তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -০৭

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সকালে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম তীব্র আমার হাতের ওপর ঘুমিয়ে আছে। উনাকে এই অবস্থায় দেখে আমার ঘুম ছুটে গেলো। পিটপিট করে চেয়ে রইলাম উনার দিকে। বেড সাইড টেবিলের ওপর বাটি ভর্তি পানি আর কাপড় দেখে বুঝলাম রাতে উনি আমার জ্বরের জন্য জেগে ছিলেন। চোখ দুটো আরো ছোট ছোট হয়ে গেলো। সারাদিনই যাকে যা তা বলি সে সারারাত জেগে আমার সেবা করলো! আমি হাতটা একটু নাড়াতেই উনি লাফিয়ে উঠলেন। আমার কাছে এগিয়ে কপাল চেইক করে৷ বিড়বিড় করে বললেন,

‘যাক! জ্বরটা কমে গেছে।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম, ‘আপনি সারারাত ঘুমাননি?’

উনি খানিকক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘুরে এসে আমার পাশটাই শুয়ে পড়লেন। ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে মুখ ঢেকে নিতে নিতে বললেন, ‘চুপচাপ শুয়ে থাকো। উঠবে না। সারারাত ঘুমাইনি এখন ঘুমাবো। যদি তোমার জন্য আমার ঘুমের ১২ টা বাজে তাহলে তোমার খবর আছে। তাই চুপচাপ এখানে শুয়ে থাকো!’

আমি উনার কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো! উনার কথা মতো চুপচাপ শুয়েই থাকলাম। জ্বরটা কমলেও শরীরটা এখনো দুর্বল লাগছে। তাই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। মাথার মধ্যে এতো এতো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। উনার দিকে ফিরে শুয়ে ছিলাম। হুট করেই উনি আমার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ তখনো। আমি তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। সারা রাত না ঘুমানোর জন্য চোখ মুখ কেমন হয়ে আছে। চুল গুলোও উস্কোখুস্কো। কতক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। ওভাবে থাকতে থাকতেই হঠাৎ দরজার নক শুনে ধ্যান ভাঙে। বাইরে থেকে তিহা ডাকছে। আমি গলার স্বরটা উচু করে বললাম,

‘তুমি যাও। আমি আসছি!’

তিহা ‘আচ্ছা’ বলেই চলে যায়। আমি কোনোরকমে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর নিচে আসলাম। আমাকে দেখে আন্টি কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

‘অন্যদিন তো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠো আজ উঠতে পারো নাই?’

‘আসলে আন্টি… ‘

আমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে তানহা বললো, ‘ফুপি সব কাজ কি তুমিই করো! তোমার যা বউমা তাতে তো সে কোনো কাজ করে বলে মনে হয় না!’

পাশ থেকে নানু চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘তুমি তোমার চড়কায় তেল দাও। ওর সংসার ‘ও’ কেমনে করবে সেইটা ‘ও’ বুঝুক। নাতবউ তীব্র কোথায় রে?’

‘জ্বি উনি ঘুমাচ্ছে নানু।’

‘এতো বেলা করে ঘুমায়!’

তিহা বললো, ‘নাহ নানু। ভাইয়া তো সকাল সকাল উঠে পড়ে। কাল রাতে ভাবির অনেক জ্বর ছিলো তাই ভাইয়া রাতে ঘুমায় নাই। এজন্যই এতক্ষণ ঘুমাচ্ছে।’

আড়চোখে মামি আর তানহার দিকে তাকালাম। তারা যেনো রীতিমতো ফুঁসে উঠলেন। সারা রাত তীব্র আমার জন্য জেগে ছিলো এটা মোটেও তাদের পছন্দ হলো না। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। নানু কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললেন,

‘এখন কেমন আছো নাতবউ? জ্বর নিয়া উঠতে গেলা কেন?’

‘নাহ নানু। ঠিক আছি এখন।’

আমার বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে, ‘তুমি ঠিক আছো কি নেই তা কি তোমাকে দেখতে বলছি? পাকনামি করে রুম থেকে বের হয়ছো কেন?’

আমি ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালাম। তীব্রর চোখ মুখ দেখে ফাঁকা ঢোক গিললাম। উনার গম্ভীর কন্ঠ শুনে নানু মুচকি হেঁসে বললেন, ‘এদিকে আসো নানুভাই।’

তীব্র এসে নানুর পাশে বসলেন। আমার দিকে তখনও তিনি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। উনার এমন ভ’য়ং’কর দৃষ্টি দেখে ভড়কে গেলাম। নানুভাই বললেন,

‘বউয়ের দেখি খুব খেয়াল রাখো!’

তীব্রর নানুর সামনে একদম অন্যরুপের মানুষ হয়ে গেলেন। হেঁসে বললেন, ‘একটু বেশিই ভালোবাসি তো তাই। তবে তোমার চেয়ে বেশি না।’

নানু শব্দ করে হাসলেন। আমি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললাম, ‘আসছে রে! ভালোবাসা আর সে! হু ফানি।’

এরমধ্যেই তানহা উঠে গটগট করে চলে গেলেন। তানহা উঠে যাওয়ায় মামি একবার সবার দিকে তাকিয়ে নিজেও পেছন পেছন গেলেন। আন্টি একবার শুধু সেদিকে তাকালেন কিন্তু গেলেন না। নানু বা তীব্র কারোরই ভ্রুক্ষেপ হলো না। দুজন দুজনের মতো কথা বলা শেষ করলেন। তারপর তীব্র আমার কাছে এসে বললেন,

‘রুমে আসো।’

আমি মাথা নাড়িয়ে উনার পিছু হাটলাম। রুমে আসতেই উনি ক্ষেপে গেলেন। আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘বের হতে নিষেধ করছিলাম না? বের হলে কেন?’

আমি ফাঁকা ঢোক গিললে বললাম, ‘তিহা তো ডাকছিলো তাই গেছিলাম।’

‘তো? ডাকলেই যেতে হবে? বলতে পারলে না আমি নিষেধ করছি নিচে যেতে!’

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘হাতটা ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।’

উনি ছেড়ে দিলেন। খুব জোড়ে না ধরলেও শরীর ব্যাথার জন্য ব্যাথাা পেয়েছি৷ উনি ছেড়ে দিয়েই গটগট করে ওয়াশরুমে ঢুকলেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশের ব্যালকনিতে তখন তানহা দাঁড়িয়ে ছিলো। সাথে মিলিও ছিলো। তানহাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলাম। তানহা আমাকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,

‘তাহলে তোমার জন্যই তীব্র আমাকে ছেড়েছে!’

‘জ্বি? বুঝলাম না!’

তানহা হেঁসে বলে, ‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নাই। তীব্র আমারে ভালোবাসে আর বিয়েও আমারেই করবে। তোমার সাথে ওর বিয়েটা জাস্ট একটা সাময়িক ডিল।’

কিছুই মাথায় গেলো না। পুরোটাই মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তবে একটা কথায় থমকালাম ভীষণ। আমাকে বিয়ে করাটা ডিল মানে! কিসের ডিল! কার সাথে এই ডিল! তানহা বাকা হেঁসে ব্যালকনি থেকে চলে যায়। পেছন পেছন মিলিও যায়। আমি ওভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কতটা সময় পর তীব্র এলো। পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘এখানে কি করো? নাস্তা করবে না? শরীর খারাপ লাগছে বেশি!’

আমি উনার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘আমাকে বিয়ে করাটা আপনার ডিল ছিলো?’

তীব্র যেনো আকাশ থেকে পড়লো। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো মুখপানে। আমি তখনো জবাবের আশায় তাকিয়ে আছি তার দিকে। সে অবাক কন্ঠে বলে, ‘কি বললেন?’

আমি ফের বললাম, ‘আমাকে বিয়ে করাটা আপনার ডিল ছিলো?’

তীব্র মুহুর্তেই ঘামতে শুরু করে। নিজেকে স্বাভাবিক করার যথেষ্ট চেষ্টা করলেন। বড় বড় শ্বাস নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘এসব উল্টা পাল্টা কথা কে বলেছে?’

আমি হাসলাম। শাড়ির আঁচল টেনে উনার কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা মুছিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আজকাল আমার লাইফটাই তবে ডিল হয়ে গেছে! আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় কোথাও না কোথাও একটু না একটু ভালোবাসেন বা আমার প্রতি আপনার সফ্ট কর্ণার আছে এজন্যই বিয়েটা করেছেন। কিন্তু!’

আমি আরো এক দফা হেঁসে চলে আসলাম। যতক্ষণ ছিলাম তীব্র মুখের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিলো। তানহার শুধু কথা আমি বিশ্বাস করতাম না যদি তীব্র কনফিডেন্স রেখে আমাকে বলতো বিয়েটা কোনো ডিল না। কিন্তু তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম, তার ঘাবড়ে যাওয়া পুরোটাই আমাকে বুঝিয়ে দিলো তানহা কোথাও না কোথাও তো সত্য। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি একটা রে’পি’ষ্টের কাছে এতোকিছু আশা-ই বা করি কেনো? নিজেকে নিজে বকতে বকতে নিচে আসলাম। তিহা আর মিলি তখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর তীব্রও আসলো। তীব্রর পাশের চেয়ারেই তানহা বসে পড়ে। আমি দেখেও কিছু বললাম না৷ খাওয়ার এক পর্যায়ে নানাভাই বললেন,

‘আজাদ আমরা কিন্তু তোমাদের একসাথে নিয়ে যাবো। ১০/১৫ দিন পরই শোভার বিয়ে।’

আজাদ আঙ্কেল খাওয়া রেখে তীব্রর দিকে তাকালেন। তীব্র তখনো খেয়ে যাচ্ছে চুপচাপ। আঙ্কেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে নানাভাই তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘নানাভাই! তোমার কোনো সমস্যা আছে?’

তীব্র ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আব্বু, আম্মু, তিহাকে নিয়ে যাও নানাভাই। আমি আর প্রানেশা যেতে পারবো না।’

‘কেনো?’

তীব্র এবার খাওয়া অফ করলেন। আগের চেয়েও দ্বিগুণ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আমি গেলে তোমাদের বাড়ির কারোর সমস্যা না হলেও আমার বউ গেলে তোমার বাড়ির অনেকেরই সমস্যা হবে নানাভাই। তাছাড়া আমার বউয়ের কান ভাঙানোর জন্য মানুষের অভাব নাই দেখতেছি৷’

তানহা রাগী চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি পাত্তা দিলাম না। নিজের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আজাদ আঙ্কেল পরিবেশ সামলানোর জন্য বললেন, ‘থাক না আব্বা! এমনিতেও তো ওদের কেবল বিয়ে হয়েছে। পরে না হয় যাবে!’

নানু বললেন, ‘নাহ। তা কেন হবে? তাছাড়া নানুভাই আর নাতবউ তো কোথাও যায়নি তাই না হয় গেলো! কয়দিন ঘুরে আসলে দুজনেরই ভাল্লাগবে।’

তিহা আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘নানু কি বুঝাতে চাইছে বুঝছো ভাবি! তোমাদের হানিমুনের কাজটাও সেড়ে যাবে। ইনডিরেক্ট এটাই বুঝালো।’

আমি কিছু বললাম না। তীব্র এরপর আর কিছু বললেন না। আজাদ আঙ্কেল বললেন তিনি বুঝাবে তীব্রকে৷ খাওয়া শেষ করে তীব্র নিজের রুমে চলে গেলেও আমি গেলাম না৷ নিচেই নানুর সাথে বসে রইলাম। আড্ডায় মেতে থাকলাম। সারাদিনে প্রয়োজন ছাড়াা আর রুমে যাইনি। এরমধ্যে তীব্রও আর ডাকতে আসেনি।

রাতে তিহা জোড় করে আমাকে একদিকে টেনে আনে। চেপে ধরে বলে, ‘কি হয়েছে ভাবি? তুমি সারাদিন থেকে দেখছি রুমে যাচ্ছো না! ভাইয়ার সাথে কি কিছু হয়ছে?’

‘নাহ। এমনিতেই যাইনি। তোমাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম তাই!’

তিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভাবি ভাইয়া আর তোমার বিয়েটা কোনো…’

এটুকু বলতেই তানহা এসে টেনে নিয়ে গেলো। আমি পিটপিট করে সেদিকে তাকালাম। তিহা একটুপর এসে বললো রুমে যেতে। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। যদিও রুমে যেতে বিরক্ত লাগছে। রুমে ঢুকতেই দেখলাম তীব্র নেই। পুরো রুম ফাঁকা। উনি আবার কোথায় গেলো! ব্যালকনিতে উঁকি দিয়েও দেখলাম উনি নেই৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ফোন বেজে উঠে। ফোনে জ্বলজ্বল করে সামির নাম ভাসছে। হঠাৎ সামি কল দিলো কেনো! আমি দ্রুত কল রিসিভ করতেই সামি ব্যস্ত গলায় বললো,

‘প্রানেশা জুথি আপু, জুই বা আন্টি কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আজ ওদের বাড়ি গেছিলাম তখন দেখলাম পুরো বাড়ি ফাঁকা। আমার মাথা কাজ করছে না। তীব্র ভাই ওদের কোনো ক্ষ’তি করেনি তো!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম৷ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক দেইনি। একটু মানিয়ে নিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here