তোমারই আমি আছি পর্ব ২৩

তোমারই আছি আমি
পর্ব-২৩
Sara mehjabin

এভাবেই আকাশভাইয়া ও অদ্বিতীর চোখ এড়িয়ে আমার আর সারার প্রেম চলতে লাগল। সারাকে পাবো কোনদিন ভাবতে পারি নি। আমি তো সারাকে ভালবেসেও দূরে সরে গিয়েছিলাম আকাশভাইয়ার জন্য। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি স‍্যাক্রিফাইস করে বোকারা। আমি আস্ত একটা বোকা বিধায় নিজের ভালবাসাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। সারা কতটা ভালবাসে আমায়। তাও আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি। এখন এইসব ভাবলে খুব কষ্ট লাগে।

অদ্বিতীর সঙ্গে জোর করে রিলেশন রাখতে বাধ‍্য হচ্ছি। কি করব, মেয়েটা আমার মিথ্যা ভালবাসাকে সত্যি সত্যি ভেবে প্রচণ্ড মায়ায় জড়িয়ে গেছে। এখন আমি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। ওকে কিভাবে বলব আমি সারাকে ভালবাসি, এতদিন অভিনয় করেছি ওর সাথে। অন‍্যদিকে সারাও আর পারছে না। আকাশভাইয়ার ভালবাসা এখন ওর অত‍্যাচারের মতো মনে হয়। আকাশভাইয়াকে এখন সহ‍্য-ই করতে পারে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। এইসব শুনলে আকাশভাইয়া কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে সারা ভাবছে না ওর সব ভয় আমাকে নিয়ে। কারণ যে দুইজন মানুষকে আকাশভাইয়া সবচেয়ে বেশি ভালবাসে আমি তাদের একজনকে কেড়ে নিয়েছি আরেকজনকে ঠকিয়েছি। এইসব জানার পর আমাকে মারতে আকাশভাইয়া এক সেকেন্ড সময় লাগবে না।

কিন্তু ভালবাসা এমন একটা জিনিস যেটার থেকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসা যায় না। আমি আর সারা শত ভয় শত বাধা অতিক্রম করে এভাবেই দিন কাটাতে লাগলাম। এই লুকোচুরি খেলার শেষ কোথায় আমি জানি না। অদৌ কখনো শেষ হবে কিনা তাও জানি না।

তারপর দাদুর কথায় আকাশভাইয়ার সঙ্গে সারার
কাবিন হয়ে গেল। আংটি-বদল হলো। সারার বয়স চৌদ্দ। শরিয়ত মতে ও বিয়ের উপযুক্ত হলেও ওদের বিয়ে নিয়ে আইনের ঝামেলা হবে। তাই আপাতত গোপন থাকছে বিয়েটা। সারার বয়স আঠারো হওয়ামাত্র ওকে আকাশভাইয়ার বৌ করে আনা হবে। চোখের সামনে ওদের বিয়ে হলো। কিভাবে সহ‍্য করব আমি? আমার সারা বৌ হয়ে গেল অন‍্যজনের। সারাও প্রচুর কান্নাকাটি করছে। কিছুতেই এই বিয়ে হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। আমি সারাকে অনেক কষ্টে বোঝালাম আপাতত চারটা বছর তো ওকে আকাশের সঙ্গে থাকতে হবে না। আমার আরেকটু সময় দরকার। আকাশভাইয়াকে আমার খুব দরকার নিজে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য। এই বাড়ি তে পড়াশোনা টা শেষ করেই জব খুঁজব। তারপর সারাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।

এতটুকু পড়ার পর আকাশের আর পড়ার শক্তি ছিল না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এগুলো পড়ে কোন রিঅ্যাক্ট দেখালো না আকাশ। সেইদিন রাতেই বাবার কাছে গিয়ে বলল নিবিড়ের এই বাড়িতে পড়াশোনা করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। ওর লেখাপড়া দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ওকে বোর্ডিং এ পাঠানো দরকার। আকাশের বাবা বাড়তি ঝামেলা পছন্দ করছিলেন না। সুতরাং তিনি খুবই স্বাভাবিক ভাবে রাজি হয়ে গেলেন।

নিবিড়কে বোর্ডিং স্কুলে রাখতে গিয়েছিল আকাশ। একা। এমনকি ড্রাইভার ও ছিল না। আকাশ নিবিড়কে বোর্ডিং-এ রেখে আসার পরেরদিন ফোন আসে নিবিড় নিঁখোজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর শুনে অদ্বিতী পুরো পাগল হয়ে পড়ল। খানবাড়ির সবাই নিবিড়ের জন্য অনেক খোঁজাখুঁজি করে। আকাশের সবচেয়ে ছোট ফুপি লিনা যে বিধবা হয়ে এইবাড়িতে থাকতেন এবং নিবিড় যাকে মা ডাকত নিবিড় হারানোর খবরে সেদিনই স্ট্রোক করে প‍্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আজো শয‍্যাশায়ী। অথচ যার সবচেয়ে বেশি রিঅ্যাক্ট করার কথা সেই আকাশ খুব স্বাভাবিক থাকল।
অদ্বিতী সেইসময় আকাশকে দেখতে পারত না। সবসময় বলত তোর জন্য আমার নিবিড় হরিয়ে গেছে। তুই ওকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিস। তোর কারণে আমি নিবিড়কে হারিয়ে ফেলেছি। আমি মাফ করব না দাদা। তোকে আমি কোনদিন মাফ করব না।

অদ্বিতী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। কাউকে সহ‍্য করত না। বলত সবাই শত্রু, সবাই আমার শত্রু। আজকে আমার জায়গায় মাইশা হলে তুই কোনদিন নিবিড়কে তাড়িয়ে দিতি না। আসলে আমি তোর নিজের বোন না আমার প্রতি তোর কোন ভালোবাসা নেই।

সেইসময় একমাত্র সারার সাপোর্ট, ভালোবাসা ও সেবায় অদ্বিতী ধীরে ধীরে সেই মানসিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনে বেরিয়ে আসে।

—————————————————————————–

সারা আজকে অনেকদিন পর আকাশদের বাসায় আসল। থাকতে না পেরে বাধ্য হয়ে আসল। সম্পূর্ণ এক একটা মাস সে আকাশভাইয়াকে দেখে নি। এইভাবে সে থাকতে পারে? আকশভাইয়া কি জানে না? তাও রাগ দেখিয়ে বসে আছে। পেঁচা কোথাকার!

সারা একটা গাঢ় নীল শাড়ি পড়েছে, হাতভর্তি কাঁচের চূড়ি। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে কপালে নীল টিপ পড়েছে। টিপটা ইচ্ছা করেই ঠিকমতো পড়ে নি। আকাশভাইয়া কপালের টিপ সোজা না হলে ঠিক করে দিয়ে দেয়। চুলগুলো ছেড়ে কানের পাশে বেলী ফুল লাগিয়েছে। এইরকম সাজে দেখলে আকাশভাইয়া রাগ কিভাবে করবে দেখা যাক!! স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই গোসল করে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। আকাশের জন্য অনেককিছু বানিয়েছে। রান্নাবান্না করতে গিয়ে খাওয়ার সময় ও পায় নি।। অসুস্থ শরীরে এইসব করে খুব দুর্বল লাগছিল সারার। তারপরেও দ্রুত সাজগোজ করে সায়ানকে নিয়ে মামার বাসায় রওনা দিল। আকাশের পারসোনাল গাড়িকে ইচ্ছা করেই খবর দেয় নি। এই গাড়ির কাজ হচ্ছে সারাকে তার কথামত সব জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। সারা যখনই ফোন করবে তখনই যেতে হবে।

পা টিপে টিপে সারা দোতলা পর্যন্ত ওঠে। আকাশের মা সারাকে দেখে “আপনার তাহলে মনে পড়েছে বড়মামি নামের একজন মানুষ আছে” বলে গাল ফোলানোর সঙ্গে সঙ্গে সারা তাড়াতাড়ি তাকে জড়িয়ে ধরল। ” এখন বুঝতে পারছি ঐ পেচা লোকটা এতো রাগ কোন জায়গা থেকে পেয়েছে। নিজে তো একটা রাগের ড্রাম তারমধ্যে একটা রাগওয়ালা হাতি জন্ম দিয়ে বসেছ। আমার মনে হয় সারাজীবন তোমাদের দুইজনের রাগ ভাঙতে ভাঙতেই আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।”

বলেই মামির গালে চুমু দিয়ে দৌড় দিল।

আকাশের রুমে দরজায় শুধু মাথাটা বের করে দেখে রাগের হাতি সত্যিই পেচার মতো মুখ বাকিয়ে বসে আছে। উফ! এই পেচা লোকটা রাগের সময় এতো কিউট হয়ে যায় কেন? সারার ইচ্ছা করল গালদুটো ধরে জোরে জোরে টান দিয়ে লাল করে ফেলতে। কিন্তু নিজের গালটা লাল হওয়ার ভয়ে করল না।

আকাশ মাথা নিচের দিকে দিয়ে বসে ছিল। সারা কখন পাশে এসে বসেছে খেয়াল করে নি। সারা যে একগাদা বকরবকর শেষ করে খাবারের বাক্স খুলছে সেটাও খেয়াল করে নি।

আকাশের মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে খাবার খাওয়াতে নিলে এক ঝটকায় সারার হাতসহ সব খাবার মাটিতে ফেলে দেয়। সারা ভয়ে কেঁপে ওঠে। অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্না করল শুধু আকাশভাইয়ার জন্য। আর আকাশভাইয়া তার এতো কষ্ট করে রান্নাকরা খাবারগুলো মাটিতে ফেলে দিল। একটুও খারাপ লাগল না? তার কাছে তার রাগটা এতোই বড়?

: তুই আমার রুমে কি করছিস? কোন সাহসে আমার রুমে ঢুকেছিস বল্? আবার খাবার এনেছিস? তোর মতো মেয়ের হাতের খাবারের চেয়ে বিষ ভালো।

আকাশ সারার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে দিল। সারা পড়ে গিয়ে অনেক ব‍্যথাও পায়। কপাল কেটে রক্ত বেরোতে থাকে।

সেই অবস্থায় সারা আকাশের পা জড়িয়ে ধরল, আমার ওপর রাগ করে থেকো না আকাশভাইয়া। আমি বলছি আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো তোমার রাগ উঠাব না। তোমার সব কথা শুনব। যা বলবে তুমি তাই করব। কান ধরলাম আমি। শুধু তুমি তোমার রাগটা একটু কমাও। আর ভুল করব না।

সারা কাঁদতে থাকে। আকাশ ওকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। অনেকক্ষণ সারাকে ধাক্কিয়ে ঘরের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করে। সারা কিছুতেই যাবে না। আকাশ মেরে ফেলুক, তবু যতক্ষণ আকাশের রাগ কমে ও যাবে না আকাশকে রেখে। আকাশ এইবার আর রাগ ধরে রাখতে না পেরে শক্ত বেল্ট দিয়ে সারাকে মারতে লাগল। খুব জোরে জোরে। একেকটা আঘাতে সারার চামড়া ফেটে যাচ্ছিল, শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। গলা ফাটিয়ে কেঁদে বলছে আকাশভাইয়া আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর পারছি না। অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার। আর মেরো না।

যে সারার চোখের পানি গড়িয়ে পড়া আগেই আকাশ তা মুছে ফেলত আজ সেই সারার এত কান্নাও আকাশের কানে পৌঁছাচ্ছে না। সারাকে পশুর মতো মেরে একটা সময় আকাশ প্রচণ্ড হাঁপিয়ে ওঠে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়তে থাকে। জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে। হঠাৎ করে কপালে কোমল কিছুর স্পর্শে চমকে ফিরে তাকায়। দেখে সারা তার আচল দিয়ে আকাশের কপাল থেকে ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে। “তোমার জিনিস তুমি মারো কাটো আমি কিছুই বলব না। কিন্তু আমার জিনিসের একটুও অবহেলা হতে দেব না। পানি খেয়ে নাও; তারপর নাহয় মারো।”

সারার হিত থেকে কাচের গ্লাসটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর সারাকে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর দরজা ঘেঁষে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে জমে থাকা কষ্টগুলো চিৎকার করে কেঁদে বের করে দিতে চেষ্টা করল। অথচ গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোল না। ঐদিকে সারা দরজার বাইরে বসে চিৎকার করে দরজা ধাক্কাতে লাগল। কাঁদতে লাগলো পাগলের তো। দরজার দুইপাশে দুইজন। একজন ভিতরে, একজন বাহিরে। একজন চিৎকার করে কাঁদছে, আরেকজন নিঃশব্দে। একজন কষ্ট পেয়ে, আরেকজন কষ্ট দিয়ে। কারো কষ্টটা সবাই দেখছে, কারোটা কেউ দেখছে না।

এরপর আকাশ দুই দুইটা সিদ্ধান্ত নিল। যার কারণে পুতুলকে হারিয়েছে তার ওপর প্রতিশোধ। আর চিরকালের মতো সারা থেকে দূরে সরে যাওয়া। সবার থেকে অনেক দূর। যেখানে কোন মায়ায় জড়ানোর ভয় নেই। বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে ইউ.এস যাওয়ার প্রস্তুতি নিল আকাশ। তার আগে

যাওয়ার আগের দিন ঘরের জিনিসপত্র প‍্যাকিং করছিল। নিজের কাজ নিজে করার অভ‍্যাস একদম নেই আকাশের। ঘরের জিনিস কোনটা কোথায় থাকে কিছুই জানে না। বারবার “পুতুল”ডাকতে নিয়ে থেমে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সব গুছিয়ে হঠাৎ ওর মনে পড়ল নিবিড় আর সারার ছবিগুলোর কথা। ঐ ছবিগুলো যাতে কোনদিন কেউ না দেখে। কিন্তু কোথায় গেল ওগুলো? আকাশ হাজার খুঁজে ও পায় না।

: অযথা রুমটা নষ্ট করো না আকাশ। ছবিগুলো আমার হাতে।

আকাশ পিছনে ফিরে চমকে উঠে, মেধা, তুমি??

মেধা: ইয়েস আমি। কালকে ইউ.এস চলে যাবে তো তাই দেখা করতে আসলাম এবং একটা কথা জানাতে আসলাম। কথাটা হলো তুমি বাংলাদেশেই থাকবে এবং কাল থেকে উই ইউল বি এনগেজড ইন আ রিলেশনশিপ।

আকাশ: হোয়াট?? আর ইউ ক্রেজি??

মেধা: নো বেবি। আই অ্যাম কুল। তোমাকে আমার সঙ্গে রিলেশনশিপ করতে হবে। আমি যা বলব তাই করতে হবে। কারণ তুমি এখন আমার খাচায় বন্দী পাখি। ( আকাশের মুখে স্লাইড করে)

আমার কথামত না চললে এই ছবিগুলো ভাইরাল করব। পুরো দুনিয়াকে তোমার আদরের পুতুলের রোমান্স সিন দেখাবো। তারপর এই সমাজ তোমার কলিজার টুকরাকে আঘাতে-অপমানে শেষ করে দেবে।ও এই সমাজে কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। ওর পরিবার ওকে মেনে নিবে না। এতো বড় পৃথিবীতে ওর কোন আশ্রয় থাকবে না। ওর শেষ পরিনতি হবে মৃত্যু।

“না” আকাশ চিৎকার দিয়ে পরপর কয়েকটা জিনিস ভেঙে ফেলল।

“মেধা ঐ চিন্তাটা মাথায়ও এনো না। আমার ভালবাসার জন্য আমি যেমন মরতে পারি, মেরেও ফেলতে পারি। আমার পুতুলের যদি কোন ক্ষতি করো তুমি ওর যতটুকু ক্ষতি করবে আমি তোমার অবস্থা তারচেয়ে খারাপ করে ফেলব। ওর দিকে নজর-ও দিও না। অবশ্য কোন কুনজর আমি পড়তেও দেব না ওর ওপর।

মেধার হাতের থেকে নিয়ে একটানে সবগুলো ছবি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলল আকাশ। মেধা অট্টহাসি তে ফেটে পড়ে।

“তুমি আমাকে এত গাধা কিভাবে ভাবলে আকাশ? এই ছবিগুলোর হাজারটা কপি আমার কাছে। আর সেগুলো কোথায় তুমি কেন দুনিয়ার সবাই মিলে খুঁজলেও বের করতে পারবে না। একমাত্র আমিই জানি ওগুলো কোথায়। সো আমার প্রতি কেয়ারফুল থাকো।”

বর্তমান…….

চলবে

( সবাইকেতোমারই আছি আমি
পর্ব-২৩
Sara mehjabin

এভাবেই আকাশভাইয়া ও অদ্বিতীর চোখ এড়িয়ে আমার আর সারার প্রেম চলতে লাগল। সারাকে পাবো কোনদিন ভাবতে পারি নি। আমি তো সারাকে ভালবেসেও দূরে সরে গিয়েছিলাম আকাশভাইয়ার জন্য। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি স‍্যাক্রিফাইস করে বোকারা। আমি আস্ত একটা বোকা বিধায় নিজের ভালবাসাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। সারা কতটা ভালবাসে আমায়। তাও আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি। এখন এইসব ভাবলে খুব কষ্ট লাগে।

অদ্বিতীর সঙ্গে জোর করে রিলেশন রাখতে বাধ‍্য হচ্ছি। কি করব, মেয়েটা আমার মিথ্যা ভালবাসাকে সত্যি সত্যি ভেবে প্রচণ্ড মায়ায় জড়িয়ে গেছে। এখন আমি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। ওকে কিভাবে বলব আমি সারাকে ভালবাসি, এতদিন অভিনয় করেছি ওর সাথে। অন‍্যদিকে সারাও আর পারছে না। আকাশভাইয়ার ভালবাসা এখন ওর অত‍্যাচারের মতো মনে হয়। আকাশভাইয়াকে এখন সহ‍্য-ই করতে পারে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। এইসব শুনলে আকাশভাইয়া কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে সারা ভাবছে না ওর সব ভয় আমাকে নিয়ে। কারণ যে দুইজন মানুষকে আকাশভাইয়া সবচেয়ে বেশি ভালবাসে আমি তাদের একজনকে কেড়ে নিয়েছি আরেকজনকে ঠকিয়েছি। এইসব জানার পর আমাকে মারতে আকাশভাইয়া এক সেকেন্ড সময় লাগবে না।

কিন্তু ভালবাসা এমন একটা জিনিস যেটার থেকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসা যায় না। আমি আর সারা শত ভয় শত বাধা অতিক্রম করে এভাবেই দিন কাটাতে লাগলাম। এই লুকোচুরি খেলার শেষ কোথায় আমি জানি না। অদৌ কখনো শেষ হবে কিনা তাও জানি না।

তারপর দাদুর কথায় আকাশভাইয়ার সঙ্গে সারার
কাবিন হয়ে গেল। আংটি-বদল হলো। সারার বয়স চৌদ্দ। শরিয়ত মতে ও বিয়ের উপযুক্ত হলেও ওদের বিয়ে নিয়ে আইনের ঝামেলা হবে। তাই আপাতত গোপন থাকছে বিয়েটা। সারার বয়স আঠারো হওয়ামাত্র ওকে আকাশভাইয়ার বৌ করে আনা হবে। চোখের সামনে ওদের বিয়ে হলো। কিভাবে সহ‍্য করব আমি? আমার সারা বৌ হয়ে গেল অন‍্যজনের। সারাও প্রচুর কান্নাকাটি করছে। কিছুতেই এই বিয়ে হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। আমি সারাকে অনেক কষ্টে বোঝালাম আপাতত চারটা বছর তো ওকে আকাশের সঙ্গে থাকতে হবে না। আমার আরেকটু সময় দরকার। আকাশভাইয়াকে আমার খুব দরকার নিজে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য। এই বাড়ি তে পড়াশোনা টা শেষ করেই জব খুঁজব। তারপর সারাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।

এতটুকু পড়ার পর আকাশের আর পড়ার শক্তি ছিল না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এগুলো পড়ে কোন রিঅ্যাক্ট দেখালো না আকাশ। সেইদিন রাতেই বাবার কাছে গিয়ে বলল নিবিড়ের এই বাড়িতে পড়াশোনা করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। ওর লেখাপড়া দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ওকে বোর্ডিং এ পাঠানো দরকার। আকাশের বাবা বাড়তি ঝামেলা পছন্দ করছিলেন না। সুতরাং তিনি খুবই স্বাভাবিক ভাবে রাজি হয়ে গেলেন।

নিবিড়কে বোর্ডিং স্কুলে রাখতে গিয়েছিল আকাশ। একা। এমনকি ড্রাইভার ও ছিল না। আকাশ নিবিড়কে বোর্ডিং-এ রেখে আসার পরেরদিন ফোন আসে নিবিড় নিঁখোজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর শুনে অদ্বিতী পুরো পাগল হয়ে পড়ল। খানবাড়ির সবাই নিবিড়ের জন্য অনেক খোঁজাখুঁজি করে। আকাশের সবচেয়ে ছোট ফুপি লিনা যে বিধবা হয়ে এইবাড়িতে থাকতেন এবং নিবিড় যাকে মা ডাকত নিবিড় হারানোর খবরে সেদিনই স্ট্রোক করে প‍্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আজো শয‍্যাশায়ী। অথচ যার সবচেয়ে বেশি রিঅ্যাক্ট করার কথা সেই আকাশ খুব স্বাভাবিক থাকল।
অদ্বিতী সেইসময় আকাশকে দেখতে পারত না। সবসময় বলত তোর জন্য আমার নিবিড় হরিয়ে গেছে। তুই ওকে এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিস। তোর কারণে আমি নিবিড়কে হারিয়ে ফেলেছি। আমি মাফ করব না দাদা। তোকে আমি কোনদিন মাফ করব না।

অদ্বিতী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। কাউকে সহ‍্য করত না। বলত সবাই শত্রু, সবাই আমার শত্রু। আজকে আমার জায়গায় মাইশা হলে তুই কোনদিন নিবিড়কে তাড়িয়ে দিতি না। আসলে আমি তোর নিজের বোন না আমার প্রতি তোর কোন ভালোবাসা নেই।

সেইসময় একমাত্র সারার সাপোর্ট, ভালোবাসা ও সেবায় অদ্বিতী ধীরে ধীরে সেই মানসিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনে বেরিয়ে আসে।

—————————————————————————–

সারা আজকে অনেকদিন পর আকাশদের বাসায় আসল। থাকতে না পেরে বাধ্য হয়ে আসল। সম্পূর্ণ এক একটা মাস সে আকাশভাইয়াকে দেখে নি। এইভাবে সে থাকতে পারে? আকশভাইয়া কি জানে না? তাও রাগ দেখিয়ে বসে আছে। পেঁচা কোথাকার!

সারা একটা গাঢ় নীল শাড়ি পড়েছে, হাতভর্তি কাঁচের চূড়ি। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে কপালে নীল টিপ পড়েছে। টিপটা ইচ্ছা করেই ঠিকমতো পড়ে নি। আকাশভাইয়া কপালের টিপ সোজা না হলে ঠিক করে দিয়ে দেয়। চুলগুলো ছেড়ে কানের পাশে বেলী ফুল লাগিয়েছে। এইরকম সাজে দেখলে আকাশভাইয়া রাগ কিভাবে করবে দেখা যাক!! স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই গোসল করে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। আকাশের জন্য অনেককিছু বানিয়েছে। রান্নাবান্না করতে গিয়ে খাওয়ার সময় ও পায় নি।। অসুস্থ শরীরে এইসব করে খুব দুর্বল লাগছিল সারার। তারপরেও দ্রুত সাজগোজ করে সায়ানকে নিয়ে মামার বাসায় রওনা দিল। আকাশের পারসোনাল গাড়িকে ইচ্ছা করেই খবর দেয় নি। এই গাড়ির কাজ হচ্ছে সারাকে তার কথামত সব জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। সারা যখনই ফোন করবে তখনই যেতে হবে।

পা টিপে টিপে সারা দোতলা পর্যন্ত ওঠে। আকাশের মা সারাকে দেখে “আপনার তাহলে মনে পড়েছে বড়মামি নামের একজন মানুষ আছে” বলে গাল ফোলানোর সঙ্গে সঙ্গে সারা তাড়াতাড়ি তাকে জড়িয়ে ধরল। ” এখন বুঝতে পারছি ঐ পেচা লোকটা এতো রাগ কোন জায়গা থেকে পেয়েছে। নিজে তো একটা রাগের ড্রাম তারমধ্যে একটা রাগওয়ালা হাতি জন্ম দিয়ে বসেছ। আমার মনে হয় সারাজীবন তোমাদের দুইজনের রাগ ভাঙতে ভাঙতেই আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।”

বলেই মামির গালে চুমু দিয়ে দৌড় দিল।

আকাশের রুমে দরজায় শুধু মাথাটা বের করে দেখে রাগের হাতি সত্যিই পেচার মতো মুখ বাকিয়ে বসে আছে। উফ! এই পেচা লোকটা রাগের সময় এতো কিউট হয়ে যায় কেন? সারার ইচ্ছা করল গালদুটো ধরে জোরে জোরে টান দিয়ে লাল করে ফেলতে। কিন্তু নিজের গালটা লাল হওয়ার ভয়ে করল না।

আকাশ মাথা নিচের দিকে দিয়ে বসে ছিল। সারা কখন পাশে এসে বসেছে খেয়াল করে নি। সারা যে একগাদা বকরবকর শেষ করে খাবারের বাক্স খুলছে সেটাও খেয়াল করে নি।

আকাশের মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে খাবার খাওয়াতে নিলে এক ঝটকায় সারার হাতসহ সব খাবার মাটিতে ফেলে দেয়। সারা ভয়ে কেঁপে ওঠে। অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্না করল শুধু আকাশভাইয়ার জন্য। আর আকাশভাইয়া তার এতো কষ্ট করে রান্নাকরা খাবারগুলো মাটিতে ফেলে দিল। একটুও খারাপ লাগল না? তার কাছে তার রাগটা এতোই বড়?

: তুই আমার রুমে কি করছিস? কোন সাহসে আমার রুমে ঢুকেছিস বল্? আবার খাবার এনেছিস? তোর মতো মেয়ের হাতের খাবারের চেয়ে বিষ ভালো।

আকাশ সারার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে দিল। সারা পড়ে গিয়ে অনেক ব‍্যথাও পায়। কপাল কেটে রক্ত বেরোতে থাকে।

সেই অবস্থায় সারা আকাশের পা জড়িয়ে ধরল, আমার ওপর রাগ করে থেকো না আকাশভাইয়া। আমি বলছি আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কখনো তোমার রাগ উঠাব না। তোমার সব কথা শুনব। যা বলবে তুমি তাই করব। কান ধরলাম আমি। শুধু তুমি তোমার রাগটা একটু কমাও। আর ভুল করব না।

সারা কাঁদতে থাকে। আকাশ ওকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। অনেকক্ষণ সারাকে ধাক্কিয়ে ঘরের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করে। সারা কিছুতেই যাবে না। আকাশ মেরে ফেলুক, তবু যতক্ষণ আকাশের রাগ কমে ও যাবে না আকাশকে রেখে। আকাশ এইবার আর রাগ ধরে রাখতে না পেরে শক্ত বেল্ট দিয়ে সারাকে মারতে লাগল। খুব জোরে জোরে। একেকটা আঘাতে সারার চামড়া ফেটে যাচ্ছিল, শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। গলা ফাটিয়ে কেঁদে বলছে আকাশভাইয়া আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর পারছি না। অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার। আর মেরো না।

যে সারার চোখের পানি গড়িয়ে পড়া আগেই আকাশ তা মুছে ফেলত আজ সেই সারার এত কান্নাও আকাশের কানে পৌঁছাচ্ছে না। সারাকে পশুর মতো মেরে একটা সময় আকাশ প্রচণ্ড হাঁপিয়ে ওঠে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়তে থাকে। জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে। হঠাৎ করে কপালে কোমল কিছুর স্পর্শে চমকে ফিরে তাকায়। দেখে সারা তার আচল দিয়ে আকাশের কপাল থেকে ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে। “তোমার জিনিস তুমি মারো কাটো আমি কিছুই বলব না। কিন্তু আমার জিনিসের একটুও অবহেলা হতে দেব না। পানি খেয়ে নাও; তারপর নাহয় মারো।”

সারার হিত থেকে কাচের গ্লাসটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর সারাকে মারতে মারতে ঘর থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর দরজা ঘেঁষে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে জমে থাকা কষ্টগুলো চিৎকার করে কেঁদে বের করে দিতে চেষ্টা করল। অথচ গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোল না। ঐদিকে সারা দরজার বাইরে বসে চিৎকার করে দরজা ধাক্কাতে লাগল। কাঁদতে লাগলো পাগলের তো। দরজার দুইপাশে দুইজন। একজন ভিতরে, একজন বাহিরে। একজন চিৎকার করে কাঁদছে, আরেকজন নিঃশব্দে। একজন কষ্ট পেয়ে, আরেকজন কষ্ট দিয়ে। কারো কষ্টটা সবাই দেখছে, কারোটা কেউ দেখছে না।

এরপর আকাশ দুই দুইটা সিদ্ধান্ত নিল। যার কারণে পুতুলকে হারিয়েছে তার ওপর প্রতিশোধ। আর চিরকালের মতো সারা থেকে দূরে সরে যাওয়া। সবার থেকে অনেক দূর। যেখানে কোন মায়ায় জড়ানোর ভয় নেই। বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে ইউ.এস যাওয়ার প্রস্তুতি নিল আকাশ। তার আগে

যাওয়ার আগের দিন ঘরের জিনিসপত্র প‍্যাকিং করছিল। নিজের কাজ নিজে করার অভ‍্যাস একদম নেই আকাশের। ঘরের জিনিস কোনটা কোথায় থাকে কিছুই জানে না। বারবার “পুতুল”ডাকতে নিয়ে থেমে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে সব গুছিয়ে হঠাৎ ওর মনে পড়ল নিবিড় আর সারার ছবিগুলোর কথা। ঐ ছবিগুলো যাতে কোনদিন কেউ না দেখে। কিন্তু কোথায় গেল ওগুলো? আকাশ হাজার খুঁজে ও পায় না।

: অযথা রুমটা নষ্ট করো না আকাশ। ছবিগুলো আমার হাতে।

আকাশ পিছনে ফিরে চমকে উঠে, মেধা, তুমি??

মেধা: ইয়েস আমি। কালকে ইউ.এস চলে যাবে তো তাই দেখা করতে আসলাম এবং একটা কথা জানাতে আসলাম। কথাটা হলো তুমি বাংলাদেশেই থাকবে এবং কাল থেকে উই ইউল বি এনগেজড ইন আ রিলেশনশিপ।

আকাশ: হোয়াট?? আর ইউ ক্রেজি??

মেধা: নো বেবি। আই অ্যাম কুল। তোমাকে আমার সঙ্গে রিলেশনশিপ করতে হবে। আমি যা বলব তাই করতে হবে। কারণ তুমি এখন আমার খাচায় বন্দী পাখি। ( আকাশের মুখে স্লাইড করে)

আমার কথামত না চললে এই ছবিগুলো ভাইরাল করব। পুরো দুনিয়াকে তোমার আদরের পুতুলের রোমান্স সিন দেখাবো। তারপর এই সমাজ তোমার কলিজার টুকরাকে আঘাতে-অপমানে শেষ করে দেবে।ও এই সমাজে কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। ওর পরিবার ওকে মেনে নিবে না। এতো বড় পৃথিবীতে ওর কোন আশ্রয় থাকবে না। ওর শেষ পরিনতি হবে মৃত্যু।

“না” আকাশ চিৎকার দিয়ে পরপর কয়েকটা জিনিস ভেঙে ফেলল।

“মেধা ঐ চিন্তাটা মাথায়ও এনো না। আমার ভালবাসার জন্য আমি যেমন মরতে পারি, মেরেও ফেলতে পারি। আমার পুতুলের যদি কোন ক্ষতি করো তুমি ওর যতটুকু ক্ষতি করবে আমি তোমার অবস্থা তারচেয়ে খারাপ করে ফেলব। ওর দিকে নজর-ও দিও না। অবশ্য কোন কুনজর আমি পড়তেও দেব না ওর ওপর।

মেধার হাতের থেকে নিয়ে একটানে সবগুলো ছবি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলল আকাশ। মেধা অট্টহাসি তে ফেটে পড়ে।

“তুমি আমাকে এত গাধা কিভাবে ভাবলে আকাশ? এই ছবিগুলোর হাজারটা কপি আমার কাছে। আর সেগুলো কোথায় তুমি কেন দুনিয়ার সবাই মিলে খুঁজলেও বের করতে পারবে না। একমাত্র আমিই জানি ওগুলো কোথায়। সো আমার প্রতি কেয়ারফুল থাকো।”

বর্তমান…….

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here