তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:১৪

#তৃতীয়_ব্যাক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ১৪

সামিয়া খানিক বাদেই আবারও বলতে শুরু করলো। সে ক্ষীণ স্বরে বলতে লাগলো,
“সেদিন সুমনের সাথে কথা বলা শেষ করেই ঠিক করলাম আমার মা হওয়ার কথাটা নিলয়কে জানাবো। তারপর ওর থেকে দূরে সরে যাবো।
সুমনও আমাকে বেশ অনুরোধ করতে লাগলো ওর সাথে যাওয়ার জন্য। আমি সুমনের কান্না, সুমনের আকুতি, কিছুই আর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওর সাথে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না।

নিলয় বাড়ি ফিরলো পরেরদিন সন্ধায়। এই দুইদিন সে আমার কোন খোঁজ খবর রাখলো না। তাকে বাসায় আসতে দেখে আমিও আর তেমন কোন আগ্রহ দেখলাম না। কিন্তু, তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
সে বাসায় এসেই ওয়াশরুমে চলে গেল। আমিও সেই ফাঁকে তার মোবাইল হাতে নিলাম। গতরাতে সুমনের সাথে আমার যেসব কথা হয়েছে, সমস্তটাই সুমন নিলয়কে বলে দিয়েছে। এবং সে এটাও বলেছে, সে আমাকে নিয়ে আসলেই পালিয়ে যেতে চায়। আমাকে বিয়ে করে সংসার করতে চায়। আমাকে সে সত্যিকারের ভালোবেসে ফেলেছে।

এসব নিয়েই সুমনের সাথে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে নিলয়ের। সমস্ত কথাই ওদের মেসেজের মাধ্যমে হয়েছে। আমি যে নিলয়ের ফোনের পাসওয়ার্ড জানি, সেটা নিলয় তখনও বুঝতে করেনি। কিন্তু, সে আজ খানিকটা ধরে ফেলে। আমি ফোন রাখার আগেই সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ওকে দেখেই আমি ফোনের পাওয়ার বাটন অফ করে দেই। সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে এগিয়ে আসে। ছো মেরে আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে ফেলে। ফোন অফ দেখে আমার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকায়। আমিও বোকা বোকা ভাব করে বলি,
তোমার ফোনটা একটু দরকার ছিল। আসলে আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই। বাড়িতে কল করতাম বলেই ফোনটা নিয়েছি। কিন্তু, আমিতো ফোনের পাসওয়ার্ড জানিনা। তাই ফোন আনলক করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু, সেটা না হয়ে উল্টো ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।

নিলয় আমাকে কিছু না বলে সামনে থেকে সরে গেল। হয়তো সে আমাকে কিছুটা সন্দেহ করতে শুরু করেছিল তখনই। কিন্তু আমাকে কিছুই বললো না সেসব নিয়ে। আমি রাতে শুয়ে শুয়ে ঠিক করলাম কী করবো। সুমন যতই আমাকে ভালোবাসি বলুক, সেও আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আর, বিয়ে করে যে সে সংসার করবে এমনটাও বিশ্বাস করার উপায় নেই। আমি সমস্ত প্ল্যান করে ফেললাম। যা করার এই রাতেই করতে হবে। সুমন আর নিলয়কে মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবেই হবে। তখনও আমার মাথায় ওদের খুন করার কোন প্ল্যান ছিল না। আমি শুধু ভাবছি, ওদের মুখোমুখি হবো। দুজনকে হাতেনাতে ধরবো। তারপর দুজনের থেকেই আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবো।”

অফিসার শীলা মনোযোগ দিয়েই শুনছিল কথাগুলো। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো,
“তাহলে খুনটা কেন করলে?”
সামিয়া মেরুদন্ড সোজা করে বসলো। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বললো,
“আমার জীবন নিয়ে খেলেছে বলে আমি তাদের খুন করিনি। আমার আগেও যাদের জীবন নষ্ট করেছে, তাদের জন্যও করিনি। পরবর্তীতে যেন আর কাউকে তারা তাদের শিকার না বানাতে পারে, সেজন্য খুন করেছি। এরজন্য আমি যেকোন সাজা পেতে রাজি আছি।”

অফিসার শীলা এবার কিছুটা ব্যথিত হলো। তার খুব ইচ্ছে করছে সামিয়াকে একটাবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু, তার শরীরের ইউনিফর্ম তাকে সেটা করতে বাঁধা দিলো। সে ঝাপসা চোখে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

সামিয়া মৃদু হেসে আবারও বলতে শুরু করলো,
“আমি পরিপাটি ভাবে সেজে নিলয়ের কাছে গেলাম। আলতো হেসে তাকে বললাম, নিলয় তুমি বাবা হতে চলেছ। আমার কথা শোনা মাত্রই সে যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
মানে? আমি তার দিকে ঝুঁকে মুখটা তার মুখ বরাবর রেখে, মৃদু হেসে বললাম, তুমি বাবা আর আমি মা হচ্ছি। কেন তুমি খুশি হওনি? সে এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে বললো, কী বলছো এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে? আমার বাচ্চা মানে? কিসের বাচ্চা? আমি কোন বাবা টাবা হচ্ছি না।
আমি তার কথায় রীতিমত চমকে গেলাম। সে নিজের সন্তানকে কী করে অস্বীকার করতে পারে?

আমি আবারও বললাম,
তুমি কি আমার সাথে মজা করছো নিলয়? আমি তোমার বাচ্চার মা হতে চলেছি। বুঝতে পারছো না তুমি?
নিলয় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চিৎকার করে বললো,
না, পারছি না বুঝতে। এই বাচ্চা আমার হতে পারে না। না জানি কার বাচ্চার দায় আমার উপর চাপাচ্ছ।
ওর কথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো আমার মাথায়। সে কী করে এসব বলতে পারে! আমি চিৎকার করে বললাম,
তুমি যে একটা শয়তান সেটা বুঝে গিয়েছি আগেই। কিন্তু, এতটাই কাপুরুষ হবে সেটা বুঝতে পারিনি। নিজের সন্তানকে কিভাবে অস্বীকার করতে পারো তুমি? আর, কিসের কার না কর বাচ্চা? কী বলতে চাও?
সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
কী বলছি বুঝো না? ফষ্টিনষ্টি করো যে, কী ভেবেছো আমি জানবো না?

নিলয়ের কথায় দ্বিকবিদ্বিক হারিয়ে ফেললাম আমি। তারমানে সে বলতে চাইছে সুমন.. ছিঃ
আমি গায়ের যত জোর আছে সবটা দিয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। ক্ষিপ্ত গলায় বললাম,
“দিনে-রাতে যে আমাকে দিয়ে তোর চাহিদা মিটিয়েছিস, সেসব ভুলে গেছিস? নিজের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছিস, লজ্জা করে না? আর কিসের ফষ্টিনষ্টি? তুই যে সুমনকে আমার দিকে লেলিয়ে দিয়েছিস, কী ভেবেছিস আমি বুঝব না? তোর সব কুকীর্তি আমি ধরে ফেলেছি। সব প্রমাণ আছে আমার কাছে, রেকর্ড সহ। সকাল হতে দে শুধু, তারপর দেখ কী করি আমি।
এই কথা বলতেই নিলয় আমার গালে থাপ্পড় দিলো। পরপর কয়েকটা থাপ্পড় দিতেই আমি মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে গেলাম।”

অফিসার শীলা অদ্ভুতভাবে ঘামছে। সামিয়ার কথা শুনে যেন তার প্রেশার বেড়ে গেছে। রাগে কান,মাথা গরম হয়ে গেছে। সে দাত কিরমির করে বললো,
“এইটা মানুষ না জানোয়ার? এরে খুন করবে না তো কী করবে!”
শীলার কথায় সামিয়া হাহা করে হেসে উঠলো। শীলা তৎক্ষণাৎ চুপসে গেল। পুলিশ হয়ে এমন কথা তার মুখে মানায় না। কিছুতেই সে এসব বলতে পারে না।

সামিয়া আবারও বললো,
“আমি মেঝের উপর কতক্ষণ পড়েছিলাম আমার মনে নেই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি নিলয় বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। আমাকে সে আর কিছুই করেনি। রাত প্রায় দুটো বাজে। আমি উঠে প্রথমে বাসার চাবি খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পেলাম না। বুঝতে পারলাম সে চাবি লুকিয়ে রেখেছে। আর, এই কারণেই এভাবে ঘুমোচ্ছে। আমি আগে থেকেই কিছু ওষুধ এনে রেখেছিলাম। নিজে খাওয়ার জন্য। ওষুধ ঠিক না, ওগুলো মূলত বিষ। মানুষের বিষ না, পোকা-মাকড়ের বিষ। বেশ কিছুদিন আগেই এনেছিলাম। কিন্তু খাওয়া হয়নি। নেটে সার্চ করে দেখেছি, এসব খেলে মানুষ মরে না। তবে অবচেতন থাকতে পারে অনেক্ষণ যাবৎ। আমি সেই বিষ সবটাই জগে ঢেলে দিলাম। তারপর আবারও মেঝের উপর শুয়ে পড়লাম। আমি জানি নিলয়ের রাতে পানি খাওয়ার অভ্যাস আছে। সে উঠে পানি খাবে।

যেমনটা ভেবেছিলাম তেমনটাই হলো। আমি শুয়ে পড়লেও ঘুমালাম না। ঘুমের ভান ধরে থাকলাম। আমি শুয়ে পড়ার ঘণ্টা দুই পড়েই নিলয় উঠলো। উঠেই আমার দিকে এগোলো। আমি ঘুমে না জেগে সেটা দেখলো। তারপর ঘরের বাইরে গেল। আমি আবারও চোখ মেলে তাকালাম। সে প্রথমে ওয়াশরুমে গেল। তারপর সেখানে থেকে এসে টেবিলের কাছে গেল। পরপর দুই গ্লাস পানি পান করে আবারও বিছানায় এলো। আমিও চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। এবার শুধু তার অবচেতন হবার পালা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here