#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৩.
.
বিষন্নতায় ঘেরা দূর্বল শরীর নিয়ে কিছুটা নড়াচড়া করতেই বাম হাতে টান লাগলো কিছুটা। মৃদু আত্মদান করে মিটমিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম ছোট খাটো একটা কেবিন রুমে। ব্যাথা লাগা হাতে তাকিয়ে দেখি স্যালাইনের নল লাগালো। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম, পরক্ষণেই তাসফি ভাইয়ের কথা মাথায় আসতেই চমকে উঠলাম। এতক্ষণে ঠিক কতটা সময় অতিক্রম হয়েছে সেটা ধরতে পারলাম না। এক হাতে ভর দিয়ে বেড ছেড়ে উঠতেই দরজার কাছে শব্দ ভেসে আসলো। সেদিকে তাকাতেই নজরে এলো রিফাপু কে। রিফাপুর বিষন্নতায় ঘেরা চেহারা দেখে ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। কাছে এগিয়ে এসে আলগোছে বসিয়ে দিলো, নিজেও আমার পাশে বসলো। আস্তে করে বললো এখন কেমন লাগছে? মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম ঠিক আছি। তখন যে হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম, সেটা বোঝার বাকি রইলো না। নিজ মনেই অপরাধীর বাসাটা যেন বিশাল আকার ধারণ করতে লাগলো।
মাথা তুলে রিফাপুর দিকে তাকালাম। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে এমন শান্ত হয়ে কেন। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“কখন আসছো?”
“একটু আগে।”
একটু থামলো রিফাপু। কিছুটা সময় নিয়ে আমার গালে হাত রাখলো। বললো,
“কি অবস্থা করেছিস শরীরের? তাসফি ভাইয়ের এই অবস্থা, তুইও এমন করেছিস। সামলাতে হবে তো নিজেকে, এমন করলে কিভাবে হবে?”
চমকে উঠলাম আমি। মনে পড়ে গেল আমাদের প্রথম কাছে আসার সেই রাতের কথা। অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমাকে ওনার সামলানো, রিফাপু মতোই ওনার বলা ‘সামলাতে হবে তো নিজেকে’ কথাটা। সেই সাথে ওনার বলা,
‘কেন? সারাজীবন তো আর বেঁচে থাকবো না আমি, কোন এক সময় তো দাদুভাই আর নানু মনির মতো তোমাকে ছেড়ে যেতেই হবে। হয়তোবা খুব তারাতাড়িই হবে, তখন তো সামলাতে হবে নিজেকে।’
হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল ভেতরটা। আটকে রাখা কান্নাটা বেরিয়ে এলো সহসায়। ঝাপটে ধরলাম রিফাপুকে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। অস্পষ্ট সুরে বললাম,
“আ..আমার জন্য ওনার এই অবস্থা। কেন বললাম আমি ওনাকে? কেন সত্যিটা না জেনে রাগারাগি করলাম ওনার সাথে? একটু তো বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো আমার, ওনার প্রতি ওনার ভালোবাসার প্রতি। কেন করলাম না সেটা, কেন এতটুকু বিশ্বাস রাখলাম না ওনার প্রতি?”
“কি হয়েছে বনু, এমন করছিস কেন? কিসের বিশ্বাসের কথা বলছিস?”
“আমার জন্য রিফাপু, শুধু মাত্র আমার জন্য ওনার এই অবস্থা। আমার প্রতি অভিমান করেই উনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কেন করলাম আমি ওনার সাথে এটা, কেন অবিশ্বাস করলাম?”
“কি করেছিস বনু, কি বলেছিস তাসফি ভাইকে?”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম, কিছুটা সময় নিয়ে বলতে লাগলাম কিয়ানা আপুর বলা সেদিনের কথা সহ প্রতিটি ঘটনা। আজকে কিয়ানা আপুর সত্যিটা বলাও বাদ রাখলাম না। সব শুনে চুপ হয়ে গেল রিফাপু, হয়তো আমাকে বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। কিছুটা সময় নিয়ে রিফাপু বলে উঠলো,
“তোরা দুজনে ইন্টিমেন্ট হয়েছিস বনু।”
এবার আমি চুপ হয়ে গেলাম। আগের চেয়ে অধিক জোরে কান্না করে উঠলাম। আমার না বলা কথাটা হয়তো বুঝে গেল রিফাপু। বললো,
“নিজেকে অপরাধী ভাবিস না রূপা, তোর জায়গায় তুই একদম ঠিক আছিস। কিন্তু তাসফি ভাইয়ের প্রতি একটু বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো। এতটা হাইপার না হয়ে সবকিছু বলা উচিত ছিলো। তাসফি ভাইয়ের সাথে কথা বলা উচিত ছিলো।”
“ও…ওই ছবিগুলো দেখে আমি ঠিক থাকতে পারি নি রিফাপু, উনি আমাকে দ্বায়িত্বের জোরে রাখতে চান সে কথাগুলো নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নি। আজ আমার জন্যই ওনার এই অবস্থা। ওনার কিছু হলে ক্ষমা করতে পারবো না নিজেকে, বাঁচতে পারবো না আমি ওনাকে ছাড়া।”
“নিজেকে দোষারোপ করছিস কেন? তাসফি ভাইয়ের এক্সিডেন্টে তো আর তোর হাত নেই। ুখন সবকিছু আল্লাহর হাতে।”
“আমি যদি ওনার সাথে রাগারাগি না করতাম, তাহলে তো এমন হতো না। সবকিছু আমার জন্যই হয়েছে রিফাপু, নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবো না।”
“নিজেকে সামলা বনু, এভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না।”
একটু থামলো রিফাপু। আমাকে সামলানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করলো। বললো,
“কারোর মনের অবস্থা ভালো নয়, এর মাঝে তুইও এমন করলে হবে? কিছু হবে না তাসফি ভাইয়ের। আল্লাহকে ডাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“উনি সত্যিই ঠিক হয়ে যাবে তো রিফাপু? জ্ঞান ফিরবে তো ওনার? আমাকে চিনতে পারবে তো?”
একটু সময় নিয়ে কিছু বলতে চাইলো রিফাপু, কিন্তু তার আগেই সাদিক কেবিনে ঢুকে গেল। কাছে এসে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো এখন কেমন লাগছে? কিছু বললাম না আমি। রিফাপুকে ছাড়িয়ে সরে আসলাম। সাদিক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“তা..তাসফি ভাইয়া কেমন আছে?”
কিছু বললো না সাদিক ভাইয়া। অসহায় দৃষ্টিতে রিফাপুর দিকে তাকালো। সকালের কথা মনে হতেই টপটপ করে দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আস্তে করে বললাম,
“ওনার কে একবার দেখবো ভাইয়া। প্লিজ না বলবেন না।”
“নিজেকে সামলাও রূপা, কিছু হবে না তাসফির। আল্লাহ কে ডাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বলেই হাতের ক্যানোলা থেকে স্যালাইনের নলটা খুলে দিলো। আবারও বললো,
“নিয়ে যাচ্ছি তবে একদম কাছে যেতে চাইবে না, দূর থেকেই দেখবে। আর কান্নাকাটি তো একেবারেই নয়।”
মাথা ঝাঁকালাম আমি, সায় দিলাম সাদিক ভাইয়ার কথায়। রিফাপু একহাত ধরে বেড থেকে নামতে সাহায্য করলো। ধীর পায়ে হেঁটে নিয়ে গেল আইসিইউর সামনে। বারো ঘন্টা পর নাকি কেবিনে দেওয়া হবে। আইসিইউ সে থাকাকালীন দেখা করার পারমিশন নেই, কিন্তু সাদিক ভাইয়ার জন্য সেই ঝামেলা পোহাতে হলো না।
গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালাম আইসিইউর সামনে। কাঁচের দেওয়ালের পাশ থেকেই ইশারা করলো সাদিক ভাইয়া, তাকাতে বললো সামনের দিকে। চোখ তুলে অপর পাশে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম সেখানেই। গায়ের শক্তি লাঘব হয়ে এলো, পরে যেতে নিতেই পিছন থেকে ধরে ফেললো সাদিক ভাইয়া ও রিফাপু। পিছন ফিরে ঝাপটে ধরলাম রিফাপুকে, কেঁদে উঠলাম জোরে। এতগুলো আঘাত নিয়ে পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা, নিথর শরীরটা পরে আছে বেডে, শরীরের সাথে এত এত নল লাগালো। তাসফি ভাইয়ের এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না আমি। শুন্য হয়ে গেল ভেতরটা। রিফাপুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম, অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগলাম,
“ওনার… ওনার তো খুব কষ্ট হচ্ছে, কিভাবে সহ্য করছেন উনি? সবকিছু আমার জন্য, আমার জন্যই এতটা কষ্ট হচ্ছে ওনার।”
.
বিষন্নতায় ঘেরা এই তিন দিন, যেন নিমিষেই চলে গেল। কিন্তু না, আমার জন্য একেকটা দিন ছিলো একেকটা বছরের ন্যায়। চাতক পাখির মতো প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি সময় অপেক্ষা করা। কখন ওনার জ্ঞান ফিরবে, কখন ওনি চোখ মেলে তাকাবেন। কিন্তু না, চোখের পাতা খোলা তো দূর একটিবার রেন্সপন্সও করেনি উনি।
আজকে তিন দিনের সকাল। ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘরে। আটটা বাজতে এখনো আধা ঘন্টারও বেশি সময়। রিফাপুর সাথে বসে আছি রিকশায়। উদ্দেশ্য হসপিটালে যাওয়া। গত রাতে অনেক জোড়াজুড়ি করেও থাকতে পারি নি হসপিটালে। সবাই এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দেয় বাসায়। সারারাত ঠিকভাবে না ঘুমিয়ে অনেকটা ভোরেই উঠেছিলাম। বাসায় টিকতে না পেরে রিফাপুকে নিয়ে চলে আসি হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
হসপিটালের সামনে রিকশা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পায়ে চলে আসি ভেতরে। যতই দ্রুত পা ফেলতে লাগি ততই যেন বুকের টিপটিপ শব্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠে। এর মাঝে দু’বার ফোন দিয়ে জেনে নিয়েছি তাসফি ভাইয়ের কথা। বরাবরের মতো ওই একটা কথাতেই আটকে ছিলে সবাই, ‘জ্ঞান ফিরেনি’। জানি না সামনে ঠিক কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সময়ের আগে ওনার জ্ঞান আদোও ফিরবে কি না সেটা জানা নেই, আর ফিরলেও কি চিনতে পারবেন সবাই কে? আমাকে চিনতে পারবেন তো উনি?
মনের কোণে নানান রকম ভীতি এসে ভীর জমালো। তবুও গায়ে শক্তি এনে হাঁটতে লাগলাম। চার তলায় এসে ভেতরে যেতে চাইলে আঁটকে দিলো। কারণ জানতে চাইলে বললো, ডাক্তার রাউন্ডে আছে, এখন রোগীর সাথে দেখা করা যাবে। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম রিফাপুর দিকে, রিফাপুও একইভাবে তাকালো। সময়ের সাথে সাথে মনের ভীতিটাও দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ তর হয়ে উঠলো। ভেতরে যাবার জন্য ছটফট করে উঠলো মন।
মিনিট দশেক অতিক্রম হবার পরেই হঠাৎ রিফাপু বলে উঠলো, সাদিক ভাইয়ার কথা। ছলছল করে উঠলো আমার চোখ দুটো। তাড়াতাড়ি ফোন দিতে বললাম রিফাপুকে। রিফাপু সাদিক ভাইয়াকে কল দিয়ে আমাদের অবস্থান জানাতেই বললো সেখানে দাঁড়াতে, আমি আসছি। কিছুটা স্বস্তির প্রত্যাশা দেখা দিলেও ঠিক স্বস্তি পেলাম না। তাসফি ভাইয়াকে সুস্থ না দেখলে সেই স্বস্তিটা যেন কিছুতেই আমার মিলবে না।
পাঁচ মিনিট পরেই সাদিক ভাইয়া চলে আসলো। দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকে নিলো আমাদের। এবার আর বাঁধা দিলে না, অনায়সেই ঢুকতে দিলো ভেতরে। গেইট পেরিয়ে ভেতরে এসেই সাদিক ভাইয়াকে বললাম,
“ভাইয়া উনি, ওনার জ্ঞান ফিরেছে?”
কথা বললো না সাদিক ভাইয়া। চুপ করে তাকিয়ে রইলো। রিফাপু বলে উঠলো,
“কি হলো কথা বলছো না কেন? ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে?”
“ভেতরে আসো, তাহলেই দেখতে পারবে।”
গম্ভীর সুরে কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না সাদিক ভাইয়া। হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। কিন্তু আমার পায়ের শক্তি সেখানেই যেন মিলিয়ে গেল। ভারী হয়ে উঠলো পা দুটো। রিফাপুর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম,
“উনি…উনি ঠিক আছে তো রিফাপু?”
“ভেতরে চল, তাহলেই দেখতে পাবো।”
বলেই আমার হাতটা চেপে ধরলো শক্ত করে, টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে। এলোমেলো পা ফেলে এসে দাঁড়ালাম কেবিনে সামনে। এই মুহুর্তে ভেতরে যাবার সাহসটা যেন হলো না। তবুও কিছুটা জোর দিলাম, হাজারো ভীতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। সামনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ছলছল চোখ তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে।
.
.
চলবে…..
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।