দহন পর্ব ১১

#দহন
#পর্ব_১১
#লেখা_মিম

এক মাস পর……
আজকাল অনিমটা বড্ড অচেনা হয়ে গেছে। শিমুল তার মাঝে আর পুরোনো অনিমকে খুঁজে পায়না। আগে তো ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে তার খোঁজ নিতো। আর এখন সারাদিনেও অনিমের খোঁজ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এই যে শিমুলের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে দুই সপ্তাহ যাবৎ, অনিম তো একবারও ঠিকমতো জিজ্ঞেস করে দেখেনি শিমুল তোমার পরীক্ষা কেমন চলছে। শুধু কোনোমতে গা ছাড়া ভাবে জিজ্ঞেস করে ভার আদায় করেছে। অথচ অন্যান্য সময় তো সে নিজে পরীক্ষার হলে শিমুলকে পৌঁছে দিতো আবার পরীক্ষা শেষে সাথে করে নিয়ে আসতো। পরীক্ষার হল থেকে শিমুল বের হওয়া মাত্রই ওর মুখের কাছে ডাব এগিয়ে দিয়ে বলতো
-” নাও, ডাব খাও। এতক্ষন পরীক্ষা দিয়ে তোমার চোখ বসে গেছে। মুখটাও খুব নিস্তেজ লাগছে। এটা খেলে ক্লান্তিটা কেটে যাবে।”
শিমুল খেতে চাইতো না। ডাবের পানি শিমুলের তেমন পছন্দ না। জোর করে অনিম তাকে খাওয়াতো। অথচ এইবার একদিনও তো অনিম এলো না তাকে হল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। ফোনের রিংটোনে শিমুলের ভাবনা ছেদ পড়লো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে মুহিবের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করলো শিমুল,
-” কেমন আছেন মুহিব ভাই?”
-” হুমমম ভালো। তুমি কেমন আছো?”
-” আমার আর ভালো থাকা……”
শিমুলের উত্তরটা শুনে মুহিবের ভেতরটায় মোচর কেটে উঠলো। মুহিব জানে শিমুল ভালো নেই। একদমই ভালো নেই শিমুল। তার জীবনটা ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে। এ কথাটা এখনও শিমুলের জানা নেই। মুহিব এ ব্যাপারে আর কথা না বাড়িয়ে কথার প্রসঙ্গ অন্য দিকে টেনে নিলো।
-” পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?”
-” এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
-” আর কয়টা বাকি আছে?”
-” আর একটা বাকি। কাল সকালে পরীক্ষা শুরু হবে। দুপুর একটায় শেষ হয়ে যাবে।”
-” যাক ভালোই হলো তাহলে। পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলে তুমি নিশ্চিন্তে আমার সাথে যেতে পারবে।”
-” আপনার সাথে? কোথায়?”
-” কাল বিকেলে আমার জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। তুমি আর অনিমও যাবে সাথে।”
-” ওহ্! তাই নাকি? যাক অবশেষে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলেন। খুব খুশি হয়েছি মুহিব ভাই। কখন বের হবেন আমাকে জানিয়ে রাখবেন। আমি সেই আন্দাজে রেডি হয়ে থাকবো।”
-” ঠিকাছে, রাখি তাহলে। কাল তোমাকে জানিয়ে দিবো আমরা কখন বের হবো।”
-” আচ্ছা।”
মুহিব ফোন টা রেখে বাবার দিকে তাকালো।
-” আব্বা আমি ঠিক করছি তো?”
-‘ তুই ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেনো মুহিব?”
-” শিমুল এসব জানার পর যদি কিছু করে ফেলে?”
-” শিমুল একদিন না একদিন এসব জানবেই। যতদিন যাবে পরিস্থিতি ততবেশি খারাপ হবে। শিমুলের কষ্ট ততবেশি বাড়বে। অনিম শিমুলের আড়ালে যা করে বেড়াচ্ছে এসব কতদিন ঢাকা থাকবে তুই ই বল। এখন পর্যন্ত অনিমকে ঐ মেয়ের সাথে তোর অনেক বন্ধুবান্ধবই দেখেছে। ওরা অনিমের বন্ধু তাই শিমুলকে কেউ কিছু জানায়নি। আজ যদি শিমুলের ভাই বা দুলাভাই অথবা কোনো আত্মীয় অনিমকে দেখে ফেলেতাহলে তারা কি মুখে আঙুল দিয়ে বসে থাকবে? কখনোই না। ওরা শিমুলকে জানাবেই।”
-” তবুও আব্বা….. অনিমকে একবার বুঝিয়ে দেখবো?”
-” ও তো তোর কাছে এখন পর্যন্ত স্বীকারই করলো না। তুই তো ওকে এই নিয়ে পাঁচ ছয়বার জিজ্ঞেস করেছিস। ও কি আজও স্বীকার করেছে?”
-” না।”
-” কোনোদিন করবেও না। কারন ও খুব ভালো করেই জানে তুই কখনোই এই নোংরামিতে ওকে সাপোর্ট করবি না। দেখ মুহিব তোকে বাস্তব কিছু কথা বলি। হতে পারে কথাগুলো স্বার্থপরের মতো শোনাবে। তবুও বলছি। নিজের ভালোবাসাকে অন্যের হাতে সঁপে দেয়াটা মহত্ত্বের কাজ না। এটা একটা বোকামি। হ্যাঁ, যদি শিমুল সুখে থাকতো অনিম বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তাহলে কখনোই এই কথাটা বলতাম না। বলছি কারন অনিম আমাকে বলার সুযোগ করে দিয়েছে। সেদিন যদি মেয়েটাকে তুই অনিমের হাতে তুলে না দিতি তাহলে ওর আজকে এই দিন দেখতে হতো না। সামনে ওর জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে তা কি তুই জানিস? আজ যদি শিমুল কোনো অঘটন ঘটিয়েও থাকে তাহলে সেটার জন্য তুইও কিছুটা হলেও দায়ী থাকবি। আজ যদি শিমুলের বিয়ে তোর সাথে হতো তাহলে কখনোই এমন মানসিক যন্ত্রনায় দিন কাটাতে হতো না।”
-” প্লিজ আব্বা, এভাবে বলবেন না। এমনিতেই অনিমের কীর্তিকলাপ দেখার পর থেকে দুই চোখের পাতা এক করতে পারছি না আমি। কি করলাম আমি এটা শিমুলের সাথে? অনিমের হাতে কিভাবে তুলে দিলাম আমি?”
-” তোকে এই কথাটাই আমি বলছি। আল্লাহ তোকে সুযোগ আরেকটা দিয়েছেন। সেটাকে হাতছাড়া করিস না। শিমুলের সাথে অনিমের সংসার কখনোই টিকবে না। হতে পারে এখন অনিম কোনো কারনবশত শিমুলকে ডিভোর্স দিচ্ছে না। কিন্তু ছয় মাস একবছর পর ঠিকই দিয়ে দিবে। শিমুলকে পাওয়ার আরেকটা সুযোগ তুই পাচ্ছিস মুহিব। আমার মতে ছাড়াছাড়ি যেহেতু হবেই তাহলে ভালো হবে আগেভাগেই হয়ে যাক। যে মানুষটা শিমুলকে ভালোইবাসে না তার কাছে ওর পড়ে থেকে অহেতুক কষ্ট পাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তুই যেভাবে প্ল্যান করেছিস সেভাবেই এগোতে থাক। একদম ভয় পাবি না। কিচ্ছু হবে না শিমুলের। ও যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে। তাছাড়া ওর এসব দেখার প্রয়োজন আছে যে ছেলেকে ও এতো ভালোবাসে সে ওর পিছনে কি করছে। আর মুহিব, চাইলে অনিমকে তুই ধরে বেঁধে শিমুলের সাথে অনিমের সংসারটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারবি। কিন্তু কোনো ফায়দা হবে না। মনের উপর কখনো জোর হয়না। অনিম শিমুলের সাথে পড়ে থাকবে ঠিকই কিন্তু কখনোই শিমুলের প্রতি সংসারের প্রতি মন বসাতে পারবে না। মনটা ওর নীলার কাছেই পড়ে থাকবে। এমন একটা অসুস্থ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানে কি বল?”

রেডি হচ্ছে মুহিব। পাঁচটা নাগাদ সে ঘর থেকে বের হবে। শিমুল আর অনিমকেও বলে রেখেছে পাঁচটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকতে। আজ কোনো মুরুব্বি মুহিবের সাথে যাবে না। যাবে না বলতে মুহিব নিবে না। কারন সে কোনো মেয়ে দেখার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেনা। যাচ্ছে অনিমের জন্য ফাঁদ পাততে।
সেদিন রাতে বাবার মোবাইলে ছবিগুলো দেখার পর পরদিনই দুজন ছেলেকে অনিমের পিছনে লাগিয়ে রেখেছিলো দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। তাদের কাছ থেকে যে সমস্ত কথা মুহিব শুনেছে তা এখন পর্যন্ত মুহিবের কানে প্রতিনিয়ত ঢোলের বাড়ির মতো বেজেই যাচ্ছে। নীলা বর্তমানে একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করে। প্রতি সন্ধ্যায় অনিম তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে। কখনোবা অফিস থেকে বেরিয়ে দুজনে কোনো রেস্টুরেন্ট বা লেকের পাড়ে অন্তরঙ্গ মূহূর্ত কাটায়। আবার কখনোবা অনিম নীলার বাসায় যায়। ঘন্টা চার পাঁচেক কাটিয়ে রাত সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ বেরিয়ে আসে। নীলা প্রায়ই হুটহাট অনিমকে পাবলিক প্লেসে চুমু খেয়ে বসে। ব্যাপারটা অনিম যে বেশ ভালোই উপভোগ করে সেটা তার মুখ দেখেই নাকি বুঝা যায়। মুহিব নিজেও চারদিন আগে একদিন অনিমকে দেখেছে। চলন্ত বাইকে ছিলো সে, পেছনে ছিলো নীলা। মূহূর্তেই মুহিবের দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে গিয়েছিলো অনিম। তাই তাকে সেদিন হাতে নাতে ধরতে পারেনি। বন্ধুমহলেও সপ্তাহখানেক যাবৎ বেশ চর্চা হচ্ছে অনিমের বিষটা নিয়ে। ঘনিষ্ঠ তিনজন বন্ধু অনিমকে দেখেছে নীলার সাথে এই একমাসের ভেতর। তারা সবাই অনিমকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। মুহিবের সাথে তো বলতে গেলে ছোটখাটো তর্কাতর্কিও হয়ে গেছে এ নিয়ে অনিমের। অনিম কোনোভাবেই সত্যি স্বীকার করতে নারাজ। বিগত একমাস যাবৎ পায়ের রক্ত মাথায় উঠে আছে মুহিবের। চাইলে সে অনিমের একটা দফারফা করতে পারতো। তবে সে গরম মাথায় সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ না। বহু ভেবে চিন্তে সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে অনিমের জালেই অনিমকে আটকাবে। তিনদিন আগে নীলার অফিস আওয়ারে মুহিব নীলাদের বাসায় গিয়েছিলো। নীলার মা গেট খুলে মুহিবকে দেখে হতবম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন। খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-” তুমি এখানে?”
-” কতবছর পর আপনার বাসায় এলাম আন্টি। আর আপনি কি না গেটে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করছেন। ভেতরে এসে কথা বলি?”
এ কথা বলে মুহিব আর ভদ্রমহিলার উত্তরের আশা করলো না। নিজেই ঘরে ঢুকে ড্রইংরুমের সোফায় বেশ আয়েশ করে বসে পড়লো। কিছুক্ষন এই কথা সেই কথা জিজ্ঞেস করলো মহিলাকে। তিনি যে না পারতে উত্তর দিচ্ছেন সেটা মুহিব তার চেহারার নকশা দেখেই বুঝে গেলো। এরপর মুহিব বললো,
-” আন্টি এবার আসল কথায় আসি যেটার জন্য আমার এখানে আসা।”
-” কি কথা?”
-” নীলার তো বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। কিছু ভেবেছেন ওর বিয়ের ব্যাপারে?”
-” পার হলো কোথায়? সবে তো মাত্র পঁচিশে পড়লো দুমাস আগে।”
-” পঁচিশ বছর বয়স কি একটা মেয়ের জন্য আপনার কাছে কম মনে হচ্ছে? এই বয়সে মেয়েরা বাচ্চা কাচ্চার মা হয়ে যায়।”
-” শোনো আমার মেয়ের বয়স নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। যখন সময় হবে তখন বিয়ে দিবো।”
-” অহেতুক কোনো মাবাবা তার মেয়েকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত ঘরে বসিয়েরাখে না আন্টি।”
-” আমরা রাখি।”
-” কেনো রাখেন সেটা আমি ভালোই জানি। অনিমের জন্য তাইনা?”
মুহিবের মুখে অনিমের নাম শোনা মাত্রই নীলার মায়ের মুখ ফ্যাকাশে হয় গেলো। কিছুক্ষন চুপ থোকার পর এক ভ্রু উচিঁয়ে বেশ চড়া গলায় বললেন,
-” এগুলো কিসব বাজে কথা বলছো হ্যা?”
-” অস্বীকার করছেন কেনো আন্টি? অনিমের সাথে যে আপনার মেয়ের প্রেম চলছে সেটা তো আপনি ভালো করেই জানেন। শুধু প্রেম বললে ভুল হবে। গভীর প্রেম চলছে ওদের মধ্যে। এই প্রেমের গভীরতা কতটুকু সেটা তো নিশ্চয়ই আপনিও জানেন। ”
-” তোমাকে এসব কে বলেছে?”
-” আমাকে কে বলেছে সেটা বড় বিষয় না। বড় বিষয় হচ্ছে এটা আমি আপনার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। একদম লুফে নেয়ার মতো প্রস্তাব।”
-” কি প্রস্তাব?”
-” নীলাকে আমার সাথে বিয়ে দেন।”
এই কথা শুনে এবার নীলার মায়ের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে।
-” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো আন্টি? আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি?”
-” তোমার কাছে আমি মেয়ে বিয়ে দিবো কেনো?”
-” কেনো দিবেন না? অবশ্যই দিবেন। আপনার মেয়ের ভবিষৎ এর কথা চিন্তা করে দিবেন। এই মূহূর্তে আপনার মেয়ে যার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে একটা বিবাহিত ছেলে। তার সাথে আপনার মেয়ের ভবিষৎ কখনোই সিকিউরড না। আপনার মেয়েকে বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে অনিমের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়। একটা জোয়ান ছেলে আপনার মেয়ের বেরুমে ঢুকে গেট লাগিয়…… থাক সেদিকটাতে না যাই। হবু বউ সম্পর্কে এমন কুৎসিত কথা বলাটা সাজে না। তবে আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি কথাটা কি বলতে চেয়েছি। অনিমের ঘরে বউ আছে। দিনশেষে তাকে বউয়ের আঁচলের নিচেই যেতে হয়। তাছাড়া সমাজে কখনোই নীলা অনিমের সম্পর্ক মেনে নিবে না। সবাই শিমুলের সাপোর্টই করবে। তাহলে শুধুশুধু একটা বিবাহিত ছেলের সাথে আপনার মেয়েটাকে আপনি অন্তরঙ্গ হতে দিচ্ছেন কেনো?আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে না মেয়েটার জীবন ধ্বংস করছেন আপনি?”
-” অনিম তো আমার মেয়েকে ভালোবাসে।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here