দহন পর্ব ৮

#দহন
#পর্ব_৮
#লেখা_মিম

মুহিবের বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার মুখে বিরক্তি এবং দুশ্চিন্তা উভয়ই দেখা যাচ্ছে। মুহিব মাথা নিচু করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ছেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে এরপর মুহিবের বাবা মুখ খুললেন।
-” বাবা রে তুই এমন একজনকে মন দিয়েছিস যাকে কোনোদিনও আমি তোর জন্য এনে দিতে পারবো না। মেয়েটা অন্য কারো বউ। এটা কিভাবে সম্ভব রে বাবা?”
-“……………….”
-” সবচেয়ে বড় কথা শিমুল তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বউ। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা? এই কথা কাউকে তুই বলতেও পারবি না যে তুই শিমুলকে ভালোবাসিস। কথাটা খুবই জঘন্য একটা কথা। মেয়ে যদি সিঙ্গেল হতো তাহলে যেভাবে পারি তোর জন্য ঐ মেয়েকে নিয়ে আসতাম। অন্যের বউকে তোর জন্য কিভাবে এনে দিবো? এটা অন্যায় মুহিব।”
-“…………….”
-” তুই এতবড় ভুলটা কিভাবে করলি রে বাবা? তোর এই একটা ভুলের জন্য তোকে কতটা কষ্ট পেতে হচ্ছে। তোর চোখের পানি আমার সহ্য হয়না। একটু আগে যখন অনিম শিমুলের হাত ধরে কেবিন থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন আমি দেখেছি তুই ওদের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলি। তোর চোখে পানি ছলছল করছিলো। এভাবে আর কতদিন কষ্ট পাবি বল? গতকালের এক্সিডেন্টটাও হয়েছে এ কারনেই। তুই মিথ্যা কথা বলেছিস। তুই ফোনে কারও সাথে কথা বলছিলি না। তুই অন্যমনস্ক হয়ে বাইক চালাচ্ছিলি। এজন্য তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে। ঠিক বলছি না আমি?”
-“…………”
-” কি রে তোকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। উত্তর দেস না কেনো?”
-” হ্যা আমি ফোনে কথা বলছিলাম না। অন্যমনস্ক ছিলাম।”
-” এভাবে আর কতদিন মুহিব? কতদিন তুই অন্য ছেলের বউ এর জন্য নিজেকে কষ্ট দিবি? দুনিয়াতে কি শিমুল ছাড়া আর কেউ নেই? বন্ধুর বউ এর দিকে কেউ কু- নজর দেয়?”
-” আব্বা আমি কোনো কু-নজর দেইনি। শিমুলকে আমি ভালোবাসি। ”
-” ছাগলের মতো কথা বলবি না। তুই জানতি পর্যন্ত অনিমের শিমুলের সাথে সম্পর্ক। তবুও কিভাবে তুই শিমুলকে ভালোবাসতে পারিস?”
-” আব্বা, শিমুলকে তখন থেকে আমি ভালোবাসি যখন অনিম ওকে চিনতোই না।”
-” মানে কি? ”
-” হুম…. শিমুলকে আমি অনিমের আগে থেকেই ভালোবাসি।”
-” তুই যদি আগে থেকেই ওকে ভালোবাসতি তাহলে ওর অনিমের সাথে প্রেম হলো কিভাবে?”
-” শিমুল তখন মাত্র এস.এস. সি. পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমাদের এলাকায় তখন নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে আসছে ওর ফ্যামিলি।”
-” শিমুলরা কি আগে আমাদের এলাকায় থাকতো?”
-” হ্যা, গতবছর বাসা চেইন্জ করে পাশের এলাকায় গিয়েছে।”
-” তারপর….।”
-” ওকে প্রতিদিন বিকালে ছাদে উঠলেই দেখতে পেতাম। প্রথমদিনই ওকে নজরে আটকে যায়। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি ওর মাত্র কিছুদিন আগে রেজাল্ট বেরিয়েছে। কলেজে ভর্তি হবে কয়েকদিনের মধ্যে। ভেবে দেখলাম মেয়ে এখনো অনেক ছোট। ওকে এখন বিয়ে করা সম্ভব না। তারউপর প্রেম করতে গেলেও ওর পড়ালেখা নষ্ট হবে। বয়স অনেক কম মেয়েটার। নিজের ফিলিংসের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারবে না। পরে দেখা যাবে সারাদিন আমাকে নিয়ে পড়ে থেকে পড়ালেখা নষ্ট করবে। এজন্য তখন আর কছু বলিনি। দূর থেকে ওর দিকে নজর রাখতাম। একবার ভেবেছিলাম আপনাকে বলবো। ভাবলাম আপনাকে বললে আপনি সেদিনই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে চলে যাবেন। তাই আর আপনাকে কিছু জানাইনি। মাস দুয়েক যাওয়ার পর একদিন অনিম এলো বাসায়। ওকে নিয়ে ছাদে গেলাম। দেখি অনিমেরও ওর দিকে নজর পড়েছে।”
-” তখন তুই অনিমকে তোর মনের কথা বলিসনি?”
-” না তখনও বলিনি। আমি কিছু বলার আগেই ও আমাকে বললো ও শিমুলকে চায়।”
-” গাধা নাকি তুই? বলতে পারলি না তুই শিমুলকে ভালোবাসিস?”
-” না আব্বা আমি ওর মুখের উপর বলতে পারিনি। তখন চার মাস আগে ওর নীলার সাথে ব্রেকআপ হয়েছে। ঐ চারমাসে ও কতটা কষ্ট পেয়েছে সেটা আমি দেখেছি আব্বা। চারমাস পর সেদিন বিকেলে আমি অনিমকে একটু খুশি দেখেছিলাম। বাপ-মা ছাড়া এতিম ছেলেটার জীবনে কেউ নেই। ও শিমুলকে ওর খুশির অবলম্বন করতে চেয়েছিলো। আমি কিভাবে ওকে মুখের উপর না করতে পারতাম আপনিই বলেন?”
-” মুহিব সব সময় সব সিদ্ধান্ত আবেগ দিয়ে নিলে চলে না। কিছু কাজ সময় থাকতে করতে হয়। প্রেম কি আর কেউ এই দুনিয়াতে করেনা? শিমুল তখন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। নিজেরটা বুঝার মতো ক্ষমতা তার ছিলো। অনিম তো ওর সাথে তখনই প্রেমে জড়িয়েছে। কই শিমুলের পড়ার তো কোনো ক্ষতি হয়নি। তাহলে তুই কেনো এতসব ভাবতে গেলি?”
-” তখন আমি বুঝতে পারিনি আব্বা।”
-” ঠিকাছে তুই অনিমের জন্য শিমুলকে স্যাকরিফাইজ করেছিস বুঝলাম। তাহলে শিমুলকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছিস না কেনো?”
-” বিগত চারটা বছর যাবৎ নিজের সাথে যুদ্ধ করেই যাচ্ছি। কোনোমতেই পারছি না। যন্ত্রনা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। আর সহ্য হয়না। মাঝে মাঝে মন চায় মরে যাই। সেটাও করতে পারি না। বহুবার অন্য মেয়ের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি।”
-” বাবা রে, শিমুলকে ভুলে যা। দুনিয়াতে অসম্ভব বলে কিচ্ছু নেই। ও এখন তোর বন্ধুর বউ। ওর প্রতি মায়া রাখাটা জঘন্য কাজ। ওকে তুই স্যাকরিফাইজ করেছিস তো করেছিসই। সেখানে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।”
-” কি করবো আমি? পারি না তো ওর কাছ থেকে মনটা সরাতে। অনেক কষ্ট হয় আমার।”
-” এভাবে তিল তিল করে নিজেকে শেষ করার মানে কি রে মুহিব?”
-” আব্বা আপনি আমার সমস্যাটা বুঝতে পারছেন না। পারলে তো সেই কবেই ওর কাছ নিজেকে মুক্ত করে নিতাম।”
-” তুই সুস্থ হ। তোর আম্মাকে বলে আমি অন্য জায়গায় মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করছি। তোকে আমি দেড় দুইমাসের মধ্যেই বিয়ে দিবো। ঘরে বউ আসলে তোর মনটা স্থির হবে।”

পরদিন সকালে ফোনে মুহিব অনিমকে আসতে বললো হসপিটালে। অনিম শিমুলকে নিয়ে উপস্থিত হলো হসপিটালে।
-” কি রে অবস্থা কি এখন তোর?”
-” এইতো আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।”
-” জ্বর আর এসেছিলো?”
-” হুম গতকাল রাত নয়টার পর আসছিলো। ডক্টর এন্টিবায়োটিক দিয়ে গিয়েছে। ঘন্টাখানেক পরই আবার জ্বরটা নেমে গিয়েছে।”
-” ইয়ে…. মুহিব ভাই আপনার ফোনটা একটু দিবেন?”
-” কেনো?”
-” না একটু দরকার ছিলো। আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। আপনার মোবাইল থেকে একটা ফোন করতাম আরকি।”
-” শিমুল তুমি আমাকে বোকা পেয়েছো?”
-” কেনো? এই কথা বলছেন কেনো?”
-” তোমার মোবাইলে সবসময়ই ব্যালেন্স থাকে। অনিম তোমার মোবাইলের টাকা শেষ হওয়ার আগেই আবার ফ্লেক্সিলোড করে দেয়। এই খবরটা আমি অনেক আগে থেকেই জানি। তুমি মিথ্যা কথা বলে আমার কাছ থেকে মোবাইলটা নিতে চাচ্ছো আমি যাকে ভালোবাসি সেই মেয়ে সম্পর্কে কোনো clue বের করবার আশায়। তোমার কি ধারনা তুমি আমাকে বোকা বানাতে চাইবে আর আমিও তোমার কথামতো বোকা হবো?”
শিমুল মিটমিট করে হাসছে। অনিম হাসতে হাসতে শিমুলকে বললো,
-” তোমাকে বলেছিলাম না মুহিবকে বোকা বানানো এত সহজ না। তুমি ধরা পড়ে যাবে।”
-” দেন না ফোনটা মুহিব ভাই। আপনার মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। আমিই আপনার ফোন থেকে খুঁজে বের করবো।”
-” তোমার এতকিছু এখন না জানলেও চলবে শিমুল। আর ঐ মেয়ের টপিক বাদ দেও। আব্বা গতকাল বলছে আমার জন্য মেয়ে দেখবে। দেড় দুইমাসের মধ্যে আমার বিয়ে দিবে। আমার বিয়ে খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে যাও আর ঐ মেয়ের ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
-” আংকেল তোর জন্য মেয়ে দেখছেন?”
-” আব্বা তো তাই বললো…. এখন শোন তোকে যেজন্য ডেকে এনেছি।”
-” কিজন্য?”
মুহিব একটা প্যাকেট অনিমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-” এখানে কক্সবাজারে যাওয়ার এয়ার টিকিট আছে তোদের দুজনের আর পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। পরশু দিনের টিকিট কেটেছি। দুজনে মিলে হানিমুনটা সেরে আয়। সেখানে হোটেল রুমও বুক করে দিয়েছি। পাঁচ-সাত দিন সেখান থেকে ঘুরে আয়।”
-” তুই কি পাগল মুহিব ভাই?”
-” এটা আজকে নতুন জেনেছিস?”
-“তোকে এই অবস্থায় ফেলে আমি হানিমুন করতে যাবো তুই ভাবলি কি করে?”
-” এখানে ভাবা ভাবির কি আছে? আমার জন্য তোদের হানিমুন প্ল্যানটা কেনো পিছাবি? এখানে আমাকে দেখার মতো আরও অনেক মানুষ আছে। তুই চিন্তা করিস না। তাছাড়া পরশু আমি রিলিজ নিয়ে বাসায় চলে যাবো। সেখান থেকে ঘুরে আয় এরপর আব্বার পছন্দ করা মেয়েগুলোকে তুই আমি মিলে দেখে আসবো।”
-” মুহিব ভাই, এটা কখনোই সম্ভব না। আপনি অনিমের বেস্ট ফ্রেন্ড।আপনাকে এই অবস্থায় ফেলে অনিম কোথাও যাবে না। আর আপনাকে কে বলেছে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করতে?”
-” বলবে আবার কে? বন্ধুর জন্য এতটুকু তো আমি করতেই পারি। তাছাড়া তোমাকে তো বিয়ে তে কিছু দেইনি। তাই এটা wedding gift দিলাম।”
-” কে বলেছে দেন নি? স্বর্নের চুড়ি তো গিফট করেছেনই।”
-” ওটা তো আব্বা-আম্মার তরফ থেকে দিয়েছে। আমি তো কিছু দেইনি। এটা আমি অনিমকে গিফট করিনি। গিফট টা করছি তোমাকে। প্লিজ শিমুল না করোনা।”
-” মুহিব ভাই,, মাসখানেক পর আমার পরীক্ষা। এই মূহূর্তে হানিমুনে যেয়ে পড়ার বারোটা বাজানোর কোনো মানেই হয়না।”
-” আরে ধুর…. এক সপ্তাহ না পড়লে কিছু হবে না। সারাবছর তো পড়েছোই। যা আনন্দ করার, অন্তরঙ্গ মূহূর্ত কাটানোর এখনই কাঁটিয়ে নাও। কিছুদিন পর যখন বাচ্চা কাচ্চার মা হয়ে যাবা তখন আর শান্তিমতো হানিমুন করতে পারবে না।”
-” কিন্তু……”
-” আর কথা বাড়িয়ো না তো প্লিজ। যেটা বলছি সেটা শুনো। তোমার কি অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা আছে? থাকলে বলে ফেলো। যেখানে যেতে চাইবে সেখানের ব্যবস্থাই করে দিবো।”
-” না মুহিব ভাই।”
-” তাহলে ব্যস। আর কোনো তর্ক করবে না আমার সাথে। এখন বাসায় যাও। আস্তে ধীরে প্যাকিং করা শুরু করো। আর শোন অনিম, টাকা-পয়সা আরও দরকার পড়লে আমাকে ফোন দিস। আমি পাঠিয়ে দিবো।”
-” কেনো এসব করছিস মুহিব?”
-” তোর জন্য করছি না, করছি শিমুলের জন্য। এখন যা, বাসায় যা। আর শোন কালকে আসার দরকার নেই এখানে। কোনো কিছুর প্রয়োজন পড়লে আমি তোকে ফোন দিবো তখন তুই আসিস।”
আধাঘন্টা পর শিমুল আর অনিম বের হয়ে চলে এলো। মুহিবের দু’চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও সে অনিম শিমুলকে এক করে দিচ্ছে। কেনো সে এমন করছে তার উত্তর হয়তো তার নিজেরও জানা নেই। আবার হয়তোবা জানা আছে। মুহিবের বাবা পিছনে এসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালেন।
-” কি আনন্দ পাচ্ছিস এসব করে মুহিব?”
-“…………..”
-” তুই ওদের একসাথে দেখলে কষ্ট পাস অথচ সেই তুই ই কিনা ওদেরকে হানিমুনে পাঠাচ্ছিস?”
-” আব্বা, আমার অসুস্থতার জন্য শিমুল বারবার আমার চোখের সামনে আসে। ওকে যখন আমি অনিমের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথা বলতে দেখি, একজন আরেকজনের হাত ধরতে দেখি আমার সহ্য হয়না। এরচেয়ে ভালো হানিমুনের বাহানায় সপ্তাহখানেক আমার চোখের সামনে আসবে না। ততদিনে আমি খানিকটা সুস্থ হয়ে যাবো। শিমুল তখন আর অনিমকে সাথে নিয়ে আমাকে প্রতিদিন দেখতে আসবে না। আমি একটু শান্তি চাই আব্বা।”
-” আর কত কষ্ট পাবি তুই? এই যে ওদের হানিমুনে পাঠাচ্ছিস এতে কি তোর কষ্ট কমবে?”
-” জানি না আমি। শুধু এতটুকু জানি এই মূহূর্তে শিমুলকে যতখানি সম্ভব আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। আমি বুঝতে পারিনি বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমার যন্ত্রনা বেড়ে তিনগুন হয়ে যাবে। তখন ভেবেছিলাম ওদের বিয়েটা হয়ে গেলে বুঝি আমার মায়াটা শিমুলের উপর থেকে উঠে যাবে। এখন দেখছি উঠার বদলে আমার মায়ার যন্ত্রনা আরও বেড়ে গেছে।”
-” তুই সিদ্ধান্ত নিয়েছিসই এমন যার জন্য তোকে আজীবন কষ্ট পেতে হবে।”
-” প্রতি মূহূর্তে এমন এক আগুনে আমি জ্বলে পুড়ে মরছি যা কাউকে বলার মতো না। যার জন্য এই আগুনে জ্বলছি তাকেও কোনোদিন জানাতে পারবো না। আব্বা আমার জন্য শিগগির মেয়ে দেখেন। আমার মনোযোগ অন্যদিকে যেভাবে পারি ঘুরাতেই হবে।”
-” তুই কষ্ট পাস না বাবা। সব কষ্টেরই অন্ত থাকে। একটু ধৈর্য ধর। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। তোর জন্য আমি রাজকন্যা এনে দিবো। দেখবি তোর অতীতের কষ্ট সব ধুয়ে মুছে যাবে ঐ মেয়েকে পেয়ে।”

১১ দিন পর……

শিমুলের মাথা খারাপ হয়ে আছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। অনিমের ভাবগতি বিশেষ ভালো ঠেকছে না তার কাছে। বেশ ভালোই তো যাচ্ছিলো তাদের দিনগুলো। হুট করে কি হয়ে গেলো অনিমের শিমুল কোনোভাবেই ভেবে কূল কিনারা করতে পারছে না। মুহিবের প্ল্যান মোতাবেকই তারা গিয়েছিলো কক্সবাজার হানিমুন করতে। হানিমুনে যাওয়ার দুদিন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকভাবেই যাচ্ছিলো। তিনদিনের দিন সকালে নাস্তা করতে গিয়েছিলো রেস্টুরেন্টে। সেখানে যেয়ে অনিমের কি হলো কে জানে! সেখানে সে খুব দ্রুত গোমড়া মুখে নাস্তাটা সেড়ে বেরিয়ে চলে এলো শিমুলকে নিয়ে। হোটেলে এসে প্রায় আধাঘন্টা থম মেরে বসে ছিলো অনিম। শিমুল প্রথমে কিছুক্ষন চুপ থেকে অনিমের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছিলো। বুঝতে না পেরে অনিমকে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে তার। কোন উত্তর না দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অনিম। ঘন্টাখানেক পর ফিরে এলো সে। সেই এক ঘন্টায় শিমুল তাকে ফোন করেছিলো পাঁচবার। একটা ফোন কলও অনিম রিসিভ করেনি। রুমে ফিরে এসেই শিমুলকে বললো,
-” ব্যাগ প্যাক করো শিমুল। আজ বিকেলেই আমরা ঢাকা ব্যাক করছি।”
-” আজই? কেনো? আমরা তো আটদিনের প্ল্যান করে এসেছি। আজকে তো সবে তিনদিন যাচ্ছে।”
-” জরুরি কাজ আছে আমার। ঢাকা ফিরতেই হবে আমাকে। বুঝার চেষ্টা করো শিমুল।”
শিমুল বুঝতে পারলো অনিমের মন ছুটে গেছে। এখানে জোর করে থাকাটা ঠিক হবে না। হানিমুন তখনই উপভোগ করা যায় যখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই সেটাকে উপভোগ করতে চায়। কিন্তু অনিম তো এখানে আর কোনোভাবেই থাকতে চায়না। তাই শিমুল আর জোর করেনি। সেও অনিমের কথামতই ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। শিমুলের কান্না পাচ্ছিলো খুব অনিমের এমন আচরনে। বহু কষ্টে চোখের পানিটাকে চেপে রেখেছিলো সেদিন। কিন্তু দুদিন যাবৎ সে আর চোখের পানি চেপে রাখতে পারছে না। ঘন ঘন কান্না পাচ্ছে তার। মুখ চেপে কাঁদছে কিছুক্ষন পর পরই গত দুদিন যাবৎ। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই হুট করেই শিমুলের মনে পড়লো মুহিবের কথা। তার সাথে অনিমের ব্যাপারটা শেয়ার করলে কেমন হয়? সে তো অনিমের বেস্ট ফ্রেন্ড। অনিমের খুঁটিনাটি সবই তো সে জানে। তার সাথে কথা বললে হয়তো অনিমের সমস্যা সম্পর্কে জানা যাবে। কিন্তু এত কথা তো ফোনে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। তার তো মুহিবের সাথে দেখা করতে হবে। সে ফোন করলো মুহিবকে।
-” হ্যালো…..”
-” মুহিব ভাই……”
-” হ্যাঁ শিমুল বলো। কি খবর তোমার?”
-” এইতো আছি ভাই। আপনার কি অবস্থা? শরীর কেমন এখন আপনার?”
-” এই তো আগের চেয়ে ভালো। পা টা ঠিক হতে সময় লাগবে।”
-” মুহিব একটা কথা বলার ছিলো।”
-” হ্যা বলো।”
-” আমি জানি আবদারটা খুব অন্যায় হয়ে যাবে। আপনার শরীরটা ভালো না। হাঁটা চলা করতে কষ্ট হয়। না বলেও পারছি না। মুহিব ভাই আপনার সাথে অনেক কথা আছে আমার। একটু দেখা করবেন আমার সাথে?”
-” কি হয়েছে শিমুল? তোমার গলার স্বরটা এমন শোনাচ্ছে কেনো? কোনো সমস্যা? অনিম কিছু বলেছে তোমাকে?”
-” ভাইয়া অনেক কথা। দেখা করে সব বলবো। একটু আসবেন প্লিজ আমার সাথে দেখা করতে।”
-” আচ্ছা ঠিকাছে আসবো। কখন আসবো দেখা করতে?”
-” ভাইয়া চারটার দিকে আসেন। আপনার বাসার কাছে যে রেস্টুরেন্টটা আছে সেখানে বসবো। আপনার আসতে সুবিধা হবে।”
-” ঠিকাছে।”
মুহিব সাড়ে তিনটার দিকেই রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে। মুহিবের সময় আজ কাটছেই না। অস্থির লাগছে খুব শিমুলের ফোনটা পাওয়ার পর থেকে। কি হলো শিমুলের? কি এমন জরুরি কথা থাকতে পারে? ওর কন্ঠ শুনে তো মনে হচ্ছিলো ও খুব টেনশনে আছে। সোয়া চারটা নাগাদ শিমুল উপস্থিত হলো রেস্টুরেন্টে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে শিমুল বললো,
-” কখন এসেছেন মুহিব ভাই?”
-” অনেকক্ষন হয়েছে। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো শিমুল?”
এই কথাটা জিজ্ঞেস করার পরই শিমুলের চোখে পানি ছলছল করতে দেখলো মুহিব। ভেতরটা আৎকে উঠলো তার শিমুলের চোখে পানি দেখে। কিছুক্ষন চুপ থেকে মুহিব আবার জিজ্ঞেস করলো,
-” কি হয়েছে শিমুল?”
-” মুহিব ভাই অনিমের কি হয়েছে?”
-” অনিমের? কি হয়েছে? কোন ব্যাপারে বলছো তুমি?”
-” অনিমের কি কোনো সমস্যা যাচ্ছে মুহিব ভাই?”
-” আমার জানামতে ওর তো কোনো সমস্যা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই তো ওর সাথে আমার কথা হয়। কই ও তো তেমন কিছু বলেনি। কেনো শিমুল? কিছু হয়েছে তোমার সাথে?”
-” -” অনিম কেমন যেনো হয়ে গেছে?”
-” কেমন হয়ে গেছে?”
-” আগের মত কথা বার্তা বলেনা। সর্বক্ষন মন খারাপ করে বসে থাকে। ওকে দেখলেই মনে হয় ও বিশাল অপরাধ বোধে তিল তিল করে শেষ হচ্ছে। কিছু একটা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। হুটহাট ঘর থেকে না বলেই বেরিয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া করেনা ঠিক মতো। আমার সাথে কেমন যেনো গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলে।”
-” কবে থেকে চলছে এসব?”
-” কক্সবাজার থেকেই শুরু হয়েছে এসব। আমরা যেদিন সেখান থেকে রওয়ানা হলাম সেদিন সকালে রেস্টুরেন্টে নাস্তা খেতে গিয়েছিলাম। হুট করে ওখানে যেয়ে ওর কি হলো কেজানে? সেখানে যাওয়ার পর থেকেই এমন আচরন করছে।
-” ওখানে কি কিছু হয়েছিলো?”
-” নাহ্ কোনো ঝামেলাই হয়নি।”
-” তোমার সাথে ঝগড়া হয়েছে?
-” নাহ্ এমন কিছু হয়নি।”
-” ওকে জিজ্ঞেস করেছো এই ব্যাপারে?”
-” হ্যা কয়েকবার জানতে চেয়েছি কিন্তু কিছুই বলেনি।”
মুহিবের মাথা এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনিমের তো শিমুলের সাথে এমন করার কথা না। যথেষ্ট ভালোবাসে অনিম শিমুলকে। শিমুল বলছে কোনো ঝামেলাই হয়নি। তাহলে কেনো এমন করছে অনিম?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here