#দহন
#পর্ব_৯
#লেখা_মিম
-” হতে পারে অনিম ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত আছে এজন্য তোমাকে সময় দিতে পারছে না। তুমি অযথাই চিন্তা করছো।”
-” মুহিব ভাই আমার চিন্তাটা আমাকে অনিম সময় দিচ্ছেনা সেটা নিয়ে না। আমার চিন্তাটা হচ্ছে অনিমের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। ও সর্বক্ষন কি নিয়ে যেনো চিন্তা করে, মনমরা হয়ে বসে থাকে। সবসময় কেমন একটা গা ছাড়া ভাব। এসব আমার আর ভালো লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
-” আরে ধুর…. বাদ দাও তো এসব চিন্তা। তুমি আমার কথা শোনো। সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো। অনিমের সামনে সবসময় হাসিখুশিভাবে থাকবা, ওকে হাসানোর চেষ্টা করবা। ওর সাথে বারবার নিজ থেকে সেধে কথা বলবা। বাহিরে ঘরতে যাও ওকে নিয়ে, খাওয়া দাওয়া করো দেখবে ওর মাইন্ড ফ্রেশ হয়ে গেছে। ওকে চিন্তিত দেখে যদি তুমি চিন্তা করে অস্থির হয়ে যাও তাহলে হবে কিভাবে? ওকে সাপোর্ট করবে কে?”
-” হুম।”
-” হুম বললে হবে না। যেভাবে বলছি সেভাবে করতে হবে।”
-” ভাইয়া আপনি ওর সাথে কথা বলে দেখেন না ওর কি হয়েছে?”
-” হ্যাঁ সেটাতো আমি বলবোই। আজ সন্ধ্যায়ই বলবো। ওকে বাসায় আসতে বলবো আজকে সন্ধ্যায়।”
-” আপনি কিন্তু ও বের হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জানাবেন কি বলেছে ও।”
-” ঠিকাছে বলবো। তুমি এক কাজ করো। আজ রাতে অনিমকে নিয়ে ডিনার ডেটে যাও। আমি ওর সাথে ঘন্টকখানেক কথা বলে বাসায় পাঠিয়ে দিবো।এরপর দুজন মিলে বাহিরে যাও।”
-” আচ্ছা।”
-” রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করে দিবো তোমাদের দুজনের জন্য?”
-” না ভাইয়া, লাগবে না। আমিই করে নিবো।”
-” তাহলে তুমি এখন বাসায় চলে যাও। আমিও বাসায় যাই। অনিমকে ফোন দিয়ে আসতে বলি।”
-” হুম।”
-” রিকশায় যাবা নাকি আমি গাড়ি দিয়ে তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসবো?”
-” আমি রিকশাতেই যাবো। আপনি বাসায় চলে যান। আপনি অসুস্থ শরীরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন এটাই অনেক কিছু।”
-” শোনো, তোমার যেকোন সমস্যা আমাকে নির্দ্বিধায় বলবে। এবার আমি অসুস্থ থাকি আর সুস্থ থাকি। এখন চলো তোমাকে রিকশা ঠিক করে দেই।”
-” লাগবে না। আমি একাই ঠিক করে নিবো।”
-” তুমি অনেক তর্ক করো শিমুল।চলো তো আমার সাথে।”
শিমুলকে রিকশায় তুলে দিয়ে মুহিব তার বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই সে ফোন করলো অনিমকে। অনিম সন্ধ্যায় আসবে জানিয়েছে। শিমুলকে নিশ্চিন্ত থাকার পরামর্শ দিলেও নিজে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না মুহিব। কি এমন হলো অনিমের? তার যত যাই সমস্যা হোক শিমুলের সাথে তো এমন করার কথা না। শিমুলকে অনিম অসম্ভব ভালোবাসে। তাহলে শিমুলকে এমন এড়িয়ে যাচ্ছে কেনো? আর সে তো তার কোনো সমস্যাই মুহিবের কাছে লুকায়না। সব সমস্যার কথা মুহিব জানে। তাহলে এই সমস্যার কথা মুহিবকে কেনো জানাচ্ছেনা? নাহ্ কোনোভাবেই অনিমের ব্যাপারটা নিয়ে হিসেব মেলাতে পারছেনা মুহিব। হিসেবটা সে তখনই মেলাতে পারবে যখন অনিম তাকে সমস্যার কথাটা খুলে বলবে।
মাগরিবের আযানের বিশ মিনিট পর অনিম মুহিবদের বাসায় এলো। কিছুক্ষন এই কথা সেই কথা বলে আগে মুহিব অনিমের ভাব-গতিটা বুঝে নিলো। তার কাছেও অনিমের ভাব গতি বিশেষ ভালো ঠেকছে না। মনে হচ্ছে অনিম এখানে থেকেও নেই। ওর শরীরটা এখানে থাকলেও মনটা পড়ে আছে অন্যখানে। কথার মাঝে মুহিব অনিমকে জিজ্ঞেস করলো,
-” ভাই তুই কি কোনো ব্যাপারে চিন্তায় আছিস?”
-” নাহ্। কেনো বলতো?”
-” মিথ্যা কথা বলছিস কেনো অনিম? তোকে আমি ছোট থেকে চিনি। তোর মুখ দেখেই বুঝতে পারে তোর মনে কি চলছে।”
-” আরে বাবা, মিথ্যা কথা বলতে যাবো কেনো বলতো? আমি বলছি তো কিচ্ছু হয়নি।”
-” দেখ, অহেতুক কথা লুকাবি না তো। বলে……”
মুহিব তার কথাটা শেষ করতে পারেনি এর আগেই অনিমের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনে রিং হওয়ার সাথে সাথেই সেটা রিসিভ করে অন্য রুমে চলে গেলো অনিম। মিনিট তিনেক পর সে মুহিবকে এসে বললো,
-” দোস্ত আজকে আমি যাই। অনেক জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তোর সাথে আমি কাল পরশু আবার দেখা করতে আসবো। তখন তোর যা জিজ্ঞেস করার করিস।”
-” তুই…..”
মুহিবকে কথাটা শেষ করতে দিলো না অনিম। এর আগেই সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। অনিমের আচরনে খুব অবাক হচ্ছে মুহিব। অনিম সবসময়ই সব ধরনের ফোন মুহিবের সামনেই রিসিভ করে। কারন মুহিবের কাছে সে কিছুই লুকায়না। তাহলে আজ কে ফোন দিয়েছিলো যে সে মুহিবের সামনে ফোনটা রিসিভ করলো না? তার উপর সে এভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। অনিম তো কখনোই এমন করেনা। যত কাজই আসুক না কেনো মুহিবের কথা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে মুহিবের সামনে থেকে নড়ে না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে শিমুলকে সে কি জানাবে? এখনের ঘটনাগুলো ওকে না বলাই শ্রেয়। আর নয়তো মেয়েটা আরো বেশি চিন্তা করবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো শিমুলকে মিথ্যা কথা বলবে। শিমুলের মোবাইলে ফোন করলো মুহিব।
-” হ্যা ভাইয়া বলেন।”
-” অনিম এসেছিলো। ওকে জি জ্ঞেস করেছি।”
-” কি বললো?”
– ” তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম ব্যবসায়ের চাপে আছে বোধহয়। তাই ই হয়েছে। সামনে অনেক বড় একটা ডিল হাতে পাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই এমন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। তুমি একদম চিন্তা করোনা। একদম নিশ্চিন্তে খাওয়া দাওয়া করো, ঘুমাও, অনিমের সাথে চুটিয়ে প্রেম করো, সংসার করো। আর সামনে তোমার পরীক্ষা। অতএব এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ঠান্ডা মাথায় পড়াশোনা করো। কিছুদিন পর অনিমের ব্যস্ততা কেটে গেলে দেখবে আগে তো সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”
রাতে খাবার শেষে সাড়ে দশটার দিকে মুহিব তার রুমে বসে মোবাইলে গান শুনছে আর শিমুলের কথা ভাবছে। মাত্রই তো বিয়ে হলো মেয়েটার। সংসার পেতেছে একমাসও তো হয়নি। অথচ এখনই মেয়েটার চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। অনিমের যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে সে তো সেটা নিঃসংকোচে শিমুলকে বলতে পারে। শিমুল যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে যেভাবেই হোক অনিমকে সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। আজ বিকেলে সে শিমুলের চোখে পানি দেখেছে। ভেতরটা তখন তার দুমড়ে মুচড়েযাচ্ছিলো। এখন পর্যন্ত শিমুলের সেই চোখজোড়া তার চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছে না। পিঠের উপর কারো স্পর্শে মুহিবের চিন্তায় ছেদ পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তার বাবা বসে আছে পিছনে। কান থেকে হেডফোন খুলে বললো
– ওহ্ আপনি আসছেন।
-” বিগত পাঁচ ছয় মিনিট যাবৎ তোর পিছনেই বসে আছি। অথচ তুই টেরই পাসনি।”
-” ঐ তো…. গান শুনছিলাম এজন্য খেয়াল করিনি।”
-” কথাটা ভুল বললি। তুই কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলি এজন্য খেয়াল করিসনি।”
-” ………….”
-” তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।”
-” হ্যা আব্বা বলেন কি কথা। আমার বিয়ের ব্যাপারে?”
-” না, অনিমের ব্যাপারে।”
-” অনিমকে নিয়ে!”
-” হুমম….”
-” বলেন।”
-” আজকে সন্ধ্যায় এক ক্লাইন্টের সাথে দেখা করে বাসায় ফিরছিলাম। রামপুরার দিকে জ্যামে আটকে ছিলাম আট দশ মিনিটের মতো। তখন দেখলাম সেই জ্যামে অনিমও আটকা পড়ে আছে। ওর বাইকের পিছনে একটা মেয়ে বসে আছে।”
-” মেয়ে! হতে পারে ওর পরিচিত কেউ। ওর বান্ধবী হবে হয়তো।”
-” মেয়েটা ওর বান্ধবী ছিলো না। এর চেে বেশি কিছু ছিলো।”
-” মানে?”
-” মেয়েটা ওকে পিছন থেকে শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। ওর পিঠের উপর বারবার নাক ঘষছিলো।”
মুহিব প্রথমে ওর বাবার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলো। কিছুক্ষনের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে তার বাবাকে বললো,
-” কি বলেন উল্টাপাল্টা কথা বার্তা! কাকে না কাকে দেখেছেন আর বাসায় এসে বলছেন অনিমকে দেখে আসছেন। আপনি ভুল দেখেছেন আব্বা।”
-” মোটেই না। আমি ভুল দেখিনি।”
-” আপনি ভুলই দেখেছেন। অনিম কখনোই এমন করতে পারেনা। শিমুল ছাড়া অন্য মেয়েকে সে কখনোই জড়িয়ে ধরার অধিকার দিবেনা। আর জড়িয়ে ধরার অধিকার তো দূরের কথা অন্য মেয়ের সাথে ওকে আমি ঠিক করে কখনো কথাও বলতে দেখিনি। ও শিমুলকে অসম্ভব ভালোবাসে। আপনি অন্ধকারে অন্য কাউকে দেখছেন। হতে পারে ছেলেটা অনিমের মতো দেখতে কিছুটা তাই আপনার এমন গড়মিল হয়েছে।”
-” আমার কোনো গড়মিল হয়নি। সেটা অনিমই ছিলো। যদি চলতি গাড়িতে বসে ওকে দেখতাম তাহলে ধরে নিতাম ভুল দেখেছি। কিন্তু আমি জ্যামে আটকা থাকা অবস্থায় দেখেছি। প্রথমে ওর পিছন দিক থেকে দেখে সন্দেহ হচ্ছিলো এটা অনিম। কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো না। কারন অনিমকে আমি চিনি ও কেমন ছেলে। দুই তিনমিনিট পর যখন ও ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলছিলো তখন ওর মুখটা দেখেছি।”
-” ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বললে তো পুরা মুখ দেখতে পাওয়ার কথা না। কারন আপনি নিজেই বলছেন আপনি নাকি ওর পিছনে ছিলেন।”
-” হ্যাঁ পুরো মুখ দেখতে পাইনি। শুধু সাইড থেকে দেখেছি।”
-” যেহেতু আপনি পুরো মুখ দেখেননি তাহলে এটা কখনোই অনিম না। এটা অন্য কেউ।”
-” আমি অনিমকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। ওর সাইড ফেইস দেখে আমি ওকে চিনতে পারবো না?”
-” আব্বা ঘটনা অন্য কিছু হলে আমি বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এভাবে একটা মেয়েকে নিয়ে? না না আব্বা।”
-” ভুলটা আমারই হয়েছে। আমার উচিত ছিলো ছবি তুলে আনা।”
এ কথা বলেই মুহিবের বাবা মুখটা কালো করে মুহিবের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। খুব মেজাজ গরম হয়ে গেছে উনার ছেলের উপর। কি অদ্ভুদ! তিনি তো আর অনিমের শত্রু না যে ওর নামে মিথ্যা কথা বলে বেড়াবেন। হ্যাঁ হতে পারে তার ছেলের ভালোবাসার মানুষটাকে অনিম বিয়ে করে ফেলেছে। তারমানে তো এই না যে উনি এখন অনিমের উপর প্রতিশোধ নিবেন। তাছাড়া প্রতিশোধ নেয়াটা খুবই অন্যায় হবে। কারন শিমুলকে নিজের দোষেই মুহিব হারিয়েছে। এখানে শিমুল বা অনিম কারোই কোনো দোষ নেই। তারউপর মুহিব বারবার বলছে আপনি ভুল দেখেছেন। ভুল দেখতে যাবেন কেনো? উনি তো আর আশি বছরের বুড়ো নন যে চোখের জ্যোতি একদমই কমে গেছে তাই তিনি চোখে দেখেন না।। এখন তিনি ভাবছেন আজ যেহেতু অনিমকে হাতেনাতে ধরতে পেরেছেন তারমানে অনিমকে তিনি ফের ধরতে পারবেন।যেহেতু বাইরে মেয়েকে নিয়ে ঘুরাফেরা করে তাহলে তো রাস্তাঘাটে আবার দেখা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এরপরের বার তার ছেলের কাছে প্রমান ছাড়া আর আসবেন না। একেবারে পাকাপোক্ত প্রমান নিয়ে আসবেন। তাছাড়া অনিমের পিছনে লোক লাগাতে হবে। তাহলেই এই মেয়ের গোমড়টা তার কাছে ফাঁস হবে।
মুহিব এই মূহূর্তে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। ওর বাবা কি বলে গেলো এসব? আচ্ছা বাবা কি সত্যিই দেখলো? অনিম যে এতটা বদলে যাচ্ছে ঐ মেয়ের জন্যই তাহলে? না না…… অনিম এমন করবে না। বিশ্বাসঘাতকতা করা অনিমকে দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু বাবার কথাটা একেবারে ফেলেও দেয়া যাচ্ছে না। যদি সত্যিই এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে শিমুলের কি হবে?
(চলবে)