তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৩২(শেষাংশ)

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩২ (শেষাংশ)

.
“তা..তাসফি ভাই শুধু আমায় ভালোবাসেন, ওনার জীবনে আমিই শেষ নারী? সেদিনের সবকিছুই মিথ্যে ছিলো? ওনার আর আপনার মাঝে কোন সম্পর্ক নেই?”

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিয়ানা আপু। আমার ফিরতি উত্তরের আসায় তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। কিয়ানা আপুর ছটফট করা চোখ দুটো দেখে ধুক করে উঠলো বুকে। তার নিস্তব্ধতায় নিমিষেই যেন আমার উত্তরটা পেয়ে গেলাম আমি। গতকাল সন্ধ্যা থেকে যে চোখ দুটোয় একফোঁটা জল বেরোয় নি, তাসফি ভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা শোনার পরও যে সার্থপর চোখ থেকে এক ফোঁটাও পানি বেরোয় নি, সেই চোখ থেকেই টপটপ করে অশ্রু বিসর্জন হতে লাগলো।

নিজেকে সামলে নিলাম কিছুটা। আস্তে করে বললাম,
“তাহলে ওই ছবি গুলো? ওই ছবিগুলোও কি মিথ্যে ছিলো?”

আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লে কিয়ানা আপু। বললো,
“হ্যাঁ! ওই ছবিগুলো মিথ্যে ছিলো, এডিট করা ছিলো। তাসফির সাথে ওমন কোন সম্পর্ক নেই আমার। নরমাল হাত ধরা ছাড়া তাসফি ওতটা কাছে আসা হয় নি আমার। বন্ধুত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো আমাদের সম্পর্ক।”

“চার বছর আগের সেই রাত? তাসফি ভাইয়ের আপনাকে ডাকা, আপনাকে ভালোবেসে কাছে ডাকা….”

“সবকিছুই তোমার জন্য ছিলো। তোমাকে কাছে পাবার জন্য, তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলো তাসফি। পাগলের মতো ছটফট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো, জ্বরের ঘোরে তোমাকে কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। ঠিক তখনই তোমার ফোন আসে, আর সেই সুযোগই আমি….”

“কেন করলেন এমনটা? কোন এত বড় মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাকে ওনার থেকে দূরে সরে দিতে চাইলেন? আমাদের সম্পর্কের মাঝে কেন এত বড় ফাটল ধরালেন?”

নিরুত্তর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ানা আপু। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না হয়তো। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না আমি। অপরাধীর বোঝাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো, গতকাল তাসফি ভাইকে বলা আমার প্রতিটা কথা যেন ফিরে আসতে লাগলো। উত্তরে ওনার বলা শেষ কথাগুলোও বারংবার উঁকি দিতে লাগলো।
দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এগিয়ে এলো কিয়ানা আপু, দু’হাতে আমাকে আগলে ধরার চেষ্টা করে বলে উঠলো,

“আমাকে ক্ষমা করে দিও রূপা। তাসফির কাছে কখনোই ক্ষমা পাবো না আমি, তুমি অত্যন্ত দিও। তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না আমি, তাসফি কখনোই বলে নি এ বিষয়ে। অন্ধ হয়ে গেছিলাম, তাসফি কে নিজের করে পাবার জন্য পাগল হয়ে গেছিলাম আমি। যার জন্য আজ বন্ধুত্বও হারিয়ে ফেললাম।”

দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিলাম কিয়ানা আপুকে। হালজা চেচিয়ে বলে উঠলাম,
“আপনার জন্য, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমি ওনাকে কষ্ট দিয়েছি, উনি আমাকে ভালোবাসেন সেটা জেনেও দূরে ঠেলে দিয়েছি। আপনার কথা গুলো বিশ্বাস করে ওনার ভালোবাসাকে আমি অসম্মান করেছি, ভালোবেসে ওনার করা প্রতিটি স্পর্শকে আমি ঘৃণা করেছি। কেন করলেন এমনটা কিয়ানা আপু? আমার ভালোবাসাকে আবেগ বলে কেন আখ্যায়িত করলেন? কি ক্ষতি করেছিলাম আমি?”

একটু থেমে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলাম। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললাম,

“এখন কেন বলছেন এসব? আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ নষ্ট করে এখন কেন বলছেন? এখন কেন এতটা মনুষ্যত্ব জেগে উঠলো আপনার মঝে?”

“আমি সত্যিই অনেক ভুল করেছি রূপা, তাসফিকে নিজের করে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি, সহ্য করতে পারতাম না ওর সাথে তোমাকে। এতকিছুর মাঝে যে আমাদের এত সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, সেই একটুও বিবেচনা করি নি আমি।”

বলেই একটু থামলো কিয়ানা আপু। একটু সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো,
“তাসফি তোমায় নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, সেটা কালকেই আমি বুঝে গেছি। তোমার জন্য আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করতেও দু’বার ভাবলো না। তখনই আমি বুঝে গেছি তাসফির জীবনে তুমি ঠিক কি। উপলব্ধি করেছিলাম আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার। তাসাফির এক্সিডেন্টের কথা শোনার পর অপরাধী সত্তা বাসা বেঁধেছিলো মনে। তোমাকে সত্যিটা বলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিললো।”

“উ..উনি আপনাকে কি বলেছেন? কি কথা হয়েছিলো আপনাদের মাঝে?”

“কালকে বিকেলের পর হঠাৎ করেই তাসফির কল আসে। হাসি মুখে কলটা রিসিভ করলেও তা নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জানতে চায় আমি কি বলেছিলাম তোমাকে। তাসফির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি আমি। ওর কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না বললে রেগে উঠে। চিৎকার করে বলে উঠে,
‘বুঝতে পারছিস না, নাকি বোঝার চেষ্টা করছিস না? কি বলেছিস তুই রূপা কে? কিসের সম্পর্ক আছে আমাদের মাঝে, কবে রাতের পর রাত কাটিয়েছি আমি তোর সাথে? সেগুলোর প্রমাণ হিসেবে কিসের ছবি দেখিয়েছিস তুই রূপা কে? কি হলো, কথা বলছিস না কেন? বল বলছি…’

চমকে উঠি তাসফির কথায়, উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে যাই। আমার চুপ থাকায় ও আবারও বলে উঠে,
‘আমার রুপু মিথ্যে বলে না কিয়ানা, ওর মনে সন্দেহ না ঢুকালে আমার ভালোবাসার অসম্মান কখনোই করবে না। কেন বলেছিস ওকে এসব কথা, কেন ওর মনে সন্দেহর বীজ বুনেছিস? কি সম্পর্ক আছে আমাদের মাঝে, কতটা গভীর সেই সম্পর্ক?’

‘তাসফি আমি… আমি তোকে ভালোবাসি। সেই কলেজ লাইফ থেকেই আমি তোকে ভালোবাসি….’

‘তোর মুখে ভালোবাসার কথা মানায় না কিয়ানা, অন্তত আমার ভালোবাসাকে ছোট করে তো নয়-ই। কি দেখিয়েছিস আমার বউকে সেটা বল। কি এমন দেখিয়েছিস যে তোর কথায় আমার বউ বিশ্বাস করে নিলো, ভুল বুঝলো আমাকে।’

তাসফির ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি। ফোনের অপর পাশ থেকেও বুঝতে পারলাম প্রচন্ড পরিমাণে রেগে আছে। তোমার প্রতি ওর এতটা ভালোবাসা আর বিশ্বাস দেখে কোন কিছুই আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না ওর কাছে। সেদিন তোমাকে বলা সমস্ত কথা স্বীকার করে নিলাম।
আমার কথা শেষ হতেই চুপ করে গেল তাসফি। ফোনের মাঝে ওর জোরে জোরে নিশ্বাস নেওয়ার শব্দটায় শুধু কানে ভেসে আসলো। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,
‘তোকে আমি বিশ্বাস করতাম কিয়ানা, অনেক কাছের বন্ধু মনে করতাম, কিন্তু আজকের পর থেকে তোর সাথে আমার সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও থাকলো না। আজকের দিনে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না আমার সাথে। আমার আর আমার ভালোবাসার মাঝে আসার চেষ্টাও করবি না।’

এক মুহুর্ত সময় না নিয়েই কল কেটে দিলো তাসফি। কিছু সময় পর যখন বুঝতে পারলাম কল কেটে দিয়েছে তখন আবারও ফোন দিলাম তাসফি কে, কিন্তু ঢুকলো না। বুঝতে পারলাম ব্লক করে দিয়েছে। চেষ্টা করেও ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না, ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও পেলাম আমি। তাসফির এক্সিডেন্টে কথা শুনে আর ধরে রাখতে পারি নি নিজেকে, তাসফির জন্য না হলেও তোমার জন্য ছুটে এসেছি। তোমাকে সত্যিটা বলার জন্য, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও রূপা।”

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিয়ানা আপুর দিকে তাকিয়ে। কান্নার মাত্রাটা যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে লাগলো, এই মুহুর্তে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে গেল আমার জন্য। অপরাধের মাত্রাটা শতগুণে বেড়ে যেতে লাগলো। কি ভাবে পারলাম আমি ওনাকে অবিশ্বাস করতে, ওনার ভালোবাসাকে অসম্মান করতে? এতকিছু বলার পরেও যে মানুষটা আমাকে প্রতি বিশ্বাস হারায় নি, তার প্রতি কেন বিশ্বাস রাখতে পারলাম না আমি?
অপরাধী সত্তাটা ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে উঠলো যেন, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। এগিয়ে আসলো কিয়ানা আপু, আমাকে সামলানোর চেষ্টা করতেই দু’হাতে আবারও ছাড়িয়ে নিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম,

“একদম দয়া দেখাতে আসবেন না, অনেক করেছেন আমার জন্য। অনেক বড় উপকার করেছেন আমাকে সত্যিটা বলে, কিন্তু সবকিছু শেষ হবার পর। আর কিছু করতে হবে না আপনার, কিছু করতে হবে না।”

দু’হাতে চোখের অশ্রুগুলো মোছার বৃথা চেষ্টা করলাম। নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম সেখান থেকে। টলটলে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম করিডর পেরিয়ে।

বেলা বারার সাথে সাথে হসপিটালে মানুষের আনাগোনাও বেড়ে যাচ্ছে। কারোর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম অনেকেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু কোন দিকেই পাত্তা দিলাম না। পরিবারের সবার সামনে এসে না দাঁড়াতেই সাদিক ভাইয়া এসে উপস্থিত হলো সেখানে, সাথে এলো আরও একজন ডক্টর। ভাইয়াকে দেখে গায়ে কিছুটা শক্তি জোগাড় হলো যেন, দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলাম সেখানে। কাউকে বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলাম,

“ভাইয়া উনি… উনি এখন কেমন আছেন? ঠিক আছেন তো উনি, অপারেশন ঠিক ভাবে হয়েছে তো? কি হলো কথা বলছেন না কেন? ওনার কিছু হয় নি তো?”

সবাই একই প্রশ্নের উত্তরের আসায় তাকিয়ে রইলো সাদিক ভাইয়া ও অপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে। কোন কথায় বললো না সাদিক ভাইয়া। কিছুটা সময় নীরবতায় থেকে ডাক্তারটি বলে উঠলো,

“আমরা আমাদের বেস্ট দিয়ে চেষ্টা করেছি, বাকিটা আল্লাহর হাতে। মি. তাসরিফের কন্ডিশন খুবই খারাপ ছিলো, মারাত্মক ভাবে হাতে, পায়ে ও মাথায় আঘাত পেয়েছে। এতটাও সেনসিটিভ অবস্থা হতো না, যদি বমি না হতো আর বমি হওয়ার পর জ্ঞান না হারাতো। অপারেশন তো সাকসেসফুল হয়েছে, কিন্তু ঠিক কতটা সাকসেস হয়েছে সেটা ৭২ ঘন্টা পরেই বুঝতে পারবো।”

সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলো। বড় বাবা বললো,
“তাসফি কি ঠিক আছে ডক্টর?”

“কতটা ঠিক আছে সেটা বলা মুশকিল। মাথায় যেভাবে আঘাত পেয়েছে, জ্ঞান যদি ফিরেও আসে তাহলে অতীতের কোন কিছুই হয়তো আর মনে থাকবে না, আমরা সেটাই আশঙ্কা করছি। আর যদি….”

চুপ হয়ে গেল ডাক্তারটি। মাথা ঘুরিয়ে তাকালো সাদিক ভাইয়ার দিকে। সাদিক ভাইয়া চোখ ফিরিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। ফুপা বলে উঠলো,
“যদি কি ডক্টর?”

“যদি ৭২ ঘন্টা পর, মানে তিন দিন পর এই সময়টায় সকাল আটটার মধ্যে জ্ঞান না ফিরে তাহলে আর জ্ঞান ফেরার সম্ভবনাও নেই। আমাদের আর কিছুই করার নেই, সবটাই উপর আল্লার হাতে। আল্লাহকে ডাকুন, বাকিটা তার ইচ্ছে।”

কথাগুলো শোনার পর আমার শিরদাঁড়া বেয়ে হালকা শীতল ভাব বেরিয়ে গেল। কথাগুলো মস্তিষ্কে ধারণ করতেই কিছুক্ষণের জন্য আমার মস্তিষ্কগুলো কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেল। গায়ের শক্তি নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন দায় হয়ে পড়লো আমার জন্য। গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত ক্লান্তি ঘিরে ধরলো আমাকে। হঠাৎই ঝাপসা হয়ে উঠলো চোখের সামনে। তবুও ঝাপসা চোখে অস্পষ্ট সুরে বলার চেষ্টা করলাম,

“কিছু হবে না ওনার, কিছু হবে না। ওনার কিছু হলে ক্ষমা করতে পারবো না আমি নিজেকে, বাঁচতে পারবো না আমি ওনাকে ছাড়া। কিছু হবে না ওনার, কিছু না….”

.
.
চলবে…..

পরবর্তী পর্ব পরশু পাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।🖤এখন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here