘুরে তাকায় ইয়ানার দিকে।

কথা ইশানের রুমের দিকে তাকিয়ে ইয়ানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ইয়ানা আপু এটা কোন ইশান ভাইয়া ? উনি তো একদমই এমন ছিলেন না।

ইয়ানা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, পরিস্থিতি মানুষকে একদমই পাল্টে দেয় কথা। তবে আমি চাই ইশান আগের মতো হয়ে যাক। ওকে এমন রুপে মানায় না, ও হাসি মুখটাই ভালো লাগে।

কথা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ইশান ভাইয়া হঠাৎ এমন হলো কীভাবে ?

ইয়ানা মুখটা মলিন করে কথাকে সব খুলে বললো এই কয়েক মাসে কী কী হয়ে গেছে। সব শুনে কথার চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে। এই মানুষগুলো কত কষ্ট সহ্য করে গেছে। ইয়ানা আবার অন্য টপিক নিয়ে কথা বলছে তবে কথার ভাবনায় এখনো ইশান। সত্যি তাকে এভাবে একদম মানায় না। তাকে আগের রুপেই মানায়।

৪১.
ইমা তৌহিদুর আর তাহেরের গলা শুনে বেড থেকে নেমে বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ধীর পায়ে বাইরে বের হয়ে ইমার চোখ কপালে। উঠান ভর্তি বাজার আর সেগুলো তৌহিদুর বুঝিয়ে দিচ্ছে জুলেখা বেগমকে।

তৌহিদুর হাসি মুখে বললো, বুঝলে জুলেখা আমার মেয়ে আর মেয়ে জামাই প্রথম এসেছে এভাবে। কোনো কিছুর যাতে কমতি না থাকে। এখানে সব নিয়ে এসেছি আর কিছু প্রয়োজন হলে বলো আবার গিয়ে নিয়ে আসছি।

জুলেখা সব দেখে বললো, না ভাইজান আর কিছুর দরকার নাই আমি এখনই রান্না শুরু কইরা দিতাছি। মানিকের মাইরে খবর দিছি এখনই চইলা আইবো। ওই আইলে পিঠা বানানোও শুরু কইরা দিমু।

তৌহিদুর রুমের দিকে এগোতে এগোতে বললো, হ্যাঁ তাড়াতাড়ি করো, জামাই ঘুম থেকে উঠার আগে সব রেডি করে ফেলো।

ইমাকে দেখে তৌহিদুর থেমে গেলো। তাহের ইমাকে এখনো দেখেনি। সে পুকুরের তাজা মাছ দেখতে ব্যস্ত। জুলেখার স্বামী জমির মিয়া পুকুর থেকে তাজা রুই মাছ ধরে এনেছে, ইমা আর ইয়াদের জন্য। তৌহিদুর আর তাহের যাবতীয় বাজার আর গরুর মাংস নিয়ে এসেছে৷ সাথে বাড়ির দেশি মুরগী জবাই করা হয়েছে।

তৌহিদুর আদর মাখা গলায় হাসি মুখে বললো, কেমন আছিস মা ?

ইমার বুকে যেনো প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো তৌহিদুরের মুখে মা ডাক শুনে। মনে হচ্ছে নিজের বাবাই তাকে মা বলে ডেকেছে।

ইমা থতমত খেয়ে বললো, আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, বললি না যে কেমন আছিস মা ?

ইমা আগের মতোই থতমত খেয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনারা কেমন আছেন ?

তৌহিদুর মুখ ভরে হাসি দিয়ে বললো, তোকে দেখে একদম ভালো হয়ে গেছি রে মা। তা জামাই কেমন আছে ?

সেও ভালো আছেন।

ঠিক আছে তুইও গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নে, রান্না হয়ে গেলে সবাই একসাথে খেয়ে নিবো।

তৌহিদুর কথাটা বলে নিজের রুমের দিকে যেতে গেলে ইমা পেছন থেকে ভাঙা গলায় বললো, বাবা ?

ইমার ভাঙা গলায় বাবা ডাকটা যেনো তৌহিদুরের কানে বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যে ডাকটা শোনার জন্য এতোগুলা বছর ধরে সে ভেতরে ভেতরে তড়পাচ্ছিলো সেই ডাকটা সে শুনতে পেলো ? তৌহিদুর ভাবলো সে ভুল শুনেছে তাই ঘুরে তাকালো ইমার দিকে।

মা তুই কিছু বললি আমাকে।

ইমা আমতা আমতা করে বললো, হ্যাঁ বাবা আমি বলছিলাম তোমরা হঠাৎ এখানে কীভাবে ?

ইমার বাকি কথাটা তৌহিদুরের কানে যায়নি সে শুধু শুনেছে বাবা ডাকটা। চোখ থেকে টপটপ পানি পরতে লাগলো তার। কষ্টের নয় সুখের পানি, পরম আনন্দের পানি এটা।

চোখ মুছে বললো, আর একবার বাবা বলবি ?

ইমার চোখেও পানি চলে এসেছে। ইমা দৌড়ে গিয়ে তৌহিদুরের বুকে আছড়ে পড়লো।

ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমাকে মাফ করে দাও বাবা। না বুঝে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তুমি মাফ না করলে সারাজীবন পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে আমাকে।

তৌহিদুর ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, বাবা কখনো তার মেয়ের উপর রাগ করে না রে মা। বাবাদের কাছে মেয়ে হচ্ছে তার আরেক মা। আমি তোর উপর একটুও রেগে নেই। একটু অভিমান ছিলো তুই বাবা বলে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে সেই অভিমান টুকুনও মুছে গেছে।

ইমা মাথা তুলে তৌহিদুরের দিকে তাকিয়ে বললো, সত্যি তো রেগে নেই ?

তৌহিদুর মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো, হ্যাঁ রে মা একদম ঠিক।

এতোক্ষণ বাবা আর বোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো তাহের। চোখে পানি চলে এসেছে তার।

ঝটপট চোখের পানি মুছে বললো, আমিও কিন্তু আছি এখানে সেটা ভুলে যেও না দু’জনে।

তৌহিদুর এক হাত বাড়িয়ে দিলে তাহেরও গিয়ে বাবা আর বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো। তৌহিদুরের বুকটা আজ ভরে গেছে৷ আজ তার দুই সন্তানকেই পেয়ে গেছে। আজ তৌহিদুরের নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। অনেক সময় পার হয়ে গেলে সবাই নিজেকে সামলে নিয়ে সরে দাঁড়ালো।

ইমা বললো, তোমরা এখানে কীভাবে, বললে না তো ?

তাহের বললো, তোরা আসার পর সাথে সাথে জমির কাকা, বাবাকে কল করে জানিয়েছে। বাবা এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে চলে আসলো। তুই আর দুলাভাই প্রথম এভাবে আসলি আমরা না আসলে হয় নাকি।

ইমা ছোট করে বললো, ওহ্ তা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলি কীভাবে ?

তাহের হেঁসে বললো, আর বলিস না গাড়িকে আজ রকেটের মতো চালিয়ে এসেছি। অন্য সময় এতো স্প্রিডে ড্রাইভ করলে বাবা বকে দেয় আর আজ বলছিলো আরো একটু তাড়াতাড়ি চালাতে।

ইমা অবাক হয়ে বললো, বাবা এমনটা কেউ করে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হতো ?

তৌহিদুর হাসি মুখে বললো, কিছু হবে না রে মা।

তাহের এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, তো আপু দুলাভাই কোথায় ?

ইমা রুমের দিকে তাকিয়ে বললো, ঘুমিয়ে পড়েছে।

তৌহিদুর বললো, তুইও গিয়ে একটু রেস্ট নে, লান্সের সময় হয়ে গেছে প্রায়।

না বাবা, তুমি যে কাজ করতে বলেছো জুলেখা চাচিকে, সে একা পারবে না আমি গিয়ে একটু হেল্প করি।

তৌহিদুর ব্যস্ত গলায় বললো, না তার দরকার নেই। জুলেখা একাই সব করে নিবে আর মানিকের মাকে নাকি আসতে বলেছে।

ইমা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো, সমস্যা নেই আমি গিয়ে হেল্প করছি।

ঠিক আছে যা, তবে সাবধানে কাজ করিস এখানে কিন্তু মাটির চুলোয় রান্না করে জুলেখা।

ইমা মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বুঝিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে আর তার পিছু পিছু তাহের গিয়ে একটা টুলে বসলো রান্নাঘরের বাইরে। জুলেখা না করলেও ইমা জোর করে হেল্প করতে লাগলো জুলেখাকে।

তাহের বললো, আপু বিকেলে গ্রাম দেখতে বের হবো কিন্তু। দুলাভাই তো আগে গ্রাম দেখেনি।

ইমা সবজি কাটতে কাটতে বললো, কিন্তু তোর দুলাভাই তো বলেছে রোদ একটু কমে এলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

কী বলছিস, আজ কিছুতেই যাওয়া হবে না। আগামীকাল বিকেলে যেতে পারবি। বাবা তোদের জন্য দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।

ইমা চিন্তিত হয়ে বললো, ঠিক আছে তোর ভাইয়াকে বলে দেখছি কী বলে।

বলা বলির কিছু নেই আগামীকালের আগে যাওয়ার কথা বলে লাভ নেই।

গল্প করতে করতে রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেলো। এদিকে ইয়াদের ঘুম ভাঙলে চোখ বন্ধ করেই পাশে হাতড়ে ইমাকে খুঁজে না পেয়ে ফট করে তাকালো। সারারুমেও ইমাকে না পেয়ে উঠে বসলো। তখনই দরজা খোলে ইমা রুমে এলো।

ইমা ইয়াদকে বসে থাকতে দেখে বললো, আপনার ঘুম ভেঙে গেছে ? আবার কী শাওয়ার নিবেন ?

ইয়াদ চোখ কচলে বললো, বাসায় গিয়ে নেবো শাওয়ার। তুমি রেডি হয়ে নাও আমরা এখনই রওনা দেবো।

ইমা রুমের আলমারি খুলে শাড়ী বের করতে করতে বললো, আজ আমরা বাসায় যাচ্ছি না।

ইয়াদ বড়বড় চোখে তাকিয়ে বললো, ইমা আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম থাকার বায়না করা যাবে না। এখানে নেটওয়ার্ক প্রবলেম আমি অফিসের কাজগুলোও করতে পারবো না।

ইমা শাড়ী বের করে বললো, আমাকে বলে লাভ নেই বাবা আর তাহের এসেছে। তারা আজ কিছুতেই যেতে দিবে না।

ইয়াদ অবাক হয়ে তাকালো ইমার দিকে। কিছু সময় পর ইমার কথার মানে বুঝতে পারলো। এরা আবার কখন আসলো সেটা বুঝতে পারছে না ইয়াদ।

তারা কখন আসলো আর হঠাৎ ?

আমরা এসেছি শুনেই এসেছে আর আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন এসেছে।

ইয়াদ থম মেরে বসে রইলো তা দেখে ইমা তারা দিয়ে বললো, কী হলো শাওয়ার নিবেন নাকি বলছেন না কেনো ?

ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো, শাওয়ার নিয়ে পড়বো টা কী শুনি ?

কেনো, তাহেরের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে নিবেন। তাহের কিন্তু আপনার থেকে কম যায় না, ওরটা আপনার হয়ে যাবে আর নতুনগুলোই এনে দিচ্ছি, যেগুলো তাহের পড়েনি আগে।

ইয়াদের উত্তরের অপেক্ষা না করে ইমা বের হয়ে গেলো। তৌহিদুর প্রতি ঈদে তাহেরের জন্য নতুন ড্রেস কেনার সাথে ইমার জন্যও কিনতো। গ্রামে ঈদ করায় ইমার জন্য কেনা সব ড্রেস ইমার বরাদ্দকৃত রুমের আলমারিতেই সাজিয়ে রাখতো তাহেরা। ইমা সেই ড্রেসগুলোর মধ্যেই একটা শাড়ী বের করে নিয়ে গেছে শাওয়ার নেওয়ার জন্য। শাওয়ার শেষ করে এসে ইয়াদকে তাহেরের একটা নতুন প্যান্ট আর পাঞ্জাবি বের হাতে ধরিয়ে দিলো। ইয়াদও বাধ্য হয়ে শাওয়ার নিয়ে এলো। এখানে ওয়াশরুম বাইরে, রুমের সাথে না। তাহেরের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি ভালো মতোই হয়ে গেছে ইয়াদের। লান্স করতে এসে ইয়াদের চোখ কপালে। টেবিল ভর্তি নানা আইটেমের খাবার সাজানো যার অনেকগুলোর নামও জানে না ইয়াদ।

ইমা ইয়াদের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আপনার না আফসোস ছিলো, কখনো শশুর বাড়ির জামাই আদর পাবেন না। এবার বুঝবেন জামাই আদর কাকে বলে।

ইয়াদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ইমার দিকে আর তা দেখে ইমা দুষ্টু হাসলো। তখনই তৌহিদুর এসে বসলো একটা চেয়ার টেনে তার সাথেই তাহের।

কেমন আছো ইয়াদ বাবা ?

হঠাৎ প্রশ্ন করায় প্রথমে চমকে উঠলো ইয়াদ পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললো, আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল ?

ওয়ালাইকুম আসসালাম।

আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছেন আপনারা কেমন আছেন ?

আলহামদুলিল্লাহ আমরাও ভালো আছি। তো বাবা শুরু করো, সব কিন্তু গ্রামের টাটকা খাবার।

ইয়াদ জী বলতেই ইমা খাবার দিতে লাগলো সবাইকে। ইয়াদ একটা শেষ করে উঠার আগেই তৌহিদুর আরেকটা দিতে বলছে ইমাকে। আর ইমাও বাধ্য মেয়ের মতো বাবার কথা শুনছে। ইয়াদ বারবার না করে যাচ্ছে আর ইমা বাবার কথায় দিয়েই যাচ্ছে। ইয়াদ এবার কটমট করে তাকালো ইমার দিকে। তাতে ইমা ভয়ে ঢোক গিললো আর বাবাকে বুঝিয়ে বললো ইয়াদ আর পারবে না, সবাইকে দিয়ে ইমাও সাথে বসে পড়লো খেতে। সবার খাওয়া শেষে ইয়াদ রুমে গিয়ে ধপাস করে বেডে শুয়ে পড়লো। জামাই আদর কাকে বলে সত্যি আজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ইয়াদ। ইমা সব গুছিয়ে রুমে এসে দেখে ইয়াদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ধীর পায়ে ইয়াদের দিকে এগিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই এক টানে ইয়াদ ইমাকে বেডে ফেলে দিলো। ইমার উপর উঠে দুহাত দুপাশে বেডের সাথে চেপে ধরে ফেললো।

ইয়াদ কড়া গলায় বললো, তখন এমন করেছিলে কেনো ? আমি না করার পরও দিয়েই যাচ্ছিলে।

ইমা আমতা আমতা করে বললো, বাবা দিতে বলছিলো, আমি কী করতাম ?

ইশ কী আমার বাপের বাধ্য মেয়ে এসেছেন। আমি জীবনেও এতো খাবার খায়নি আজ একসাথে যতটা খেয়েছি।

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, একেই বলে জামাই আদর বুঝেছেন ? আপনার আর আফসোস করতে হবে না কখনো। চাইলেই এমন জামাই আদর পেয়ে যাবেন। একটু পর জুলেখা চাচি পিঠা বানাবে বিভিন্ন আইটেমের সেগুলোও খাবেন।

ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে বেডে শুয়ে পড়ে বললো, ইম্পসিবল, যে খাবার খেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে আগামী দুদিন আর খেতে হবে না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। তোমার জুলেখা চাচির রান্নার হাত অতুলনীয়।

৪২.
ইশান প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে আর কথা ইশানের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে। ইয়ানার খাওয়া আগে শেষ হয়ে গেলে সে নিজের রুমে চলে গেলো। টেবিলে রয়ে গেলো শুধু কথা আর ইশান। অন্য সময় হলে ইশানের বকবকানিতে কথা বিরক্ত হয়ে যেতো আর আজ ইশানের চুপ করে থাকায় কথা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।

কথা বললে কী আপনাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে ?

ইশানের দিকে তাকিয়ে কথা প্রশ্নটা করতেই ইশানের হাত থেমে গেলো। কথা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে তবে ইশানের দৃষ্টি আগের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ।

ইশান শান্ত গলায় বললো, হয়তো মৃত্যুদন্ডের থেকেও কঠিন কোনো শাস্তি হবে।

এটুকু বলেই ইশান আবার খেতে লাগলো। কথা যদি ইশানের মনের ভেতরটা দেখতে পেতো তাহলে জানতে পারতো সামনে বসে থাকা মানুষটা তার সাথে কথা বলার জন্য কতটা ছটফট করছে প্রতিটা মুহূর্তে। অন্যদিকে কথা প্রচন্ড মিস করছে আগের ইশানের সেই দুষ্টুমিগুলো। এখন কথা বুঝতে পারছে সেই হাসিখুশি ইশানকে তার কতটা ভালো লাগে। কথা মনে মনে ঠিক করলো ইশানকে সে আবার আগের মতো করেই ছাড়বে। আনমনে খেতে গিয়ে হাতে মাছের কাটা ফোটে গেলো কথার।

আহ্,,,,,

কথার মৃদু চিৎকারে ইশান তাকালো কথার দিকে। কথা আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে, আঙ্গুলের ডগায় রক্ত বের হয়ে গেছে। ইশান উঠে গিয়ে কথার এঁটো আঙ্গুলটা মুখে পুরে নিলো।

কথা চমকে উঠে বললো, আরে আরে কী করছেন এটা আপনি ? ছিহ্ আমার এঁটো আঙ্গুল মুখে পুরলেন কেনো ?

ইশান ইশারায় কথাকে চুপ করতে বলে ঠোঁট দিয়ে কথার আঙ্গুল চেপে ধরে রেখেছে। ইশান হঠাৎ কথার আঙ্গুলটা শুষে নিলে কথা শিউরে উঠলো। এক দৃষ্টিতে তাকালো ইশানের দিকে, কথা সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে।

ইশান মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে ধমক দিয়ে বললো, সাবধানে খাওয়া যায় না ? মাছের কাটা বাছতে পারো না বললেই হতো, আমি বেছে দিলাম। আর নাহলে চিকেন বা অন্যকিছু দিয়ে খেতে, যেটা পারো না সেটা করতে যাও কেনো ? এখন যদি হাতে না বিঁধে কাটা গলায় বিঁধে যেতো।

ইশানের ব্যস্ত গলায় শাসন দেখে কথা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইশানের দিকে। এটুকুর জন্য এতো শাসন ? এতক্ষণ জোর করে কথা বলানো যাচ্ছিলো না আর এখন কথা একটু আহ্ বলতেই নিজের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। কথা ইশানের চোখে নিজের জন্য অঢেল ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে। নিজেকে নিয়ে ইশানকে ভাবতে দেখছে।

আপনি কী সত্যি ভালোবাসেন এই শ্যামবর্ণ, আনস্মার্ট, গেয়ো মেয়েটাকে ?

কথার মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে ইশানের হুঁশ ফিরে সে এতক্ষণ কী করছিলো। এবার না সরে আসতে পারছে আর না কথার পাশে থাকতে পারছে। আর প্রশ্নের উত্তরটা কী দেবে দু-টানায় পরে গেছে সে।

চলবে,,,,,,
চলবে,,,,
চলবে,,,
আজ গল্পটা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি। সব কেমন এলোমেলো লাগছিলো বারবার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here