তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১১

0
715

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১১
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

স্নিগ্ধার চেঁচামেচি শুনে আদনানের মা সাজেদা খানম ছুটে আসলো। একবার স্নিগ্ধা একবার আদনানের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি হইছে এইখানে? তোরা দুইটা আবার ঝগড়া করছিস?”
“কোনো ঝগড়া-টগড়ার কিচ্ছু হয় নাই ফুপি। আমি বুঝে গিয়েছি তোমার ছেলের আমাকে জাস্ট সহ্য হচ্ছে না। তাই সে প্রতিনিয়ত আমাকে হেনস্থা করার তালে থাকে। আমি কাল সকালেই চলে যাবো ফুপি। কারো চোখের কাটা হয়ে থাকার ইচ্ছে আমার নেই।”
কথাটুকু বলে অগ্নিদৃষ্টি ফেললো আদনানের দিকে। তারপর হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
সাজেদা খানম কটমটিয়ে তাকালো ছেলের দিকে। কাটখোট্টা ভাবে বলল,
“এত্ত বড় হয়েছিস তবুও দুইটায় বদলালি না। কেন ক্ষ্যাপাস মেয়েটাকে? কী করেছিস আজ আবার?”
“কিচ্ছু করিনি মা। তুমি ওকে জানো না? ড্রামা কুইন একটা! ড্রামা করছে। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সাজেদা খানম ধমকে উঠে বললেন,
“চুপ থাক বেয়াদপ।”
বলে তিনিও চলে গেলেন।
আদনান আগের মতোই গালে হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো। উপর উপর স্নিগ্ধার রিয়েক্ট পাত্তা না দেয়ার ভাব দেখালেও মনে মনে একটু অবাক হলো। স্নিগ্ধা এতো রিয়েক্ট করবে সেটা ও বুঝতে পারেনি। এমন আচরণ ও হরহামেশাই করে। স্নিগ্ধা পাল্টা শোধ নেয়। কিন্তু কখনো এতো সিরিয়াস রিয়েক্ট করে না। আজ কী হলো হঠাৎ কে জানে!
সেই ছোট থেকেই স্নিগ্ধা ওদের সাথে থাকে। স্নিগ্ধার মা মারা যাওয়ার পর সাজেদা খানম-ই সাথে করে নিয়ে আসে। আদনার আর স্নিগ্ধা সেইম এইজ এর হওয়ার সুবাদে অনেক আগ্রহ কাজ করে আদনানের মায়ের। মা হারা মেয়েটার জন্য নিদারুণ মায়া অনুভব করে। সবচাইতে বড় ব্যাপার তার কোনো মেয়ে নেই। স্নিগ্ধাকে দিয়েই সেই শখটা পূরণ করেছে।
আদনান এমনিতে চুপচাপ হলেও স্নিগ্ধার সাথে সম্পর্ক সাপেনেউলে! ওর ধারনামতে স্নিগ্ধার মতো ফাজিল আর একটাও নেই। সকাল বিকাল নিয়ম করে মাইর দেয়া উচিৎ এই মেয়েকে!

তবে আদনান ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের। ঠুসঠাস রেগে যাওয়া ওর স্বভাবে নেই। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় সুন্দর করে সামলে নেয়ার অসম্ভব সুন্দর একটা গুন ওর আছে। আদনান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। টিশার্ট টা টেনে পরিপাটি করলো। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে পানি খেলো। তারপর এগিয়ে গেলো স্নিগ্ধার রুমের দিকে। দরজা খোলাই ছিলো। মেয়েটা খাটের উপর পা ভাঁজ করে বসে আছে। মেজাজ যে ভয়ানক বিগড়ে আছে, তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আদনান। নিজের হাত দুটো ভাঁজ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। গলা খ্যাকাড়ি দিলো,
“উহুম, উহুম!”
স্নিগ্ধার কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। আদনান একটু নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এই যে ম্যাডাম? আমি কি একটু আসতে পারি আপনার রুমে?”
স্নিগ্ধা খটখট করে হেঁটে আদনানের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিড়মিড় করে বলল,
“না, আসতে পারেন না। এখানে আপনার কোনো কাজ নেই। সারাদিন-রাত যেখানে যেখানে আপনার কাজ ছিলো সেখানে যান। অনুগ্রহ করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।”
বলেই খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আদনান নাছর বান্দা। ও জানে কি করে এই মেয়ের রাগ ভাঙাতে হয়। কন্ঠে অনেকটা কষ্ট কষ্ট ভাব এনে বলে,
“ও মেহুরানী? শোন না! আমার কিন্তু খুব ক্ষুধা লেগেছে। তুই না বেড়ে দিলে কিন্তু খাবো না আমি। এবার ভেবে দেখ, আসবি কি আসবি না!”
দরজার ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। শেষমেশ বাধ্য হয়েই দরজার কাছ থেকে সরে সোফায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। সাজেদা খানম এসে বললেন,
“ভাত বেড়ে দিবো?”
আদনান হাই তুলতে তুলতে বলল,
“মেহু খেয়েছে?”
“না, বলেছিলো তুই আসলে তোর সাথে খাবে। এখন তো দিলি মেয়েটাকে রাগিয়ে।”
“কিছু হয় নাই এতে। ওর রাগ দুই মিনিটের। একটু পরই আসবে। তুমি যাও। মেহু আসলেই খাবো।”
সাজেদা খানম মাঝে-মধ্যে অতিষ্ঠ হলেও ওদের খুনশুটিগুলো বেশ উপভোগ করে। দুজনের ভাবখানা এমন যেন, কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারছে না! কিন্তু সত্যি এটাই কাউকে ছাড়া কারো চলেও না। মৃদু হেসে সে তার রুমে চলে গেলো।
আদনান সটান হয়ে সোফাতেই শুয়ে পড়লো। এক হাত ভাঁজ বুকের উপর আরেক হাত কপালের উপর রাখলো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। চোখ দুটো বন্ধ করতেই ফোনে টুং করে আওয়াজ হলো। টি-টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে ক্লান্ত চোখেই ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই, নয়নতারার নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। আদনান চট করে উঠে বসলো। এই প্রথম নয়নতারা নিজে থেকে মেসেজ দিয়েছে! উত্তেজনা নিয়ে মেসেজ বক্সে ঢুকতেই ভেসে উঠলো,
“আই এম স্যরি। ঐভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি। এবং ধন্যবাদ আমার চিরকুট টা খুঁজে এনে দেয়ার জন্য।”
এই ছোট্ট মেসেজটাতেই খুশি খুশি লাগছে আদনানের। ফোনের গ্যালারীতে ঢুকে একটা ছবি বের করে জুম করে দেখলো বারবার।
অসম্ভব সুন্দর মেয়েটার মুখের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে আদনানের দু’চোখ জুড়ে। নয়নতারার কথা মনে পড়লেই লুকিয়ে তোলা এই ছবিটা দেখে আদনান। নয়নতারা যদি জানতে পারে, আদনান লুকিয়ে ওর ছবি তুলেছে, তবে নিশ্চই অভদ্র বলবে। মনেমনে কথাটা ভাবতেই হেসে ফেলে আদনান। হাসলে এক গালে হালকা টোল পরে ছেলেটার। কি যে সুন্দর লাগে দেখতে!
ছেলে মানুষ হাসি সুন্দর হওয়া খুবই অন্যায়, ভয়াবহ অন্যায়! হাসি সুন্দর হবে মেয়েদের, ছেলেদের হাসি সুন্দর হবে কেন? আশ্চর্য!
দূর থেকে দেখছে আর ভাবছে স্নিগ্ধা।
এই ছেলেটার হাসিমুখটা দেখলে সব রাগ এক নিমিষে উধাও হয়ে যায়। কেন কে জানে! ওর সব রাগ-অভিমান ছেলেটাকে ঘিরে আবার সব রাগ-অভিমান দূর করার মহা-ঔষধ ও ছেলেটার কাছে।
চাপা অভিমানটা পুরোপুরি কাটার আগেই আরো একটু অভিমান জাগলো মনে। কি দেখে হাসে ও? নয়নতারাকে দেখে? এত পছন্দ কেন করতে হবে একটা মেয়েকে?
স্নিগ্ধার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মোটেও কান্না করা যাবে না। কথায় কথায় কেঁদে ফেলা ওর কাছে অতিরিক্ত আহ্লাদ মনে হয়। আদনান যাকে ইচ্ছে তাকে পছন্দ করুক। তাতে ওর কি?
তবে ও মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে, খাবার বেড়ে দিবে ঠিকই তবে আদনানকে ডাকবে না এবং নিজেও খাবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে জোরে জোরে আওয়াজ করে প্লেট, জগ-গ্লাস, বাটি-টাটি নাড়াতে লাগলো।
আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে উঠলো আদনান। স্নিগ্ধাকে দেখতে পেয়ে চোখেমুখে খুশি ভাবটা আরো বেড়ে গেলো। ফোনটা টি-টেবিলের উপর রেখে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলো। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
“মেহুরানীর রাগ কি কমেছে?”
স্নিগ্ধার কপাল কুঁচকানো। আদনানের প্লেটে ভাত দিতে দিতে বলল,
“আমাকে কেউ যেন এই নামে না ডাকে। আমার সুন্দর সুন্দর দুইটা নাম আছে। মেহজাবিন এবং স্নিগ্ধা। কেউ এই দুই নামে ডাকতে পারলে ডাকবে, না পারলে ডাকবে না।”
আদনান মুখ চেপে হাসলো। স্নিগ্ধা রেগে গিয়ে যখন এভাবে কথা বলে, তখন ওর বেশ লাগে। সে ভাব নিয়ে বলল,
“পারবো না এত কঠিন কঠিন নামে ডাকতে। ‘মেহ-জা-বিন’ কত্ত বড় নাম! এত বড় নাম ধরে ডাকতে ডাকতেই আমার দম ফুরিয়ে মারা যাবো। তারপর হলো গিয়ে, ‘স্নিগ্ধা’ বাপরে বাপ! কি কঠিন! উচ্চারণ করতে গিয়েই তো দাঁত সব নড়ে গেলো। তুই যেমন ডেঞ্জারাস তোর নামগুলোও তেমন ডেঞ্জারাস। এর চাইতে আমার মেহুরানীটাই বেটার! মেহুরানী, মেহুরানী, মেহুরানী! একশো বার ডাকবো। সমস্যা? সমস্যা হলেও কিছু করার নাই, ফুট।”
স্নিগ্ধার অসম্ভব ভালো লাগে এই ডাকটা।
আদনান যখন মেহুরানী বলে ডাকে তখন মনে হয় এর থেকে সুন্দর কোনো ডাক হতেই পারে না। উপর উপর রাগ দেখায় কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে এই ডাকটা।
স্নিগ্ধা ওর ভালোলাগাটা চেপে রেখে খিটখিটে স্বরে জবাব দিলো,
“মেহজাবিন ডাকতে আপনার কষ্ট লাগে! কিন্তু ঠিকই বারবার করে দরদ দেখিয়ে নয়নতারা-টয়নতারা ডাকতে পারেন। গুড, ভেরি গুড। আপনি যা ইচ্ছে তাই করুন, তাতে আমার কি? বাট খবরদার মেহু-টেহু ডাকবেন না। কেউ একজন না ডাকতে পারলে মারা যাবো না।”
আদনান স্নিগ্ধার কথা কোনোরূপ পাত্তা না দিয়ে বলল,
“তরকারী আজ কে রেঁধেছে? তুই? অনেক ঝাল। তুইও ঝাল তোর তরকারীও ঝাল। দুনিয়াটা এখন ঝালময়! উহহহ!”
“আমার তরকারী ঝাল লাগলে আপনার নয়নতারাকে বলুন মিষ্টি মিষ্টি তরকারী রেঁধে দিতে। খেতে হবে না আমার রান্না। আমি তো পারি না, তাই না?”
আদনান হো হো করে হাসে। স্নিগ্ধার হাত টেনে বসিয়ে বলে,
“বোস। প্লেটে ভাত নে, তোর স্পেশাল ঝাল তরকারী নে তারপর খেয়ে-টেয়ে ভরা পেটে ইচ্ছেমত বকা দে। ওকে?”
“খাবো না।”
“খেতে হবে।”
“খাবো না মানে খাবো না।”
“খাবি মানে খাবি। আর এখন খেলে, কাল তোকে আমি ট্রিট দিবো, প্রমিস।”
স্নিগ্ধার এমনিতেও খুব ক্ষুধা লেগেছে। খাবার নিয়ে মেয়েটা রেগে থাকতে পারে না। তাই ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করলো,
“সত্যি?”
আদনান স্নিগ্ধার মাথায় চটি মেরে বলে,
“তিন সত্যিরে মিস ড্রামা কুইন।”
স্নিগ্ধা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“আবার?”
আদনান এক হাতে এক কান ধরে নত শিকার করে বলে,
“স্যরি, স্যরি!”
.
.

সকাল হতেই আদনানের রুমে নক করতে থাকে স্নিগ্ধা। অতি ব্যস্ত গতিতে ডাকে,
“এই যে মহারাজ? শুনছেন? আপনার ঘুম কি আজ ভাঙবে? নাকি ট্রিট দেয়ার ভয়ে উঠবেনই না!”
আদনানের ঘুম পাতলা। এক ডাকেই উঠে বসলো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“কিসের ট্রিট? তোর কি বিয়ে টিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি? কি সাংঘাতিক!”
স্নিগ্ধা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আদনান! আবার কথার খেলাপ করছিস? রেগে যাচ্ছি কিন্তু!”
আদনান দরজা খুলে বলল,
“হেই ম্যাডাম? আদনান হাবিব কখনো কথার খেলাপ করে না। যা, গিয়ে নাস্তা রেডি কর। খেয়ে-টেয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হবো। একটু ঘুরাফিরা করে দুপুরের লাঞ্চ করে ফিরবো। ওকে?”
স্নিগ্ধা উল্লাস নিয়ে বলল,
“ওকে, ওকে! থ্যাংক ইউ মিস্টার আদনান হাবিব ওরফে ভদ্র শয়তান!”
:
স্নিগ্ধা আর আদনান বাসা থেকে বের হলো দশটার দিকে। ঠিক করলো পতেঙ্গা যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। বারোটার দিকে পতেঙ্গা গিয়ে পৌঁছাল ওরা। বাইকে করে আসার ফলে এই দুই ঘন্টাও অনেক মজা করে কেঁটেছে। পথে পথে বাইক থামিয়ে এটা সেটা খেয়েছে। যদিও আদনান খেতে চায় নি। স্নিগ্ধা জোর করে খাইয়েছে। ওর ধারনা মতে ঘুরতে বেড়িয়ে স্ট্রিট ফুড না খেলে ঘুরাটাই বৃথা।
ওরা যখন পতেঙ্গার পাশের স্টল গুলো ঘুরে ফিরে দেখছিলো তখন আদনান একটা মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেলো। অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠের মেয়েটা বার বার করে ডাকছে,
“আরজু? এই আরজু? শোন না ভাই!”
………(চলবে)

(দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here