তোমার পরিনীতা -২১
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছিলেন বীরেনবাবু। বহুদিন পরে আজ সুমনকে দেখে মনে খুব শান্তি লাগছিল উনার। আজ সুমনকে দেখে মনে হচ্ছে ওর কাঁধ থেকে বড় ধরনের একটা বোঝা নেমে গেছে। সুমনের ক্লান্ত, মলিন মুখটায় আজ অনেক দিন পরে ভোরের স্নিগ্ধতার আভাস।
বাপ-মা মরা হতভাগীর এমন হাসি খুশি মুখটা দেখলে বুকটা আনন্দে ভরে উঠে বীরেন বাবুর। বড্ড অবহেলায় মানুষ হলো তার এই মা মরা নাতনিটি। তারপরও পাশের বাড়ির রামের বৌটা আছে বলে রক্ষে। অনেক করে সে সুমনের জন্য, তা না হলে মঞ্জু যা ব্যবহার করে সুমনের সাথে… বাসার একটা কুকুর বেড়ালকেও মানুষ এতোটা দূর দূর করে না।
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বীরেনবাবু।
আদিত্য ছেলেটা আসলেই বড় ভাল। সমীরের মুখে কাল আদিত্যর দেয়া প্রস্তাবটা শুনে ভীষন অবাক হয়েছেন তিনি। আজকাল এমন ভালো মানুষও তাহলে পৃথিবীতে আছে ? বীরেন বাবু মানেন দুর্দিনের বন্ধু খাঁটি বন্ধু। আদিত্যর এমন নিজে থেকে টাকা ধার দেয়ার প্রস্তাবটা শুনেই যে সুমনের মনটা আজ অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এটা ভাবতেই চোখদুটো আনন্দাশ্রুতে ভরে আসতে চাইলো বীরেনবাবুর। এই অল্প ক’দিনেই আদিত্যকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছেন তিনি, মনে মনে আদিত্য আর সুমন, ওদের দু’জনকে ঘিরে একটা আকাশ কুসুম কল্পনাও করে ফেলেছেন। মনে আশা আদিত্য যদি একটু আগ্রহ দেখায়… তবে আদরের নাতিনটিকে আদিত্যর হাতেই সমর্পণ করবেন বীরেনবাবু।
সুমন আজ সকাল থেকেই প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছিল গোটা বাড়িটা জুড়ে। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও গাইছিল। আজ মনটা ওর সত্যিই বড় চঞ্চল, থেকে থেকে মনে হচ্ছে খানিকটা নেচে বেড়ায় কিন্তু বড় হয়ে যাওয়ার জ্বালা খুব, সবকিছুতেই খালি বিধিনিষেধের বেড়াজাল। তাই মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গেয়েই আনন্দটা উপভোগ করছিল সুমন। কত্তোগুলো চুড়ি কিনে দিয়েছে শ্রাবনদা.. সবগুলো সুমনের পছন্দের। বড় হয়ে রোজগার করে সুমনও একদিন শ্রাবনদাকে অনেক কিছু কিনে দিবে।
মনের আনন্দে সুমন এতোটাই বিভোর ছিলো যে মঞ্জুমামী যখন একটা বড় টিফিন বাটি ওর হাতে ধরিয়ে দিল তখন হুঁশ জ্ঞান খুইয়ে এক দৌড়ে বড়মার কাছে ছুটলো সুমন।
“কিরে সুমন… আজ কি এতো নিয়ে আসলি সকাল সকাল টিফিন বাটি ভরে? ”
“কি জানি বড়মা, আমি খুলেও দেখিনি… মামী হাতে দিয়ে বললো দিয়ে আয় আর আমি অমনি দৌড়ে চলে আসলাম।”
নির্মলা টিফিন বাটির মুখ খুলে একটু অবাক হলেন… বাটি ভরা পোলাও, দেশী মুরগী, ডিমের কোরমা, ছানার পায়েস। মঞ্জু হঠাত কোন খুশিতে এতো কিছু পাঠালো? কি ব্যাপার… সুমনের বিয়ে ঠিক হয়নিতো? নির্মলা একবার ভাবলেন সুমনকে দিয়ে মঞ্জুকে আবার জিজ্ঞেস করাবেন কিনা, কিন্তু তাতে আবার মঞ্জু কি মনে করে থেমে গেলেন। কি জানি…. কাল শ্রাবণ সবাইকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো সেই আনন্দেই পাঠালো কিনা কে জানে?
“সুমন, মা যাতো এই চাটা শ্রাবণকে দিয়ে আয় আর তোর কাকাবাবুর ইজি চেয়ারের পাশে এই পত্রিকাটা রেখে আয়।”
নির্মলা, সুমনের হাতে চায়ের কাপের সাথে আজকের কাগজটা ধরিয়ে দিলেন।
সুমন নিউজপেপারটা রাখতে গিয়ে দেখলো কাকাবাবু কার সাথে যেন জমিজমা নিয়ে আলোচনা করছেন ফোনে। সুমন পেপার রাখতে রাখতে চেষ্টা করলো আলোচনার বিষয়বস্তু একটু আধটু বুঝতে কিন্তু তেমন কিছু ওর ঘটে ঢুকলো না। আসলে চুরি করে আর কাহাতক শোনা যায়। তবে এটা ওদের বাড়ির জমির বিষয় নয় এটা জেনে একটু স্বস্তি হলো সুমনের। কাকাবাবু পটলবিল বলে একটা জায়গা নিয়ে কথা বলছিলো।
শ্রাবন ওর ঘরের কোনায় রাখা লম্বা সোফাটায় আধাশোয়া হয়ে একটা কেসের ফাইল দেখছিলো। ডিভোর্সের মামলা, মহিলা সম্পর্কে ওর দূর সম্পর্কের পিসি হন। বাবা বলেছে ভদ্রলোকটিকে ভালো মতো ফাঁসাতে, পাত্তিওয়ালা লোক। বড় বাজারের হার্ডওয়ারের তার তিন তিনটা দোকান, সবগুলোরই রমারমা ব্যবসা। কিন্তু শ্রাবণের কেন যেন মনে হচ্ছে ভদ্রলোকটির তেমন কোন দোষ নেই, একটু আধটু মাল খায় এই যা। শ্রাবন লোক লাগিশেছিল তবে কোন মেয়ে মানুষের দোষ পায়নি। এই পিসেমশাই লোকটি সম্ভবত ভীতু প্রকৃতির আর ওর পিসিমাটি স্বভাবের দিক থেকে উল্টো… বেশ দজ্জাল, সাথে বাপের টাকার অহংকারও খুব। তেলে জলে তাই মিশ খায়নি, উল্টো দুইয়ে মিলেমিশে বেশ ঘটিনাটি বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে আর ওর বাপও সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তাই বোনের দায় উদ্ধারের নামে ছেলের হয়ে দুটো পয়সা আয়ের বন্দোবস্তো করেছেন। শ্রাবণ কলম মুখে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে ডিভোর্সটা কি করে ঠেকানো যায় তাই ভাবছিলো কিম্তু আশপাশ থেকে হঠাত পরিচিত ফুলের গন্ধ এসে নাকে ঢুকতেই ফাইলটা ও পাশের সেন্টার টেবিলে রাখলো।
“কী? ” শ্রাবণকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো সুমন। ওরম ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে কি দেখছে শ্রাবনদা, ওর কি হঠাত তিনটে মাথা গজালো নাকি?
“কিছু না, তোকে তো আস্ত একটা জারুল ফুলের ঝাড় মনে হচ্ছে… এতো সুন্দর বেগুনি রঙের শাড়ি পেলি কই? ” শ্রাবণ ভ্রুগুলো নামিয়ে স্বাভাবিক করলো। আজকাল সুমোকে দেখলে খালি দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে ওটা বড় বেমানান দেখায়, তাই এই বিকল্প ব্যাবস্থা। সুমো মনে করে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে বলে শ্রাবণ মনযোগ দিয়ে ওকে দেখছে। কত কিছুই নতুন নতুন আজকাল শিখছে শ্রাবণ প্রেমে পড়ে…
“মামা কিনে দিয়েছিলো গত জন্মদিনে। আচ্ছা শ্রাবনদা কেউ যদি কাউকে যেচে টাকা দিয়ে উপকার করতে চায় তাহলে সেটা নিলে কি মানুষ ছোট হয়ে যায়? সে তো টাকা নিতে চায়নি, তারপরও একরকম জোর করে দিলে কি টাকা ফিরিয়ে দেয়া উচিত? ” সুমন হুট করে জিজ্ঞেস করে ফেললো। আদিত্যর টাকা দেয়ার ব্যাপারটা আসলে সামলে রাখতে পারছেনা সুমন। একদিকে যেমন ভীষন আনন্দ হচ্ছে আবার অন্যদিকে কেমন যেন নিজেদের ছোট ছোটও মনে হচ্ছে। আদিত্যবাবু ওদের লোভী ভাববেন নাতো?
কিন্তু সুমনের এই কথার সারমর্ম শ্রাবণের অজানা। ওর সামনে এখন শুধুই বেলীফুলের ঘ্রান, কেমন মাতাল মাতাল ঠেকছে। তাই সুমন ঠিক কী কারনে এটা জানতে চাইলো শ্রাবণ বুঝতে পারলনা। কাল জোর করে নিয়ে গিয়ে চুড়ি কিনে দিল বলে জিজ্ঞেস করছে নাতো সুমো? শ্রাবন সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো।
“মানে, আমি তোকে জোর করে কখন টাকা দিলাম? ”
“আহা… আমি কি তাই বললাম, তোমার টাকা নিতে আবার কবে কি ভেবেছি? ”
“তবে? ”
“ওহো.. একটু বুদ্ধি চাইছি আর অমনি জেরা শুরু করে দিলো… আমি কি কোর্টে দাড়ানো আসামী নাকি? ” সুমন ঠোঁট উল্টালো। সব কথা অত জানতে হবে কেন?
“ফুহ…তুই আর আসামী! কি যে বলিস। বরঞ্চ তুই তো দিন দিন জজ সাহেবা হওয়ার ধান্ধা করছিস। কিছু একটু হলেই হুলো বিড়ালের মতো গোঁফ তা দিস। কবে কী একটু বলেছিলাম বাপরে বাপ, মহারানীর তাই এত্তো রাগ হলো যে আমাকে কাল এত্তোগুলো ঘুস দিতে হলো। ”
শ্রাবণের কথায় সুমনের চুড়ির কথা মনে পড়লো। ইশশ… দেরী হয়ে যাচ্ছে, চারু একবার চুড়িগুলো দেখতে চেয়েছে। এরপর ওপারে গেলে চারুও নাকি মেলা থেকে ওরকম চুড়ি কিনবে। সুমন ওখান থেকে একজোড়া চুড়ি একবার চারুকে দিতে চাইলো কিন্তু শ্রাবনদা কিনে দিয়েছে, এই চুড়ি ও প্রানে ধরে কাউকে দিতে পারবেনা… বড্ডো শখের জিনিস ওর।
“ওহো, চা টা তাড়াতাড়ি ধরো। আমার অনেক তাড়া আছে, চারু একবার ওবাড়ি যেতে বলেছে। ”
“হমম… খালি দিনমান চারুদের বাড়ি ছোটা হয় তাই না? এতো লুডু খেললে এরপর তোকে আমি ঠিক অলিম্পিক গেমসে পাঠিয়ে দিবো আর সোনা না জিতে ফিরলে সোজা বে অফ বেঙ্গল।”
লুডুর নাম শুনে সুমন জমে গেল। খেয়েছে… ওরা ইদানিং সত্যি অনেক লুডু, ক্যারাম এসব খেলে চারুদের বাড়িতে। কিন্তু শ্রাবনদা সেটা জানলো কি করে? আচ্ছা সেদিন যে সন্ধ্যায় চারুদের বাড়ির জানালা দিয়ে একবার শ্রাবনদাই ছাদে দাড়িয়ে আছে বলে মনে হলো ওটা সত্যি নাতো? কিন্তু পরের মুহূর্তেই সেটা হেসে উড়িয়ে দিলো সুমন। কী যা তা ভাবছে ও, এগুলো জানার জন্য প্রীতি একাই যথেষ্ট। কথার ফুলঝুরি ওটা। একটা জানতে চাইলে ফ্রিতে নিজেই দশটা বলে দেয় আর শ্রাবনদা তো চকলেটের লোভ দেয়, দশটা কেন প্রীতি দশ হাজারটা সিক্রেট বলে দিবে ওই চকলেটের লোভে।
শ্রাবণ চোরাচোখে সুমনের চিন্তিত মুখটা দেখছিলো। হাবলিটা শিওর ভাবছে শ্রাবণ ওর গোপন তথ্যগুলো পায় কি করে.. হা.. হা। সুমো যে কার সাথে পাল্লা দিতে আসে, শ্রাবন দি লইয়ারের কি তথ্য বের করার একটা রাস্তা, মোড়ে মোড়ে ওর গোয়েন্দা লাগানো আছে…. সেখানে সুমো তো একটা চুনোপুঁটি মাত্র। কিন্তু শ্রাবন এখন নিজেও বড় টেনশনে আছে, এই বোকারহদ্দ মেয়েটাকে ও প্রপোজ করে কি করে ? শ্রাবণ এতো আগ্রহ করে গর্দভটাকে জারুল ফুলের সাথে তুলনা করলো আর সুমোর মাথায় কী সব টাকা- পয়সার হিসেব ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেয়েরা বলে পুরুষের চোখ দেখলেই তার ভিতরটা পড়ে ফেলতে পারে… কিন্তু তাহলে ওর বেলায় সব উল্টো কেন? সুমো কি ওর দিকে সানগ্লাস পড়ে তাকায় যে সব অন্য শেডের দেখ, শ্রাবণের ভীষন রাগ হলো মনে মনে। শয়তান মেয়েটার চোখ দুটো গেলে দেয়া উচিত।
“না, না…. লুডু খেলতে যাবো না তো, কাল যে চুড়িগুলো কিনে দিলে তার দু’একটা চারুকে দেখাব তাই… ” সুমন মাথা নিচু করে নখ খুটতে লাগলো মেঝেতে, শ্রাবনদা আবার না তেড়েমেরে আসে। আজকাল চারুদের বাড়ির নাম শুনলেই অমন করতে থাকে… হিংসুটে কোথাকার।
” হমম ”
সুমনকে এখন এতো সুন্দর লাগছে যে শ্রাবণের ইচ্ছে হচ্ছে সুমোকে জড়িয়ে ধরে খেয়ে ফেলতে কিন্তু সুমোর আপার হেড নিয়ে শ্রাবণের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দেখা গেল শ্রাবণ জড়িয়ে ধরলো আর চিৎকার করে সারা পাড়া একত্র করলো গাধীটা। তখন শ্রাবণের কারও সামনে মুখ দেখানোর উপায় থাকবেনা। অবশ্য এটার একটা পজেটিভ দিকও আছে, পাড়ার লোক একত্র হলে ধরে বেঁধে ওদের বিয়ে দিয়ে দিবে সালিশ বিচার করে… বাঙ্গালী এই একটা বিষয়ে বড্ডো পটু আর শ্রাবণের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ থাকবেনা এমন বিয়ে হলেও, বিয়েটা সুমোর সাথে হলেই হলো। সবচেয়ে মজার কথা হলো, ওরকম হলে ওর বাবা রামনাথ চৌধুরীরও সাধ্যি নেই এ বিয়ে ঠেকায়। কথাটা মনে হতেই হেসে ফেললো শ্রাবন।
“কী অতো হাসছো.. ও শ্রাবনদা? ”
“উমম… মমম..
তোর মাথা। এখন যা ভাগ এখান থেকে, কোন উপকার তো আসে না শুধু শুধু আমার কাজ নষ্ট করতে আসে।”
ইনসাল্ট সুমো.. ইনসাল্ট। শ্রাবন তোকে সোজা বাংলা ভাষায় ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে,ভেবে দেখ কত্তো বড় অপমান।
“কী.. আমি তোমার কাজ নষ্ট করি? আর কক্ষনো তোমার ঘরে পা দিব না, এই আমি চললাম.. হুহ। একেত সকাল সকাল ভাল মুখ করে চা দিতে এলাম আর তার বদলা কতকিছু শুনিয়ে দিচ্ছে। মানুষের উপরকার করতে নেই, অমানুষ অকৃতজ্ঞ, না.. না কৃতঘ্ন একদম,” একদমে বলে থামলো সুমন।
“বাহ…. এরকম তেঁতো বিষের মতো চা দিয়ে তুই আমার উপকার হয়েছে বলতে চাইছিস?” শ্রাবণ মুচকি হেসে হাতের কাপটা পিরিচের উপর রাখলো।
“তেঁতো! তেঁতো কেন হবে? ”
“কেন হবে তার আমি কি জানি? তুই এক চুমুক খেয়ে দেখ, তারপর বল আমি সত্যি বলছি কি মিথ্যে বলছি।”
শ্রাবণের কথায় সুমন সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে এক চুমুক চা মুখে দিলো কিন্তু তেমন কোন হেরফের টের পেলনা। তবে শ্রাবনদা এর থেকে একটু বেশি মিষ্টি খায় চায়ে এটা সত্যি। আসলে শ্রাবনদার চাই তেমন পছন্দ না কিন্তু বড়মার কেন যেন কফি দেখলেই রাগ হয়, বলে ওসব বিদেশি জিনিস খেলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয় আর শ্রাবনদা বাইরে থেকে শুধু কফি খায়।
“আমি কি এক কাপ কফি বানিয়ে এনে দিবো… বড়মা এখন নিজের ঘরে বোধহয়।”
“না.. একটু চিনি কম ছিল এই আরকি।”
“তবে কি চিনি দিয়ে নিয়ে আসব? ” সুমন কাপটা হাতে নিতেই শ্রাবন থামিয়ে দিল।
“লাগবেনা যা, মিষ্টি যেটুকু লাগতো সেটা হয়ে গেছে ”
“অ্যা…। কি করে?”
” কিছু না তুই যা, আমি এখন জরুরি কাজ করছি আর তুই কেবল আমায় বিরক্ত করছিস, এই ফাইলটা আমায় আজই পড়ে শেষ করতে হবে,” শ্রাবণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো।
“কারও উপকার করতে চাইতে নেই.. হুহ, শুধু অপমান আর অপমান, আর কোনদিন আসবো না,” ভেঙচি কেটে সুমন শাড়ির আঁচলের গিটটা খুলে এক মুঠো বেলী ফুল টেবিলের উপর রাখলো।
“তাইতো বলি, এতো সুন্দর গন্ধ তো তোর কাছ দিয়ে আসার কথা না। তুই থাকিস সারাক্ষণ রান্নাঘরের আশেপাশে, ইঁদুর- বিড়ালের সাথে, পেটকি কোথাকার।”
” শ্রাবনদা, ভালো হবে না বলছি। ওরকম বাজে কথা বললে আর কোনদিন ফুল তুলে দিব না। ”
সুমন জোরে জোরে বলেই বাড়ির দিকে পা চালালো। কিন্তু তারপর আবার গতিটা একটু কমালো। দরজা ছাড়িয়ে বড় বড় শিকের জানালাটা পাড় হবার সময় আড়চোখে দেখলো শ্রাবনদা ফুলগুলি নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে শুঁকে দেখছে।
“যাক বাবা… রাগ করেনি , নাহলে ঠিক দরজার বাইরে ছুড়ে ফেলতো। হি.. হি.. ”
কিন্তু বাড়ি ঢুকেই যে আজ কপালে এমন ঠেঙ্গানি জুটবে সেটা কে জানতো। সুমন ঘরে যাওয়ার জন্য পা দিতেই মামী চিৎকার করে বলে উঠলো,
” টিফিন বাটিটা কি চারুদের বাড়িতে দিয়ে এলি? মনোরমাদিকে বলেছিলিস তো আদিত্যর জন্য সব আমি নিজের হাতে রেঁধেছি…. কোনটা যেন তাকে বাদ না দিয়ে খায়।”
চলবে….
তোমার পরিনীতা – ২২
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
” সুমনদি খেতে এসো,” প্রীতির ডাক শুনে মাথা তুলে আবার দুই হাঁটুর ভাজে মুখ লুকালো সুমন।
“কি হলো এসো… বলছি।”
চোখ গরম করে তাকালো প্রীতি, সুমন খায়নি বলে ওরা সবাই না খেয়ে বসে আছে যে।
“তুই যা প্রীতি.. আমার পেট কেমন ভার ভার ঠেকছে, আমি এখন খেতে পারবো না।”
নাক টেনে টেনে বললো সুমন। এ বেলা বকা খেতে খেতেই ওর পেট ভরে গেছে।
“তা তো ঠেকবেই.. যে বকুনি খেলে মায়ের কাছে তখন….. তাতে আগামী এক সপ্তাহ তোমার পেট ভরা থাকারই কথা, এখন ওঠো চলো।”
“খুব মজা লাগছে না? ” প্রীতির পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো সুমন।
“মোটেই না, মা যখন তোমায় বকছিলো তখন আমার মায়ের উপর কি ভীষন রাগ হচ্ছিল, তুমি জানো? কি এমন হয়েছে খাবারগুলো চারুদিদের বাড়ি না গিয়ে শ্রাবনদাদের বাড়ি গিয়েছে বলে ? শ্রাবনদারা কী আমাদের জন্য কিচ্ছু করেনা…. এই তো কাল কত খরচ করে নদীতে ঘুরাতে নিয়ে গেল… মা আসলে বড় একচোখা, ” প্রীতি নিজের মুখটা খানিকটা ভেংচে উঠলো।
” তুই থাম প্রীতি, নিজের মা নিয়ে অত মন্দ কথা বলা ভাল নয়। ”
“তবে তুমিও এখন খেতে চলো, নাহলে বাবা কিন্তু ভাত খাবে না।”
মামা এখনও খায়নি শুনে সুমন ওর লম্বা চুলগুলো নিয়ে প্যাঁচ দিয়ে বড়সর একটা খোঁপা বানিয়ে ফেললো চট করে । তারপর পায়ে স্যান্ডেল গলাতে গলাতে বললো ” নে এবার চল।”
খাবার দুই এক গাল মুখে তুলতেই মামীর মধুর কথাগুলো আবার কানে আসতে লাগলো সুমনের… “মানুষের এতো বড় ক্ষতি করেও কিছু মানুষ দিব্যি পেটপুরে খেতে পারে, ধন্যি এমন মানুষদের। মা মরেছে তো কী হয়েছে ছা দিয়েই আমার সংসারের বারোটা বাজানোর বন্দোবস্ত করে গেছে তারা।”
মৃত মায়ের সম্মন্ধে অমন কটুকথা শোনার পর সত্যি আর কিছু মুখে তুলতে ইচ্ছে হলোনা সুমনের, কিন্তু মামার সামনে খাবার রেখে ও চলেও যেতে পারছিলনা। সুমন ভুলে টিফিন বাটিটা চৌধুরী বাড়ি দিয়ে এসেছে শোনার পর থেকে একভাবে সুমনকে গালাগালি করেই চলেছে মঞ্জু, সমীর কয়েকবার মানা করা সত্বেও সে থামেনি।
সুমনকে মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখে সমীর এবার আর মঞ্জুর সাথে বাড়তি কথার মধ্যে গেলেন না। আস্তে করে নিজের প্লেট থেকে মুরগির রানের টুকরোটা সুমনের প্লেটে তুলে দিলেন। ব্যাপারটা মঞ্জুর চোখ এড়ালো না… তবে মুখ বন্ধ হলো আর সেটার ঝাল মেটাতে রান্নাঘরের বাসন – কোসন সব ঝনঝন করে মেঝেতে পড়তে লাগলো।
সুমন এসব দেখে অভ্যস্ত তাও ওর চোখজোড়া জলে ভাসছিলো। মামার সামনে যেটুকু না হলেই নয় তেমন কয়েক গাল খাবার মুখে দিয়েই খাবার ঘর থেকে উঠে এলো ও। আসার সময় ডাব্বুর প্লেটে মুরগির রানটা জোর করে গুঁজে দিয়ে আসতে ভুললো না সুমন।
আড়চোখে পুরো ঘটনাটা দেখে মেজাজ খুব খারাপ হলো প্রীতির। সুমনদি একটা ভুল করে ফেলেছে.. এটা নিয়ে এতো হাঙ্গামা করার কি আছে মায়ের? আর দোষতে মায়েরও ছিল, বলা নেই কওয়া নেই টিফিন বাটি ধরিয়ে দিয়েছে সুমনদির হাতে! এ বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে চৌধুরী বাড়িতেই কেবল খাবার যায়। সুমনদি বুঝবে কী করে যে ওটা আদিত্য বাবুর জন্য ছিলো, আর দিয়ে যখন ফেলেছে তখন সেটা নিয়ে চ্যাঁচামেচি করে লোক হাসানোর কী মানে? বড়মা ওদের দুবোনকেই পূজায় কাপড় দেয়… কই মা তো সেসময় কোন টু শব্দও করেনা, উল্টো খুশি হয়।
……………………
শ্রাবণ সবেমাত্র ভালো করে খেয়েদেয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছিলো, তার মধ্যেই থালা বাসনের প্রচন্ড ঝংকার শুনতে পেয়ে জায়গায় থেমে যেতে বাধ্য হলো।
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে শব্দের উৎসটা বোঝার চেষ্টা করলো শ্রাবন, তারপর গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, ” শব্দটা সমীর মামাদের বাড়ি থেকে আসছে নারে মুকুন্দ?”
“হ্যাঁ, ছোট দাদাবাবু…. সেই কখন থেকে চিৎকার চ্যাঁচামেচি চলছে, কান ঝালাপালা হয়ে গেল।”
মুকুন্দের কথায় শ্রাবণ হেসে ফেললো, চিৎকার করছে মানেই মঞ্জু মামী… নাহলে ও বাড়িতে এতো জোরে চিৎকার করে কেউ কথা বলে না। সমীর মামা তো একদম ঠান্ডা ধরনের একজন মানুষ, আর বাকী যারা তারা হিসেবে কোন শব্দই করে না। কিন্তু আবার এতো গোলমাল বাঁধল কি নিয়ে?
সুমনকে কয়েকবার কল দেওয়ার পরও শ্রাবনের একটা কল রিসিভ হলো না। তারমানে নির্ঘাত মামী, সুমোকেই ঝাড়ছে। কিন্তু দুপুরেই মা ওকে বেশ কয়েক পদের খাবার খেতে দিলো… বললো মঞ্জু মামী, সুমোকে দিয়ে পাঠিয়েছে। তাহলে একবেলায় মধ্যে আবার এমন অগ্নুৎপাতের কারনটা কি? অঘটনঘটনপটিয়সী কোন নতুন ঘটনা করে ফেলেননিতো?
শেষ পর্যন্ত পুরো ঘটনাটা শ্রাবণের কাছে খোলসা হলো প্রীতির সাথে কথা বলে। মঞ্জুমামীর রাগের কারন শুনে শ্রাবন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলনা। একবার মন চাইলো হো হো করে হাসে আবার মনে হলো এক্ষুনি মঞ্জু মামীকে দু’কথা শুনিয়ে দেয় সুমোকে বকার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে শ্রাবণের কিছুই করা হলো না। একবার ভাবলো মঞ্জু মামীকে বাজারের টাকাটা হাতে ধরিয়ে দেয়.. স্বার্থপর মহিলা একটা, কিন্তু পর মুহূর্তেই সেই আইডিয়াটাকে ময়লার বাস্কেটে ফেলে দিলো ও। টাকা পেলে আবার ওই আদিত্যকে খাবার রান্না করে পাঠাবে মঞ্জু মামী। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে শত্রুকে এমন জামাই আদর করে খাওয়ানের কোন সদিচ্ছা শ্রাবণের আদৌ নেই।
প্রীতি একটা কাজ কর দেখি বোন ”
”
” কি শ্রাবনদা? ”
“ফোনটা রেখে সুমোকে একবার বাইরে পাঠা দেখি, বলবি আমি গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি। খুব আর্জেন্ট দরকার.. কেমন।”
“আচ্ছা ”
সুমন বাইরে বের হয়ে আসতেই শ্রাবণ গাড়ি স্টার্ট দিলো।
“নে ওঠ…..”
শ্রাবণ পাশের সীটটা দেখিয়ে সুমনকে গাড়িতে বসতে বলতেই সুমনের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো। এখন ওর পক্ষে বাইরে যাওয়া একেবারে অসম্ভব। এমনিতেই সকালে এক ভুল করে সারাদিন মামীর গালমন্দ খেয়েছে ও আজ ,তাতে আবার এখন শ্রাবনদার সাথে বাইরে যেতে চেয়ে সেই অপরাধের ষোল কলা পূর্ন করতে চায় না ও।
“কি হলো আয়… ”
“না শ্রাবনদা, আমি এখন কোথাও যেতে পারবনা।আজ মামীর মেজাজ খুব খারাপ, তারমধ্যে বাইরে গিয়েছি শুনলে কি যে করবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ”
“বাইরে গিয়েছিস শুনলে রাগ হবে… না আমার সাথে গিয়েছিস শুনলে রাগ হবে?”
“মানে? ”
” মানে খাবার চারুদের বাড়ির বদলে আমাদের বাড়িতে গিয়েছে বলেই তো এতো গন্ডগোল.. নাকি? ”
এই যা .. শ্রাবনদা জানলো কি করে? ছি ছি কি লজ্জা। সুমন লজ্জায় উড়নার কোনা দাঁত দিয়ে কাটতে লাগলো।
“নে এবার ওঠ .. তোর পিছনে সময় নষ্ট করা ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে। ”
“কিন্তু শ্রাবনদা.. ”
শ্রাবন এবার আর কথা খরচ করলো না, গাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা সুমনের হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।
সুমন প্রতিবাদ করতে যেয়েও চুপ করে গেল। এখন কথা বললেই শ্রাবনদা ক্ষেপে যাবে। তার চেয়ে যা হচ্ছে হোক… মামীর গালি তো ও এমনিতেও খাচ্ছে প্রতিনিয়তো।
শ্রাবন একটা ভাল রেস্তোরাঁর সামনে এসে গাড়িটা থামালো।
“এখানে কেনো এলে শ্রাবনদা?” সুমন অবাক হবার ভান করলো।
“আগে ভিতরে চল… ওখানে গেলেই দেখতে পাবি।” শ্রাবন আগে আগে হেটে একটা টেবিল ঠিক করলো।
সুমন আবছা ভাবে বুঝতে পারছিল যে শ্রাবন ওকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে কিন্তু ব্যাপারটা সুমনের জন্য বড় লজ্জার। শ্রাবনদা নিশ্চই জেনে গেছে যে সুমন মামীর কাছে খুব বকা খেয়েছে আজ আর সেই সাথে বকা খাবার কারনটাও হয়তো তার অজানা নেই। সুমন যে আজ ভাত খায়নি সেটাও নিশ্চিত জেনে গেছে… সব মিলিয়ে নিজের এই ছোট্ট জীবনের এতো বিড়ম্বনা সুমনকে কেমন নাজেহাল করে তুললো। কেন ওর সাথেই এগুলো হয়.. কেন আদিত্যর বদলে ওর মন শ্রাবনদার দিকেই ছোটে, কেন এতো বেহায়া ওর মনটা… মনে মনে নিজেকেই শাপ শাপান্ত করতে লাগলো সুমন।
ওয়েটার সামনে আসতেই মেন্যুবুক ঘেটে অনেকগুলো খাবারের অর্ডার দিল শ্রাবন। বোকাটা আজ উল্টোেপাল্টা করে খুব ঝার খেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। প্রীতি বললো খেতে বসেও নাকি মঞ্জু মামীর কাছ থেকে রেহাই পায়নি সুমো । শ্রাবনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, সুমোর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দেয় কিন্তু তাতে সুমোর কেঁদে ফেলার সম্ভাবনা আছে, এমনিতেই চোখমুখের চেহারা খুব বেশি সুবিধার দেখাচ্ছে না।
খাবার আসতেই সুমনের প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলো শ্রাবন।
“আমি এতো খাবোনা শ্রাবনদা.. খানিক আগেই মাত্র খেয়েছি।”
“একদম কোন এক্সকিউজ দিবি না। যা দিয়েছি সব তোর ফেভারিট আইটেম, সো কোন রকম আরগুমেন্ট ছাড়াই খাবি।”
“আমি কোন এক্সকিউজ দিচ্ছি না শ্রাবনদা।”
” আবার কথা বলে, আগে খা… তারপর তোর কাছ থেকে পুরো রামায়ন কথা শুনবো আমি ,” শ্রাবণের কথা শুনে সুমন জায়গায় মুখে স্কচটেপ লাগালো। বকা কেন খেয়েছে সে কথা সুমন জন্মেও শ্রাবনদাকে বলতে পারবে না। সব শোনার পর শ্রাবনদা যদি দুষ্টুমি করেও ওকে জিজ্ঞেস করে বসে যে, আদিত্যর জন্য পাঠানো খাবার ও কেন বড়মার হাতে দিয়ে এলো তখন… সুমন কি উত্তর দিবে? কিভাবে বলবে আদিত্যর কথা ওর মাথাই ছিল না। একথা শুনলে এক শ্রাবনদার ভাবে মাটিতে পা পড়বেনা সাথে ওর দিকে বড় বড় চোখ করে জানতে চাইবে কেন আদিত্যর কথা মাথায় ছিল না। তখন এতো কথা সুমন কায়দা করে শ্রাবনদাকে বলতে পারবেনা, উল্টো নিজেই ধরা খেয়ে যাবে। আর ধরা খেলে সুমন কোথায় গিয়ে ডুবে মরবে?… আত্মঘাতী হতে ওর বড্ড ভয় করে।
………………………………………
রামনাথ চৌধুরী মুখে হাসবার চেষ্টা করলেও ভিতরে ভিতরে তার অন্তরটা আসলে পুড়ছিলো। শুধু পুড়ছিলো বললে ভুল হবে এ যেন দাবানল লেগেছে… গোটা অন্তরটা চড়চড় করে উঠছিলো, উহ্ কি অসহ্য এক ব্যাথা। আর জ্বলবে নাই বা কেন? এতোদিন পাহারা দিয়ে রেখে… তীরে এসে তরী ডুবলে কার ভাল লাগে?
“আপনার উপকার আমি কোনদিন ভুলতে পারবনা রামনাথদা … বিপদের দিনে আপনি আমার আর আমার পরিবারের জন্য যা করেছেন সে ঋন কোনদিন শোধ হবার নয়। তারপরও কোন ভুল হয়ে থাকলে এই ছোট ভাইটিকে নিজের ভাই মনে করে ক্ষমা করে দিবেন,” সমীর করজোড়ে মাফ চাইলো রামনাথ চৌধুরীর কাছে। একটু আগে আদিত্য এসে নিজের পুরো টাকাটা সমীরের হাতে তুলে দিয়েছে। সমীরও আর দেরী করেননি, দৌড়ে চলে এসেছেন টাকা পরিশোধ করার জন্য।
সমীরের কথাগুলো যেন বিষের ছিটের মতো লাগলো রামনাথের কাছে,” মায়াকান্না কেন দেখাচ্ছ সমীর.. সত্যি সত্যি নিজের দাদা মনে করলে কী আর এমন ভাবে টাকাগুলো ফেরত দিতে পারতে? সেদিন তোমার বৌদি হঠাত দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য আবদার করাতে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো হুট করে। জানোই তো মেয়ে মানুষ টাকা পয়সার সমস্যা একেবারেই বুঝতে চায়না, সাথে তার চিকিৎসার প্রয়োজন.. বাতের ব্যাথার জন্য, সেকারনেই তোমাকে সামনে পেয়ে ওরকম দুটো গরম কথা বলে ফেলেছিলাম। কিন্তু তাই বলে দুদিনের মধ্যেই বাড়ি বেঁচে সেটাকা আদায় করার কথা আমি বলিনি।”
“না.. না.. দাদা, বাড়ি আমি বিক্রি করিনি। আসলে সাহায্য করেছে যে ছেলেটা সে বড় ভাল মানুষ আর সৎ, এমন গুনী মানুষ সহজে চোখে পড়েনা।”
“ছেলেটা? কোন ছেলেটা?” রামনাথ চৌধুরী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। এ তল্লাটে কে এমন বড়লোক এলো যে সমীরকে সাহায্য করে।
“সেকথা বলতে নিষেধ আছে দাদা… নাহলে আপনাকে অবশ্যই জানাতাম,” সমীর মনে মনে জিভ কাটলো, এটুকু বলাও অনাবশ্যক ছিলো…. আদিত্য নিজের নামটা বলতে খুব করে না করে দিয়েছে।
“হমম… ভাল মানুষই মনে হচ্ছে তবে দেখো এই অতিমানব আবার তোমায় সুযোগ বুঝে বিপদে না ফেলে।”
সমীর চুপ করে রইলেন..
রামনাথ আলমারি খুলে জমির দলিলটার দিকে ভাল করে আরেকবার দেখলেন, তারপর অত্যন্ত তাচ্ছ্যিলের সাথে সমীরের সামনে ফেললেন। রামনাথ ঠিক কী কারনে এতো ক্ষিপ্ত সেটা বুঝতে না পারলেও সমীর, রামনাথের ক্রুর আচরনের সাথে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। তাই আর কোন প্রকার বাক্য ব্যায় না করে সেখান থেকে চলে আসাই উপযুক্ত মনে করলেন।
শ্রাবণ খাবার খাইয়ে, এক বাক্স আইসক্রিম আর দুটো গানের ডিস্ক কিনে দিয়ে সুমনকে বাসায় নামিয়ে দিল। আজ বিশেষ কাজে সুজয়ের বাড়ি যাচ্ছে ও। কিছুদিন চুপ থাকার পর গতকাল আবার তিন তিনটে মেসেজ পাঠিয়েছে লাবণ্য। প্রতিটা ম্যাসেজেই শ্রাবণের প্রতি ক্ষোভ ঝরে পড়ছে লাবণ্যর। ওদিকে সুজয় পারিবারিকভাবে লাবণ্যর বাবার কাছে ওদের বিয়ের জন্য প্রস্তাব রেখেছে, কিন্তু লাবণ্য কিছুতেই সুজয়ের সাথে বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না, বেচারা সুজয় এতে ভেঙ্গে পড়েছে।
শ্রাবন মৌমিতার মারফত সব জেনেছে। ও তাই আজ ঠিক করেছে যে লাবন্য আর ওর বিষয়টা নিয়ে সুজয়ের সাথে একেবারে খোলাখুলি আলাপ করবে। আর সুজয়কে যেটা সত্যি সেটাই বলবে… কোন রাখ ঢাক রাখবে না। শ্রাবণের এখন লাবণ্যর প্রতি বিশেষ কোন আগ্রহ আর কাজ করে না, যেটা ওকে দেখার প্রথম প্রথম হতো। কিন্তু বারবার বলা সত্বেও লাবণ্য সেটা মানতে নারাজ। এখন এর দায় শ্রাবণ কেন নিজের ঘাড়ে নিবে? ও তো লাবন্যকে কখনো প্রপোজ করেনি বরঞ্চ লাবণ্যই উল্টো ওর প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলো বলে তাকে শ্রাবণ এক কথায় ওকে না করেনি। যদিও এখন মনে হচ্ছে সেটাই করা উচিত ছিল ওর। কিন্তু তখন সুমোর জন্য ওর ভালোলাগাটা, ভালোবাসা হয়ে ঝরে পড়েনি, একবেলা না দেখলে হারাবার ভয় হয়নি, কাছে এলে ওই চোখে ডুবে যাওয়ার সাধ হয়নি। কিন্তু এখন অদ্ভুত এই ইচ্ছেগুলো রঙিন ঘুড়ি হয়ে ওর আকাশে দিনমান উড়ে বেড়ায়, এখন কী করে শ্রাবণ, লাবণ্যর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিবে?
সুজয়ের সাথে লাবণ্যর ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে শ্রাবণের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু তারপরও শ্রাবণ আজ মুখ খুললো। ওর কথায় সুজয় কতটা দুঃখিত হলো বলা মুশকিল তবে দুঃখ যে পেল এটা বুঝতে কোন সমস্যা হলোনা শ্রাবণের। নিজের কথা শেষ করে শ্রাবণ যখন বের হয়ে এলো,তখন আজ প্রথম বারের মতো সুজয় ওর সাথে সাথে নিচে নেমে এলোনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠলো শ্রাবণ, বিরবির করে বলে উঠলো, “মন বড় জটিল জিনিষ… কোথায়, কার জন্য, কেন যে সে বাঁধা পড়ে সে তা নিজেই জানে না।”
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে কি মনে করে আবার থামলো শ্রাবণ। সুমোর কি অবস্থা একটু দেখে যাওয়া উচিত, কেবল ওর জন্য খাবার দিয়ে আসতে গিয়েই এতোগুলো বকা হজম করেছে বোকা মেয়েটা। সুমোর জন্য ভালোবাসার পাহাড়ের গায়ে আরো খানিকটা ভালোবাসা জমা হলো আজ শ্রাবণের।
প্রীতিদের বাড়ির ভিতরে পা দিয়েই সরগরম আলোচনার আভাস পেল শ্রাবন। সেই সাথে মনটা একটু খারাপও হলো। আজকাল যখনই আসে তখনই আদিত্যর দেখা পায় শ্রাবণ এ বাড়িতে। সমীর মামার বিশেষ স্নেহভাজন বলে কি সব সময়ই এ বাড়িতে বসে থাকতে হবে নাকি আদিত্যর?
ওকে দেখেই সমীর মামা… আরে শ্রাবন, এসো… এসো বলে ডাকলেন। সেখানে বসতেই টেবিলের উপর অনেকগুলো ছবি দেখতে পেল শ্রাবণ।
“এগুলো কারা মামা? ”
“আর বলোনা বাবা.. আমাদের সুমনের জন্য অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে … তাই নিয়েই এতোক্ষণ অনেক আলোচনা হচ্ছিল আদিত্যর সাথে।”
সুমোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব! কোন শালার ঘাড়ে কটা মাথা দেখিতো… আগ্রহের সাথে ঝুকে সবগুলো ছবি নিয়ে একে একে দেখতে লাগলো শ্রাবণ। তার মধ্যে দু’একজন আবার বেশ পরিচিতও ঠেকলো ওর কাছে। খবর নিতে হবেতো বাছাধনদের….
“কিন্তু এদের মধ্যে কেউই নাকি সুমনের বর হবার যোগ্য নয়, তাই সবগুলোকেই না করে দেব মনে করছি,” সমীর বলে উঠলেন।
সমীরের কথা শুনে… শ্রাবণ আড়চোখে আদিত্যকে একবার দেখলো। কেন যে এদের কাউকেই আদিত্যর মনে ধরেনি আর কোনদিন ধরবেও না সেটা শ্রাবণ বেশ জানে, তবু আদিত্যকে খোঁচা দেওয়ার শখটা ও হাতছাড়া করতে পারলনা। বেশ চিন্তিত ভঙ্গিমায়, আফসোসের সুরে বলতে লাগলো, ” আমার তো দু’একটা পাত্রকে বেশ ভালোই লাগলো… শহরে নিজেদের ঘরবাড়ি আছে, পরিবারও ভালই মনে হচ্ছে। তা আদিত্য বাবুর এতো ভালো পাত্র পছন্দ হলোনা কেন? ”
আদিত্যর তখন উত্তর দেবার মতো অবস্থা নেই, সুমনের চিন্তা এখন তার দিনরাতের সঙ্গী হয়ে দাড়িয়েছে। নিজে তাই বিদেশে যাবার আগে যে করে হোক সমীরের মাথা থেকে সুমনের বিয়ের ভূতটা নামাতে ও ব্যাস্ত।
চলবে….