নিরাবতার হৃদয় কোণে পর্ব -১২+১৩+১৪ ও শেষ

#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩

বেশিদূর যাওয়া হলোনা মিতালী আর ইশরাকের। কোথা থেকে নির্ভীক এসে টপকালো। নিজের নাম ধরে ডাক পড়ায় পেছন ঘুরে তাকালো মিতালী। ইশরাক চোখেমুখে বিস্ময়বিমূঢ় ভাব ফুটিয়ে বলল,
-“তুই না বাজারে গিয়েছিলি?”

নির্ভীক আগেই ইশরাকের প্রশ্নের জবাব দিলোনা। মিতালীর দিকে ক্রু*দ্ধ দৃষ্টি ফে*লে বলল,
-“বলেছিলাম না কথা আছে তোর সাথে। আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি!”

মিতালী ভীষণ আশ্চর্য হলো। নির্ভীকের সাথে তো তার এমন কোন কথাই হয়নি। তাই বলল,
-“কিন্তু তুই তো আমায়….”

এতটুকুতেই থামতে হলো মিতালীকে। নির্ভীক বাঁধা দিয়ে বলল,
-“এখন আর এত কথা বলতে হবেনা।”

অতঃপর ইশরাকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো। খানিকটা ভারী সুরে বলল,
-“আমি মিতাকে পৌঁছে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি চলে যাও। অফিস করে নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত তুমি।”

ইশরাক কিয়দংশ সময় নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো নির্ভীকের শক্ত ভাঁজে লুকিয়ে রাখা একজোড়া চঞ্চল চোখে। অতঃপর ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। যার অর্থ বা মর্ম উপলব্ধি করতে পারলোনা নির্ভীক। ইশরাক সামনে ইশারা করে বলল,
-“চল, দুজনে গিয়েই দিয়ে আসি। আর আমি ঠিক আছি, ক্লান্তি বোধ হারিয়ে সেই কবেই সতেজতা ফিরে এসেছে।”

কথাটি বলতে গিয়ে আড়চোখে মিতালীকে দেখলো।
নির্ভীক কথা বাড়ালোনা। মিতালীকে পৌঁছে দিলো দুজন।

★★★

টিমটিমে চাঁদের আলোয় যখন মিতালীকে পৌঁছে দিয়ে দু’ভাই রাস্তায় নামলো, পায়ে পা মিলিয়ে সমানতালে হেঁটে চললো, তখন ইশারাকই আগে কথা বলল,
-“মিতালীকে ভালোবাসিস?”

চমকানোর কথা থাকলেও চমকালো না নির্ভীক। এটুকু সত্য যেন সবার জানা উচিত।

-“বুঝতে পেরেও তুমি পিছু নিয়েছো?”

ইশারাক জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁ*ড়*লো,
-“সে ও কি তোকে ভালোবাসে? বলেছে কখনো?”

নির্ভীক হুট করেই থেমে গেলো। নিভে গেলো তার গম্ভীর ভাব, চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসলো।
ইশরাক তা দেখে হাসলো। বলল,
-“তোর মতো তুই চেষ্টা করে যা। আমি তোকে বাঁধা দেবোনা। দেখি এই ল*ড়া*ই*য়ে কার জয় হয়।”

এরপর দুদিকেই নিরবতা চললো। কেউ কোনো কথা বললোনা। মূলত নির্ভীক কথা বাড়াতে চাইলোনা। দু’ভাইয়ের মাঝে ঝা*মে*লা বাঁধিয়ে পরিবারে অ*শা*ন্তি বাড়াতে চাইছেনা সে।

★★★

দুদিন পরের ঘটনা। ভোরের আবছা আলো কে*টে গিয়ে সূর্যের আগমন। ঘাসের উপর হালকা শিশির বিন্দু রৌদ্রজ্জ্বল ছোঁযায় ঝলমল করে উঠছে। ফজরের নামায পড়ে কিছুক্ষণ তসবিহ জপছিলেন রোজী বেগম। বেশিক্ষণ বসলেন না, দুটো মেয়েই একটুপর বেরিয়ে পড়বে। তাদের নাস্তার ব্যবস্থায় উঠে পড়লেন।
মিতালী বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে বাবাকে দেখতে গেলো। শরীর পূর্বের তুলনায় আরো দুর্বল হয়ে গিয়েছে। গতমাসে একহাজার টাকার ঔষধ এনে দিয়েছিলো মাত্র দশদিনের। তখন খানিকটা সুস্থ বোধ করলেও এখন পূর্বের তুলনায় একটু বেশিই অসুস্থ। বাবা চোখ খুললেন না। রোধ হয়ে আসা হাত-পা গুলো নিজে নিজে নাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বলা যায় ব্যায়াম, যাতে একেবারেই অবস না হয়ে যান। তাহলে যে তাকে নড়াচড়া করতে স্ত্রী আর মেয়েদের কষ্ট হয়ে যাবে। মিতালী বাবাকে দেখে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো ‘তার যদি কাড়াকাড়ি টাকা থাকতো তবে, আব্বাকে সে কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে পারতো।’

প্রতিটি নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তের একটাই দীর্ঘশ্বাস। আর সেটা হচ্ছে টাকা।

★★★

আজও মিতালীর গতিপথে রিকশা এসে থামলো। সে উঠলোনা রিকশায়। আজ কিছু কড়া কথা বলার পালা। এভাবে রোজ রোজ লোকসমাজে তাকে হে*ন*স্তা করার জবাব নেবে সে। পাশে মাহা ও ছিলো। মিতালী তার হাত ধরে সামনে এগোলো। ইশরাক রিকশা থেকে নেমে সে ও ওদের পেছন পেছন আসলো।

জনাকীর্ণহীর্ণ সরু রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে গিয়েও পা জোড়া থামিয়ে নিলো মিতালী। আশেপাশে লোকসমাগম নেই। এটাই কথা বলার মোক্ষম সুযোগ। মিতালীকে থেমে যেতে দেখে ইশরাক বলল,
-“রিকশায় উঠলেনা যে?”

মিতালীর চোয়াল খানা শক্ত হয়ে আসলো। মরম রূপ ভাটা পড়লো কঠিন খোলসের আড়ালে। শান্ত রূপে কঠিন হলো সে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“কেন রোজ রোজ আমি ভাড়া ছাড়া রিকশায় উঠবো? যখন আমার মনে হবে আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা আছে, আমি রিকশায় চড়ে যেতে পারবো। তখন আমি নিজ থেকেই উঠবো।”

ইশরাক ডান ভ্রু খানিক কুঁচকে নিলো। রাশভারি গলায় শুধালো,
-“তোমার ভাড়া দেওয়ার প্রয়োজন তো পড়ছেনা।”

এতক্ষণ যাবত ঠান্ডা মস্তিস্কে বাক্যালাপ চললেও এ পর্যায়ে তেতে উঠলো মিতালী। খানিক জোরালো কন্ঠে বলল,
-“আমরা আত্মসম্মান চিনি। আর নিজেদের আত্মসম্মান আছে বলেও মনে করি। এতটুকু জ্ঞান আমাদের আছে যে, কে আমাদের কতটা পছন্দ করে। আমরা ও তাকে ঠিক ততটাই সম্মান দিতে জানি। শুধু শুধু তাকে বিরক্ত করিনা।”

কথার তীরটা যে সরাসরি ইশরাককেই ইশারা করলো সেটা সে হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই নিঃসংকোচ প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-“কাউকে পছন্দ করা কি অপরাধ?”

মিতালী কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
-“পছন্দ করা অপরাধ নয়, কিন্তু তার অপছন্দীয় কাজগুলো করা অপরাধ।
আশাকরি আমাদের পিছু পিছু আপনাকে আর দেখতে পাবোনা।”

কথাটি বলেই মাহার হাত চেপে পা বাড়ালো মিতালী। চোখের কোন জলে চিকচিক করছে মাহার। সে এতটুকু আজ নিশ্চিত হলো যে ইশরাক ভাই আপুকে পছন্দ করে। এজন্যই বুঝি এতদিন তার সাথে ভাব জমিয়েছে? ছলেবলে কৌশলে কিভাবে আপুর কথা জিজ্ঞেস করতো, তা ও মনে পড়ে গেলো। সে চোখের জল গড়াতে দিলেনা, তার পূর্বেই স্কার্ফের কোনা দিয়ে সন্তর্পণে মুছে নিলো চোখের কোন।

ইশরাক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কী হলো ঠিক বুঝলোনা। মিতালী কি কোনোভাবে বিয়ের পূর্বের দুজনের সন্ধিটাকে ভ’য় পাচ্ছে? তবে সে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

★★★

আজ মালিহাকে পড়াতে এসেই মিতালী চেয়ারম্যান চাচার খোঁজ করলো। তিনি বাড়ি ছিলেন না বিধায় মালিহাকে পড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নির্ভীক ও এসে পড়লো মিতালীকে পৌঁছে দিতে। চেয়ারম্যান সাহেব স্ত্রীর কাছে জরুরি তলব শুনে মিতালীর মুখোমুখি বসলেন।

-“বলো মিতালী, কী বলতে চাও?”

শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো মিতালী। সরল গলায় বলল,

-“আব্বা আমায় নিয়ে দু*শ্চি*ন্তা*য় থাকেন। সন্ধ্যার পর কখনো বাড়ির বাইরে থাকিনি তো। তাছাড়া সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়ে বাড়ি ফিরি। তারপরই এখানে আসতে হয়। আমি পরিবারকে সময় দিতে পারিনা। আব্বা – মা চাইছেন না আমি সন্ধ্যার পর কোথাও পড়াই। ক্ষ*মা করবেন আমায়। আপনারা আমার বি*প*দে অনেক সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু বাবা – মায়ের অবাধ্য হয়ে আমি মালিহাকে পড়াতে পারছিনা।”

নির্ভীকের মনে লাড্ডু ফোটে। এতদিনে মেয়েটা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ইচ্ছে হলো একবার মিতালীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বলতে ইচ্ছে করলো ‘শুনতে পাচ্ছিস? তোর সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে আমার বুকের লাব ডাব বেড়ে গিয়েছে’।

চেয়ারম্যান সাহেবের চোয়ালে আঁধার নামলো। তিনি বেশ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,

-“সে কি কথা মিতালী? এতটা অনুনয় করে বললাম তোমায়, তাছাড়া মালিহাকে ও দেখছি তোমার সাথে বেশ মিলেমিশে পড়াশোনা করছে। এখন তুমি এ কথা বললে কি চলে?”

-“আমি দুঃখিত চাচা। কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায় নেই।”

মিতালীকে বাঁচাতে নির্ভীক বলল,
-“মালিহা কে না হয় আমিই পড়াবো এখন থেকে।”

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
-“এতদিন পড়াতে পারিসনি, এখন পারবি? ও পড়বে তোর কাছে?”
অতঃপর মিতালীর উদ্দেশ্য বলল,
-“তোমার রাতে পড়াতে সমস্যা তো? তাহলে দিনে পড়িয়ে দিও।”

মিতালী ইতস্ততভাবে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা। অনবরত দু’হাত কচলে চলেছে।

সেটা লক্ষ করে চেয়ারম্যান সাহেব তীক্ষ্ণ চাহনি ফে*লে বললেন,
-“দিনের বেলা ও সমস্যা?”

মিতালী লজ্জায় আর জবাব দিতে পারলোনা। তার তো সকাল থেকেই সময় নেই। সামনেই বছর শেষে সবার পরীক্ষা আসছে। কোন স্টুডেন্টের মা – বাবাই শিক্ষক ছাড়তে চাইবেন না। আর না সে দিনে মালিহাকে পড়াতে পারবে।
মিতালীকে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব বিরস মুখে জবাব দিলেন,

-“আচ্ছা বেশ।”

মিতালী সালাম জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মালিহাকে পড়াতে তার ভালোই লাগে। তাকে পড়ানো বাদ দিয়েছে বাধ্য হয়ে। তার একমাত্র কারণ ইশরাক। তার চোখের দৃষ্টি খুব ভালো কিছু বলছেনা। এভাবে তার দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলা কারো নজরে পড়ে গেলেই সর্ন*নাশ। সবাই হয়তো তার দোষই চোখে দেখবে। গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের দো*ষই ধরা হয় বেশিরভাগ সময়। কেউ ইশরাকের দো*ষ দেবেনা। সবাই মিতালীর চরিত্রে আঙ্গুল তুলবে। সবার মুখেমুখে রটে যাবে ‘টাকার লো*ভে চেয়ারম্যানের ছেলেকে হাত করেছে।’
কেননা মিতালীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। হাজার দু’য়েক টাকার জন্য আত্মসম্মানে সে দা*গ লাগতে দেবেনা।

নির্ভীক পেছন থেকে প্রফুল্লচিত্তে শুধালো,
-“চল আইসক্রিম খাই।”

মিতালী বাঁধ সাধলো।
-“এখন ঠান্ডার প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। আইসক্রিম খাবোনা।”

নির্ভীক বাঁধা মানলোনা। তাকে দাঁড় করিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে এলো দোকান থেকে।

★★★

রাতে বাবার সাথে আলাদা ঘরে বসলো ইশরাক। কিছু সময় থম ধরে পড়ে রইলো। এরপরই ঠাস করে বলে দিলো,

-“আমি মিতালীকে বিয়ে করতে চাই।”

চেয়ারম্যান সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।

#চলবে…….#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৪

গম্ভীর স্বরে শুধালেন চেয়ারম্যান সাহেব,
-“মিতালীকেই কেন বিয়ে করতে হবে?”

ইশরাকের কাঠকাঠ জবাব,
-“কারণ তাকে আমার পছন্দ। তোমার কোন আপত্তি আছে কি?”

-“আমার আপত্তি থাকবে কেন? তবে তার পরিবারের ঘোরতর আপত্তি থাকতে পারে।”

ভ্রু কুঁচকে গেলো ইশরাকের।
-“কেন? আমি কি পাত্র হিসেবে অযোগ্য?”

-“পাত্র হিসেবে তোর যোগ্যতা কেমন সেটা আমি জানিনা। সেটা বিচার করার অধিকার এ বাড়ির কারো নেই। সেটা অন্যরা বিচার করবে।
মিতালীর পরিবারের কথা বলছি, কারণ তুই দেশে ফেরার পূর্বেও মাহবুব প্রস্তাব এনেছিলো। মতিন সাহেব না করে দিয়েছেন। মেয়ে পড়তে চায়, পড়ুক।”

ইশরাকের কুঁচকে যাওয়া ভ্রু শীতল হলো। দুশ্চিন্তার ছাপ কিছুটা হালকা হলো। রাশভারী গলায় বলে বসলো,
-“তুমি বোঝালে তারা ঠিকই রাজি হবে। পড়তে চায় পড়ুক। আমিতো তাতে হস্তক্ষেপ করছিনা।”

ছেলের সাথে বোঝাপড়া করে বেশ একটা সুবিধা হলোনা। বিষয়টা দেখছেন বলে ইশরাককে উঠতে বললেন।

শয়নকালে স্ত্রীর মতামত যাচাই করলেন চেয়ারম্যান সাহেব। প্রত্যুত্তরে ইশরাকের মা ছেলের চাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে আফসোসের সুরে বললেন,

-“আমার লেখাপড়া জানা শিক্ষিত পোলার লাইগা মিতালী? মিতালীর লগে আমার ইশরাকরে মানানসই লাগে? আমি কইতাছিনা মাইয়াটা দেখতে খা*রা*প বা মাইয়াটা ভালা না। তয় আমার পোলার লগে তারে আমি কল্পনাও করিনা।”

চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত হলেন।
-“থামবে তুমি? শিক্ষার তুলনা করছো তো? তোমার ছেলে যতটুকুতে পৌঁছাতে পেরেছে, মেয়েটার ততটুকু পথ এখনো বাকি আছে। তাই শিক্ষার বড়াই করো না।
তাছাড়া বিয়ে তোমার ছেলে করবে, সংসার ও সে করবে। আমরা মাঝখান থেকে বাঁধা দিতে গেলে সারাজীবন আমাদের দু*ষ*বে।”

ইশরাকের মা বিরসবদনে বললেন,
-” এ বাড়ির বউ হইয়া আইবো বইলাই বুঝি মালিহারে পড়ানো ছাড়ছে? আমি কিছু জানিনা। আপনেরা বাপ-পোলা মিলা যা করার করেন।”

‘সংসারের অ*শা*ন্তি শুরু’ কথাটি বিড়বিড় করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন চেয়ারম্যান সাহেব।

★★★

বেলা বাড়ছে। রান্নার যোগাড় করতে শিলনোড়া নিয়ে বসলেন রোজী বেগম। অসময়ে বাড়িতে চেয়ারম্যান সাহেবের এমন আকস্মিক আগমনের হেতু খুঁজে পেলেননা তিনি।

চেয়ারম্যান সাহেব মতিন সাহেবের ঘরে চেয়ার টে*নে বসলেন। একপাশে মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন রোজী বেগম। উনার চোখজোড়া ফলমূল আর মিষ্টির প্যাকেটে নিবদ্ধ। মূলত তার দৃষ্টি সবকিছুর কারণ খুঁজে চলেছে। চেয়ারম্যান সাহেব স্বাভাবিক বাক্যালাপ শেষ করে গলা ঝেড়ে নিলেন। মতিন সাহেবের হাত নিজ হাতের মুঠোয় বন্দি করে বললেন,

-“ভাই আমি আপনার কাছে আজ কিছু চাইতে এসেছি।”

মতিন সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
চেয়ারম্যান সাহেব নিজ থেকেই বললেন,
-“আমার ছেলে ইশরাক দেশে ফিরেছে, তা তো জানেন। তার জন্য পাত্রী খুঁজছি। এখন ছেলের আপনার বড় মেয়ে মিতালীকে পছন্দ হয়ে গেলো। আমি সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই আপনার কাছে এসেছি। আশা রাখছি আপনি আমায় ফিরিয়ে দেবেন না।”

মতিন সাহেব আর রোজী বেগম রীতিমতো হতভম্ব। এমন কিছু উনারা কস্মিনকালেও প্রত্যাশা করেননি। এতক্ষণে এতসব ফল-মিষ্টির রহস্য উদঘাটন করতে পারলেন তারা। মতিন সাহেব অল্প হাসলেন।
প্রচন্ড আবেগ নিয়ে বললেন,
-“আমার বড় ইচ্ছা নিজের সন্তানেরা বড় হইবো, খুব বড়। মাইনষের মতো মানষ হইবো। আমার মাইয়ারা পড়তে চায়। আমিও এইডাই চাই। আপাতত বিয়ার কথা আমি চিন্তাও করিনা। আপনে মনে ব্যথা নিয়েন না।”

চেয়ারম্যান সাহেব আশ্বস্ত করে বললেন,
-“পড়ালেখার কথা আপনি চিন্তা করবেন না ভাই। ইশরাক বলে দিয়েছে মিতালী যতটুকু পড়তে চায়, পড়বে।
তাছাড়া আপনার বোঝা উচিত মেয়েটাকে। সারাদিন খাটুনি, সংসারটা তার কাঁধে। বিয়ে হয়ে গেলে সে নিজের পড়াশোনা ও চালাবে, আর আপনাদের দেখভাল করার জন্যেও ইশরাক আছে। অন্তত মেয়েটার কথাটা ভাবুন।”

রোজী বেগম সবকিছু শুনেই মত দিতে চাইলেন। কিন্তু মতিন সাহেব সরাসরি কোনো জবাব দিলেন না। তিনি দু’কলম পড়ালেখা না জানলেও বিবেকবুদ্ধিহীন মানুষ নন। তাইতো বললেন,

-“আমি মিতালীর লগে কথা কই, তারপর আপনেরে জানামু। আমার মাইয়ার কথার দাম আমার কাছে সবার আগে। ”

চেয়ারম্যান সাহেব উনাদের সময় দিয়ে বিদায় নিলেন। বলে গেলেন দ্রুত যেন খবরটা জানায়।
তিনি যেতেই রোজী বেগম স্বামীর উপর ক্ষো*ভ প্রকাশ করলেন।
-“এমন ভালা সুযোগ হাতছাড়া করলেন ক্যান? মাইয়ার কথার দাম দিবেন ভালা কথা। এখন কি আপনের আগের সময় আছে? মাইয়াটার চেহারা দেখছেন? দিনদিন আমাদের লাইগা খা*ট*তে গিয়া কী হইতাছে? তার পড়ালেখা করনের ইচ্ছা যেহেতু বিয়ার পরেও পূরণ হইবো তখন এত বাহানা ক্যান?”

মেয়ের কষ্টের কথা ভেবে রোজী বেগম রাজি হলেও মতিন সাহেব বললেন,
-“হেইডা তুমি বুঝবানা। আমার মাইয়া ছোডবেলা থেইকা আমার কথার দাম দিয়া আইছে। কোনোদিন তার লাগি কোনো অভিযোগ বাড়িতে আসেনাই। আমি ক্যামনে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তে তার কথার দাম না দিই?”

রোজী বেগম নিজের কাজে ফিরে গেলেন। স্বামীর কথায় উনার মন সন্তুষ্ট হলোনা। মেয়েটা খালি বাড়ি আসুক, তাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েই ছাড়বেন তিনি।

★★★

মায়ের মুখে ইশরাকের বিয়ে কথা শোনার পর থেকে শান্ত থাকতে পারলোনা নির্ভীক। সে কি হারাতে বসেছে তার সুখ’কে? তার অস্থিরতা মাত্রা ক্রমশ বাড়লো বৈ কমলোনা। সে দ্বিধায় ম*র*ছে। মরমে পু*ড়ে খাঁখাঁ করছে চিত্ত জুড়ে। মিতালী এ মুহূর্তে বিয়ে করবেনা সে শতভাগ নিশ্চিত। তবুও, তবুও কোথাও একটা হারানোর ভয় তাকে কাবু করে ফেলেছে। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। যদি তার উন্মাদনা প্রেমানলে হাজার বছরের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে? যদি চিরতরে হারিয়ে যায় সে মানুষ?

মিতালীর কপালে সামান্য বলিরেখা ফোটে উঠলো। একইভাবে নির্ভীককে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে তোর? এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”

নির্ভীক উন্মাদের মতো আচরণ করতে গিয়েও থেমে গেলো। কেবল মন্থন গতিতে জবাব দিলো,
-” আমার আজকের কবিতাটি গুরুত্ব দিয়ে শুনবি?”

মিতালী আলতো হেসে বলল,
-“আচ্ছা বল।”

নির্ভীক গভীর আবেগে মিশে গেল। আজ গভীর ভাবে নিজেকে উপলব্ধি করলো সে। শ্রুতিমধুর তার আবৃত্তিকৃত কবিতাখানা গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে মিতালী।

“তুমি কি আমার আকাশ হবে?
মেঘ হয়ে যাকে সাজাবো
আমার মনের মত করে।

তুমি কি আমার নদী হবে?
যার নিভিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে
তরী বেশে ভেসে যাবো কোন অজানা গন্তব্যের পথে।

তুমি কি আমার জোছনা হবে?
যার মায়াজালে বিভোর হয়ে
নিজেকে সঁপে দেব সকল বাস্তবতা ভুলে।

তুমি কি আমার কবর হবে?
যেখানে শান্তির শীতল বাতাসে
বয়ে যাবে আমার চিরনিদ্রার অফুরন্ত প্রহর।

আবুল হাসান।

কিছু মুহুর্তের জন্য সম্মোহিত হলো মিতালী। তার নয়ন জোড়ায় সীমাহীন ঘোর।
নির্ভীক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার জবাবের আশায়। মিতালী কি বুঝতে পারেনি এটা কেবল কবিতা নয়, তাকে ভালোবাসার নিমন্ত্রণ।
মিতালীর ঘোর কা*ট*লো মায়ের ফোন পেয়ে। তার অভিব্যক্তি বদলে গেলো। একটু আগের কি ভীষণ মায়া তার চোখজোড়ায় রইলোনা।

মা জানালেন আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। কিন্তু কারণ জানালেন না।
কথা শেষ করে সময় দেখলো মিতালী। স্বাভাবিক গলায় বলল,
-” চল, পিরিয়ড টাইম শেষ।”

নির্ভীক তার জবাব না পেয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে শুধালো,
-“এ ব্যথা আমি সইতে পারবোনা মিতা!”

এক পা ও এগোতে পারলোনা মিতালী। রোধ হয়ে আসা পা জোড়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে সুস্থে নিজেকে স্বাভাবিক করে পেছন ঘুরলো। মিথ্যে ব্যকুলতা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“সে কি! কোথায় ব্যথা হচ্ছে তোর?”

নির্ভীকের আঁখিদ্বয় নিমেষহীন মিতালীর কাঠিন্য চোয়ালে ঘুরঘুর করলো। অতঃপর অধর কোন জুড়ে ঠে*লে আসলো একটুখানি তাচ্ছিল্যমাখা হাসি। বলল,
-“কিছু না, চল।”

মিতালীকে পেছনে রেখেই নির্ভীক চলে গেলো। রেখে গেলো এক আকাশ অভিমান। তাকে সম্পূর্ণ বুঝেও যে মানুষ তার অনুভূতি হেলা করে, সে মানুষ তার না পাওয়ার খাতায় থাক। নিরবতায় পড়ে থাকুক হৃদয়ের এককোণে ভীষণ যত্নে।

নির্ভীকের গমন পথে চেয়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মিতালীর। জীবন বড্ড বিচিত্র, বড্ড কঠিন। আমরা যত সহজে কল্পনা করতে পারি, বাস্তব চিত্রে তা সাধন করা দুষ্কর। ভাবনার ইতি টেনে উঠে পড়লো মিতালী।

★★★

মাহা এখন আর ইশরাককে দেখে অনুভূতি গুলো বাড়তে দেয়না। সে ইতি টা*ন*তে চায় তার অনুভূতির। আজ নিজেই নিজের অনুভূতিগুলোকে ঠু*ন*কো আবেগ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে চাইলো। সে শুধুই প্রেমে পড়েছে, ভালোবাসা চেনেনি। ভুল সময়ে ভুল মানুষকে সে পেতে চেয়েছে। নিজের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। অব্যক্ত কষ্ট গুলো বুকের খাঁচায় বন্দী করে রাখলো। সুখ সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া গেলেও ব্যথা কেবল নিজের। আজ বোনের বিয়ের কথাও শুনলো। মা যে রাজি আছেন তা বেশ বুঝতে পারলো সে।

মিতালী বাড়ি ফেরার পর থেকে মা আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ খাতিরযত্ন করছেন। মা ভালোবাসেন না এমন নয়। কিন্তু আজ প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত মনে হলো। খাবার সময় মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সব কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন রোজী বেগম। কিন্তু মেয়ের কথায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো।

-“মা কিছু বলতে চাও আমায়?”

রোজী বেগম চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ জবাব না পেয়ে মায়ের দিকে ফিরলো মিতালী। মা বললেন,

-“সব বাপ – মা’ই সন্তানের ভালা চায়। আমরাও চাই।”

-“হ্যাঁ, সে তো ভালো কথা।”

রোজী বেগম ইতস্তত করে বললেন,
-“তোর লাইগা ভালা একখান প্রস্তাব আইছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ছোড পোলা ইশরাকের তোরে পছন্দ।”

মিতালী আর খেলোনা। ভাড়া ভাতে পানি ঢেলে দিলো।
রোজী বেগম ভ’য় পেলেননা। মেয়েকে তিনি বোঝাবেনই। তারা আর কতকাল বাঁচবে? তার একটা গতি করে দিয়ে যেতে পারলে নিশ্চিন্তে পরপারে যেতে পারবেন। তার একটা শক্ত স্থান হবে। তাদের অনুপস্থিতিতে মাহাকে ও দেখে রাখতে পারবে মিতালী।

মিতালী শান্ত চোখে মাকে দেখলো।
-“কী জবাব দিয়েছিলে তোমরা?”

-“শোন, এমন ভালা সমন্ধ আর খুঁইজা পাওন যাইবোনা।”

“বুঝতে পেরেছি” বলে আর এক মুহূর্ত মায়ের সামনে টিকলোনা। আজ মস্তিস্ক কাজ করলোনা। প্রতিদিন হাজারটা চিন্তা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া, দিনের পর দিন মানসিকভাবে বিপর্যয় তাকে নিঃশেষ করার পথে নিয়ে গেলো। সে আপাতত মায়ের সিদ্ধান্তের ওপর একটা কথাও বলতে পাারলোনা। কেবল শুনে গেল চুপচাপ।

#চলবে…….#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৫

খোলা অন্তরিক্ষে চাঁদের স্নিগ্ধ হাসিটি ও আজ বি*ষা*ক্ত রূপ নিয়েছে। এ কেবল মিতালীর দৃষ্টিতে। জানালার ধারে শয্যা হওয়ায় বিস্তৃত গগনতল দৃষ্টি সম্মুখে স্পষ্ট দৃশ্যমান। খোলা জানালার ফাঁক গলিয়ে অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কি যেন একটা ভেবে ভেবে ম*রি*য়া হয়ে উঠলো সে।
তৎক্ষনাৎ আব্বার ঈষৎ কাঁপা কন্ঠস্বরের ডাক পড়লো। ভাবনা তার ভাটা পড়লো। আব্বার আদর মাখা ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলোনা মিতালী। বিছানা ছেড়ে আব্বার কাছে গেলো।

মেয়েকে পাশে বসালেন মতিন সাহেব। পরম মমতায় চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বললেন,
-“তুই এত চিন্তা করিস না মা। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়া আমি কিছুই করুমনা। তোর মা যা ইচ্ছা বলুক গা। তুই নিজেরে নিয়া ভাব।”

রোজী বেগম সবই শুনতে পেলেন। গরম তেলে একফোঁটা পানির ন্যায় ছ্যাৎ করে উঠলেন তিনি। ঘোড়ার গতিতে বাবা – মেয়ের মাঝখানে ঢুকলেন। কন্ঠে তেজ নিয়ে বললেন,
-“আমার কথার দাম থাকবে ক্যান? মাইয়ার উপর বইসা খাইতে ভাল্লাগবো। এত খাটাখাটুনিতে অল্প কয়েকদিনেই চেহারা যা ভাঙাচোরা হইছে। আরো কয়েকদিন গেলে কেউ আর বিয়া ও করতে চাইবোনা। এত ভালা পোলা, ভালা সম্বন্ধ পায়ে ঠে*ল*তা*ছো বাপ – মাইয়া মিল্লা। আমি আইজই চেয়ারম্যান সাহেবরে কমু বিয়ার বন্দোবস্ত করতে।”

স্ত্রীর আচরণে ক্ষু*ব্ধ হলেন মতিন সাহেব। হাঁক ছাড়লেন তিনি। বললেন,
-“বেশি লো*ভ করন ভালা না। বেশি খাইতে চাইলে পরে অল্পের নাগাল পাইবানা।”

মাথায় এক চিনচিনে অনুভূতি খেলা করলো। এমন ঝা*মে*লা আরো কিছুক্ষণ স্থগিত থাকলে পা*গ*ল হয়ে যাবে মিতালী। অস্থির লাগছে সবকিছু। রা*গ লাগলো ভীষণ। ঘরের সমস্ত জিনিস ভাঙচুর করার ইচ্ছে জাগলো। জীবন যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন চারদিক থেকেই সমস্যারা ঝেঁকে ধরে। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ম*রে যায়। তবুও এই মানুষগুলোর কথা ভেবে আবারও বাঁচার আকাঙ্ক্ষা জাগে।
মিতালী বিরক্ত হয়ে খানিক উচ্চস্বরে বলল,

-“চুপ করবে মা? বিয়ে করে নিলেই সব সমস্যা চুকে যাবে? আমার কোন ইচ্ছের দাম নেই তোমার কাছে? ভালো ছেলে, ভালো ঘর, ভবিষ্যতে আর কোন চিন্তা থাকবেনা। এটাই তোমার ভাবনা তো?
কিন্তু মা তোমার ধারণা ভুল ও তো হতে পারে। হতে পারে আমার জীবনটা বন্দি খাঁচার পাখির মত হয়ে গেল। তোমাদের জীবন আরো দুর্বি*ষহ হয়ে উঠলো। তোমরা এখন নিজের সারাজীবনের অর্জিত সম্পত্তি ভো*গ করছো। তোমাদের সেই সম্পদ তোমাদের সন্তান। অন্যকারো সন্তান নয়।
আমায় বিয়ে দিয়ে অন্যের দয়া নেবে? কেন নেবে? আজ নিজের চাহিদার কথা মেয়েকে যেভাবে মুখ ফোটে বলতে পারছো, তখন ও কী বলতে পারবে?
পারবে না। কারণ তখন তোমার নিজের ও লজ্জা করবে এই ভেবে যে, পরের কাছে কত চাইবো?
কেউ খুশি হয়ে এক টাকা দেওয়া আর তাকে বারবার মনে করিয়ে দশ টাকা চেয়ে নেওয়া সমান কথা নয়।
ঘরে বাজারের সংকট হলে সন্তানকে যেমন নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা মেয়ের জামাইকে বলা যায়না। সন্তান ভুলে গেলেও তাকে দ্বিতীয়বার মনে করিয়ে দিতে অস্বস্তি হবেনা। কিন্তু মেয়ের জামাইকে মনে করিয়ে দিতে ঠিকই তোমার অস্বস্তি হবে। অপমানে লাগবে।
হয়তো একসময় সেই মানুষটিও বিরক্ত হবে, কিন্তু মুখ ফোটে কিছু বলবেনা। তাহলে বলো তুমি কোনটা চাও? ধরাবাঁধা জীবন, না-কি এক টাকায় নিজের সংসারে সুখ?”

একঘেয়ে রোজী বেগম বুঝলেন না। তিনি চওড়া গলায় বললেন,
-“লম্বা লম্বা ভাষণ দিয়া জীবন চলেনা। তোর বিয়া চেয়ারম্যানের পোলার লগেই হইবো। এডাই আমার শ্যাষ কথা।”

শান্তশিষ্ট মেয়েটা মুহূর্তেই উশৃংখল রূপ ধারণ করলো। হিতাহিতজ্ঞান শূন্যে তুলে বে*য়া*দ*বি করে বসলো। সামনে থেকে মেলামাইন এর মগ তুলে আছড়ে ফেললো। মাটিতে টপকে টিনের সাথে গিয়ে ঝনাৎ শব্দে লাগলো। দু’টুকরো না হলেও ফেটে গেলো মগটি। মেয়ের এমন রা*গ দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন রোজী বেগম। হাত চালাতে আর দেরি করলেন না। বাঁ গালে স*পা*টে চ*ড় বসালেন।

-“একটা বে*য়া*দ*ব জন্ম দিছি আমি। এই দিন দেখার লাইগা তোরে পেটে ধরছি?”

মিতালীর চোখজোড়া পানিতে ভরে উঠলো। তার চৌচির হয়ে ফেটে যাওয়া ভেতরটা যদি কাউকে দেখাতে পারতো। পরিবারের কথা চিন্তা করে শতবার সে মনের বিরুদ্ধে লড়েছে। স্থান দিয়েছে মস্তিস্ককে। একটা মানুষ কতবার ভাঙলে তাকে আর ভাঙা যায়না? মায়ের আচরণ আজ তাকে পীড়া দিয়েছে। সে যে বেয়াদবি করেনি, এমনটা ও নয়। মা তো তার কঠিন মুহূর্তে পাশে থেকে তাকে সাহস যোগাতে পারতো। কিন্তু তিনি সেটা না করেই মেয়ের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।

মতিন সাহেব ধ*ম*কে উঠলেন স্ত্রীকে,
-“এত বড় মাইয়ার গায়ে হাত তোলন কোন অভ্যাস? তুমি আর আমার মাইয়া গো গায় হাত দিবা না। যা কওনের মুখে কইবা।”

মিতালীকে কাছে ডাকলেন। সে গেলোনা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো গালে হাত দিয়ে। রোজী বেগম দপদপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন। মতিন সাহেব আবারও মেয়েকে ডাকলেন। মিতালী ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো।
তিনি নরম সুরে মেয়েকে বোঝালেন,
-“মায়ের লগে এমন আচরণ ঠিক না মা। তোর মায়ের রা*গ কমলে ঠিকই সব বুঝবো।”

-“আমি এখন যাই আব্বা।”
মিতালী আর দাঁড়ালোনা। ঘরে ফিরেই কাঁথার নিচে মুখ লুকালো। মুক্ত করলো দুঃখ নামক কিছু জলের ফোঁটা।
মাহা পড়ার টেবিলে বসেও পড়ায় মন দিতে পারেনি। অনিমিখ নেত্রে বিধস্ত বোনকে দেখে যাচ্ছে। তাদের জীবনে এত বি*ষা*দ কেন?

★★★

নির্ভীক আর বাড়াবাড়ি করলোনা। না কোনো কবিতা পাঠ করলো। পূর্বের সেই ভালো বন্ধুর মতো তার আচরণ স্বাভাবিক রইলো। তার মুখশ্রী ম্লান হয়ে আসা সূর্য রশ্মির মতোই দেখালো। সে যেমন দিনের শেষ ভাগে তেজ হারিয়ে নিস্তেজ অন্ধকারে তলিয়ে যায়, ঠিক তেমনি।
ঢিলে হয়ে আসা ঝুঁটি রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলো মিতালী। তাদের মধ্যকার নিরবতা ছেঁদ ঘটালো নির্ভীক। বি*ষা*দ চিত্তে আলতো হেসে বলল,

-“তুই তো এখন আমাদের বাড়ির বউ হবি, বন্ধু থেকে ভাবি হয়ে যাবি আমার। ওহ্! ভুলেই গেলাম আমার তো বাড়িই নেই।”

মিতালী অসহায় চাহনিতে চাইলো। নির্ভীকের ভেতরটা তার অজানা নয়, বরং তার কাছে সহজ ভাষায় একটি খোলা বই। প্রত্যুত্তর করতে পারলোনা মিতালী।
হুট করেই তাদের মাঝে ইশরাকের আগমন ঘটলো। কোনো ধরনের ফর্মালিটি ছাড়াই নির্ভীকের উদ্দেশ্যে বলল,

-“মিতালীর সঙ্গে আমার কথা আছে। তুই একটু সরে দাঁড়া।”

নির্ভীক একবুক অভিক্ষেপ আর একরাশ অভিমান নিয়ে বিনা বাক্য-ব্যয়ে সরে গেলো।
মিতালী ধপ করে জ্বলে উঠলো। কঠিন গলায় বলল,
-“আপনাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি সেদিন। আপনার সাথে আমার না কথা আছে, আর না নির্ভীক এখান থেকে সরবে।”

ইশরাক ক্রো*ধ নিয়ে বলল,
-“কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা আছে। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি এলাউ না।”

ততক্ষণে নির্ভীক বাড়ির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলো অনেকদূর। কাঁদতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তার চোখদুটো বড্ড নিষ্ঠুরতা করলো তার সাথে। চোখ ফেটে একফোঁটা জল গড়ালোনা। অথচ ভেতরটা তচনচ হয়ে যাচ্ছে।

নির্ভীককে তৃতীয় ব্যক্তি বলায় কন্ঠের তেজ বেড়ে গেলো মিতালীর।
-“নির্ভীক কখনোই তৃতীয় ব্যক্তি ছিলোনা। বরং আপনি আমাদের বন্ধুত্বে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে শীঘ্রই ভাঙ্গ*ন ধরাবেন।”

ইশরাক রা*গ দমন করার চেষ্টা করে বলল,
-“নির্ভীকের কথা বাদ। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। মানলাম তোমার পেছনে ঘোরাঘুরি পছন্দ নয়,তাই আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। সেটা নাকচ করার কারণ কী?”

মিতালী বারবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার কার্যকলাপ পছন্দ নয় বলে পিছু ছাড়তে বলেছে, সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বুকের পাটা দেখাচ্ছে? নিজেকে শান্ত করে বলল,
-“আপনাকে নিয়ে আমি এসব কখনোই ভাবিনি।”

-“কেন? আমি কি খা*রা*প ছেলে? কোন বদ অভ্যাস আছে? বাড়িঘর, চাকরি এসব নেই? চেহারা খারাপ? কোনটা?”

স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলো মিতালী।
-“কোনোটাই না।”

-“তবে?”

মিতালী স্পষ্টভাষায় বলল,
-“মানুষ যাকে ভরসা করতে পারেনা, তার সাথে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেও পারেনা। আমার ভরসার স্থানে আপনি নেই, সেখানে অন্যকারো বাস।”

অপমানে লাল হলো চোখজোড়া। ইশরাক মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত করে নিলো। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,
-“সেই ব্যক্তি কি নির্ভীক?”

মিতালী শক্ত মুখে জবাব দিলো,
-“যতটুকু জানানোর আমি জানিয়েছি। বাকিটুকু ব্যক্তিগত থাকতে দিন।”
#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৬

বাতাসে সুতীব্র মিষ্টি প্রেমের ঘ্রাণ। বিয়ে বাড়ির জামকালো আয়োজন। হরিদ্রাভ শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে একটুকরো শরীর। রেলিং বিহীন ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে এক হলদে নর। তাকে অনুসরণ করে এগোলে মিতালী। নিশ্চুপ পা ফেলে তার পেছনে দাঁড়ালো। অত্যল্প সময় স্থির থেকে জুতা খুলে তারই মতো পা ঝুলিয়ে বসলো। তবুও ভাবান্তর হলোনা নির্ভীকের।
প্রিয়ার বিয়েকে উপলক্ষ করেই দুজনের এখানে আসা। আগামীকাল প্রিয়ার বিদায়ক্ষণ। মিতালী ভাবলো নির্ভীককে এক অজানা সত্য জানানো প্রয়োজন। তাইতো নিরবতায় ছেদ ঘটালো। দূর আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিবদ্ধ করলো নির্ভীকের অল্পবয়সী যুবক চেহারায়। তার মধ্যে এখনো পৌরুষভাব, বলিষ্ঠ রূপের আগমন ঘটেনি। মিতালী তেজহীন গলায় শুধালো,

-“তোকে একটা সত্যি জানাতে চাই।”

এবার বোধহয় নির্ভীকের মনযোগ কাঁ*ড়তে পারলো সে। সত্যি জানার আগ্রহ দেখিয়ে চেয়ে রইলো নির্ভীক। নিষ্প্রভ কন্ঠে মিতালীর জবাব,

-“প্রিয়া তোকে ভালোবাসে।”

নির্ভীক ভীষণরকম চমকালো। সাথে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো বোধহয়। কেননা, সে যে অন্যকিছু শুনতে চেয়েছিল। নির্ভীকের স্তব্ধ, হতবিহ্বল চাহনি দেখে মিতালী হাসলো। বলল,
-“তুই কখনো বুঝতে পারিস নি?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে ফিরলো নির্ভীক। বলল,
-“বোঝার সময় পাইনি। আমি তখন অন্যকাউকে নিজেকে বোঝাতে ব্যস্ত।”

প্রত্যুত্তরে মিতালী কিছুই বলতে পারলোনা। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। মিতালী নিজ থেকেই বলল,
-“কতদিন কবিতা শোনাচ্ছিস না, বলতো?
আমি একটা কবিতা মুখস্থ করেছি, তোকে শোনাবো বলে। শুনে উত্তর দিস।”

নির্ভীক আগ্রহ দেখালো।
মিতালী নরম কন্ঠে আবৃত্তি করলো,

“তুমি আমার একলা ছাদের কপোত হবে?
সারা দুপুর কানের কাছে
বাকুম বাকুম গান শোনাবে।

কিংবা হবে জংলা ফুলের শিশিরকণা?
আমি তবে জল পিয়াসী ফড়িং হব
তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাব, লক্ষীসোনা।

তুমি হবে চিমটি আঁধার মায়ার আঁধার?
সেই আঁধারে জন্ম নেবে
মৃত্তিকা ফুল খোঁপায় বাঁধার।

তুমি হবে একলা গাঙের হলদে পাখি?
ঝরা পাতায় কান্না দেব,
তিয়াস পেলেই অশ্রু পিয়াই লক্ষী পাখি।

অথবা নীল বুকের মাঝে কালচেটে তিল?
রাখব তবে খুব গোপনে
হব সুখের রোদ কুড়ানো অবোধ শঙ্খচিল।

তুমি আমার রূপোর জড়ো গয়না হবে?
অঙ্গ ভরে রাখবো তোমায়
অথবা খুব সাজবো যখন একটা
নতুন আয়না হবে?

তুমি হবে শেষ বিকেলের হলদে আলো?
কৃষ্ণচূড়ায় মেঘ জমাব
চেঁচিয়ে কবো এমন মায়া কে মাখালো, কে মাখালো?”

বিকেল চড়ুই।

অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নির্ভীকের। অনিমিখ নেত্র বিচরণ করলো মিতালীর সারা মুখশ্রীতে। আর সে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়।
কন্ঠনালি রোধ হয়ে এলো নির্ভীকের। অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,

-“তুই…”

মিতালী হাসলো। লজ্জা মিশ্রিত হাসি। চোখে খুশির চিকচিক ঝিলিক।

প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে চিত্তচাঞ্চল্যকর ভাবে নির্ভীক বলল,
-“একবার জড়িয়ে ধরি।”

অনেকটা পিছিয়ে গেলো মিতালী। চোখ পাকিয়ে বলল,
-“একদম না।”

নির্ভীক নিটোল ঠোঁটে মিটিমিটি হাসলো। আজ তার সুখের দিন। সেদিন বাড়ি গিয়ে জানতে পারলো মিতালী ইশরাককে বিয়ে করবেনা বলে না করে দিয়েছে। তখন খুশি হলেও প্রচন্ড অভিমান হয়েছিল তার। কেন মিতালী কিছু শেয়ার করেনি? আজ আর সেই প্রগাঢ় অভিমান স্থায়ী নেই।

★★★

রীতি ধরে রাখতে বছর ঘুরে শীত ঋতুর আগমন। সকাল সকাল খেঁজুর রসের মিষ্টি ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে বাড়ি। দু’বেয়ান সাথ জুড়ে রসের শিরনি আর ভাপা পিঠা তৈরি করছেন, সাথে একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টা।
মাহা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে নিলো।
বোনের মতো স্টুডেন্ট অবস্থায় নিজের পড়ার খরচ নিজেই বহন করছে।

নির্ভীক আর মিতালী নিজেদের কাজের উদ্দেশ্যে বের হলো।
তাদের ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে নির্ভীক নানু-দাদির কাছেই থাকে।
মিতালী, নির্ভীক দুজনই পেশায় শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছে। যদিও দুজনে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।

প্রিয়ার বিয়ের কয়েকমাস পরই মিতালীর বাবা পরলোক গমন করেন। এরপরই শুরু হয় মিতালীর নতুন লড়াই। মাহবুব এসে বাড়িতে জায়গা দখল নিয়ে ঝা*মে*লা বাঁধায়। যেহেতু মিতালী আর মাহা দুজনের সমান সম্পত্তির মালিক মাহবুব, তাই সে ভেবেছিল দুবোন হয়তো কোন এক সময় তার কাছেই সম্পত্তি বিক্রি করে দেবে। আর সে ও অল্প দামে কিনে নেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। মাহা, মিতালী কেউই সম্পত্তি বিক্রি করলোনা। বাবার শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে রইলো।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই নির্ভীকের পিড়াপিড়িতে দুজনে বিয়ে করে নিলো। ব্যাপারটা বছরখানেক গোপন থাকলেও পরক্ষণে সবাই জেনে গেলো। লুকিয়ে বিয়ে নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে একদফা গন্ডগোল বাঁধলে নির্ভীক মাকে নিয়ে ও বাড়ি থেকে ভাড়া বাড়িতে গিয়ে ওঠে। যেহেতু বিয়ে সম্পর্কে জানাজানি হয়ে গিয়েছে, তাই মিতালীকে ও নিয়ে গেলো। মিতালী একা গেলোনা। তার মা-বোনকে সাথে নিলো। দুজনের রোজগারে সংসার চললো বেশ। মাহা নিজের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজে নিয়ে নিলো।

দুজনের বাকি পড়াশোনা, সংসার, খুনসুটি ভালোবাসায় দিন চললো বেশ। ততদিনে দুজনের মাঝেই পরিপূর্ণতা চলে এলো।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। দুজনের আয়ে এক টুকরো জমি কেনা হলেও বাড়ির কাজ এখনো ঠিকঠাক হয়নি। অর্ধেক কাজ হয়ে আপাতত কাজ স্থগিত রাখা হলো অর্থসংকটের কারণে। বাকি টাকার ব্যবস্থা হলেই বাড়ির কাজ সম্পন্ন হবে।

★★★

শুক্রবার ছুটির দিন। দল বেঁধে সবাই আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে আসলো। পূর্বের মনমালিন্য এখন আর নেই। মাঝেমধ্যে সবার বাসায় সবার আসা যাওয়া হয়।
খাবার টেবিলে গোল হয়ে যখন ইশরাক, নির্ভীক, চেয়ারম্যান সাহেব সহ বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা বসলো, তখন মিতালী ইশরাকের স্ত্রীর সাথে খাবার বেড়ে দেওয়ার কাজে হাত লাগালো। মাথায় আঁচল টে*নে গিন্নি রূপে খাবার পরিবেশন করলো দুজনই। খাওয়ার মাঝে ইশরাক নিজের স্ত্রী আর মিতালী দুজনকেই দেখলো। মিতালীকে একটা সময় সে চেয়ে থাকলেও এখন আর চায়না। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে সে। হৃদয়ের এক কোনে মিতালী নামটি পড়ে রইলো, আর সমস্ত ভালোবাসার প্রকাশ স্ত্রীর জন্য। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মাহা এতবছরের জমানো আবেগ সন্তর্পণে গোপন করে গেলো। কাউকে হারিয়ে ফেললো প্রথম প্রথম আমরা যতটা উন্মাদনায় মরিয়া হয়ে উঠি, কয়েকমাস কিংবা বছর কে*টে গেলেই বি*ষা*দ গুলো সয়ে যায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নিজের জীবন নিয়ে মাহাকে এখন খুশি বলা চলে।

বিকেলেই দু’বোন বাবার ক*ব*র দেখার উদ্দেশ্যে বের হলো। একটা সময় মিতালী জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর জীবনে এমন কেউ আছে? যে তোকে সবকিছুর বিনিময়ে পেতে চায়।”

মাহা জবাব দিলোনা। মৃদুস্বরে হাসলো।
মিতালী তা লক্ষ করে বলল,
-“এমন কেউ থাকলে ফিরিয়ে দিসনা। তাকে আঁকড়ে ধরে রাখিস। একদিন আমার মতো গর্ব করে বলতে পারবি তুই সত্যিই সুখে আছিস।”

★★★

কুয়াশার রাতে গায়ে চাদর জড়িয়ে হাতে হাত গলিয়ে হাঁটছে দুজন। মিতালীর ঠান্ডা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষে চলেছে নির্ভীক।
-“তোমার হাতগুলো এমন সাপের গায়ের মতো ঠান্ডা হয়ে থাকে কেন?”

মিতালী আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি সাপের শরীর ধরে দেখেছো?”

নির্ভীক বিড়বিড় করে বলল,
-“ধরতে গেলেই তো ফনা তোলে ফোঁসফোঁস করে।”

কথাটি মিতালীর কর্ণধার এড়ালো না। হেসে নিজ থেকেই নির্ভীককে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
-“আমি ফনা তোলে ফোঁসফোঁস করি? নিজে যে সময়ে-অসময়ে কাছে আসো, তার বেলায়?”

নির্ভীক ফিসফিস কন্ঠে বলল,
-“একটা কবিতা শোনাই?”

মিতালী মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। নির্ভীক আওড়ালো,

“উত্তপ্ত খরায় আমি তৃষ্ণার্ত,
তুমি একফোঁটা জল।
তৃষ্ণা মেটাতে ছুঁয়ে দিই
তোমার আধখোলা খোঁপার চুল।
তুমি মধুচক্র – স্বেদজলে তেজস্বী
আমি মধুলোভী মৌমাছি,
তোমারই অধরসুধায় তৃপ্তি খুঁজি।”

মিতালী আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নির্ভীককে।
তুই থেকে তুমিতে এসেছে ছেলের জন্মের পর। ছেলের সামনে একে অপরকে তুই করে ডাকাটা বেমান। সেজন্যই তুমিতে এসেছে।

★★★

সকাল সকাল মা – বোনকে সাথে নিয়ে বাবার ভিটায় গেলো মিতালী। মাহবুবা এখন বড় হয়েছে। আগে বাবার ভ*য়ে ফুফুদের সাথে কথা না বললেও এখন বলে। বুঝ হয়েছে তার।
ভেতর ঘর থেকে মাহবুব আর পিয়ালীর ঝ*গ*ড়া শোনা যাচ্ছে। মাহবুব দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। কাজে যায়না, ঠিকঠাক বাজার করেনা। খেয়ে না খেয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়ে থাকে পিয়ালী। মাহবুবকে কিছু বললেই দুজনের মধ্যে ঝ*গ*ড়া বাঁধে।
যে যতটুকু করবে, সে ততটুকু ফল পাবে। কর্মফল একদিন সবাইকেই ভো*গ করতে হয়।

বাড়িটি দেখে নিয়ে মামা শশুর বাড়ি তথা চেয়ারম্যান বাড়ি গেলো মিতালী। সেখান থেকেই নির্ভীক সহ তাদের ভাড়া বাসায় চলে গেলো। আগামীদিন থেকে আবার ও চলবে পূর্বের নিয়ম। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
দাম্পত্য জীবনের এতবছরে এসেও নির্ভীক আর মিতালী কেউ এখনো ভালোবাসি বলেনি। তারা অন্তঃকরণে বিপরীত মানুষটির আনাগোনা উপলব্ধি করছে। কিছু ভালোবাসা মুখে বলতে হয়না, প্রতিটি কাজে প্রমাণিত হয়। নিরবে অন্তঃকোণে বেঁচে থাকে।

#সমাপ্ত।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here