তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১২

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১২
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

আদনান সানগ্লাসটা খুলে এদিক সেদিক তাকায়। ডাকের উৎসটা খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আর ডাক শুনতে পায় না। স্নিগ্ধা স্টলের জিনিসপত্র গুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলো। হঠাৎ আদনানকে এভাবে অস্থির হতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?”
আদনান পকেট থেকে ফোন বের করতে বলে,
“কিছু না।”
কারো নাম্বারে ব্যস্তগতিতে ডায়াল করতে করতে স্টল থেকে বেড়িয়ে সমদ্রের পাড়ে আসে। ওপাশ থেকে ফোন উঠানোর সাথে সাথে বলে,
“হ্যালো, নয়নতারা? আমাকে একটু বলবেন আরজুর কোনো রিলেটিভ’স চিটাগাং থাকে কি-না?”
আদনানের এরূপ প্রশ্নে নয়নতারা বিস্মিত হয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“হঠাৎ এসব জানতে চাচ্ছেন কেন?”
আদনান অস্থির হয়ে উঠে। ও নিজেও অবাক হয়ে যাচ্ছে নিজের অস্থিরতায়। খানিক বিরক্তি নিয়ে বলে,
“উফফ! এতো পাল্টা প্রশ্ন করছেন কেন? যা জিজ্ঞেস করেছি তা বলুন, ফ্যাস্ট।”
নয়নতারার সোজাসাপ্টা উত্তর,
“জানি না। আমি তার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না। তার মাকে এবং তাকেই শুধু দেখেছি তাদের পরিবারে। আর শুনেছিলাম বড় একটা আপু আছে। তারা কই থাকে-না থাকে সে ব্যাপারে কিছু জানি না। জানতে চাইও না।”
খুব সহজে রেগে না যাওয়া ছেলেটা এই পর্যায়ে ভীষণ রেগে গেলো। একটু কড়া গলায় বলল,
“জানেন না মানে কি, হ্যা? একটা মানুষকে এতো ভালোবাসেন অথচ তার ব্যাপারে কিছুই জানেন না, এটা কেমন কথা? আবার বলছেন, জানার ইচ্ছে নেই! তা থাকবে কেন? সব কিছু নিয়ে খামখেয়ালি করা এক প্রকার স্বভাব হয়ে গিয়েছে আপনার! বেশি হেলাখেলা করলে কোনো কিছুই টিকে না, মনে রাখবেন।”
নয়নতারা চুপচাপ সব শুনলো। কিচ্ছুটি না বলে ফোনটা কেটে দিলো।
আদনান আবার ফোন দিলো, কিন্তু ফোন বন্ধ।
নয়নতারা ফোনটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। আজকাল কোনোকিছুই, কোনো ঘটনা গায়ে মাখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কিছু কথা থাকে, যার ভার বহন করার সাধ্য সবার থাকে না। গলায় আটকানো কাটার মতো বিঁধে থাকে মনে। নয়নতার চোখের কোনে এক ফোঁটা জল উঁকি দিলো কি? দিলো বোধহয়!

আদনান ফোনটা পকেটে রেখে দু’হাত দিয়ে চুল গুলো সরালো কপাল থেকে। একটা দীঘর্শ্বাস ফেলে নিজেকে বকলো মনে মনে। খুব বেশি রিয়েক্ট করে ফেলার অনুতাপ হতে লাগলো। রাগ লাগছে খুব। এতো রিয়েক্ট করার কি ছিলো? ও তো জানে নয়নতারা কেমন। একরোখা, একগুঁয়ে, ভীষণ চাপা স্বভাবের মেয়েগুলার জানাশোনার পরিধিটা যে আহামরি বড় হয় না, তা তো ওর জানা। জেনেশুনে এমন স্টুপিডের মতো কেন করলো কে জানে!
আদনান যখন অনুতাপ বোধে হাহুতাশ করছিলো তখন পাশে এসে দাঁড়াল স্নিগ্ধা।
আদনান যেন চমকালো। স্নিগ্ধা আছে তা যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। মেকি হেসে বলল,
“চল ঐদিকটায় ঘুরি।”
স্নিগ্ধা থমথমে মুখে চেয়ে থেকে বলল,
“বাসায় যাবো।”
মেয়েটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। কারো প্রতি ছেলেটার এই নিদারুণ মায়ার অনুভুতিটা খুব করে অনুভব করলো স্নিগ্ধা। ওর খুব হিংসে হয় আজকাল। অন্যকারো প্রতি আদনানকে বিমোহিত হতে দেখলে মুষড়ে যায় ওর মন। আবেগহীন মেয়েটার মন আবেগে ভরে উঠে। চোখ দুটোও বোধহয় খানিক ভিজে উঠে! আদনান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“এখনি কেন? চল আরো কিছুক্ষণ ঘুরি। লাঞ্চ করে দ্যান যাবো। এখন কি কিছু খাবি?”
স্নিগ্ধা তাকায়। কি যেন ছিল সেই চাহনিতে! অভিমান-অভিযোগ নাকি অন্যকিছু?
“বাসায় যাবো আদনান। তুই থাকলে থাক, আমি একাই চলে যাচ্ছি।”
বলে চলে যেতে লাগলে স্নিগ্ধা। আদনান হাত টেনে থামায়। করুন দৃষ্টি ফেলে বলে,
“রাগ করেছিস মেহু?”
“না। রাগ করবো কেন?”
“ও হ্যা তাই তো, রাগ করবি কেন? তোর সাথে তো রাগ করার মতো কিছু করি নি।”
স্নিগ্ধার ছোট্ট জবাব,
“হু।”
“একটা কথা বলি?”
“ইচ্ছে হলে বল।”
“তুই তো নয়নতারাকে খুব একটা পছন্দ করিস না। কিন্তু আমি মেয়েটাকে অসম্ভব পছন্দ করি। ওকে কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগে না। মেয়েটা সবার থেকে আলাদা।”
স্নিগ্ধার মায়া হলো। প্রথমবারের মতো নয়নতারাকে বলতে ইচ্ছে হলো,
“ছেলেটা তোমায় খুব পছন্দ করে, তুমি কেন করো না? তুমি কি বোকা? এত বোকা কেউ হয়?”
স্নিগ্ধা অভিমানটা চেপে রাখলো। আদনানের বাহুতে চাপড় মেরে বলল,
“চল খাবো। ক্ষুধা লেগেছে।”
আদনান তার সুন্দর হাসিটা দিলো। স্বভাবসুলভ স্নিগ্ধার মাথায় চাটি মেরে বলল,
“আমারও ক্ষুধা লাগছে, চল।”

ওরা যখন হাঁটা ধরলো ঠিক তখনই কেউ একজন ওদের পেছন এসে মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে দুজনের আঙুল ধরলো। আদনান আর স্নিগ্ধা থেমে পাশ ফিরে তাকাতে দেখলো তিন-সাড়ে তিন বছরের একটা পুতুলের মতো বাচ্চা মেয়ে হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান নড়তে লাগলে সে আধো আধো গলায় বলল,
“এই আংকেল? আন্তি? নইলো না! আম্মু, নানু আল(আর) মামাল সাতে নুকুচুলি কেলি। তোমলা নললে দেকে ফেলবে।”
স্নিগ্ধা আর আদনান একে অপরের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকালো। এত মিষ্টি কথা শুনে বাচ্চাটাকে আদর করে দিতে ইচ্ছে হলো তখনই।
কিন্তু প্রিন্সেস টার কথা অমান্য তো তারা করতে পারে না! তাই সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। স্নিগ্ধা নিচু কন্ঠে বললো,
“কিন্তু প্রিন্সেস? সবাইকে বলে লুকিয়েছো তো?”
পিচ্চি’টার সহজ উত্তর,
“না।”
“হায়রে! কি বলো বাবুই? তোমাকে না পেয়ে শেষে যদি তারা কেঁদে ফেলে তারা?”
পুঁচকে’টা স্নিগ্ধার চাইতেও নিচু কন্ঠে বলল,
“না না! কাঁদবে কেন? আমাল মামা আতে না? আমাল মামা সুপাল হিরো। সুপাল হিরো সাতে তাকলে কেউ ভয় পায়? তোমলা তো দেকি খুবই বোকা! আমাল আম্মু আল নানুল তাইতেও বোকা। হি হি হি!”
মুখে হাত রেখে কুটকুট করে হাসি দেখে যে কারো কচলে দিতে ইচ্ছে করবে। স্নিগ্ধা আহ্লাদ নিয়ে বলে,
“এই আদনান? কি কিউট রে পুঁচকে’টা! আদর না করে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”
স্নিগ্ধার কথা শেষ হওয়ার আগেই একজন বৃদ্ধার ডাক ভেসে আসলো,
“নানু ভাই? ও নানু ভাই?”
পুঁচকেটা পেছন থেকে কুটকুট করে হাসছে সেই ডাক শুনে। আদনান বৃদ্ধাকে ইশারায় জানান দিলো ওদের পেছনেই আছে। এর মাঝেই কেউ একজন ছুটে এসে আদনান আর স্নিগ্ধার পেছন থেকে বিচ্ছুটাকে লুফে নিলো। দু হাতে অনেকটা উপরে উঠিয়ে বলল,
“এইতো, ধরে ফেলেছি আমার দুষ্ট ফুল’কে।”
বিচ্ছুটা এবার খিলখিল করে হাসছে।
আদনান পেছন ফিরে দেখলো, শ্যাম বর্ণের তরুণ ছেলেটাকে। সাদা-কালো চেকপ্রিন্টের শার্ট এর সাথে কালো জিন্স প্যান্ট পরিহিত। এই ছেলেটার হাসির সাথে কারো হাসির মিল পেলো যেন আদনান। ঐ গেঁজ দাঁত দুটোই কি কারণ? খুব চেনা-পরিচিত মানুষকে অনেকদিন বাদে দেখলে যেমনটা লাগে ঠিক তেমনটা লাগছে। কিন্তু ছেলেটা তো ওর চেনা-পরিচিত কেউ না, তবে?
আদনানের এসব ভাবনার মাঝেই একজন মেয়ে এগিয়ে এলো। বিচ্ছুটার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“এই ফাজিল মেয়ে? তোমাকে আমি মাইর দিবো, বুঝেছো? খুব পাঁজি হয়ে গিয়েছো। কাউকে না বলে এদিকে কেন এসেছ, হু?”

পুঁচকে টা এবার একটু মন খারাপ ভাব করলো। তবে ভয় পেলো না। কারন সে তার সুপার হিরো মামার কোলে। সে তার মামার গলা জড়িয়ে নালিশ করলো,
“দেকো মামা, আম্মু আমাকে বকে!”
ছেলেটা মেয়েটা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এই আপু? বকছো কেন? একদমি বকবা না আমার ফুলকলি কে।”
বিচ্ছুটার মুখে পুনরায় হাসিতে ভরে উঠলো।
আদনান আর স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো পরিবারটার খুনশুটি দেখেই যাচ্ছিলো। স্নিগ্ধা কাছে এসে বলল,
“তোমার নাম কি প্রিন্সেস?”
“আমাল নাম ফুল! মামা বলেছে।”
ছেলেটা হাসছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি।
আদনান প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে থেকে বলল,
“সত্যিকারে ফুল? ঘ্রান হয়, এই ফুলে?”
ফুল যেন দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলো। সে একবার তার মামার দিকে তাকালো, তারপর আদনান আর স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওর রিয়েকশন দেখে সবাই হেসে ফেললো। আদনান আর স্নিগ্ধা আদর করলো কোলে নিয়ে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সবার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠলো আদনান আর স্নিগ্ধার।
এক পর্যায়ে এসে ছেলেটা আদনানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার সাথে তো পরিচয়-ই হলো না! হাই, আমি আহনাব আরজু। সাথে আমার মা, আপু, আর আমার ফুলকলি। দুষ্ট-মিষ্টি ফুল আমাদের।”
আদনানের পুরো শরীর যেন শিওরে উঠলো। তার মস্তিষ্ক থেমে আছে ‘আরজু’ নামটাতে! ছেলেটা কি সত্যিই সেই আরজু? নাকি সেইম নামের অন্য কেউ? কিন্তু নয়নতারা বর্ণনার সাথে অনেক কিছুই মিলে যায়। তবে কি সত্যিই!
আদনান ঘামছে অনবরত। স্নিগ্ধা লক্ষ্য করলো। আদনানের হাত চেপে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? এমন করছিস কেন? কোনো সমস্যা?”
“ন…না, কিছু না।”
বলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো আদনান। ছেলেটার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো,
“আদনান হাবিব। আপ-আপনি কোথায় থাকেন? ঢা…ঢাকা?”
বৃদ্ধা মতো মানুষ টা তাড়া দিয়ে বলল,
“বাবা, আমাদের যেতে হবে এখন। কিছু মনে করো না, হ্যাঁ?”
“না, না। ঠিক আছে।”
আদনান উপর উপর ‘ঠিক আছে’ বললেও মনে মনে বলছে, ‘ঠিক নেই, কিচ্ছু ঠিক নেই!’
ওরা চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারো নয়নতারাকে ফোন লাগালো আদনান। স্বাভাবিক ভাবেই ফোন উঠালো না। আদনান উশখুশ করে মেসেজ পাঠালো,
“আমাকে আরজুর পুরো নামটা বলুন, নয়নতারা। প্লিজ এখন এটলিস্ট এটা বলবেন না যে, জানেন না। প্লিজ বলুন নয়নতারা। খুব জরুরী।”
মেসেজ সেন্ড করার প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লাই এলো,
“আহনাব আরজু।”
উত্তেজনায় প্রচন্ড বাতাসের মধ্যেও ঘেমে একাকার হয়ে গেলো আদনান। মেসেজটার দিকে তাকিয়ে বারবার করে বলতে লাগলো,”শিট, শিট, শিট। খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। এত কাছে পেয়েও….!”
স্নিগ্ধাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো মেয়েটা সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান একছুটে ওর কাছে গেলো। গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“মেহু? তুই একটু এখানেই দাঁড়া। আমি জাস্ট দুই মিনিটেই আসছি।”
বলেই চোখের নিমিষে হাওয়া হয়ে গেলো। স্নিগ্ধা উদাস হয়ে ভাবে, “কিসের জন্য আদনানের এতো অস্থিরতা! কি পেয়েছে ও?”
……..(চলবে)

(রিচেইক দেয়া হয় নি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here