তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৭০ ও শেষ

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৭০

রিয়া হাতের চুড়ি গুলো ঠিক করে চেঁচিয়ে বলল, “হলো তোমার? আর কতোক্ষণ লাগবে। বলি আমরা কি বিয়ে শেষ হলো যাবো!”
বাড়ির বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ আসছে। রিয়া আবারো চেঁচিয়ে বলল, “দিয়া গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে,‌তোমার কি এখনো হলো না। এতো কিসের সময় লাগছে তোমার। বর তো তুমি না!” আফিন দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে বলল,‌”সে তো বিয়ে হয়ে গেল এই ছ’মাস! এখনি দ্বিতীয় বিয়ের কথা কেন তুলছে।”
রিয়া দাঁত কামড়ে পায়ের জুতো খুলতে নিল।আফিন হাসতে হাসতে এগিয়ে বলল,‌”এই মজা করছিলাম, রেগে যাচ্ছো , কেন? চলো, চলো!”রিয়া রেগে অস্থির হয়ে রওনা হলো।
দিয়া সানগ্লাস নামিয়ে আফিন আর রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “বলি আজ তো তোদের বিয়ে না, একটু আগে আসলেই পারতি।

“এখন সকাল ৯ টা বাজে, বর যাত্রী নিশ্চয় এখন রওনা দিবে না।”

“তা দেবে না,‌কিন্তু বর কে তো আপনার তৈরি করতে হবে সেটা ভুলে গেছেন, দুলাভাই!

আফিন মুখ ভেংচি কেটে গাড়িতে বসে বলল,‌‌”রাখ তোর দুলাভাই। ভুলে যাস না তুই আমার বান্ধবী!

“শ্যালিকা কি অনেক নাকি!”

“না বেশি না, তিনটা! এতেই অস্থির আমি। রাত দিন শুধু ফোন করে করে..
বাকি কথা শেষ করা গেলো না রিয়ার চোখ রাঙানিতে।‌বেচারা আফিন পাক্কা ফেঁসে গেছে। দিয়া হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল।

আহনাফ শব্দ করে শ্বাস ফেলল। ফোন রিসিভ করে বলল, “বলো!

“শান্ত উঠেছে!

“না, এখনো উঠেনি।

“১০ টা বাজতে চলল, ও এখনো কি করছে?

“ঘুমোচ্ছে।

“সব দোষ তোমার। বার বার করে বললাম দেরি করে ঘুমোতে না। উঠাও এবার ওকে!

“তানিশা!

থপ করে ফোনটা কেটে গেল।‌ আহনাফ আবারো ডাকতে শুরু করল,‌শান্ত! এই শান্ত! উঠ না ভাই!

শান্ত এবার ওপাশ হয়ে ওদিকে গেল। ও ঘুমিয়েছে ৭ টার দিকে। এখন উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। ঘণ্টার আওয়াজ আসছে, মিনি আর অমিও ঘরে ঢুকেছে। আহনাফ শান্ত উঠানোর সব চেষ্টা করছে। তড়িখড়ি করে ঘরে ঢুকল নীলাভ্র, আহিম আর আহিম। তিনজন’ই আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,‌ “ও এখানো ঘুমায়!

আহনাফ হাসল। আশালতা ঘরে ঢুকে চোখ কপালে। ছেলে এখনো ঘুমাচ্ছে।‌ সেও কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করল। এতে কাজের কিছু হয় নি, শান্ত বরং চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এবার আর বরযাত্রী যাওয়া হবে না।

আহিম দাঁত বের করে হেসে বলল, “বরযাত্রী যাবে কিন্তু বর যাবে না, এটা বল!

“বর না গেলে বিয়ে হবে কার।

নীলাভ্র ফোন হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “তাহলে তো আজ আর বিয়ে হবে না। আমি বরং নিঝুম কে ফোন করে বলি, বিয়ে ক্যান্সেল!
অতঃপর ফোন করল। ফোন বাজতেও শুরু করল। স্পিকার অন করা! দু’বার রিং হতেই শান্ত লাফ মেরে উঠলো। নীলাভ্র ফোন কেটে দিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। আফিন‌ কোমরে হাত রেখে বলল, ওর হাল তো আমার থেকেও খারাপ। বিয়ের আগেই বউয়ের নাম মরি মরি অবস্থা। আমার অবস্থা টা দেখ। রিয়ার জ্বালায় শেষ আমি!
দরজার আড়াল থেকে রিয়া বলে উঠল, “কিছু বললে তুমি!
আফিন হকচকিয়ে গেল।‌ মাথা দুলিয়ে বলল,‌”না তো। এই তো শান্ত উঠে গেছে।‌ চল ভাই উঠে পড়। অনেক কাজ আছে!
“আমি এখন এক কাপ কফি খাবো, এর আগে এখান থেকে উঠবো না।
আশালতা ছেলের জন্য কফি আনতে আবারো নিচে গেল! এতো গেল বরের বাড়ির অবস্থা! এবার আসি কনে বাড়ির‌‌ খবর নিয়ে। নিঝুম এই নিয়ে তিন বার তার বিয়ের লেহেঙ্গা পড়ে ট্রাই করছে। দু’বার বিয়ের আগে,‌আজ বিয়ের দিন। লেহেঙ্গা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচছে। লাল রঙের এই লেহেঙ্গায় তাকে বেশ বানিয়েছে। শত সেলফি তুলে ফেলেছে সাজগোজ করাবার আগেই। তানিশা দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলল, “এভাবেই বিয়ে করতে চলে যাবো।

“এই ভাবেই তো আমাকে বেশ লাগছে তাই না।

“ফালতু বক বক রাখো! নাস্তা খেয়ে নাও। এরপর তৈরি হয়ে বসো,‌পার্লার থেকে লোকজন আসবে।

নিঝুম এগিয়ে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, তোমার বিয়ে কবে হবে?

“জানি না!

“জানি না মানে,‌আহনাফ কে জিজ্ঞেস করো নি!

তানিশা জবাব নি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এই মেয়েটা কিছু বুঝতে চায় না। শুধু কথা ঘুরাবে। তিথি আর ইফা খেতে বসেছে। তানিশা এসে সেখানে বসল। হিনা চায়ের কাপ রাখল। তানিশা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল। মঈনুল হক কে আসতে দেখা যাচ্ছে। তিনি এসে নিঝুমের কথা জিজ্ঞেস করলেন। হিনা বলল, “ও ঘরেই আছে!”

মঈনুল হক সেদিকে রওনা দিলেন। দরজার সামনে দেখলেন নিঝুম বিয়ের লেহেঙ্গা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। বড় লক্ষী লাগছে মেয়েটাকে। এই মেয়ে আজ চলে যাবে পরের ঘরে। ভাবতেই তার বুকে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। চোখে অশ্রু জমছে মঈনুল হকের। মেয়ের সামনে আর গেলেন না। তিনি দরজার সামনে থেকে চলে গেলেন।
বরযাত্রী এসে পড়েছে। টাকা নিয়ে তেমন কোন ঝামেলা হয় নি। তানিশা মুখ ফুটে বলতেই শান্ত মানিব্যাগ সামনে রেখে দিল। তানিশা শুধু বলেছিলো, “আমাদের অশান্ত সাহেব কিপ্টা না, টাকা নিয়ে কেউ তাড়াহুড়ো করো না!”

বিয়ের পর্ব ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে। জায়ান আহমেদ নিজে উপস্থিত থেকেছেন। তানিশা আহনাফের পাশে দাঁড়ানো। এক দিকে বর বউ কবুল বলছে। অন্যদিকে তানিশা আহনাফ কে বলছে, “চলো! এর পরের বিয়েটা আমরা সেড়ে নিই।” আহনাফ হাসল। জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। নিঝুম বেশ কায়দা করে শান্ত কে চোখ টিপ মারল।‌‌ আহনাফের চোখে পড়েছে ব্যাপারটা। এর সাথেও আরো একজন দেখেছে এই কান্ড! নীলাভ্র! সে মুগ্ধ চোখে দেখছে নিঝুম কে। ইশ্! এই মেয়েটিকে আজ কি সুন্দর লাগছে। নীলাভ্র ভাবছে, বিয়ের সাজে এমন সুন্দর মেয়ে আর‌‌ হয়তো কখনো দেখবে না সে।

বিদায় পর্বে কান্নাকাটি হবে না তা হয় না। অথচ নিঝুম একফোঁটা চোখের জল ফেলল না। তার মতোই তার ছোট বোন হিনাও নিশ্চুপ। তাদের চোখে অশ্রুর রেশ অবদি নেই। তাহমিনা বেগম শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কেঁদে যাচ্ছেন। মঈনুল হক বেশ শক্ত মানুষ। তিনি খুব সুন্দর করে তাদের বিদায় দিলো। তবুও কান্নার স্বর পাওয়া যাচ্ছে। হ্যাঁ কাঁদছে, মেহমানদের মধ্যে আসা বোন গুলো কাঁদছে। অপূর্ণতা পূর্ণ করছে তারা।

নিঝুম একদমই কাঁদে নি বিষয়টা ভুল। সে কান্না জমিয়ে রেখেছে। করুণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে ছিল। অতঃপর গাড়িতে উঠতেই শান্ত কে একা পেয়ে কাঁদতে শুরু করল সে। শান্ত কিভাবে তাকে শান্ত করবে এটাই ভেবে পেলো না। গাড়ির সামনে বসে থাকা নীলাভ্র আর আহনাফ অবাক হয়ে নিঝুমের কান্না দেখছে। এই মেয়েটা এতোক্ষণ চুপ ছিল কি করে।‌ নিঝুম কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন অশান্ত, আমি আপনার সাথে যাবো না।”

“সত্যি যাবে না, আমি গাড়ি ফিরিয়ে নিবো।”

“আমি বললাম তো যাবো না, যাবো না আমি কোথায়।”

বলেই তাকে ধরে কান্না শুরু। শান্ত তার কপালে চুমু খেয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর বলছে, “এতো কেঁদো না, মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে।” নিঝুমের কানে কথাটা তেমন ভাবে গেলো না। মঈনুল হক মেয়ে বিদায়ের পর বেলকনিতে একা এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। হিনা পানির গ্লাস হাতে বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। মঈনুল হক মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এতোক্ষণ চেপে থাকা কান্না এবার যেন বেরিয়ে আসছিল। বাবা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল হিনা। সে বার বার বলছে, “আপার কাছে যাবো,‌আমাকে‌‌ আপার কাছে নিয়ে চলো বাবা!”‌ শক্ত মনের মানুষ মঈনুল হকের চোখেও এবার পানি জমতে শুরু করল।

——–

বাসর ঘরে নিঝুম একা বসা। তার একা বসে থাকার কথা নয়। নতুন বউকে কেউ একা ছাড়ে না। তানিশা বের হবার সময় বলে গেল, “অশান্ত আসছে!”‌ তার দু মিনিট পরেই অশান্ত ঘরে ঢুকল। নিঝুম তাকে দেখেই বিছানা থেকে নেমে গেল। শান্ত’র হাতের‌ প্লেটে বিরিয়ানি। নিঝুম বলে উঠল, “এটা কার?”

“তোমার?”

কথাটা শুনে নিঝুম বোধহয় একটু বেশি খুশিই হলো। সে দৌড়ে বিরিয়ানির প্লেট হাতে নিয়ে খেতে শুরু করল। নাকের নথের জন্য খাওয়া মুশকিল। শান্ত কিঞ্চিত হেসে এগিয়ে এসে নথ টা ধরল। নিঝুম হেসে খেতে লাগল। শান্ত হেসে দেখছে তাকে। নিঝুমের মনটা এবার হয়তো খানিকটা ভালো হয়েছে। শান্ত বলে উঠল, “মিসেস চশমিশ! বিরিয়ানি খেতে কেমন?”

“খুব ভালো!”

“ক্ষিদে লেগেছিল খুব!”

“হুম।

“আমায় সাধবে না।

নিঝুম মাথা দুলিয়ে চামচে খাবার তুলে ধরল। শান্ত খেলো না, বরং হেসে উঠল। দরজা নক করছে কেউ। শান্ত উঠে দরজা খুলতে গেল। আহনাফ দাঁড়িয়ে, সে হেসে আইসক্রিম বাটিটা এগিয়ে দিল। নিঝুম উঠে ছুটে এসে আইসক্রিম হাতে নিয়ে বলল, “আমার জন্য!”

আহনাফ হেসে মাথা দুলাল। দরজা খোলার আওয়াজ শুনেই মিনি দৌড়ে এ ঘরে ঢুকল। তার পিছু পিছু অমিও! যতোই হোক, ঘরটা এতোদিন তাদের ছিল।‌ এখন আছে কি না সন্দেহ! নীলাভ্র ছুটে এসে দুটি কে কোলে তুলে বলল,‌ “দরজা খোলার শব্দেই এক দৌড় দিল। কি অবস্থা!

শান্ত হাসলো। নিঝুম মিনি কে একটু আদর করে দিল। শান্ত অমির দিকে তাকিয়ে। বেচারা কে নিঝুম এখনো ইগনোর করে। আহনাফ আর নীলাভ্র চলে গেল। নিঝুম খাটের মাঝখানে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে শান্ত তার সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়া দেখছে। আইসক্রিম শেষ করেই, নিঝুম বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই লেহেঙ্গা, এই সাজ, এসব কিছু নিয়ে। শান্ত হকচকিয়ে বলল,‌” তুমি এভাবে ঘুমাবে।

“অশান্ত আমার ঘুম পাচ্ছে।

“পাগল হলে নাকি, এগুলো নিয়ে ঘুমাবে কি করে? উঠো,‌ বদলে এসো।

“আমার কোন জামাকাপড় নেই এখানে।

“এমন ভাবে বলছো এর আগে আমার জামাকাপড় কখনো পড়ো নি।

নিঝুম দাঁত বের করে হাসল। শান্ত নিঝুমের হাত ধরে বলল, “অজুহাত চলবে না। আমি এসব একদম পছন্দ করি না। চট করে উঠে ফ্রেশ হয়ে এসো।”
নিঝুম উঠে উল্টে বসল। আঙুল দিয়ে মাথার দিকে ইশারা করে বলল, ,”নিন, চুলের ক্লিপ গুলো খুলে দিন।

“আমি?”

“নাহলে কি আমি? আমি এসব পড়ে ঘুমোতে পারবো না, এটা আমার অসুবিধা না। আপনার অসুবিধা। আচ্ছা আগে হাতের এই চুড়ি গুলো খুলে দিন।
বলেই হাত বাড়িয়ে দিল। শান্ত বিছানায় বসে একে হাতের চুড়ি গুলো খুলতে লাগল। নিঝুম এক জোড়া হাতের বালা দেখিয়ে বলল, “এগুলো নাকি হৈমন্তী আম্মুর, মা আমাকে পড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কিছু দিন পড়ে থাকতে। ওগুলো খুলবেন না।
শান্ত হাত নিয়ে বালা দুটো ছুঁইয়ে দেখল। মা’র শেষ চিহ্ন বলে তার কাছে একান্ত কিছুই নেই।‌ অথচ নিঝুম কি জলদিই সেটা পেয়ে গেল। মাথার ক্লিপ গুলো খুলে বলল, “বাড়িতে একবার ফোন করবে,‌ বাবার সাথে কথা বলার দরকার।”

“আমি হিনা’র‌ সাথে কথা বলেছি। এতোক্ষণ সে কেঁদেছে। এখন কথা বলবে আমার কাঁদবে। থাক কাল কল করবো।”

“তোমার মন কি এখনো খুব খারাপ।

“খুব না,‌একটু‌ খারাপ।

“মন খারাপ করো না, আমি আছি তো।

“এইজন্য’ই একটু খারাপ।
বলেই নিঝুম হেসে ফেলল। শান্ত’র‌ মনে হলো, নিঝুমের মতো সে হলে বোধহয় খুব ভালো হতো। ও চট করে নিজের মুড বদলে ফেলতে পারে। এই যেমন দুঃখে কাঁদতে পারে,‌আবার এই সব দুঃখ ভুলে হাসতেও পারে। শান্তও এবার সেটাই চেষ্টা করছে। আশালতার সাথে তার সম্পর্ক সেরকম ভাবে ঠিক হলেও কবীরের সাথে এখনো ঠিক হয়নি। এই বাড়িতে আছে আজ একমাস! এরপর থেকে এখানেই থাকতে হবে তাকে। ঘরে আসবার পথে কবীর ছেলের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, “বিয়ে করেছো, ভালোবেসে বিয়ে করেছো। খেয়াল রেখো এই ভালোবাসা টা যেনো থাকে। সবাই বলে মা বাবার কিছুটা অংশ সন্তান যেন পায়। আমি দোয়া করি,‌আমার কিছুই যেন তুমি না পাও, তুমি কেন আর কেউই না পাক। আমি মানুষটা বড় বাজে। ক্ষমা করে দিও এই মানুষটিকে!

শান্ত শুধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কোন শব্দ তার মুখ দিয়ে বের হয় নি। সে ক্ষমা করে দেই নি, এটা স্পষ্ট। কিন্তু পুরোপুরি রেগেও নেই। সে চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা আরো কিছুদিন পর সফল হবে। কোন কিছুর সমাধান খুব সহজে হয় না, সমস্যা যতদ্রুত ঘটে, ততো তাড়াতাড়ি সমাধান হলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তাকে সমাধান করতে হবে, আর কারো জন্য না হলেও নিঝুমের জন্য। নিঝুম ভালো থাকলেই দিনশেষে সে শান্তিতে থাকবে। নিঝুমের মুখের হাসি দেখে এখন তার প্রতিটা সকাল শুরু হবে। এসব এখন শুধুই তার কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনা বাস্তব হতে দেরি নেই।

“অশান্ত, চুল গুলো আঁচড়ে দিন।”

“এই তুমি পেয়েছো কি? কখন থেকে আমায় খাটিয়ে যাচ্ছো‌।

“আহ, চুল গুলো ঝট পাকিয়ে গেছে তাই বলছি।

“বাসর রাতে বসে এখন আমি তোমার চুল আঁচড় দেবো।

“তো আর কি করবেন!

শান্ত জবাব দিলো না। নিঝুমের সাথে কথায় সে পারবে না। নিঝুম এবার চারদিকে নজর দিল। বিছানায় গোপালের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। বিছানায় চারদিকে ফুলের মালা। পুরো ঘর জুড়ে মোমবাতি! মোমবাতি গুলো দেখতে সুন্দর লাগছে।‌ রঙ বেরঙের মোমবাতি গুলো কাঁচের ভেতর থেকে সুন্দর’ই লাগছে।‌ নিঝুম আহ্লাদী সুরে বলল, “এই অশান্ত, মোমবাতি গুলো আমি নিভাবো।

“কেন? এটা কি খুব মজার কিছু!

নিঝুম উত্তেজিত হয়ে দ্রুত মাথা দুলাল। শান্ত’র মনে হলো, নিঝুম কে ইমপ্রেস করা খুব সহজ। আবার রাগিয়ে দেওয়াও খুব সহজ। কোন কারণ লাগে না রাগতে। শান্ত যথাসম্ভব নিঝুমের চুল গুলো ধীরে আঁচড়ে দিচ্ছে। তবুও নিঝুম নালিশ করে যাচ্ছে, “অশান্ত তার চুল গুলো ছিঁড়ে ফেলছে। এবার সে খুব তাড়াতাড়ি টাক হয়ে যাবে।”

হাঁটু অবদি পড়ে থাকা টি শার্ট আর মেঝেতে লেপ্টে থাকা ট্রাউজার পড়ে নিঝুম হাজির। শান্ত এতোক্ষণে বিছানা পরিষ্কার করেছে। নিঝুম এক লাফে বিছানায় উঠে পড়ল। শুয়ে বলল, “গুড নাইট অশান্ত!” বলেই চোখ বুঝল। শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখনো তার চেঞ্জ করা বাকি। ক্লান্ত লাগছে খুব আবার এভাবে ঘুমাতেও অস্বস্তি লাগছে। এখন শাওয়ার না নিলে তার খুব আসবে না। গোসল সেরে এসে শান্ত ঘরে ঢুকল। তার খানিকটা অবাক লাগল। নিঝুম বিছানায় ঘুমোচ্ছে।‌ এখন থেকে রোজ এমনটা ঘটবে। নিজের ঘরেই ঢুকলেই‌ নিঝুম কে দেখতে পাবে। সবসময় সে থাকবে তার কাছে। কখনো হাত ছাড়া হবে না,‌এটা কল্পনা না যে ছুঁতে গেলেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। শান্ত তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। নিবু নিবু আলোয় জ্বলছে মোমবাতি। মনে পড়ল, নিঝুম বলেছিল, মোমবাতি সে নিভাবে। কিন্তু এখন তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। অপূর্ণ ইচ্ছা শান্ত পূরণ করল। মোমবাতি নিভাতে গিয়ে তার মজা লাগল না। কিন্তু সে শতভাগ নিশ্চিত ছিল,‌এই কাজটা নিঝুম করলে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। তখন তার কাছে খুব ভালো লাগতো। কিছু কিছু কাজ হয়তো নিঝুম করলেই মানায়, তাকে মানাবে না। এতো কাজের পর শান্ত এবার এসে বিছানায় মাথা রাখল। ল্যাম্পশেডের আলো জ্বলছে। নিঝুমের মুখটা দেখা যাচ্ছে। সে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। এখন থেকে নিঝুম প্রতি রাতেই শান্ত’র পাশে ঘুমাবে।‌ শান্ত এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল নিঝুম কে। অন্য হাত দিয়ে ল্যাম্পশেড বন্ধ করল। নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। তার কপালে চুমু খেল। নিঝুম তার পাশে,‌ এ এক অন্য ধরণের অনুভূতি। খারাপ লাগছে, এই অনুভূতি শুধু সে একাই অনুভব করছে। ইচ্ছে করছে নিঝুম কে ডেকে তুলতে। জিজ্ঞেস করতে, “তার কেমন লাগছে এভাবে অশান্ত’র বুকে ঠাঁই মিলে?”নিশ্চয়ই ভালো লাগছে!

#চলবে….#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৭১ ( শেষ পর্ব )

এক বছর পর,
তানিশা ঘুম থেকে উঠে চারপাশ দেখছে। আশ্চর্য! তার ঠিক মনে আছে, গতরাতে আহনাফের ঘরেই ঘুমিয়েছিল সে। এখানে এলো কি করে? কে আনলো? আহনাফ! তানিশা ঘর ছেড়ে বের হলো। বাড়িতে কেমন নিরব লাগছে, সবাই কি চলে গেছে। সে কি তবে খুব দেরি করে উঠলো তবে। রান্না ঘর থেকে খুটখাট শব্দে সেদিকে এগুলো সে। তানিশা সামনে দাঁড়ানো। আহনাফ ওমলেট তৈরি করছে। তানিশা কে দেখা মাত্র একগাল হেসে বলল,‌‌”গুড মর্নিং! ঘুম ভালো হয়েছে।

“নাহ!

“না কেন?

“আমি ভেবেছিলাম তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো, তুমি সেই আশায় জল ফেলে দিলে।

“আমার কোলেই ঘুমিয়েছিলে। ঘুমানোর পর তোমাকে ওই বেডে শুইয়ে দিয়েছি।

“কেন?

আহনাফ কিছু বলল না। হাসল! তানিশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আহনাফ কে। কি সুদর্শন এই ছেলে! এই সকালে যেন তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। যতবার তাকে দেখে ততোবার’ই সে মুগ্ধ হয়। এর রহস্য কি? দিন দিন এই ছেলে এতো সুদর্শন হয়ে কেন যাচ্ছে। আহনাফ কফি মগ টা এগিয়ে দিল। তানিশা এক চুমুক দিয়ে রেখে দিল। আহনাফের‌‌ কাজ এখনো শেষ হয় নি। তানিশা পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল । আহনাফ তানিশার হাতে হাত রেখে বলল, “কি হলো?

“আমার কথার জবাব দাও।

“কি জবাব দেবো?

“আমি কিন্তু আজ রাতেও এখানেই থাকবো!

আহনাফ হাসল। হাত ধরে পেছন থেকে ঘুরিয়ে সামনে আনলো তানিশা কে। তানিশা হাসছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। দুই হাত দিয়ে আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে আছে আদুরে স্বরে বলল, “আমি কিন্তু সত্যি আজ এখানেই ঘুমাবো।

“না, আজ রাতে তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবো।

“কেন থাকলে কি হবে? কয়েকদিন পরেই তো আমাদের বিয়ে।

“যখন বিয়ে হবে তখন থাকা যাবে।

তানিশা ভ্রু কুঁচকালো। হম্ভিতম্ভি করে আহনাফের কপালে হাত রেখে বলল, “দেখি দেখি তোমার জ্বর কমেছে কি না।

“আমার আর জ্বর নেই। অজুহাত দেওয়া বন্ধ করো।

তানিশা শীতল হাত আহনাফের গালে রেখে বলল , “ইশ্! কি গরম তোমার শরীর!

“হ্যাঁ , তোমার হাত কি ঠান্ডা জানি আমি। ছেলেমানুষী বন্ধ করো তানিশা, আজ তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো।

“আমি আব্বু কে বলে আজকের রাতটা থাকি না।

“না, দরকার নেই বললাম তো।

তানিশা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। আহনাফ সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করল। সাথে সাথে তানিশা এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। তাকে বুকে মাথা রেখে মৃদুস্বরে বলল, “তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না।

“না বাসি না।

“একটুও আদর করো না।

“না করবো না।

মাথা তুলে বলল, “এমন কেন করছো?

“আমি না তুমি করছো!

তানিশা চট করে থুতনিতে চুমু খেয়ে বলল, “দেখো কতো ভালোবাসি তোমায়!

আহনাফ তাকিয়ে রইল। তানিশা হেসে উঠলো। আহনাফ তানিশার মাথায় হাত রেখে চুল গুলো কানে গুঁজে দিয়ে বলল, “বলো, কি হয়েছে?

“ভালোবাসি!

“আমিও বাসি।

“না মিথ্যে কথা, তুমি আমায় ভালোবাসো না।

আহনাফ তানিশার কোমরে হাত রেখে চট করে তাকে উঠিয়ে সামনে বসাল। তানিশা হেসে আহনাফের‌‌ গলা জড়িয়ে ধরল। আহনাফ বলে উঠল, “বলো কি করতে হবে, খবরদার আজ রাতে থাকার কথা বলবে না।

“কিছু করতে হবে না, এভাবে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকো আমার সামনে। দু’চোখ ভরে দেখবো তোমায়।

“তোমার যা ইচ্ছে!

আহনাফ কিঞ্চিত হেসে দাঁড়িয়ে রইল। তানিশা হাত বাড়িয়ে তার গালে হাত রাখল। একবার মাথার চুল ঠিক করে দিচ্ছে‌। একবার গালে হাত রাখছে। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “একি করছো?

তানিশা চট করে তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, “তোমায় দেখছি।

“তুমি আমায় টিজ করছো, একে দেখা বলে না।

তানিশা হেসে কলার ধরে আহনাফ কে কাছে টেনে বলল, “করলে করছি, তুমি আমার সম্পত্তি। তোমাকে টিজ করার অধিকার শুধুই আমার!

বলেই আহনাফের গলার কাছে চুমু খেয়ে বসল। আহনাফ হাত ছাড়িয়ে বলল, “ছাড়ো আমায়!

তানিশা শার্ট টেনে ধরে বলল, “না ছাড়ছি না।

“খুব অবাধ্য তুমি।

“হুঁ, শুধু তোমার জন্য!

আহনাফ মৃদু হেসে তানিশার কোমর আঁকড়ে ধরে বলল, “ভদ্র মেয়েরা এমন করে না।

“রাখো এসব, আচ্ছা বলো না ভালোবাসো আমায়।

“হুঁ!

“কি হুঁ হুঁ করছো।

“আচ্ছা, ভালোবাসি তোমায়! হয়েছে শান্তি।

“না আরো একবার বলো!

আহনাফ হেসে আবারো বলল, “ভালোবাসি, আমি শুধু তোমাকেই‌ ভালোবাসি!

তানিশা মিটিমিটি হেসে বলল, “আরো একবার!

আহনাফ চুপ হয়ে গেল। খানিকটা এগিয়ে তানিশার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “ভালোবাসি, ভালোবাসি , ভালোবাসি! ঠিক আছে এইবার!

তানিশা মুখ টিপে হাসল। দু’জনে খুব কাছাকাছি! আহনাফের চোখ সরছে না তানিশার থেকে। তানিশা তার চোখে চোখ রেখে বলল, “তুমি জানো, আমার কতো সাধনার ফল তুমি। এই দিনটার জন্য কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম আমি।

“কাঁদছ কেন?

“কাঁদছি না, খুশিতে এই হাল আমার।

আহনাফ এগিয়ে তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া বসিয়ে দিল তানিশার চোখে। চোখ গড়িয়ে অশ্রু গড়িয়ে তার। সেই অশ্রু মুছে দিল আহনাফ। তার নরম ঠোঁটের ছোঁয়া বসাল তানিশার কপালে। হাত মুঠো করে শার্ট আঁকড়ে ধরল তানিশা। চোখ মেলে তাকাল সে। আহনাফ তার কাছে, অনেক কাছে। তার গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া অনবরত পড়ছে তার মুখে। দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন আজ তার বাস্তব। রাত জেগে যাকে শুধু কল্পনায় আপন করছে এখন সে তার কাছে। অনেক কাছে! সবচেয়ে বড় কথা, এখন সে শুধুই তার। আহনাফ এখন তার নিজস্ব, একান্ত! কেউ ভাগ বসাতে পারবে না এখানে। এক এক করে আহনাফ তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া বসিয়ে যাচ্ছে‌ তানিশার মুখে। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে তার। পারছে না এখান থেকে ছুটে চলে যেতে। আঁকড়ে ধরছে আহনাফ কে। আহনাফ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল তানিশা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তার। এতো দিনের তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে চলেছে। তানিশা চোখ বন্ধ করে নিল। আহনাফ এগিয়ে গেল তার ঠোঁট জোড়ার দিকে। কেঁপে উঠলো তানিশা। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে! কিছুক্ষণ পরই তাকে ছেড়ে দিল আহনাফ। মুখ তুলে আহনাফের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। তার বুকে মুখ লুকিয়ে নিল সে। লজ্জায় বোধহয় এবার মরেই যাবে সে। বুকের থুকপুকানিতে অস্থির সে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আহনাফ দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সযত্নে।

“আমায় কখনো ছেড়ে দিবে না তো তুমি!”‌
কথা গুলো অস্পষ্ট বলল তানিশা। তার কথা গুলো যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল। আহনাফ হেসে বলল, “কখনো না!” তানিশা হেসে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। মনে মনে বলল, “তুমি আমায় ছেড়ে দিলেও আমি কখনো তোমায় ছাড়বো না, কখনো না।”

——-

কয়েকদিন আগেই আশালতা আর কবীর গেছে তার জায়ান আহমেদ’র কাছে। জায়ান আহমেদ খানিকটা অসুস্থ তবে ওতোটা গুরুতর না। কবীর চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে তার সকল দায়িত্ব এখন শান্ত’র। কবীরের কেবিনেই বসে আছে সে। একটু আগেই বাবার সাথে কথা বলেছে একটা প্রোজেক্ট নিয়ে। এই একবছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। বাবা ছেলের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। নিঝুম এখন আগের থেকেও আরো বেশি ছেলেমানুষী করছে। শুধু বদলায়নি মিসেস চশমিশের অশান্ত ভালোবাসা। শান্ত অক্লান্ত ভাবে ভালোবেসে যাচ্ছে তাকে।

রায়ান আংকেল একটু আগেই শান্ত’র‌ কেবিন থেকে বের হয়েছে। শান্ত মিটিং এ বসেছে। রায়ানের কেবল মনে হচ্ছে স্যারের সাথে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু কবীর তাকে নিতে চায় নি। বিশ্বস্ত একজন কে ছেলের পাশে রেখে গেছে। কোন অসুবিধা পড়লেই রায়ান তাকে উদ্ধার করতে পারবে। রায়ানের উপস্থিত বুদ্ধি অসাধারণ!

রায়ান সামনে তাকিয়ে দেখল তড়িঘড়ি করে এদিকেই ঢুকছে নিঝুম। নিঝুম কে চেনে না অফিসের এমন কেউ নেই। সবাই তাকে দেখে সালাম জানাচ্ছে। কিন্তু নিঝুম কে দেখে মনে হচ্ছে সে মারাত্মক রেগে আছে। রাগে তার পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। সে হন হন করে রায়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “অশান্ত কোথায় আংকেল!

রায়ান আংকেল ইশারায় শান্ত’র কেবিন দেখাল। দেখানো টা বোধহয় ভুল হলো। নিঝুম হন হন করে সেদিকেই যাচ্ছে। এখন মিটিংয়ের কি হবে?
শান্ত কোন একটা প্রোজেক্ট নিয়ে বিস্তারিত কথা শুনছিল। রুমে কারো আসার উপস্থিত পেয়ে বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। বলাই আছে, ভেতরে যেন কেউ প্রবেশ না করে। কিন্তু নিঝুম কে দেখেই যেন তার মুখটা মলিন হয়ে গেল। মনে পড়ল, সকালে মারাত্মক ঝগড়া করে বের হয়ে চলে এসেছিল সে। নিঝুম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। শান্ত দেখছে কলিগদের! একজন দেখছে অপরজনকে। এর মাঝে একজন বলে উঠল, “মিস্টার শান্ত! এনি আপনার মিসেস নাহ!

শান্ত মাথা নাড়ল। নিঝুম ভেতরে প্রবেশ করে কোনায় থাকা সোফায় বসে পড়ল। শান্ত দাঁড়িয়ে বলল, “আই এম সরি, মিটিং টা খানিকক্ষণের জন্য পজ করতে হচ্ছে। আপনাদের বাকি কথা রায়ান আংকেল শুনবে! যদি কাইন্ডলি…

একজন হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ইটস্ ওকে, আই আন্ডারস্ট্যান্ড!
বাকি দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল তার সাথে সাথে। বের হয়ে গেল কেবিন থেকে। শান্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে তাকাল নিঝুমের দিকে। তাকে দেখেই মনে ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে সে। শান্ত পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো নিঝুমের কাছে। পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও পানি খাও!

নিঝুম পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পুরো পানি শেষ করল। শান্ত হাসার চেষ্টা করল। শীতল গলায় বলল, “তুমি এখানে কেন?

“দরকার ছিল তাই এসেছি।

“কি দরকার?

“সকালের ঝগড়ার কথা ভুলে গেছেন।

“একদম না।

“দোষটা কার ছিল?

শান্ত খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমার!

“সরি বলে এসেছিলেন?

“না, তাই বলে এখানে চলে আসবে। ফোন করলেই তো হতো।

“আমি সেজন্য আসি নি। আমি এসেছি কারণ আমি খুব রেগে আছি। কিন্তু এতো রাগ নিয়ে যদি ঘরে বসে থাকতাম তাহলে আপনি জানতেন কি করে? তাই আপনার সামনে এখন বসে থাকবো। আপনি বসে বসে দেখবেন আমি কতোটা রেগে আছি।

“তুমি কি সত্যি এখানে বসে থাকবে।

“হুঁ!

“কিছু এনে দেবো, খাবে।

“একদম খাবারের লোভ দেখিয়ে আমার রাগ কমানোর চেষ্টা করবেন না। আমি কিছু খাবো না, এখানেই বসে থাকবো।

“আচ্ছা!

বলেই উঠে দাঁড়াল শান্ত। নিঝুম এখান থেকে এক পাও নড়বে না সে বুঝে গেছে। এসে আবারো নিজের চেয়ারে বসল। সামনে থাকা ল্যাপটপ অন করে কাজ করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। নিঝুম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে তার দিকে। আড়চোখে তাকে দেখছে বার বার। পুরোটাই তাকে বিরক্ত করবার ধান্দা। শান্ত ল্যাপটপের এক পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখল নিঝুম তার দিকেই আছে। দ্রুত মুখ সরিয়ে নিল সে। না এভাবে কাজ করা যায় না। উঠে দাঁড়াল। হাতে একটা ফাইল নিয়ে পড়তে লাগল। চশমার আড়াল থেকে নিঝুমের‌ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এসে বিরক্ত করছে তাকে। শান্ত হতাশ! সে চেয়েও পারছে না কিছু কঠিন কথা বলতে। গায়ের সুট খুলে রেখে দিল সে। সাদা রঙের শার্টের হাতা বটে ফেলল। শার্টের সামনের দুটো বোতাম খুলে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসল। এসি চলছে রুমে তবুও তার অসহ্য গরম লাগছে। নিঝুমের দিকে মুখ ফিরতেই দেখল সে হাসছে। এটা তার বিজয়ের হাসি! শান্ত কে জ্বালিয়ে বেশ মজা পাচ্ছে সে!

পেরিয়ে গেল খানিকটা সময়। বেশ অনেকক্ষণ পর শান্ত ফিরে তাকাল নিঝুমের দিকে। না নিঝুম জেগে নেই, সে ঘুমোচ্ছে। কোন মতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে। শান্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে তাকে বার বার। মুচকি হাসছে। কেন এতো ভালোবাসে সে নিঝুম কে! এই মেয়েটার মাঝে কি আছে এতো! সাদা নীল রঙের একটা শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। শান্ত উঠে দাঁড়াল। নিঝুম পড়ে যাচ্ছে। সে ছুটে এলো নিঝুমের কাছে। গড়িয়ে পড়ার আগেই ধরে ফেলল তাকে। নিঝুমের ঘুম অবশ্য ভাঙল না। খুব যত্ন করে তাকে ঠিক মতো শুইয়ে দিল। মুখের উপর থাকা চুল গুলোও কানে গুঁজে দিল। আলতো করে চুমু খেলো নিঝুমের কপালে। মেয়েটা এখনো আগের মতোই আছে। সে ভুলেই গেছে এখন সে বিবাহিতা! সারাদিন ছোটাছুটি, ঘুরাঘুরি! শান্ত’র ভালোবাসার তাকে বদলে যেতে দিচ্ছে না। সেদিন রাতে শান্ত জামা কাপড় পড়ে বিছানার উপর লাফাচ্ছে। কোন কারণ নেই, তার ভালো লাগছে তাই করছে। শান্ত খুব আলতো করে নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। একসময় নিঝুম ঠেলতে ঠেলতে শান্ত’র গায়ে এসে পড়ল। শান্ত তাকে বুকের মধ্যে জায়গা দিল। এই সময় কারো আসার শব্দ। মেয়েটা অনুমতি না নিয়েই তড়িখড়ি করে ঢুকে গেছে। ভেতরে এসেই কথা বলতে লাগলো অনবরত। শান্ত ইশারায় তাকে চুপ করতে বলল। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। শান্ত তাকে হাতের ইশারায় দেখাচ্ছে , নিঝুম ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা ধীরে ধীরে বলল, “স্যার এই ফাইল!” শান্ত হাতের ইশারায় তাকে ফাইল রেখে যেতে বলল। মেয়েটা দ্রুত ফাইল রেখে সরি বলে বের হয়ে গেল। লজ্জায় তার নাজেহাল অবস্থা! বস কে এভাবে দেখবে এটা স্বপ্নেও ভাবে নি সে। বস আর বসের বউ এভাবে, হায় হায়! হাসি চেপে রাখা কষ্টকর। আবারো পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। ইশ্! স্যার কতোটা না ভালোবাসে তার বউ কে। হুট করে ঢুকে পড়া একদম উচিত হয় নি তার। কিন্তু এভাবে ঢুকে পড়ায় স্যার কে একদম’ই লজ্জিত দেখলো না সে। বরং দেখলো বিচলিত, তাদের কথাবার্তার আওয়াজে না তার ঘুমন্ত স্ত্রী জেগে যায়। বড্ড ভালোবাসে সে তাকে। সামনে দিয়েই আরেকটা মেয়ে চলে যাচ্ছিল। মেয়েটা হাসতে হাসতে তাকে ডেকে বলল, “জানিস , কি হয়েছে?”

নিঝুমের ঘুম ভাঙল অনেকক্ষণ পর। ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেকে শান্ত’র বুকের মধ্যে পেল সে। শান্ত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখের চশমা ঠিক করে বলল, “আপনি এখানে, কি করছিলেন?

“তোমায় দেখছিলাম।

“অফিসের কাজ রেখে আমায় দেখেছিলেন।

“কি করবো বলো, আমার বউ এখানে বসে থাকলে আমার নজর অন্য কোথায়ও কি করে যাবে!

নিঝুম মুখ ভেংচি কেটে হেসে ফেলল। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যা, সময় তো হয়ে গেল।

“জানি! চলো বেরিয়ে পড়া যাক, ওরা সবাই এতোক্ষণে এসে পড়েছে!
নিঝুম হেসে উঠে দাঁড়াল। শান্ত সুট টা পড়েই নিঝুমের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ল।

ছোটখাটো একটা গেট টুগেদার! প্রতি সপ্তাহে তারা বন্ধুবান্ধব একত্র হয় এখানে। আজ সবাই আসবে আহনাফের বাসায়। দিয়া আগে থেকেই উপস্থিত! কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখা মিলল নিঝুম আর শান্ত। আহনাফ হেসে তাদের ঘরে ঢুকাল। তানিশা হেসে পানির গ্লাস নিয়ে এলো। শান্ত ঘরে ঢুকে বলল, “আর কেউ আসে নি।

তানিশা বলল, “আমাদের চোখে পড়ে না তোর!

“বাহ রে পড়বে না কেন?

দিয়া মুখ ভেংচি কেটে বলল, “আমাদের কেন পড়বে। দেখছিস না একজন কে সাথে করে নিয়ে এসেছে।

নিঝুম পাশে বসে দিয়ার গাল টেনে বলল, “এখনো দেখি সহ্য হয় আমাকে।

“ঢং , দেখি সরো তো!

“বাহ রে, দিন দিন কি সুন্দর হয়ে যাচ্ছো তুমি! বিয়ে একটা এবার করেই ফেলো। দেখো না তানিশা আর আহনাফ কি ভালো কাজ করছে।

দিয়া পায়ের উপর পা তুলে বলল,‌”বিয়ের মতো পাপ কাজ আমি করছি না ভাই। একা আছি, এতেই ভালো আছি।

শান্ত হেসে দিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “দোয়া করি বৎস, তোমার ইচ্ছা যেন পূরণ হয়!

দিয়া কপাল কুঁচকে তাকাল। হেসে উঠলো সবাই। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “আজকের স্পেশাল গেস্ট এখনো এসে পৌঁছায় নি?

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কার কথা বলছিস?

শান্ত জবাব দিলো না হাসল। কলিং বেল বেজে উঠলো আবারো। নীলাভ্র ঘরে ঢুকে স্নিগ্ধ হাসি হাসল। চোখ পড়ল নিঝুমের দিকে। নিঝুমের মুখে কিঞ্চিত হাসি। দিন দিন নিঝুমের প্রতি তার ভালো লাগা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা সত্যি কোন কাজের কথা না। নিঝুম তার বন্ধুর বিবাহিতা স্ত্রী! নীলাভ্রর উচিত তার মনকে স্থির করা। সেই চেষ্টা করছে সে। কিন্তু সত্যি বলতে নিঝুমের জন্য অন্য কোন মেয়েকে তার মনে এখন অবদি ঠাঁই দিতে পারে নি ।আশ্চর্য! মেয়েটা কি জাদু জানে। নাহলে কয়েকদিনের সাক্ষাতে মনের এই দীর্ঘ পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না নীলাভ্র। ঝগড়ার আওয়াজ আসছে। চেঁচিয়ে কথা বলছে তিথি আর আহিম। এ দুজন সারাক্ষণ ঝগড়া করতে থাকে। কখনো তাদের মুখে ভালোবাসার শব্দ টি শোনা যায় নি। অথচ দুজন দুজনকে যথেষ্ট ভালোবাসে। একদিন না দেখে থাকতে অবদি পারে না তবুও কেউ বলছে না মুখ ফুটে। দুজনের এই অপ্রকাশিত ভালোবাসা কতোদিন থাকে কে জানে। তাদের কথা ভেবে হাসল আহনাফ আর শান্ত! মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে একজন অপরজনের। তাদের দুজনের ঝগড়ার বিষয় পায়ে পারা মাড়ল কে। তিথি বলছে আহিম ইচ্ছে করছে তার পায়ের উপর পারা মেরেছে। আহিম যতোই না বলছে তিথি কোনভাবেই সে কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। নিঝুম উঠে তিথি কে তার পাশে বসিয়ে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। জমজমাট ভাব সবার মাঝে। আফিন আর রিয়া সবেমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে। ওহ! রিয়া আবার তিন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা! নিঝুম তার পাশে বসে বলল, “আচ্ছা রিয়া আপু, তোমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে!

“জানি না আমি!

নিঝুম মলিন মুখে আফিনের দিকে তাকাল। আফিন হাসল। রিয়া খাচ্ছে, ইদানিং তার খাওয়া দাওয়া বেড়ে গেছে। এখন খাচ্ছে আবার সবার সাথে বসেও খাবে। তানিশা এসে আমের আচাড় রাখল তার সামনে। রিয়া চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে ‌। নিঝুম রিয়ার পেটে হাত রাখল। শান্ত বলে উঠল, “কি ভাবছো এতো মন দিয়ে?

“আমি ভাবছি, ছেলে হবে নাকি মেয়ে ‌। জানো আমার মনে হচ্ছে ছেলে হবে।

“না মেয়ে হবে, দেখে নিও।

“আহা অশান্ত, আমি বললাম তো ছেলে হবে।

“আমি বলছি মেয়ে!

“না ছেলে!

“না মেয়ে!

মাঝখানে রিয়া ধীর স্বরে বলল, “কিন্তু বাচ্চা তো আমার হবে, ঝগড়া তোরা কেন করছিস?

শান্ত চুপ হয়ে গেল। নিঝুমের সাথে সাথে তার মাথাটাও গেছে। আহনাফ তার মাথায় ধপাস করে বারি মেরে বলল, “তোর মাথাটা গেছে রে শান্ত!
তানিশা জোড়ে হেসে বলল , “নিঝুম ওর মাথা টা খেয়েছে।
নিঝুম বলল, “ছিঃ! ওসব কি খাওয়ার জিনিস নাকি!
হেসে উঠলো প্রত্যেকে। সবার মাঝে কমতি ছিল শুধু একজনেরই। আহনাফ শান্ত কে জিজ্ঞেস করল, “স্পেশাল গেস্ট’র কথা।” শান্ত বুঝতে পারল আহনাফ সেই সম্পর্কে কিছুই জানে না। তানিশা জিজ্ঞেস করল ইফার কথা। সে কোথায়? এখনো এলো না যে!
বলতে বলতে ইফা হাজির। কিন্তু শুধু সে একা না। তার সাথে রয়েছে আরো একজনও। সুদর্শন এক যুবক একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সে অনেকটা লাজুক। মুখটা কাঁচুমাচু করে রেখেছে। ইফা হেসে বলল, “ওর নাম রিহান, আমার বন্ধু!”

আহনাফ হেসে বাঁকা চোখে তাকাল শান্ত’র দিকে। এই বুঝি তাদের স্পেশাল গেস্ট। নিঝুম আর তানিশা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইফার মুখটা লজ্জায় মাখামাখি অবস্থা। তিথি ছুটে এসে দাঁড়াল ইফার পাশে। অবশেষে ইফা মুভ অন করেই ফেলেছে। এই জিনিসটা সবার পক্ষে সহজ হয় না। সবাই পারে না, কিন্তু ইফা করে দেখিয়েছে। নীলাভ্র ইফার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিঝুমের দিকে ফিরল। কাকতালীয় ভাবে নিঝুম ও তার দিকেই ফিরল। হেসে ফেলল দুজন। সেই রহস্য তাদের দুজনের মাঝেই আটকে আছে। আগেরকার দিনের কথা সবাই এখন ভুলে গেছে। তারাও ভুলে যেতে চায়!

——–

শান্ত গোসল সেরে বের হয়ে এসে দেখল নিঝুম খাটের মাঝখানে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। একবার উঁকি দিলো অমি আর মিনির বিছানায়। তাদের কিছু মিষ্টি মিষ্টি বিড়াল বাচ্চা হয়েছে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে তারা। শান্ত তাদের ঠিক করে রেখে দিল। অমি ততোক্ষণ তার পাশে পাশে ঘুরছিলো। বোধহয় সেও তার বাচ্চার খেয়াল রাখছে। শুধু তাই না, মিনিও ঘাড় বাঁকিয়ে বাকিয়ে দেখছে। শান্ত হাসল। অমি কে কোলে তুলে চুমু খেলো। বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাল। তিনটা বাচ্চা! এদের সবগুলো কে দেখতে একরকম। এখনো নাম রাখা হয় নি। নিঝুম এদের নাম খুঁজছে। আহনাফ কে বলে এসেছে তিনটে সুন্দর নাম খুঁজে দিতে। শান্ত ঘরে এসে দেখলো নিঝুম এখনো বিছানায়। সে হেসে এগিয়ে গেলো সেখানে। তার উপর খানিকটা ঝুঁকে বলল, “মিসেস চশমিশ কি ভাবছো?”

“কিছু না।

শান্ত হেসে তার মাথায় হাত বুলাল। অমনি দেখলো চুল গুলো ভেজা। সে হেসে হাত টেনে নিঝুম কে বসিয়ে মাথায় চুল মুছে দিতে লাগল। নিঝুম আয়নার দিকে ফিরল। শান্ত তাকে দেখে হাসছে। সে দাঁত বের করে একগাল হেসে বলল, “অশান্ত আমি দেখতে সুন্দর তো!

“হুম অনেক সুন্দর!

“আগের মতো সুন্দর!

“তুমি সবসময়ই আমার কাছে সুন্দর!

নিঝুম ফিরে বসল। শান্ত’র কোলে বসে তার গলা জড়িয়ে ধরল। তার মুখে স্নিগ্ধ হাসি। সেই হাসি দেখে হাসছে শান্ত। শান্ত নিঝুমের‌ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কিছু বলবে?

নিঝুম মাথা দুলিয়ে না বলল। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসছি।
শান্ত ভ্রু কুঁচকালো। ওপাশে তাকিয়ে দেখল পানির বোতল এখানেই রাখা। নিঝুম কি তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে তবে। দরজা খোলার আগেই শান্ত চট করে এসে দাঁড়াল সেখানে। নিঝুম হকচকিয়ে গেল,‌দ্রুত তা সামলে হেসে বলল , “কি হলো?

“তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো?

“কই না তো।

“তাহলে মিথ্যে কেন বলছো?

“কি বলেছি!

অবাক চোখে তাকিয়ে রইল নিঝুম। তাকে দেখে অনেকটা বিচলিত মনে হচ্ছে। শান্ত হুট করেই নিঝুমের কোমর ধরে কাছে টানল। গালে হাত রেখে বলল, “বলো কি হয়েছে?

“কিছু না!

শান্ত চট করে তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, “বলো কি হয়েছে?

নিঝুম মাথা দুলিয়ে না বলল। শান্ত চট করে আবারো তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে একই প্রশ্ন করল। নিঝুম হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে শান্ত’র বুকে মাথা রাখল। শান্ত মৃদুস্বরে বলল, “এখনো বলবে না কি হয়েছে?

“অশান্ত আজ জোৎস্না রাত।

শান্ত হেসে কোলে তুলে নিল তাকে। বেলকনির দোলনায় বসাল তাকে। তার পাশেই বসে পড়ল সে। তার হাতে নিঝুমের হাত। দুজনে একসাথে বসে আকাশের ওই এক টুকরো চাঁদ দেখছে। বরাবরের চাঁদটা আছ ভীষণ সুন্দর।‌নিঝুম শান্ত’র বুকে মাথা রেখে বলল, “আজ অনেক মজা হয়েছে অশান্ত, ইফার বন্ধুটা দেখেছেন। রিহান! ইফার জন্য একদম পারফেক্ট সে।

“হুঁ! আর কিছু বলবে?

“না। শুধু এতোটুকুই।

শান্ত ঘুরে তাকাল। নিঝুমের থুতনি হাত দিয়ে উঁচু করে তার মুখের সামনে আনলো। বলে উঠল, “তোমার দৃষ্টি আমায় বলে দিচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাও!

“আপনি বুঝতে পারছেন অশান্ত, আমার মনের কথা।

শান্ত বুঝার চেষ্টা করল। ভ্রু কুঁচকালো সে। নিঝুমের গালে হাত রেখে বলল, “আমি যেটা ভাবছি সেটাই কি সত্যি চশমিশ!

লজ্জায় মুখ লুকালো নিঝুম। শান্ত সোজা হয়ে বসল। দুই হাত নিঝুমের দুই গালে রেখে বলল, “তুমি এতো ছোট্ট মেয়ে, তুমি কিভাবে একটা বাচ্চা সামলাবে বলো। আমি তো তোমাকেই নিয়েই পারি না।

মুখটা মলিন করে ফেলল নিঝুম। গাল থেকে হাত দুটো সরিয়ে উঠে চলে যেত নিল সে। শান্ত তার হাত টেনে হিচকে টানলো তার কাছে। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বিরক্তি স্বরে বলল, “ছাড়ুন আমায়!

“আহ রাগ করছো কেন? আমি তোমাকে এটাই বোঝাতে চাইছি এটা খুব বড় সিদ্ধান্ত! ভেবে নাও আরেকবার।

“আমি কিছু জানি না অশান্ত। আমিও রিয়ার মতো একটা কিউটি বেবী চাই।

“ওর বাচ্চা এখনো হয় নি।

“হবে তো, আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না।

“আমি বুঝতে পারছি।

“তো কিছু বলুন।

শান্ত হাসল। নিঝুমে‌র গালে চুমু খেলো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, তুমি যা চাও তাই হবে।

“সত্যি!

“হুঁ, তার জন্য তোমায় আমার হতে হবে!

নিঝুমের দৃষ্টি আঁটকে গেল।‌ শান্ত মৃদু হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিঝুম পিছিয়ে যাচ্ছে। শান্ত ততোই এগিয়ে আসছে। একটা সময় আটকে গেলো সে। শান্ত ধরে ফেলল তার হাতটা। তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া বসিয়ে দিল নিঝুমের গালে। চমকে উঠল সে।‌ শক্ত করে ধরে ফেলল শান্ত’র‌ হাতটা। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে।‌‌ শান্ত এগিয়ে আসছে তার দিকেই।‌ ঠোঁট দুটো আঁকড়ে ধরতে সময় লাগল না তার। নিঝুম চেয়েও পারছে না তাকে ছাড়াতে। শান্ত তার হাত দুটো ধরে নিল শক্ত করল। উঠে দাঁড়িয়ে কোলে তুলে নিল নিঝুম কে। ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছে নিঝুম। শান্ত তাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। চোখ থেকে সরিয়ে ফেলল চশমাটা। ঝাপসা ঝাপসা চোখে শান্ত কে অনুভব করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।‌ সে বেশ বুঝতে পারছিল শান্ত তার পুরো মুখে চুমু খাচ্ছে। তার গলায় মুখ ডুবালো সে।

——–

জোৎস্না রাতের সঙ্গি হয়েছে আরেকজন। তানিশা বেলকনির এক কোনায় দাঁড়ানো। আহনাফ দুই হাতে কফি মগ নিয়ে ঢুকলো। তানিশার পাশে এসে দাঁড়াল। হাতের একটা মগ এগিয়ে দিল তার দিকে। তানিশা কফি মগে এক চুমুক দিয়ে আহনাফের দিকে ফিরল। মাথার চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আহনাফ শীতল কন্ঠে বলে উঠল, “দ্রুত কফি শেষ করো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো।

তানিশা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এক হাত দিয়ে তার বাহু জড়িয়ে বলল, “বড়ো নিষ্ঠুর তুমি, খালি আমায় কষ্ট দাও!

আহনাফ জবাব দিল না, চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। তানিশা হুট করে এসে তার সামনে থেকে জড়িয়ে ধরল। আহনাফ হাসল। কফি মগে চুমুক দিল সে। তার দৃষ্টি এখনো আকাশের দিকে। তানিশা মুখ উঁচু করে তাকিয়ে রইল আহনাফের দিকে। চোখের পাতা ফেলে সে দেখছে তাকে। আহনাফের এক হাত প্যান্টের পকেটে। অন্য হাতে কফি মগ। তানিশা আদুরে স্বরে বলে উঠল, “কি হলো?

আহনাফ হাসল। এক হাত জড়িয়ে ধরল তাকে। বলে উঠল, “আমার কফি কিন্তু শেষের পথে!

তানিশা আবারো অভিমান করে মুখ লুকালো তার বুকে। আহনাফ হেসে উঠলো শব্দ করে!

‌ ‌ ||সমাপ্ত||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here