#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্বঃ ৮
বিরতিহীন ভাবে পায়চারি করছে মেঘ,অস্থির লাগছে ভীষণ, ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। পাশেই রুচিতা বসা মিষ্টিকে কোলে নিয়ে। শিমু অনবরত কেদেই চলেছে।
-ভাই? ভাই আফুর কিছু হবে না তো? ওর কি অনেক লেগেছে? রক্ত বেরিয়েছে? কতোখানি? অনেক বেশি কেটে গেছে? বলো না ভাইই
রাফাত একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে,দুদন্ড স্থির দাড়াচ্ছে নাহ,আদ্রিশ আর নিবিড় গেছে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ আনতে। মেঘের নিজেরও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, নিজেকে উৎকন্ঠা দমিয়ে ভাইকে শান্ত করতে বললো
-রাফাত কাম ডাউন। কিচ্ছু হবে নাহ ওর,খুব বেশি লাগেনি। তুই এতটা হাইপার হয়ে গেলে ওদের কে সামলাবে?
বলেই চেয়ারে বসে থাকা রুচি,আরশি আর শিমুকে ইশারা করে দেখালো। মিষ্টি গুটিসুটি মেরে দলা হয়ে আছে মায়ের কোলে,বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে অনেক। যদিও ওর কোনো ক্ষতি হয়নি।
মেঘ এখনো সেই দৃশ্যটা কিছুতেই ভুলতে পারছে নাহ। অফিস থেকে জরুরি ফোন আসাই সে সাইডে গিয়েছিলো কথা বলতে, রুচির চিৎকার শুনে ছুটে আসে,এসে তাদের অনুসরণ করে তাকাতেই যেনো তার হৃদপিণ্ডেত গতিপথ থমকে যায়। ভরা রাস্তার মধ্যে মেয়েটা দৌড়ে গেছে মিষ্টি কে বাচাতে, এক লহমা অপেক্ষা না করে মেঘ ও ছুটে যায়,কিন্তু ততোক্ষণে গাড়িটা এক ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। মিষ্টি কে বুকে আগলেই মাটিতে লুটিয়ে পরে পালক। মাথাটা রাস্তায় বারি লাগায় তৎক্ষনাৎ রক্তপাত শুরু হয়। মেঘ রুচি আর শিমু ছুটে যায় সেখানে। পালকের বুক থেকে মিষ্টি কে নিয়ে রুচির কাছে দিয়েই, কোলে তুলে নেয় পালক কে।
পালকের কপালের এক পাশে কেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেই ররক্তক্ষরণ পালকের কপালে থেকে যেনো মেঘের ভেতর টাই ও ছড়িয়ে পরছে। তারও রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে বুকের ভেতর অজানা কোনো স্থানে। পালকের এই অবস্থা তাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে ভীষণ। পালককে পাজা কোলে তুলে নিয়ে দৌড়ে যায় গাড়ির দিকে,পালক কে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে এক হাতে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরে,আরেক হাতে হাড়ি স্টার্ট দেয়, কোনো দিকে হুস নেই মেঘের, এতটা আতংকিত সে আগে কখনো হয়নি, সে বরাবর ই ঠান্ডা শান্ত মস্তিষ্কের মানুষ, কিন্তু পালকের এই অবস্থায় নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছে নাহ, পালকের এই ঘা তাকে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে।
অচেতন অবস্থায় ই জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানছে, পালককে এক হাতে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নেয় মেঘালয়, মনে মনে বার কয়েক বলে “কিচ্ছু হবে নাহ পালক,আমি আছি। কিচ্ছু হতে দেবো নাহ আমি” পালকের কপাল থেকে ঝড়ে পরা রক্তে আইভরি রঙের শার্ট টা ভিজে একাকার,বুকের কাছের জায়গা টাতে রক্ত শুকিয়ে গেছে। কিন্তু ঘা টা এখনো দপদপে, মেঘ কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে নাহ। মেয়েটার আঘাত তাকে এতো যন্ত্রণা কেনো দিচ্ছে?
যেই মেয়েটা আগ পাছ না ভেবে নিজের জীবনের পরোয়া না করে এভাবে ছুটে গেলো বাচ্চাটাকে বাচাতে,তাকেই কি নাহ মেঘ ভরা রাস্তায় থা’প্পড় দিয়েছিলো, সে ঘটনা মনে পরতেই মেঘের অনুতপ্ততা আরও এক ধাপ বেড়ে যায়।
-ডক্টর!
রাফাতের কথায় হুস আসে মেঘের,স্মৃতিচারণ ভেঙে যায়, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ইমার্জেন্সি কেবিন থেকে ডাক্তার আর নার্স বেরিয়ে আসছে, তৎক্ষনাৎ ছুটে যায় মেঘ
-ডক্টর? ইজ সি অলরাইট? মেজর কোনো ইস্যু হয়নি তো? পালক ঠিক আছে?
ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলে,শান্ত ভাবে উত্তর দেয়
-কাম ডাউন মি.চৌধুরী। চিন্তিত হবেন নাহ, নাউ সি ইজ বেটার, মেজর ইঞ্জুরি হয়নি, কপালের কাটা টাতে আমরা ট্রিটমেন্ট দিয়েছি,পায়ের দিকটাই বেশ লেগেছে, কিছুদিন বেড রেস্টেই থাকতে হবে, পায়ের উপর প্রেশার একেবারে না দিলেই ভালো। বাকিটা, সি উইল গেট ওয়েল সুন ইনশাআল্লাহ।
পাশ থেকে রাফাত ছুটে এসে প্রশ্ন করে,
-ডক্টর ওর কি জ্ঞান ফিরেছে? আমরা কি ওকে একটু দেখতে পারবোনা?
-পেশেন্ট কে ব্যাথা আর ঘুমের ওষুধ দেওয়ার কারণে জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে
আদ্রিশ আর নিবিড় ও চলে আসে ওষুধ নিয়ে, নিবিড় জিজ্ঞাসা করে
-ডাক্তার ওর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? ও কবে সুস্থ হবে?
ওদের এমন বাচ্চাদের মতো একের পর এক করা প্রশ্নে ডাক্তার মৃদু হেসে বলে
-ও খুব তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ, আর কিছু না হোক তোমাদের জন্য হলেও হবে।
বলেই স্থান ত্যাগ করে, মেঘ ডাক্তারের সাথে তার কেবিনে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে আসে।
এসে দেখে রাফাত,নিবিড়, আদ্রিশ,শিমু আরশি পাচজন মিলেই কেবিনের সামনে দরজাটার গ্লাসে চেয়ে আছে, পালকের দিকে, শিমু আর আরশির কান্না এখনও থামেনি।
আরশি আদ্রিশকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেদে ওঠে, রাফাত নিবিড় বাকিদের চোখেও পানি স্পষ্ট, কোনো রকম চোখের পানি মুছে ধমকে বলে আদ্রিশ
-এই ছেমড়ি, এমন মরা কান্না জুড়েছিস কেনো,তোর বিশ্রি কান্না শুনে রোগীদের অ্যাটাক আসবে,এভাবে ভ্যা ভ্যা করে কেদে আফুর ঘুমটা ভাঙ্গানোর মতলব তাই তোহ, সর তো সর আমার শার্টে তো ইচ্ছে মতো নাকের পানি চোখের পানি মুছে যা তা করলি।
আরশি সরে এসে কান্নামিশ্রিত গলায় বলে
-তোরা আসলেই খুব ব’জ্জাত,জীবনে মানুষ হবি নাহ তোরা। আমি আফুকে এভাবে দেখতে পারছি নাহ। ওকে উঠতে বলনা,এইতো ঘন্টা খানিক আগেই কথা বলে গেলাম কি থেকে কি হয়ে গেলো।
বলে আবারও কেদে দেয়,পাশ থেকে শিমু বলে
-ও খুব তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে যাবে দেখিস,আফু অনেক স্ট্রং। এসব ছোট খাটো জিনিসে ও দমে নাহ
শিমুর কথায় নিবিড় বকে ওঠে।
-এক্সাক্টলি, সবাইকে কি নিজের মতো ছিচকাদুনি ভাবিস নাকি, যে এই হো হো করে হাসা শুরু করলো আর এই ফ্যাসফ্যাস করে কাদা শুরু করলো
নিবিড়ের কথায় ঠাস করে এক ঘা বসিয়ে দেয় আরশি,আবারও পাচটা মিলে গ্যানজাম শুরু করে,এই পাচজন যেখানে গ্যঞ্জাম সেখানে, যদিও আজ ভীষণ ফাকা লাগছে।
মেঘ দূর থেকে দাড়িয়ে দেখছে ওদের, ওদের মাঝে পালকের হাস্যজ্বল চেহারা টার ভীষণ অভাব বোধ করছে সে।।
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে, এগিয়ে গেলো ওদের দিকে
-রাফাত? অনেক ক্ষন তো হলো,সকালে বেড়িয়েছিস সবাই, বাড়ি ফিরে যা তোরা,আপুকেও নিয়ে যা এভাবে সারাদিন থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে।
-ভাইয়া আফুকে এখানে রেখে কি করে যাবো
-আমি আছি, মানে ডক্টর ওকে একদিন অবসার্বেশনে রাখতে বলেছে। তোরা বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার আসিস। ততক্ষণে আমি আছি,মা আর ফুপিও ভীষণ চিন্তা করছে,ওদেরকেও তো সামলাতে হবে
মেঘের কথায় কিছুক্ষণ ভেবে রাফাত বলে
-ঠিক আছে ভাই,আই তোরাও চল
বলে রুচির কাছে যায়,রুচিতার কান্না এখনও থামেনি,তার ধারণা সবটা তার দোষেই হয়েছে, সে যদি মিষ্টি কে দেখে রাখতো,তাহলে সে দৌড়ে যেতেও নাহ,আর নাহ পালক ওকে বাচাতে গিয়ে এতোকিছু হতো। রাফাত গিয়ে রুচির সামনে হাটু গেড়ে বসে
-এই যে কাদুনি? হইছে? নাকি হসপিটালে বন্যা বইয়ে দেওয়ার ইরাদা আছে
তখন রুচির পাশে এসে আরশি বসে বলে
-আর কেদোনা তো আপু,আফু তো এখন ঠিক আছে, তুমি কেনো শুধু শুধু বেশি ভাবছো, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন,তাই তো অল্পেই কেটে গেছে বিপদ, তুমি যদি এভাবে কাদো আফু কিন্তু খুব কষ্ট পাবে।
-এইতোহ,আমাদের ঢেপসি বুঝে গেলো আর তুই এখানো বুঝতে পারলি নাহ,কান্না থামাবি তুই,তোর জন্য প্রিন্সেস ও ভয় পেয়ে গুটিয়ে আছে দেখ, তুই এবার কান্না না থামালে কিন্তু আমি সিমেন্ট এনে তোর চোখ প্লাস্টার করে দেবো।
রাফাতের কথায় রুচি কান্না মুখে হেসে ফেলে। তখন আদ্রিশ এসে বলে
-এই না হলে রুচি আপু,তোমার মুখে কিন্তু কান্না একেবারেই যাইনাহ। তিয়াস ভাই এই লুক দেখলে কিন্তু লুঙ্গি ধরে পালাবে।
বলেই হাহা করে হেসে দেয় সবাই,পালককে বাইরে থেকে আরও একবার দেখে একে একে বেরিয়ে যায় ওরা,শিমু তো যেতেই চাইনি,বারবার বলেছে ভাইয়া আমি থাকি প্লিজ
মেঘ এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়েছে,হসপিটালের ফিনাইলের গন্ধে এমন পরিবেশে অনেক ক্ষন থাকলে শেষে সবাই একসাথে অসুস্থ হয়ে পরবে।
সকলে চলে যাওয়ার পর, ধীর পায়ে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে মেঘ, আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সফেদ বিছানায় নির্জিব হয়ে পরে থাকা মেয়েটির দিকে
সিঙ্গেল বেডটাতে, সাদা চাদরটা পেট পর্যন্ত উঠিয়ে রাখা, কপালে সদ্য করা ব্যান্ডেজ, পায়ের গোড়ালির দিকটাতেও শুভ্র কাপড়ের আস্তরণে ঢাকা, উজ্জ্বল ফর্সা চেহারাটা কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, ঘন নেত্রপল্লবটা স্থির হয়ে আছে, পাতলা গোলাপি পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট দুটো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে,বন্ধ চোখ জোড়া কেপে কেপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।
মেঘ নিঃশব্দে পাশে গিয়ে বসলো,পলকহীন চাহনিতে আগা গোড়া পরখ করছে পালক কে,মেয়েটার মুখ জুড়ে সীমাহীন মায়া। এরকম বিধ্বস্ত চেহারা টাও যেনো মেঘে কাছে ভীষণ স্নিগ্ধ, শুভ্র লাগছে মেঘের। ভীষণ ইচ্ছে করছে একবার ছুয়ে দেওয়ার,চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া পানি ভীষণ যত্নে মুছে দেওয়ার।
কাপা কাপা হাত এগিয়ে দিলো পালকের দিকে। খুব সন্তপর্ণে ছুয়ে দিলো আখিযুগল,সযত্নে মুছে দিলো চোখের কোনে জমে থাকা বিন্দুকণা।
মেঘের বুকের বা পাশটায় যেনো জমাট বেঁধে আছে, কিছুতেই থামাতে পারছে নাহ ভেতরের চড়াঘাত। বারংবার কল্পনার দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে রক্তে মাখামাখি চেহারা টা,অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে বুকের মাঝে পরে থাকা। মেঘের এ মুহুর্তে ভীষণ অবাধ্য,নিষিদ্ধ ইচ্ছা হলো। ভীষণ ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরতে,ব্যাথা যন্ত্রণা গুলো নিজের মাঝে শুষে নিতে।
মেঘ ধপ করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো,উঠে দাড়ালো, কি হচ্ছে তার সাথে, এমন কেনো হচ্ছে। দুদিনের চেনা মেয়েটার জন্য এতো মায়া কেনো লাগছে, কেনো তার সীমাহীন মায়ার বৈরাগ্য তার সত্তা জুড়ে ছুয়ে যাচ্ছে! ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে বার কয়েক এদিক ওদিক ঘুরালো। নাহ অহেতুক চিন্তা জুড়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। এসব ভাবাও ভুল।
নিজেকে হাজারো ভাবে বুঝাচ্ছে মেঘ,সে তো এমন নাহ,কোনো মেয়েকে দেখে এধরণের চিন্তাভাবনা আনার মতো ব্যক্তিত্ব তার নয়,সে তো ভীষণ প্রখর ব্যক্তিত্বের মানুষ। যার ভেতরটাও বাহিরের মতোই শান্ত। কিন্তু নাহ,কিছু তো একটা হচ্ছে,কেনো তার শান্ত সমুদ্রে,প্রলয়ের উচ্ছাস শুরু হচ্ছে
ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও তাকায় পালকের দিকে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিন রাতের দৃশ্য। সেই ঝমঝম বৃষ্টি, বৈরী হাওয়া আর বেহালার সুর আনা রমণীর চেহারা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বসে পালকের পাশে, নির্জিব হয়ে পরে থাকা ছোট্ট হাতটা নিজের বলিষ্ঠ হাতের আঙ্গুলের মাঝে গলিয়ে নেয়।
হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘোর কাটে মেঘের,ফোনটা পকেট থেকে বের করে হাতে নিয়ে দেখে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
হীডিংঃ পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত, আগামি দিন বড়ো করে দেবো ইনশাআল্লাহ। সকলের জন্য দু’আ আর শুভকামনা#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্বঃ ৯
-হ্যালো বাবা
-মেঘ,ইজ এভরিথিং অলরাইট?পালক কেমন আছে এখন
-সি ইজ বেটার নাউ,একদিন অবজার্বেসন এ রাখতে হবে, কাল বিকেলের মধ্যেই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো
-আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি নাহ, যদি বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারতাম নাহ,মেয়েটা লক্ষী ভীষণ জানতাম,এতো বড়ো একটা রিস্ক নেবে ভাবতেও পারিনি
-আ’ম অলসো সারপ্রাইজড বাবা, কি থেকে কি হয়ে গেলো। বাট থ্যাংক গড সি ইজ ফাইন।
-তোমার আম্মু ভীষণ চিন্তা করছে,আমাকে ফোন করে কান্নায় থামেনা,কোনো রকমে বুঝিয়েছি। এতো প্যানিক নিলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে
-আমি মায়ের সাথে কথা বলছি,পালক এখন ভালো আছে এতোটা টেনশন করতে হবে নাহ
-আমি আর তোমার আংকেল কালকেই বিডিতে ব্যাক করবো, রুচি ইবনাত কে ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করেছে।
-আপুকে আমরা সামলে নেবো, তোমরা চিন্তিত হবে নাহ,টেইক ইউর টাইম
আরও কিছুক্ষণ রমজান চৌধুরীর সাথে কথা বললো মেঘ, রমজান চৌধুরী তার ব্যাবসায়ীক কাজে এক সপ্তাহ যাবৎ দেশের বাহিরে গেছেন। আর ভাগ্যক্রমে ইবনাত হোসেনের একই দেশেই সেমিনার ছিলো,যার ফলে দুজনেই দেশের বাহিরে। একমাত্র ছেলে দেশে ফিরে বাবাকে পাইনি বলে তার ভীষণ আফসোস, এই জন্যেই এতো তাড়াহুড়ো ফেরার,তার উপর এই অ্যাকসিডেন্ট।
_________________
হালকা ঝাপসা সাদা ছাদটার বুকে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা চোখের সামনে ভাসছে। নাকে কড়া ফিনাইলের গন্ধটা এসে ঠেকছে, তীব্র গন্ধটা নাকে ঠেকতেই চোখ কুচকানোর ফলে,কপাল টাই ব্যাথায় তিরতির করে উঠলো। মনে হচ্ছে কপালের বা পাশটা জুড়ে ব্যাথার শিরশিরানি ছড়িয়ে গেলো। টিপটিপ করে চোখ দু’টো খুললাম।
সফেদ রঙের মাঝারি ঘরটায় হালকা নীল রঙের পর্দায় জানালা আর দরজা আবৃত। ডানপাশটাই রাখা একটা চেয়ার। বাম পাশটাই ঘাড় ঘুরাতেই টান অনুভব করলাম। ঘাড় ঘুরানোর প্রচেষ্টা ব্যার্থ হলো। চোখ দুটো মেলে তাকালাম। হাতের কনুইয়ে ভর করে উঠতে গেলেই ইঞ্জুরি টেপ লাগানো হাত টাই শক্তিহীনা অনুভব করে পরে যেতেই নিলাম তখনই আমায় ডান পাশ দিয়ে দুটো হাত খুব যত্নে আঁকড়ে ধরলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বেশ ভয় পেয়েই আঁকড়ে ধরলাম এক হাতে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। কুচকে যাওয়া চোখের পাতা মেলে তাকালাম আমায় ঝাপটে ধরা হাতদুটোর মালিকের দিকে।
আচানক ধক করে উঠলো বুকের ভেতর, রগে রগে কেমন শীতল স্রোত বয়ে গেলো,ধুকপুকানির শব্দের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।
অত্যন্ত সুদর্শন আর নীলকণ্ঠা মনির চেহারা এতো কাছ থেকে দেখতে পারা টা একটু বেশিই অপ্রত্যাশিত ছিলো। ওমন ইন্দ্রনীলের চোখ মেলে তাকানোটা যেনো কায়ার ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। যন্ত্রণা টা শরীর ছাড়িয়ে ভেতরে পৌঁছে গেলো।
ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছি, পুরুষালি হাত দুটোর ভীষণ সযত্নে আগলে ধরায় সারা শরীর যেনো বেইমানি করলো,ধীরে ধীরে নিজের বাকি শক্তি টুকুও ছেড়ে দিলো,কেমন অবশ লাগছে। নিজ সামর্থ্য নিয়ে উঠার শক্তিটুকুও পাচ্ছিনা। আকড়ে ধরা দুহাত ছেড়ে পরে যেতে নিলেই আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিলো, কাপা কাপা চাহনিতে চোখ তুলে তাকালাম। বেহায়া দৃষ্টিকে কিছুতেই আটকাতে পারলাম নাহ। নীল রাঙা চোখ দুটো আমার দিকে স্থীর, দুজনের মাঝে ব্যবধান দু এক ইঞ্চিখানেকের ও কম, লোকটার নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শ্রবণ যন্ত্রে আঘাত হানছে।
-ঠিক আছো?
ধীর কণ্ঠে পুরুষের করা প্রশ্ন যেনো ভেতরের তোলপাড় আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো
আছড়ে পরা গরম নিঃশ্বাসে সারা মুখ ছেয়ে গেলো, তীব্র পুরুষালি ঘ্রাণটা ভীষণ মোহনীয় লাগছে, আচ্ছা এটা কি পারফিউম নাকি উনার নিজের শরীরের ঘ্রাণ? উহু,এটা মোটেও উচিত নাহ,কোনো পুরুষের শরীরের ঘ্রাণ এতোটা মোহনীয় হওয়া তো অপরাধ। আমায় ভীষণ বেহায়া করে দিচ্ছে।
গাঢ় খয়েরি ঠোঁট জোড়া স্মিত ফাকা করে আবারও প্রশ্ন মেঘের
-কষ্ট হচ্ছে নূর?
নূর? আমায় তো নূর বলে কেও ডাকেনি? আফারা থেকে আফু অথবা পালক বলেই সম্বোধিত আমার নামটা, এ নামে উনি কেনো ডাকলো আমায়। হাজারো উৎকন্ঠা দমিয়ে সামান্য ঘাড় নেড়ে ধীরে বললাম
-হু
উষ্ণ শ্বাস টা আবারও আছড়ে পরলো মুখ জুড়ে, তার সাথে পুরুষালি কড়া কণ্ঠের নমনীয়তায় প্রশ্ন
-শুয়ে থাকবে? নাকি বসিয়ে দেই?
আবারও শুধু ঘাড় নাড়ালাম। উনি সযত্নে দু’হাতের বন্ধন গাঢ় করে আমায় বসিয়ে দিলেন। পিঠের পেছনে নরম বালিশটা রেখে চেয়ার চেনে বসলেন
শার্টের বা পাশটার রক্তের দাগ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে তার।। মস্তিষ্ক এবার কিছুটা সচল হলো,একে একে সব মনে করিয়ে দিলো। মিষ্টির পেছনে রাস্তায় ছুটে গিয়ে রাস্তার মাঝখান্র দাড়িয়েছিলাম,গাড়িতে ভীষণ জোরে ধাক্কা লেগে রাস্তায় পরে গেছিলাম,চোখের সামনে ঝাপসা ঝাপসায় দেখেছিলাম মেঘালয় চৌধুরীর ছুটে এসে আমায় কোলে তুলে নেওয়া,তার পর আর কিছু মনে নেই।
মিষ্টি? হ্যাঁ তাই তো, বাচ্চাটার কিছু হয়নি তো?
-মিষ্টি কোথায়? ওর কিছু হয়নি তো? রুচি আপু কই,মিষ্টির কোথায় লেগেছে?
একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি,বাচ্চাটার কিছু হলো নাহ তো
-আরে,কুল। শান্ত হও,মিষ্টি একদম ঠিক আছে,আপুর কাছেই আছে, ওর কিচ্ছু হয়নি।
একটু থেমে আবারও বললেন
-এতো ভালোবেসে কেও জড়িয়ে নিলে ক্ষতি কিভাবে হয় বলো
উনার কথায় কিছুটা শান্ত হলাম যাক এঞ্জেলের তো কিছু হয়নি। কিন্তু আমি একা কেনো? শিমু,আপু, নিবি আদ্রি,রাফ ওরা কই। ওরা কেও আসেনি আমার কাছে? এই লোকটা একা কেনো। হুট করেই ভীষণ মন খারাপ হলো। হাত পা ছাড়িয়ে কাদলে হয়তো ভাল্লাগতো।
ওরা আমায় ইট্টুও ভালোবাসে নাহ?
আমার ফুস হওয়া মুখটা দেখে মেঘালয় চৌধুরী ভ্রুকুটি করে তাকালো,অতঃপর প্রশ্ন করলো
-অ্যানি প্রবলেম? কি হয়েছে?কষ্ট হচ্ছে?
আমি কাঁদো কাঁদো করে বার দুয়ের ঘাড় নারালাম
-কি হয়েছে বলো আমায়,ডাক্তারকে ডাকবো?
-না
-তাহলে?
-ওরা কেও আসলো নাহ? আমায় দেখতেও আসলো নাহ,আমায় আপনার কাছে একা থাকতেই দিয়ে কোন তল্লাটে গেছে সবাই
আমার কথায় কিছুক্ষণ থ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন,এরপর আঙুলের সাহায্যে কপাল ঘষে বললেন
-ওরা এসেছিলো সবাই ছিলো,কিন্তু আমি পাঠিয়ে দিয়েছি
-কেনো?
-কারণ ওরাও তোমার মতো ছিচকাদুনে, সবগুলো বসে বসে কাদছিলো। এভাবে সারাদিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কান্নাকাটি করলে অসুস্থ হয়ে যাবে, তাই। চিন্তা করোনা একটু বাদেই চলে আসবে আবার।
ওহহ তার মানে এসেছিলো,আবার চলেও গেলো? এই কি বললো? আমি ছিচকাদুনে,আমি কই কাদুনে,আমিতো একটুও কাদিনি
-আপনি আমায় ছিচকাদুনে কেনো বললেন?
-কই তোমায় তো বলিনি,আমিতো রাফাতকে বলেছি
ভ্রু জরো করে বললাম
-শুধু রাফাত কেই বলেছেন?
আবার কথায় বার দুয়েক ঘাড় নাড়িয়ে বললো
-নাহ, শুধু রাফাত কেনো। আপু,নিবিড়, আদ্রিশ,শিমু,আর আরশি। সবাইকেই বলেছি। বাচ্চার মতো কাদঁছিলো সকলে
-সত্যিই? ওরা সবাই কাদছিলো?
-হ্যাঁ তো
-আপনি কাদেন নি?
আমার প্রশ্নে আচানক চোখ তুলে তাকালেন,উনার এমন স্থীর চাহনীতে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।ইস কিসব বলে দিলাম,উনি কেনো কাদবে, উনি কে? ধুর,মুখটাও যেখান সেখানে ব্রেক ফেইল করে।
-আমারো কান্না করা উচিত ছিলো নাকি?
এক ভ্রু উচিয়ে হাত দুটি ভাজ করে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন
আমি কিছুক্ষন হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।হুহ আইছে কাদা উচিন আলা। পারে তো শুধু থা’প্পড় দিতে। উনার সাথে তো কথায় বলা উচিত নাহ। টুপ করে একটা ভেঙচি দিয়ে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকলাম।
আমার ভেঙচি দেওয়ায় হয়তো অবাক হয়েছেন বটে,কিন্তু আমার কি আমি তাকাবো নাহ।
-ট্যান ট্যারানন!!
হঠাৎ অনেক গুলো কণ্ঠস্বর একসাথে শুনেই তৎক্ষনাৎ তাকাতেই এক ফালি হাসি জুড়ে গেলো গালে। নিবিড় রাফাত শিমু আরশি আদ্রিশ,সবাই হাজির। হাতে টিফিন বক্স নিয়ে। ঘরে ঢুকেই থপ করে আমার পাশে এসে বসলো রাফাত
-আফুউ? বেবি কেমন আছো
আরেক পাশে এসে আরশি বসে বললো
-কিরে বলদি,রাস্তায় চিত হইতে কেডায় কইছিলো তোরে,জানিস কতো চিন্তা হচ্ছিলো
আরশির কথায় নিবিড় মাছি তাড়ানোর মতো হাত করে বললো
-চুপ যাহ,ছেমরি। টেনশন করে একেবারে উদ্ধার করে দিয়েছে, বাড়ি গিয়েই তো চাড়ি গিলতে বসেছিলি
আদ্রিশ এর মাঝ থেকে বলে উঠলো
-তোরা থামবি? আফু আজ আমি রান্না করেছি তোর জন্য,শিগগির খেয়ে বল তো কেমন হইছে।
আদ্রিশের কথায় আরশি বলে ওঠে।
-এহহ,আইছে রাধুনি। ওর একটা কথাও বিশ্বাস করিস নাহ আফু, রুচি আপুই সুপটা বানাচ্ছিলো তোর জন্য, ও দুবার চামচ নেড়েছে বলেই নাকি ও রান্না করেছে। পুরো রাস্তা কান টা পচিয়ে দিয়েছে নিজের রান্নার গুনগান করে করে
-তুই থামবি ছেমরি, আমি না নাড়লে তো সুপটা হতোই নাহ,তোরা ভীষণ মিথ্যেবাদী, আফু তুই শিগগির খা আর আমার প্রশংসা কর।
রাফাত এদের থামিয়ে সামনে তাকিয়ে বলে
-এই বলদেশ্বরি,তুই মুখটা এমন থেতলে যাওয়া কুমড়ার মতো কইরা রাখসোস ক্যান রে। তখন থেইকা দেখিতাছি
রাফাতের কথায় তাকিয়ে দেখি শিমু একপাশে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে মন খারাপ করে। জানি আমি। আমার সামান্য মাথা ব্যথা হলেও ওর সহ্য হয়না,ও যে এখনো হার্ট অ্যাটাক করেনি এই অনেক
নিবিড় তখন বললো
-এই বলদ,তুই মুখটা ঠিক করবি না কি বল? কখন থেকে দেখছি তোর বিশ্রি এক্সপ্রেসন,তুই তো সাংঘাতিক লোক রে! আমাদের একটু কিছু হলে তুই এমন মুখ করে রাখবি যে লোকে আমাগো মৃত ভাইবা কবর দিয়া দেবো।
-আসলেই,এখনো সময় আছে এই বলদেরে বহিষ্কার কর আমাদের গ্যাং থেকে
আরশি আর নিবিড়ের কথায় ও কোনো হেলদল নাই,চুপচাপ আমার কাছে এসে দাড়ালো। ফোলা ফোলা চোখে বললো
-পালক তুই ঠিক আছিস? খুব ব্যাথা হচ্ছে তোর?
-লেহহ শুরু হলো,এই ছেমরি তোর ভালো পরিবেশ টা সহ্য হচ্ছে নাহ,আজাইরা প্রশ্ন বাদ দেহ,না তো মুখে স্যালাইন লাগাবো তোর
এবার শিমু মুখ খুলে বললো
-কিন্ত স্যালাইন তো হাতে লাগাতে হয়
ব্যাস,,যা এক্সপেক্ট করেছিলাম,বোকা সোকা উত্তর। হাহা করে হেসে উঠলাম ছয়জন। আমাদের খেয়াল ই নাই যে এখানে আরও একজনের উপস্তিতি আছে।
-এহেম এহেম
মৃদু কাশির শব্দে হাসি থামিয়ে তাকালাম।
মেঘালয় চৌধুরী সটান দাঁড়িয়ে হাত দু’টো পকেটে গুজে। আবারও সেই গম্ভীর ভাবলেশহীন চেহারা। রাফাত এগিয়ে বললো
-ভাই তুমি এখন বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হও,দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, মামনী চিন্তিত অনেক। তুমি ফিরে যাও।
-ওকে,বাট কোনো প্রয়োজন হলেই আমাকে ফোন করতে ভুলবি নাহ, ডক্টরের সাথে কথা বলা আছে,সকল ব্যবস্থা করা আছে,বাট এনিহাও কোনো প্রবলেম হলেই আমাকে ইনফর্ম করবি।
-ঠিক আছে ভাই
ঘাড় টা মৃদু কাত করে আমায় এক মুহূর্ত দেখে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলো।
আমি তাকিয়ে আছি লোকটার যাওয়ার পানে।
সবাই তো আছে,তাও যেনো ফাকা ফাকা হয়ে গেলো যায়গা টা ভীষণ।
সে তো কথা বলছিলো নাহ এতোক্ষন, তবুও যেনো নিঃশব্দ লাগছে ভীষণ
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
হীডিংঃ আজকের পর্বের রেসপন্স বেশি হলে বোনাস পার্ট দিবো ইনশাআল্লাহ। শুভকামনা সকলের জন্য।
হ্যাপি রিডিং#তুমি_আসবে_বলে
#হুমাইরা_হাসান
পর্বঃ ৯ (বর্ধিতাংশ)
নিঃস্তব্ধ রাত,অদূর হতে ভেসে আসছে যানবাহনের হর্ণ আর চাকার শব্দ। অন্ধকার ছেয়ে আছে পুরো ঘরটা জুড়ে। জানালার পাশে জালানো ছোট্ট একটা টেবিল লাইট। যার মৃদু আলো পর্দা ভেদ করে বিন্দু বিন্দু পরে আছে ব্যালকনিতে।
কাউচ টাতে বসে আনমনের ভাবনায় মগ্ন মেঘ,হাতে ধাতুর তৈরী যন্ত্রটা মুখে ধরে চোখ বুজে সুরের ছন্দ মিলিয়ে প্রগাঢ় শ্রুতিমধুর আওয়াজে ভরিয়ে তুললো নিঃশব্দ পরিবেশ টা।
বন্ধ চোখে হাতের আর ঠোঁটের কম্পনের নিপুণতায় সুরের ঝংকার বাজিয়ে যাচ্ছে।
হুট করে হাত চালনা থামিয়ে দিলো,ঠোঁটের কম্পন স্থীর হলো,গভীর সুনয়ন জোড়া খুলে খোলা আকাশে চেয়ে মাথা এলিয়ে দিলো।
মস্তিষ্ক জুড়ে রয়েছে অদ্ভুত চিন্তাভাবনা। এমন চিন্তা ভাবনা তো আগে হয়নি? তার সাথে তার সমবয়সী অনেকেই ছিলো,কতো কতো সময় একসাথে কাটিয়েছে,কাজ করেছে। সুদর্শন হওয়ার দরুন হাজারো রমণীর আকাঙ্খা হয়েছে। কিন্তু নিজ মনে কারো জন্যেই গভীর আবেগ,অনুতাপ আসেনি। কেনো কল্পনার দৃশ্যপটে এক চেহারা বারবার আসছে,কেনোই বা শ্রবণ যন্ত্রে একই কণ্ঠের ঝংকার বারংবার বাজছে
মেঘালয়ের চোখের সামনে আজও স্পষ্ট সেদিনের অশ্রুমাখা চেহারা টা। ভরা রাস্তায় যখন ওমন একটা কুপ্রস্তাব দেখে আগপাছ না ভেবে মেঘ থা’প্পড় দিয়েছিলো,তখন ওমন মায়াভরা চোখের চাহনি আর অশ্রুভেজা কপোল দেখে এক মুহুর্তের জন্য মেঘালয়ের মনেও কম্পন উঠেছিলো। কিন্ত নিজের বিবেক আর এমন হীনমন্যতা দেখে সে ভেতরের অনুভূতি কে দমিয়ে খুব কড়া হয়েছিলো সেদিন, কিন্তু ভুল তো ভেঙে গেলো। মায়াভরা চোখের মেয়েটির তার চেয়েও মায়াবতী চেহারা সামনে এলো।
রাতের ওমন বৈরী আবহাওয়ার দৃশ্য আর সেদিন সকালে যখন ধাক্কা লেগে পরতে নিলে মেঘালয় ঝাপটে ধরেছিলো তখন তার তিরতির করে কাপাঁ চোখ,ঠোঁট সদ্য স্নান করা ভেজা চুলের স্নিগ্ধতায় মেঘালয় সেখানেই সেই মুহুর্তেই নিজেকে হারিয়েছে। তবুও নিজেকে বারংবার বুঝিয়েছে এ ভুল! চরম ভুল।এমন কিছুই নাহ, হয়তো নিজের করা ভুলের অনুতপ্ততার কারণেই এতোটা মায়া লেগেছে মেয়েটার প্রতি,কিন্তু নাহ পরিস্থিতি, সময়,অনুভূতি, ভাবনা তাকে বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে মেঘালয় চৌধুরী হেরে যাচ্ছে,প্রখর ব্যক্তিত্বের প্রাপ্তবয়স্ক মনটা এক কিশোরের ন্যায় আচরণ করছে।
তখন কেবিনে তাকে দু’হাতে ঝাপটে ধরার পর,যখন দূরত্ব টা একেবারে ঘুচে যাচ্ছিলো,রমণীর উষ্ণ শ্বাসের ছড়াছড়ি তে তার আনন তপ্ত হয়েছিলো,তখন নিজেকে সামলানো বড্ড দায় লাগছিলো।
বসা থেকে উঠে দাড়ালো, হাতের যন্ত্রটা রেখে ঘরে গিয়ে সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো,লম্বা ঘুম দরকার, ভেতর টাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার।
কিন্ত মন তো মানতে নারাজ,কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে এপাশ ওপাশ করেও কোনো লাভ হলো নাহ। চোখ দু’টো বন্ধ করলেও একই চেহারার প্রতিফলন বারবার, মস্তিষ্ক জুড়ে চিন্তা কেমন আছে, কি করছে? অনেক কি কষ্ট হচ্ছে?
উফফ এ মাত্রাতিরিক্ত ভাবনা তাকে কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না কিছুতেই নাহ
_______________
ভোরের আলো ফুটেছে অনেক আগেই। কেবিনের পর্দা ভেদ করে মৃদু নরম আলো ভেতরে আসছে। সাথে হালকা বাতাস। আবহাওয়া টা খুব ভালো মনে হচ্ছে নাহ,বৈশাখের আবহাওয়ার পরিবর্তন রূপ ভরসাহীন, এই ভালো তো এই আকাশ জুড়ে কালো
ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ খানেক আগে,তবুও চুপটি করে শুয়ে আছি,কাল থেকে একভাবে শুয়ে থাকার কারণে পিঠে এক প্রকার চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়েছে, কিন্ত আমি অপারগ। যেমনি নিজের ইচ্ছায় চলতে পারছি না,তেমনি আমায় আপন ইচ্ছায় চলতে দিচ্ছেও নাহ। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ অন্তত দুদিন হলেও পা মাটিতে নামানো যাবে নাহ। আমার হুরহুর দলের লোক গুলো সব ঘুমে কাদা। কাল রাতভর গল্প আড্ডা দিয়ে ভোর রাতে শুয়েছে,কতো করে বললাম বাড়ি ফিরে যেতে, সকলে এক কথায় নারাজ। আরশির বাবা মা এসে আমায় দেখে গেছেন। আন্টি আর মামনীও এসেছিলো,দীর্ঘ সময় আমার কাছে বসে ছিলেন। তাদেরকেও রাতে পাঠিয়ে দিয়েছি শুধু পারিনি এগুলোকে পাঠাতে
নিচে বিছানা করে এলোমেলো ভাবে পরে আছে সবগুলো, ডানপাশের দিকে শিমু আর আরশি জড়ো সরো হয়ে শুয়ে আছে, আর বাম পাশের দিকে তাকানোও দায়। রাফাত উপুর হয়ে শুয়েছে। তার পিঠের উপর এক হাত আর পা তুলে আছে আদ্রিশ,আর নিবিড় এক পা চেয়ারে আরেক পা আদ্রিশের পেটের উপর তুলে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এদের ঘুম দেখে ডাকার ইচ্ছাও হচ্ছে নাহ।
এর মাঝেই দরজাটা কেও ধীরে ঠেকে ফাক করলো, ওদিক তাকাতেই আবারও নজরে আসলো কাঙ্ক্ষিত চেহারা। ফর্সা গায়ে গাঢ নীল রঙের শার্ট টা ভীষণ মানিয়েছে, একদম চোখের রঙের সাথে মিশে গেছে, কালো রঙের প্যান্টের সাথে ধবধবে সাদা কেটস টা পরনে। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। উনার আগমনে আমি একটুও অবাক হইনি,আমিতো জানতাম উনি আসবে,আমিতো উনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম. কিন্ত কেনো আমি কি করে জানি উনি আসবে,আমি কেনোই বা অপেক্ষা করবো তার জন্য। মাথাটা আমার এলোমেলো কেনো হয় উনার কথা ভাবলে।
সকালের আলোয় অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগছে। ক্লান্তির ছাপ থাকা চেহারা টাও যেনো সীমাহীন মায়াভরা লাগছে।
চোখ দু’টো আমার দিকের স্থির, এগিয়ে এসে দাড়ালো আমার ভীষণ পাশে,খুব শান্ত ভাবে জিগাসা করলো
-ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হচ্ছে?
জবাবে মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলাম। উনি চোখ ফিরিতে এদিক ওদিক তাকাতেই যেনো থ হয়ে গেলো। এভাবেও কেও শুয়ে থাকে? তাও একজন নাহ পুরো পাঁচ জন। রাফাত একটু ছেলেমানুষ সেটা তার জানা,কিন্তু তার সাথেও যে সব একই কোয়ালিটির জুটবে এটা ভাবতেও মেঘের চিন্তা হয়। এরা কে কখন কি করবে কোনো ঠিক নেই,সবগুলো ছেলেমানুষ।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সবার বেহাল দশা দেখে ঠোঁট এলিয়ে মৃদু হাসলো। চোখ তুকে সামনে তাকাতেই আবারও, আবারও যেনো হার্ট বিট মিস হয়ে গেলো। শুভ্র সুতির পাতলা জামা পরনে ঘুম থেকে উঠায় এলোমেলো চুল আর ফোলা ফোলা চোখে যেনো সর্বনাশা লাগছে পালককে। মায়াভরা চোখের স্থির চাহনী তার দিকেই আবদ্ধ। মেঘের ভীষণ পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে সে নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে,তার চিন্তাভাবনার বাধ ছাড়িয়ে যাবে
হঠাৎ শব্দে ধ্যান ভাঙলো পালকের,পাশে চেয়ে দেখে ঘুমের ঘোরেই গুতোগুতি করতে আদ্রিশ আর রাফাত,তিনজনের ট্রাইএঙ্গেল টাইপ শুয়ার কারণে নিজেরাই জ্যাম হয়ে গেছে, এক জনের পা এক জনের পিঠের নিচে তো আরেকজনের হাত আরেক জনের পায়ের নিচে। কিছুক্ষণ উতপাত করে তিনজনের ই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠেই আদ্রিশ বললো
-ইয়ার নিবিড়, তোরে বাড়িতে রাখছে কেমনে বল তোহ, সা’লা আমার পিঠের চুরমুর বানিয়ে দিসোস,
-নিবিড় ঢুলু ঢুলু কণ্ঠে বলে ওঠে আমারে কস ক্যান,এইডারে ক হালায় আমার হাত আর পিঠ ফাডায় দিছে ভাই।
-তোমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।
পেছন থেকে আগত কণ্ঠে ঘার ঘুরিয়ে দেখে মেঘ কে। রাফাত প্রশ্ন করে।
-ভাই কখন এলে
-মাত্রই। মা খাবার পাঠিয়েছে, তোরা যা ফ্রেশ হয়ে আই।
তিনজনে টলমলে পায়ে উঠলো, নিবিড় আর আদ্রিশ বেরিয়ে গেলে রাফাত ফিরে এসে আরশি আর শিমুর কাছে যায়,পানির বোতল টা নিয়ে ধপ করে শিমু আর আরশির গায়ে ঢেলে দেয়। ধরফরিয়ে উঠে শিমু
-ভূত প্রেত আত্মা!!
বলেই চিল্লাতে শুরু করে
-এই ছেমড়ি চুপ,এইখানে ভূত তোর শ্বশুর পার্সেল করে পাঠাবে নাকি, ফটাফট দুটাই উঠ নাতো দুইটারেই কমোডের পানিতে চুবাম,তগোরে কি ভেটকাইয়া ঘুমানোর জন্য আনছি
রাফাতের কথায় এ দুটোই টলতে টলতে বাহিরে গেলো ফ্রেশ হতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো সবাই,এর মাঝে নার্স এসে চেকাপ করে গেছে, তাদের ভাস্যমতে সব ঠিক থাকলে আজ বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারবো।
নিবিড় আর আদ্রিশ বাহিরে গেছে কোনো কাজে। মামনী ফল,স্যান্ডউইচ, আর ফ্রুট জুস পাঠিয়েছে। শিমু আমি আর আরশি বসে ওরা খাচ্ছে আর আমাকেও খাইয়ে দিচ্ছে
রাফাত গেছে তার ভাইয়ের সাথে কোনো জরুরি আলোচনা করতে।
_________
সমস্ত ফরমালিটিস পুরোন করে,হাজারো নিয়ন কানুন বাধ্যবাধকতার লিস্ট ধরিয়ে অবশেষে আমার ছুটি হলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
আরশি সকালের পর বাড়িতে গেছে, আদ্রিশ আর নিবিড় ও ফিরে গেছে, আর যানিয়ে গেছে আমি বাড়ি ফেরার আগেই নাকি তারা চলে আসবে,সব গুলোয় মিলে কিসের খিচুড়ি পাকাচ্ছে ওরাই যানে।
যেহেতু আমায় অ্যাডমিট করার সকল ফরমালিটিস মেঘালয় চৌধুরীই করেছেন, তাই রিলিজের সাইন ও তারই দরকার। আপাতত শিমু আর উনিই আছেন আমার সাথে। সকল ঝামেলা শেষে বেরোবো এই জেল টাইপ কেবিন থেকে,কিন্তু এখানে ঘটলো আরেক বিপত্তি।
-আমি কিছুতেই যাবো নাহ
আমার কথায় শিমু বললো,কি হয়েছে, কোনো সমস্যা? কেনো যাবি না
-আমি এই হুইলচেয়ারে বসে কিছুতেই যাবো নাহ আমি কি ল্যাংড়া নাকি পঙ্গু যে এটাতে করে যেতে হবে কিছুতেই নাহ।
আমায় হাজার কিছু বলেও রাজি করানো গেলো নাহ, শেষে মেঘালয় বললেন
-আ’ম আস্কিং ইউ ফর দ্যা লাস্ট টাইম,তুমি কি সত্যিই এভাবে যেতে চাও না?
আমার কাঠ কাঠ জবাব
-নাহহ
-ওকে দ্যান,দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান ওয়ে
বলেই ধপ করে আমায় কোলে তুলে নিয়ে হাটা ধরলেন। আমি এখনও বুঝতে পারলাম নাহ কি হলো,আশেপাশের লোকেরা শুধু হা করে তাকিয়ে আছে। আমি পারছি না মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে।
চলবে ইনশাআল্লাহ
হীডিংঃ দেরি হবার জন্য দুঃখিত