#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ১৩
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সামিয়া। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না আসলে সে এখন জেগে না ঘুমে। অবচেতন মনে হাতড়ে বেড়াচ্ছে যেনো কিছু একটা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। খানিকক্ষণ আগেই তার ডিএনসি করা হয়েছে। তার গর্ভের সন্তান আর বেঁচে নেই। সে এই বিষয়টা নিয়ে খুব একটা ব্যথিত নয়। এই বাচ্চাটা এসেছেই দুর্ভাগ্য নিয়ে। তাকে আজ না হোক কাল এভাবেই মরতে হতো। কাল না মরে আজ মরেই সে ভালো করেছে।
ভ্রূণ অবস্থাতেই সে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। সামিয়ারও এই বাচ্চার জন্য খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে না। বাচ্চাটার প্রতি তেমন মায়াও জন্মায়নি এখনও। আর ক’দিন গেলে হয়তো মায়া জন্মে যেতো। ধীরে ধীরে বাচ্চাটা গর্ভে বড় হতে থাকতো, আর মায়ের মনে ভালোবাসা তৈরি হতো। সেটা আর হলো না। এই ভালো হলো, কষ্ট’টা কম হলো। কয়েকদিন বা মাস বাদেই তার মায়ের ফাঁসি হবে। একজন ডাবল মার্ডার কেসের আসামির ফাঁসির আদেশ ছাড়া আর কী হবে!
তখন মায়ের সাথে সাথে এই বাচ্চাটাও ফাঁসিতে ঝুলতো। কিংবা, মানবিকতার খাতিরে বাচ্চাটা জন্মানো পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিত রাখা হতো। বাচ্চাটা জন্মানোর পর শুধু মা’কে ফাঁসিতে ঝোলানো। আর বাচ্চাকে কোন আশ্রমে দেওয়া হতো। তখন বাচ্চাটা বড় হতো এক খুনি মায়ের পরিচয়ে। যে মা তার স্বামী এবং প্রেমিককে একসাথে খুন করেছে!
এসব থেকে সে মরেই ভালো করেছে। ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে না দিয়ে সরাসরি নিভে গেছে। এই বরং ভালো হয়েছে।
সারাটাদিন সামিয়া একভাবেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকলো। তার বেশ রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সাথে প্রচণ্ড দুর্বলতা। ঠিকমত না খাওয়া, বিশ্রাম না নেওয়া, ডাক্তার না দেখানো, অতিরিক্ত চিন্তা, সমস্তটা মিলিয়েই সে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই কারণেই বাচ্চাটাও চলে গেছে। সেদিন আর কেউ সামিয়াকে বিরক্ত করতে এলো না।
সামিয়ার বাবা-মা’ও গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। এই শহরে আপন বলতে সামিয়ার আর কেউই নেই। সে এখন সম্পুর্ণ একা হয়ে গেল এই ধরণীতে।
পরেরদিন অফিস টাইমে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে হাসপাতালে এলো অফিসার শীলা। সামিয়াকে বাকি জিজ্ঞাসাবাদ টুকু করবে বলে। সামিয়া সুস্থ হলেই তাকে সরাসরি হাজতে প্রেরণ করা হবে। তখন আর কোনভাবেই তার সাথে দেখা করা বা জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু, বাকি কথাগুলো না শুনলে অফিসার শীলা কোন সিদ্ধান্তেও আসতে পারছে না।
অফিসার শীলাকে দেখে শুকনো ঠোঁটে হেসে উঠলো সামিয়া। সামিয়ার এই হাসিটা শীলার কাছে খুব একটা সুখকর হলো না। বুকের মধ্যে গিয়ে বিধলো যেনো সামিয়ার শুকনো মুখটা। সদ্য সন্তান হারানো একজন মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে সে। প্রফেশনাল কাজকে আগে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। এখানে মনের আবেগে কিছু বলা বা করার কোন উপায় নেই।
শীলা সামিয়ার হাসির প্রতুত্তরে হাসতে পারলো না। সে মুখটা ভার করে তার পাশে এসে বসলো। শীলা আসার সাথে সাথেই কেবিন থেকে নার্স বের হয়ে গেল। শীলা কোন ভনিতা না করে সরাসরি বললো,
“আমি কেন এসেছি সেটা নিশ্চই বুঝতে পেরেছো। আমার কিছু করার নেই, আমাকে এখন আসতেই হতো। তুমি অসুস্থ জেনেও তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ আমার করতে হবে। আমি নিরূপায়।”
সামিয়া আবারও শুকনো হাসি দিয়ে বললো,
“আপনার কাজ আপনি করুন, আমি ঠিক আছি।”
শীলা আবারও বললো,
“এবার বলো তবে খুন দুটো কেনো করেছো। আর তোমার সাথে অন্য কেউ জড়িত আছে কি-না।”
সামিয়া শোয়া থেকে উঠে ঝুঁকে বসলো। বেডের সাথে বালিশ রেখে সেখানে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলো। শীলা হা করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
মিনিট খানেক নিঃশ্চুপ থেকে সামিয়া বললো,
“আমি কয়েকদিন সুমন আর নিলয়ের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলাম। দু’জনের অফিস যে একটাই সেটা বুঝতে পারলাম একদিনের মাথাতেই। আমি কখনোই নিলয়ের অফিসে যাইনি। সেদিনও গেলাম না। কিন্তু, দূর থেকে ফলো করতে লাগলাম। হ্যাঁ, যেটা ভেবেছিলাম সেটাই হলো। সুমনও ওই একই অফিসে প্রবেশ করলো। প্রথমে ভেবেছিলাম সে নিলয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছে, কিন্তু না। সুমন আসলে ওই অফিসেরই কর্মচারী। আমি বাসায় ফিরে এলাম।”
এ পর্যন্ত বলে সামিয়া থেমে গেল। শীলা একটু নড়েচড়ে বসে বললো,
“তারমানে দু’জন একই অফিসের কলিগ! তারপর কী হলো?”
সামিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আমি কিছুদিন নিলয়ের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে লাগলাম। নিলয় যেন কিছুতেই সন্দেহ না করে, সেই বিষয়টা মাথায় রাখলাম। অপরদিকে সুমনের সাথেও সম্পর্ক ঠিক রাখালাম। উল্টো সম্পর্কে আরো গভীরতা আনলাম। এভাবে চললো আরো কিছুদিন। এদিকে আমি চুপিচুপি নিলয়ের ফোনও চেক করতে থাকলাম। সেখানে সন্দেহজনক আরো অনেককিছুই পেলাম। বুঝতে পারলাম সুমন আমার সাথে যা করছে তার সবটা নিলয়ের কথায়। কিন্তু, কেন এমনটা করছে সেটা ধরতে পারছিলাম না। আর নিলয়ই বা আমাকে কেন অন্যের দিকে লেলিয়ে দিয়েছে সেটাও মাথায় আসছিলো না।
চিন্তাভাবনা আরো গভীরে নিয়ে গেলাম। সুমনের সাথে নিজেকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ফেললাম। সে আগে ফোনে আমার সাথে রোমান্স করতে চাইতো, আমি রেগে যেতাম। এখন আমি সেটাও করতে শুরু করলাম। আমার মাথায় শুধু একটা বিষয়ই ছিল, ওদের মধ্যকার গোপন রহস্যটা আমাকে জানতে হবে। এরজন্য আমার যতদূর যেতে হয় যাবো।
এসব করতে করতেই একদিন জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি কথাটা নিলয়কেও জানলাম না। নিজের মধ্যেই রেখে দিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল, আমি এদের সবটা জেনে তারপরই একটা সিদ্ধান্তে আসবো। নিলয়কে ডিভোর্স দিয়ে নিজের মতো করে বাচ্চাটা নিয়ে বাঁচবো। সেখানে সুমনেরও কোন স্থান থাকবে না। কিন্তু….?”
সামিয়া হাপিয়ে যাচ্ছে বারবার। কথাগুলো বলতে গিয়ে জড়িয়ে আসছে তার কথা। শীলা বুঝতে পারলো সামিয়ার কষ্ট হচ্ছে। সে সামিয়াকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। সামিয়া খুব ধীরে, একটু একটু করে পানিটুকু পান করলো। শীলা বাকি কথাগুলো শোনার অপেক্ষায় বসে আছে। সামিয়া খানিক জিরিয়ে নিয়ে বললো,
“সুমনের সাথে একরাতে কথা বলছিলাম। সেদিন নিলয় বাসায় ফিরেনি। আমি এমন একটা রাতের অপেক্ষাতেই ছিলাম এতদিন। আমি সুমনকে এমনভাবে আমার প্রতি আকৃষ্ট করলাম যে, সুমন আর এই মুহূর্তে অন্য কিছুই বুঝছে না। আমি এই সময়টাকে কাজে লাগালাম। ওকে হুট করেই বললাম নিলয়ের সাথে তোমার সম্পর্ক কিসের? সুমন কিছুটা ভরকে গেলেও সে বললো, নিলয় ওর অফিসের বস। এর আগে আমি সুমনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলাম। সুমন তাতে আরো আকৃষ্ট হলো আমার প্রতি। আমি আবার বললাম, সে তার বসের স্ত্রীর সাথে কেন এমন একটা সম্পর্ক স্থাপন করলো! আর, এই সম্পর্কের পরিণতি কী হবে!
সে একবাক্যে বললো, আমি তোমাকে বিয়ে করব। আর বস এমনিতেও তোমাকে রাখবে না। কথাটা শুনে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না। পাল্টা বললাম কেন রাখবে না? সে আর কিছু বললো না। শুধু বললো বস তোমাকে ভালোবাসে না। তোমাকে শুধু ব্যবহার করছে। এইটা জানতে পেরেই আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। তোমার মত একজন মেয়ের সাথে বস এমনটা করতে পারে না। কিছুতেই না।
তখন আমি বললাম, আমার প্রতি তবে করুনা করছো? তখন সে বলে, আরেহ না! এভাবে বলছো কেনো? আমি-তো তোমাকে ভালোবাসি।
এরপর আর কিছু বললাম না আমি।”
শীলা অবাক হয়ে বললো,
“সুমন তোমাকে কি আসলেই ভালোবাসতো? ভালোবাসলে ওকে মেরে ফেললে কেন? আমার না মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সবটা কেমন ধোঁয়াশা লাগছে।”
শীলার কথায় সামিয়া মৃদু হাসলো। সে বললো,
“সুমন আসলে আমার সাথে অভিনয় করেছে। শুধুমাত্র একটা রাত আমাকে তার কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সে এসব বলেছে। সে যদিও সত্যি বলেছে, কিন্তু নিজেরটা খোলাসা করেনি। শুধু নিলয়ের ব্যাপারটা বলেছে। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও ওর সাথে অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। শুধুমাত্র ঘটনা কী সেটা জানতে। সুমন আসলেই নিলয়ের কথায় এসব করেছে। কিন্তু, অভিনয় করতে করতে সে একটু হলেও আমার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিল। শেষের দিকে সে আমাকে নিয়ে পালিয়েও যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি আর ওকে বিশ্বাস করতে পারিনি।”
“হুম, বুঝলাম। কিন্তু নিলয় কেনো এমনটা করলো? সে অন্য মেয়েকে পছন্দ করত?”
“না। তার পেশাই এটা ছিল। যা আমি পড়ে ধরতে পারি।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে, সে আসলে আমাকে পাচার করতে চেয়েছিল। আমার আগেই দুজন মেয়েকে সে পাচার করেছে। তারা প্রেমিকা ছিল বলে কাজটা সহজে পেরেছে। আমি বউ হওয়াতে সে সুমনের আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্ল্যান ছিল, সুমন আমার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়বে। তারপর আমাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করার জন্য পালিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ওর সাথে পালিয়ে গেলেই ব্যস্, তাদের কাজটা সম্পাদন হবে। আমাকে গাড়িতে উঠাতে পারলেই তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতো। কিন্তু, শেষ অব্দি কিছুই করতে পারেনি দুজন। সুমন সেদিন রাতে আমার কাছে এসব স্বীকার করে। আমার কাছে রেকর্ড ছিল। অবশ্য ফোনের মধ্যে ছিল, ফোনটা এখন আমার কাছে নেই। সে আমার কাছে এসব স্বীকার করে, আমার কাছে ক্ষমা চায়। আমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে সেটা বলে। আমাকে নিলয়ের হাত থেকে রক্ষা করবে সেটার প্রতিশ্রুতিও দেয়।”
শীলা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তাহলে সুমনকে কেন খুন করলে?”
সামিয়া আর কিছুই বললো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে শীলার দিকে তাকিয়ে রইলো। শীলাও ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলো সামিয়ার বলা কথাগুলো।
চলবে…..