#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_১১_ও_১২
বাড়িতে এসে প্রথমে ফোন হাতে নিল আহনাফ! গতকাল রাত থেকে এখন অবদি ফোনের ধারেকাছে ছিল না সে। ফোন অন করতেই স্ক্রিনের সামনে অনেক মেসেজ ভেসে উঠলো। আহনাফ মেসেজ অপশনে ক্লিক করতেই দেখতে পেলো সবগুলো মেসেজ’ই তার দেওয়া। এতো মেসেজ পড়লো না। প্রথম মেসেজ শুধু “সরি” শব্দ টা পড়েই ফোন অফ করে রেখে দিল। বাকি মেসেজে তার অজুহাত ছিল! এতো অজুহাত চায় নি সে! বিছানায় ধপ করেই শুয়ে পড়ল সে। খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে, এখন একটু ঘুমোতে পারলে বোধহয় ভালো হতো।
আরমান সাহেব ছেলের ঘরের সামনে এলেন। গতকাল রাতে যে ছেলে বাড়িতে ছিল না এটা তার অজানা নয়। জানতেন শান্ত’র সাথেই ছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে নক করলেন না, সোজা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে আহনাফ! আরমান সাহেব বিছানার দিকে অগ্রসর হলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে তার আর ছেলের মাঝে দূরত্ব বেড়ে গেছে।
নিঝুম বাড়িতে এসেই ধপাস করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। আজ খুব ক্লান্ত সে। অনেক ঝড় বৃষ্টি গেছে আজ তার উপর! দুঃখ হচ্ছে খুব। আহনাফ আজ পর্যন্ত তার নাম’টাই জানতো না। এমনটা হতে পারে এটা ভেবেই অবাক হচ্ছিল। রাগ হচ্ছে খুব! রেগে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে তাতেই কামড়াতে লাগলো। তার ক্রাশ তার সাথে কথা বলছে, হাসছে অথচ তার নাম জানতো না। তাহলে তার কথা ভাবতো কি করে! নাকি আদৌও ভাবতো না। আহ! নিঝুম আর ভাবতেই পারছে না। হুট করেই জোরে চেঁচিয়ে উঠলো!
হিনা সবে স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা সোফায় রাখতেই চিৎকার শুনে থতবত খেয়ে গেল। নিঝুমের মা ঘর থেকে ছুটে এলেন কি হয়েছে বোঝার জন্য। দুইজনেই একসাথে ছুটে ঢুকলেন নিঝুমের ঘরে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন নিঝুমের দিকে। কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে নিঝুম। কি হলো মেয়েটার? পাগল হয়ে গেল নাকি?
মা বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বসলেন। নিঝুম চুপ হয়ে কোলবালিশ কামড়ে ধরল। মা গম্ভীর স্বরে বলে উঠেন,
“চিৎকার করছিস কেন? কি হয়েছে? ষাঁড়ের মতো একটা গলা। মেয়ে মানুষ এভাবে চিৎকার করে নাকি।
নিঝুম মাথা নাড়িয়ে বোঝাল কিছু হয় নি। মা ধপাস করে মাথায় বারি মেরে বলেন, তাহলে চেঁচামেচি করছিস কেন? পাগল কোথাকার!
আর কতো গুলো কথা বলে চলে গেলেন তিনি। নিঝুম পিছন ঘুরে মা’র চলে যাওয়া দেখতে লাগল। চোখ পড়ল হিনার দিকে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। নিঝুম উঠে বসল। চোখের চশমা খুলো রাখল সে। হিনা তার পাশে বসে বলল, কি হয়েছে রে আপা! তুই ওভাবে চিৎকার করলি কেন?
“কিছু হয় নি!
অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই হাঁটু উপুড় করে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল নিঝুম। হিনা ভ্রু কুঁচকে বলল, কিছু একটা তো হয়েছে, নাহলে কি তুই নতুন কিছু ঘটিয়েছিস!
“আমি কি ঘটাবো?
“সারাদিন আকাম না করলে বুঝি তোর পেটে ভাত হজম হয়!
নিঝুম রেগে বালিশ ছুঁড়ে মারল। চোখ চশমা না থাকায় বালিশ হিনা’র পাশে গিয়ে পড়ল। হিনা কুটকুট করে হেসে বেড়িয়ে গেল। নিঝুম রেগে আবারো বালিশে কামড় বসাল!
——-
শান্ত ঘরে একবার এপাশে যাচ্ছে আরেকবার ওপাশে। হাতের বাটিতে পাস্তা একটু পর পর মুখে দিচ্ছে আর হাসছে । রান্না ঘর থেকে তার সার্ভেন্ট দুজন উঁকি মেরে শান্ত কে দেখতে লাগল। শান্ত’র আচরণ অনেকটা অস্বাভাবিক! শান্ত চামচ দুই ঠোঁট দিয়ে আঁকড়ে ধরে হেসেই যাচ্ছে। অতঃপর চেয়ার টেনে বলে উঠে, মিস চশমিশ এখন ঝুম ঝুমাঝুম ঝুম! বলেই হেসে উঠলো।
হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়াল সার্ভেন্ট দুজন। শান্ত হাসি থামিয়ে তাদের দিকে ফিরল। একজন বলে উঠল,
“স্যার কাজ শেষ!
“ঠিক আছে যাও!
দুজনেই মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। শান্ত’র ঘরের যাবতীয় কাজ এরা দুজন’ই করে। দুপুর বেলা আসে আর সন্ধ্যা হবার পর পরই চলে যায়। আজও তার ব্যতীক্রম হলো না। শান্ত এবার চেয়ার ছেড়ে সোফায় এসে বসল! পুরো ফ্লাটে এখন সে একা! কোন কাজ নেই তার। টিভি অন করে একটা মুভি দেখতে শুরু করল। মুভি তে নায়িকার চোখে চশমা দেখেই মিস চশমিশ’র কথা মনে পড়ল। ঝুমের মুখটা তখন দেখাল মতো। এবার হাসতে হাসতে সোফায় শুয়ে পড়ল শান্ত। নামটা আসলেই অনেক সুন্দর! ঝুম ঝুমাঝুম ঝুম!
কলিং বেল বেজে উঠল। শান্ত হাসি থামিয়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরল। কে এলো এখন? কারো আসার কথা ছিল। মনে করতে পারল না। শান্ত উঁকি দিয়ে দেখল আহিম, আফিন আর নীলাভ্র! ওরা এখানে মানেই আজ সারারাত আড্ডা দিবে। আর তাই হলো। চারজন মিলে সারারাত আড্ডা দিল। মাঝরাতে শান্ত’র ঘুম ভাঙতেই দেখল মেঝেতে ঘুমিয়েছিল সে। উঠে দাঁড়িয়ে দেখল একেকজন একেক জায়গায় শুয়ে আছে কোনভাবে। বিয়ারের বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। শান্ত একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা ফেলে নিজের বিছানায় এসে বসল। বিছানায় এক কোনেই নীলাভ্র শুয়ে ছিল। শান্ত ধপাস করে তাকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল!
——
আরমান সাহেব খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে তার ছেলের জন্য। ইফা গিয়ে একবার ডেকে এসেছিল। এতোক্ষণে তো এসে পড়ার কথা। খানিকক্ষণ পরেই আহনাফ কে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা হলো।
খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে আরমান সাহেব বলে উঠেন, ভার্সিটিতে তোমাদের বাড়াবাড়ি বেড়ে যাচ্ছে!
আহনাফ বাবার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু বলল, কেন কেউ কিছু বলেছে!
“তোমাদের ব্যাপারে কেউ এসে অভিযোগ করবে এটা কার সাধ্যি! কিন্তু তাই বলে এভাবে আর কতোদিন চলবে। ঠিক একদিন না একদিন কেউ তো এসে অভিযোগ করলে তখন তোমাদের কাউকেই ছেড়ে দেব না আমি। একজন বাবা না প্রিন্সিপাল হয়েই পানিশমেন্ট দেবো তোমাদের!
আহনাফ আর কথা বাড়াল না। ইফা নিজের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে আরমান সাহেব আর আহনাফ কে খাবার সাধছে সে! আরমান সাহেব আবারো গম্ভীর স্বরে বলে উঠেন,”শান্ত কে একটু শান্ত থাকো বলো!
“তুমি জানো ও কারো কথা শুনতে চায় না।
“কিন্তু তোমার কথা তো শুনে, একটু দেখে শুনে রাখতে পারো। ছেলেটার উপর খুব মায়া লাগে বলে কিছু বলতে পারি না। ছোট থেকেই অনেক কিছু সয়েছে। ভালো সঙ্গ থাকলে নাকি সেও ভালো হয়। কিন্তু তোমাদের বেলায় দেখছি অন্যরকম। কেউই বদলাচ্ছো না তোমরা। না তুমি বদলেছো আর না ও!
“আমরা যে যেমন তেমনি ভালো লাগে আমাদের। পরিবর্তন হবার কোন দরকার নেই।
আরমান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর বলেন, “শান্ত’র বাবা সেদিন ফোন করেছিল!
আহনাফ শক্ত গলায় বলল, তার ব্যাপারে একটা কথা বললে আমি এখান থেকে উঠে চলে যাবো।
আরমান সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। ইফা পরিবেশ ঠিক করতে কিছু মজার কথা বলতে শুরু করল। আরমান আর ইফা হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু আহনাফের মুখে কোন হাসির রেখা দেখা গেল না। অনেকটা গম্ভীরতা নিয়েই খাওয়া শেষ করে উঠে গেল সে। সবসময় এমনটা হয় না, শুধু শান্ত’র বাবার কথা তোলায় তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। অতঃপর দ্রুত খাবার শেষ করে ঘরে চলে গেল। আরমান সাহেব ছেলের চলে যাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলের অভিমান বুঝতে পারে সে।
আহনাফ ঘরে এসে বিছানার দিকে তাকাল। বিছানার পেছনে দেওয়ালে ছবি আঁকা! তার আর শান্ত’র ছোট বেলার ছবি। শান্ত খুব জেদি, রাগ উঠলে মাথা ঠিক না ওর। কখনো হারতে চাইতো না সে। কিন্তু ওর এখনো মনে আছে এই ছোট্ট শান্ত’ই একদিন খুব কাঁদছিল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। ফুটপাতে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যাচ্ছিল সে। কতোই বা বয়স হবে তখন, এই ১০ বছরের একটা ছোট্ট ছেলে। আহনাফ সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিল তখন। রাত কম হয় নি, পুরো রাস্তাই অন্ধকার ছিল! আহনাফের চেনা জানা সব জায়গায় খুঁজল সে শান্ত কে। অবশেষে একটা কফি শপের বাইরে দেখতে পেলো সে শান্ত কে। দোকানের বাইরে বসে কাঁদছিল শান্ত। তার পুরো শরীর কাঁপছিল। আহনাফ সাইকেল রেখে হেঁটে এলো তার কাছে। শান্ত’কে ডাকতেই মুখ ফিরে তাকাল সে। মুখের কপালে আ*ঘাত, ঠোঁট কেটে র*ক্ত পড়ছে। গালের এদিকটাও ফুলে উঠেছে এতোক্ষণে। ফর্সা মুখখানা কান্নার প্রভাবে লাল হয়ে গেছে। ছোট একটা বাচ্চার মতো কাঁদছে সে। মনে হচ্ছে ৫ বছরের কোন বাচ্চা রাস্তায় হামাগুড়ি খেয়ে কাঁদছে। গায়ের জামায় ময়লা লেগে আছে। আহনাফ বসল শান্ত’র সামনে। বলে উঠল, তুই আন্টির কাছে গেছিল!
শান্ত’র কান্না তখন বেড়ে গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আ..আমি খুব ভয় পেয়েছি আহনাফ। আম্মু কথা বলেনি আমার সাথে। অ…অনেক অন্ধকার ছিল সেখানে। দেখ আমি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি!
বলেই হাত দেখাতে লাগলো আহনাফ কে। আহনাফ তাকিয়ে দেখল হাত ছি*লে রক্ত পড়ছে। খেয়াল করল পড়া প্যান্ট টাও ছিঁড়ে গেছে হাঁটুর কাছে। আহনাফ তখন শান্ত’র হাতে ফু দিয়ে বলল, আমি ফু দিয়ে দিচ্ছি দেখবি ব্যাথা কমে যাবে!
শান্ত কান্না থামিয়ে দিল। আহনাফ তার ছোট হাত দুটো ধরে ফু দিতে লাগলো। অতঃপর নিজের পকেটে হাত দেখল টাকা আছে। শান্ত’র দিকে ফিরে হেসে বলল, আইসক্রিম খাবি, আমার কাছে টাকা আছে!
শান্ত মাথা নাড়ল। অতঃপর আহনাফের সাথে দাঁড়িয়ে গেল সে। আহনাফ শান্ত’র হাত ধরতে গিয়ে দেখল তার হাতের ডগায় লাল দাগ হয়ে আছে। কিন্তু সেটা কিসের দাগ তখন বুঝতে পারি নি আহনাফ। কিন্তু এখন বুঝতে পারে এটা ছিল বেঁধে রাখার দাগ। শান্ত কে মারধর করে বেঁধে রাখা হয়েছিল! ছোট বেলার অনেক স্মৃতিই মনে থাকে না কারো। কিন্তু শান্ত’র এই ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে আহনাফের। এখন এসব মনে পড়লে রাগে তার শরীর কম্পিত হয়।
হঠাৎ করেই ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে বেলকনির দিকে আগাল। ওপাশ থেকে মিষ্টি গলার স্বর ভেসে এলো,
“সরি! প্লিজ রাগ করো না। আসলে কি হয়েছিল জানো…
আহনাফ কিঞ্চিত হেসে বলল, বাদ দাও! আমি ভুলে গেছি!
“সত্যি!
“হুম!
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল। আহনাফের মন এখন শান্ত হলো। মুহূর্তেই সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করল তার। সেই গম্ভীরতা এখন আর নেই তার মাঝে। অনেক রাত অবদি গল্প করল তার সাথে। কথায় কথায় তার মিষ্টি হাসির শব্দ শুনতে পেল আহনাফ। তখন তার ঠোঁটের কোনেও হাসির রেখা দেখা যেত!
——
গত ৩ দিন হলো, শান্ত রোজ’ই এখন ভার্সিটিতে এসে বোর হচ্ছে। কারণ জ্বালানোর জন্য মিস চশমিস যে নেই। গত কয়েকদিন ধরে কোন খোঁজ খবর নেই তার। আজও কি আসবে, আসলে তো এতোক্ষণে দেখতো তাকে! আহিম পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে শান্ত একবার ভার্সিটির গেটের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার এদিকে। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। আহিম বলে উঠল,
“কার অপেক্ষা করছে? মিস চশমিশ বিড়ালের।
“কয়দিন হলো বল তো আসে না। কি হয়েছে কে জানে?
“মনে হয় বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে।
“তেমনটা হলেও জানতে পারতাম।
“তাই! কিভাবে জানতি।
শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে আহিমের দিকে তাকাল। আহিম ভ্রু কুঁচকালো। শান্ত উহুম উহুম করে বলল, মিস ঝুম তো ইফা’র বেস্টু! তাই বিয়ে হলে তো ইফা সেটা আহনাফ কে বলতো আর আহনাফ আমাকে!
“২% হলেও কথায় লজিক ছিল তাই কিছু বললাম না।
“মানে কি বলতে চাস তুই।
আহিম হাসল। এই হাসির রহস্য আবার কি? আহিম সামনে ইশারা করে দেখাল তিথি কে। চকলেট খেতে খেতে হেলতে দুলতে আসছে সে। শান্ত আর আহিম এসে হুট করেই দাঁড়াল ওর সামনে। বেচারা তিথি ভড়কে গিয়ে হোচট খেল। কোনমতে সামলে বলল,
“আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া!
আহিম বলল, ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?
“জ্বি ভাইয়া অনেক ভালো!
শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, তা তোমার বেস্টুর খবর কি?
“কে নিঝুম!
আহিম হেসে শান্ত’র দিকে তাকিয়ে বলল, হুম মিস চশমিশ!
তিথি গলা পরিষ্কার করে বলল, ভাইয়া ওর তো বিয়ে!
শান্ত আর আহিম দুজনেই চমকে উঠে বললো, কিহ?
শান্ত অবাক চোখে তাকাল আহিমের দিকে। আহিম হতচকিয়ে বলল, “আরে আমি তো এভাবেই বলেছিলাম! সত্যি আমি কিছু জানি না।
তিথি বলে উঠল, আরে পুরো কথা তো শুনুন! বিয়ের দাওয়াত পেয়েছে, সেখানে গেছে। ওর হামমম কাজিন হ্যাঁ ফুফাতো বোনের বিয়ে সেখানে গেছে। সাপ্তাহ খানিক লাগবে আসতে!
শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, আর্ধেক কথা মুখে রেখে বলো কেন?
তিথি এক গাল হেসে বলল, সরি ভাইয়া। এখন আমি আসি!
শান্ত তিথি’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, আপনার হাসিটা সুন্দর, আসেন!
তিথি লজ্জা পেয়ে চলে গেল। আহিম হেসে বলে, “পাগল মেয়ে একটা! বাই দ্যা রাস্তা বিয়ের কথা শুনে তুই এমন হতচকিয়ে গেলি কেন?
“মানে?
“মানে যেভাবে শক খেলি, মনে হচ্ছিল!
“তো কি মনে হচ্ছিল!
“বিরহ!
“কিহহ?
“ওই দেখ তানিশা বিরহ হাতে এদিকে আসছে!
শান্ত ওদিকে ফিরল, দূর থেকে তানিশা কে দেখা গেলো রেগে ফুসফুস করে আসতে। তার হাতে ফুটন্ত কাঠগোলাপ দেখে মুখ টিপে হাসল দুজন। এখন জোরে হাসলেই বিপদ!
“কি হয়েছে?
তানিশা রেগে শান্ত’র হাতে ফুল টা থপ করে দিয়ে চলে গেলো। তানিশা যেতেই দুজন হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। শান্ত হাসতে হাসতে তাকাল ফুলের দিকে। এই ফুলের স্নিগ্ধতা অনেক! প্রতিবার এই স্নিগ্ধতা মুখরিত করে শান্ত কে।
——
কয়েকদিন পর,
চিরচেনা সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিঝুম। রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে দেখছে ভার্সিটির গেট। রাস্তা পার হয়ে আসতে হবে এদিকে। গাড়ি চলাচল তেমন একটা নেই রাস্তায়! নিঝুম পা এগিয়ে চলতে লাগল।
ভার্সিটিতে এসেই খানিকটা অন্যরকম লাগলো, আজকের পরিবেশ কেমন অগোছালো। কিছু একটা বোধহয় হয়েছে। সবাই বলাবলি করছে, আবার হাসছেও। নিঝুম ভাবতে লাগল, এর মানে সে ছাড়াও আরো অনেকের সাথেই তাহলে অনেক কিছু হয়।
ভার্সিটিতে প্রবেশ করতেই দেখল কয়েক জায়গায় বেশ ভিড়। দেওয়ালে কি কিছু তাহলে টাঙানো হলো। নোটিশ বোর্ডের দিকে আগাল সে। ভিড় কম নয় সেখানেও। হাসাহাসির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। নিঝুম চোখের চশমা ঠিক করে উঁকি মেরে দেখতে লাগল। ভিড় কিছুটা কমলো। ঠ্যালাঠ্যালি সামলে সামনে এসে পড়ল নিঝুম। কিছু একটা টাঙানো হয়েছে, নিঝুম ঠিক করে দেখার চেষ্টা করলো। যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ! পোস্টারে বড় বড় করে লেখা She is a great fool!
নিঝুমের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ছবিটা ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলো সে। এটা কি তার ছবি! না না এটা সে না! তাহলে কে? কিছুক্ষণ ভালো করে তাকিয়ে থাকার পর মনে পড়ল এই মেয়েটার চেহারা। নাম জানে তবে সেদিন যে মেয়ে গুলো তানিশার সামনে তার ব্যাপারে মিথ্যে অভিযোগ করেছিল এটা সেই মেয়ে! নিঝুম ঢোক গিলল। এই মেয়েটার হাল মারাত্মক, মাথায় কি সব ঢেলে দিয়ে তার উপর একটা ফুল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কি লজ্জাজনক ব্যাপার এটা। নিঝুম তাকিয়ে দেখল পুরো ভার্সিটি জুড়েই এই পোস্টার। খারাপ লাগছে মেয়েটার কথা ভেবে, না জানি তার মনের অবস্থা কেমন হবে!
বলতে বলতে মেয়েটা এসে হাজির! সবাই আঙুল তুলছে মেয়েটা কে। হাসাহাসিও করছে অনেকে। কাল যারা মেয়েটার বন্ধু ছিল আজ তারাও ওকে দেখে দূরে সরে গেল। নিঝুম করুণ ভাবে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে সময় নিল না। আশপাশের পোস্টার সবই চোখে পড়ল তার। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। নিঝুমও দৌড়াল তার পিছনে কিন্তু তাকে আর পেলো না। এর আগেই গাড়িতে উঠে চলে গেলো সে। হাঁফাতে লাগলো নিঝুম! খুব রাগ হচ্ছে তার,এতোটা ঘৃণ্য কাজ কে করতে পারে। তার মনে কি আদৌও একটু মায়া ছিল না। মেয়েটা যদি এখন কিছু একটা করে বসে তাহলে কি হবে? ভাবতেই নিঝুমের হৃৎস্পন্দন বাড়তে লাগল। বুকে হাত রেখে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগলো সে। আবারো হেঁটে এসে দাঁড়াল সেই পোস্টারের সামনে। রাগে হাত বাড়াল পোস্টার ছিড়ার জন্য। তখন’ই হঠাৎ কানে এলো প্রিন্সিপাল স্যার। নিঝুম ফিরে তাকাল। সত্যি প্রিন্সিপাল আসছে, এসে তার পাশেই দাঁড়ালো। নিঝুম একটু সরে গিয়ে সালাম দিল। কিন্তু স্যার হয়তো কথাটা কানে নেয় নি। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পোস্টারের দিকে। তার সাথে থাকা দুজন স্যার প্রিন্সিপালের কানের কাছে বললেন, এটা শান্ত ওদের কাজ! গতকাল ওরাই নাকি মেয়েটা কে হেনস্তা করছিল। প্রিন্সিপাল স্যার গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর চলে গেলেন। নিঝুম পোস্টারের দিকে তাকিয়ে রইল। বলতে শুরু করল, আমি আসলেই বোকা! এ কাজ শুধু একজন’ই করতে পারে। আর এটা ওই অশান্ত! এসব অনাসৃষ্টি কাজ একমাত্র উনিই করতে পারেন। ( দাঁতে দাঁত চেপে বলল ) গ্যাং ডেভিল!
বলেই পোস্টার টেনে ছিঁড়ে ফেলল সে। আরো কয়েকটা পোস্টার ছিঁড়তে লাগল এভাবে। অতঃপর শান্ত’র খোঁজে পা বাড়াতেই সামনে এসে দাঁড়াল তিথি,
“কিরে কোথায় যাচ্ছিস?
“সর এখান থেকে।
“নিঝুম পাগলামি করিস না, আমাদের মাঝখানে পড়ার কোন দরকার নেই।
“কেন নেই, যদি এখন মেয়েটা কিছু একটা করে বসে তাহলে কি তুই পারবি নিজেকে বোঝাতে। পারবি নিজেকে ক্ষমা করতে। একটুও খারাপ লাগবে না তোর। কেন কিছু করার সাধ্য থাকার পরও কিছু করলাম না আমরা।
“নিঝুম আমি বুঝতে পারছি কিন্তু তুই শোন…
নিঝুম কিছু শুনল না। তিথি তার পিছনেই যেতে লাগল।
শান্ত কে পাওয়া গেল ক্যাম্পাসের ওখানে বড় বট গাছের নিচে। সবাই ওখানেই আড্ডা দিচ্ছিল তারা। নিঝুম বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল শান্ত’র দিকে। শান্ত’র চোখ তখন অবদি পড়ে নি নিঝুমের উপর। নিঝুম হন হন করে এগিয়ে এসে দাঁড়াল শান্ত’র সামনে। শান্ত নিঝুম কে দেখে বলে উঠল,
“আরে মিস চশমিশ যে…
বাকি কথা বলার আগেই চট করে একটা চড় মেরে বসল নিঝুম। উপস্থিত থাকা সকলে হতচকিয়ে উঠলো। তানিশা আকস্মিক ভাবে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। আফিন, আহিম আর নীলাভ্র অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। কিন্তু এতো কিছুর মাঝে উপস্থিত ছিল না আহনাফ। এখন অবদি ভার্সিটিতে আসি নি সে। শান্ত চোয়াল শক্ত করে রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রইল। তিথি ভয়ে হাত কামড়াতে শুরু করল। চারদিক তাকিয়ে ইফা কে খুঁজতে লাগল সে।
নিঝুমের দৃষ্টি স্থির! হাতের পোস্টার গুলো ছুঁড়ে মারল শান্ত’র মুখে। রিয়া আর দিয়া থতমত খেয়ে গেল।তানিশা রেগে এগিয়ে আসতে নিতেই রিয়া তাকে থামিয়ে দিল। তানিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, তোমার এতোটা সাহস হয় কি রে?
নিঝুম সেই কথা পাত্তা দিল না। শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নিঝুমের দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ওয়াট দ্যা হেল..
“সাহস কি করে হয় আপনার!
শান্ত ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিঝুম শান্ত’র দিকে আরেক পা এগিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলে, এমনটা কিভাবে করতে পারেন আপনি। মেয়েদের সম্মান করতে জানেন না। একটা মেয়েকে এতোটা হেনস্থা করেন কি করে? একবারও ভেবেছেন এই মেয়েটার কথা। যার মান সম্মান নিয়ে এই খেলা খেললেন তার মান সম্মানের কথা একবার ভাবা উচিত ছিল না আপনার ,কি হলো বলুন! চুপ করে আছেন কেন?
শান্ত ঠোঁট কামড়ে বলল, তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই!
“মানে, মানে কি বলতে চান আপনি। যা মন চায় যখন মন চায় তাই করবেন। কি ভাবেন আপনি নিজেকে। কি মনে করেছেন কি ? কেউ কখনো প্রতিবাদ করবে না এসবের। ভালো লাগে এসব করে, একটা মেয়ের সাথে এমনটা করে মজা পান আপনি। শুধু আপনি না আপনারা সবাই! মানে আমি বুঝতে পারি না কি মাটি দিয়ে তৈরি আপনারা। এতোটা নির্মম হৃদয় কি করে হয় আপনাদের!
ঘন শ্বাস নিতে নিতে শান্ত’র দিকে তাকিয়ে রইল নিঝুম। শান্ত চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, এই জন্য তুমি চড় মারলে আমায়। আমায় মারলে..
“হ্যাঁ আপনাকে , আপনাকে মেরেছি চড়। একরম একটা ঘৃণ্য কাজের জন্য চড় মারাই উচিত আপনাকে। শুধু চড় না আরো অনেক কিছুই দরকার।
“তা সেগুলো করবে না। শুধু কি চড় মারবে!
নিঝুম কপাল কুঁচকে নিল। শান্ত হেসে উঠলো। অতঃপর ঠোঁট কামড় বলল, “কাজটা ঠিক করো নি! শান্ত কে চড় মেরেছ? এর দাম সুদে আসলে পাবে তুমি।
“ছিঃ! এতোটা নিচ আপনি। এতোটা নিচ কিভাবে হতে পারেন আপনি!
শান্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তা আমি তোমায় বলবো না। সরো আমার সামনে থেকে!
বলেই নিঝুমের হাত ধরে তাকে ছুড়ে ফেলল সামনে থেকে। নিঝুম অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। এমন কাজের জন্য এতোটুকু খারাপ লাগছে না শান্ত’র। বড়ই অবাক হচ্ছে সে। শান্ত চলে গেল। তার পেছন পেছন সবাই গেল। তানিশা এসে নিঝুমের সামনে দাঁড়াল। শুধু মাত্র রাগের মাত্রা টা বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। নিঝুম সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ইফা আর তিথি দৌড়ে এলো তার কাছে!
——–
আহনাফ সবে গাড়ি পার্ক করে ভার্সিটিতে ঢুকল। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে এসব পোস্টার দেখে চোখ আটকে গেলো তার। গতকালের কথা পড়ল তার – আহনাফ হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসে এসে দাঁড়াল। তখনই দেখতে পেল শান্ত’র সামনে একটা মেয়ে মাটিতে বসে আছে। কিছু একটা হয়েছে তখন’ই বুঝতে পারলো। এর মাঝেই তানিশা এসে ধপ করে মেয়েটার মাথায় একটা কেক ফেলে দিল। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল। ভেবেছিল ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না, আজ এইসব পোস্টার বলে দিচ্ছে সব এখানে শেষ হয় নি।
শান্ত এসে বসল নিজের গাড়িতে। আহিম আর আফিন মানা করছে অনেক। কিন্তু কোন কথা শুনছে না সে। কাউকে সাথে না নিয়েই গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে গেল সে। নীলাভ্র ছুটে গেল আহনাফ কে কল করতে!
নিঝুম কারো কথাই শুনছে না। সব গুলো পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে সে। ইফা বা তিথি কারো কথাই কানে দিচ্ছে না। হঠাৎ করেই চোখ পড়ল আহনাফের দিকে। সেও দেওয়ালের পোস্টার ছিঁড়ছে। নিঝুমের মাথায় রাগ চড়ে বসল। হন হন করে হেঁটে এসে দাঁড়াল আহনাফের সামনে। বলে উঠল,
“এখন এসব করে লাভ কি? যখন এসব হচ্ছিল তখন কি আপনি আটকাতে পারেন নি!
আহনাফ নিঝুমের দিকে ফিরল। চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারো পোস্টার ছিঁড়তে শুরু করল সে। নিঝুম আবারো বলে উঠল,
“আপনারা কেন এমন বলুন তো।
“সব মানুষ সমান হয় না।
“নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে ভালো প্রমাণ করছেন।
“ও যেমন বেশি ভালো না তেমন না বেশি খারাপ ও না।
“ওহ তাহলে বলছেন এভাবে এই মেয়েটার মান সম্মান নষ্ট করা ভালো কাজ।
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ যেচে না এলে শান্ত কখনোই কিছু করে না।
“অবিশ্বাস্য! আপনাদের বন্ধুত্ব দেখে অবাক হই। কি করেছিল মেয়েটা। বেশির থেকে বেশি হলেই প্রপোজ’ই তো, কি তাই নয় কি? ভালোবাসা কি অপরাধ! যদি তাই হয় তাহলে আপনি কেন ভালোবাসার এড়িয়ে যাবার পথেও ফুল ছুড়ে দেন বলুন!
আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিঝুমের দিকে। রাগে কাঁপছে নিঝুম। হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠলো আহনাফের। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই অবাক কন্ঠে নিঝুম কে বলল, “তুমি শান্ত কে চড় মেরেছ!
নিঝুম চোয়াল শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ মেরেছি!
অতঃপর হন হন করে হেঁটে চলে গেল নিঝুম! আহনাফ বলে উঠল, আমি আসছি। অতঃপর কল কেটে ছুটতে লাগলো সে!
#চলবে….