প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -৩৮

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩৮

“এতো বড় একটা নিউজ তুমি আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছো? আমাকে এটা বলো যে, তোমার মাথায় আসলে চলছেটা কী?”

সৌহার্দ্য চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে তরীর দিকে। তরী অস্থির হয়ে উঠছে। তার চোখে-মুখে শঙ্কা, অস্বস্তি স্পষ্ট। সৌহার্দ্যের সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে হুট করে বিছানায় বসে পড়লো। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। কেন যেন সবকিছু ঠিকঠাক লাগছে না! তরী হাতে হাত ঘষছে, ছটফট করছে। সৌহার্দ্য বললো,

“এমন ছটফট করছো কেন? তোমার হাবভাব দেখে কেন যেন স্বাভাবিক লাগছে না!”

“না! তেমন কিছু না।”

“তুমি কি টেনশন করছো কিছু নিয়ে? আমাদের বেবি আসছে, এতে তুমি হ্যাপি নও? তুমি তো দুইদিন আগে জেনেছিলে প্রেগ্ন্যাসি নিয়ে! আমাকে একবারও বললে না কেন? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো তুমি টেস্ট করাতে গিয়েছিলে? তাও আবার অরুণীর হসপিটালে? কেন? আমি থাকতে তোমার এতো কিছুর কী প্রয়োজন? আমাকে একবার বললেই পারতে তোমার প্রব্লেমগুলো। এছাড়া তুমি আমার হসপিটাল বাদ দিয়ে অন্য হসপিটালে গিয়েছো। সবদিক বিবেচনা করে আমার ধারণা এক জায়গায় গিয়েই দাঁড়ায়। আর সেটা হলো, তুমি আমার থেকে সবটা লুকাতে এতো কিছু করেছো!”

তরী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্যের চোখে সন্দেহ। তরী তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,

“না! না!! তুমি… তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।”

“তাহলে ঠিক কোনটা? বুঝাও আমাকে!”

“আসলে… আমি আসলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম! এজন্যই এতো কিছু করতে হলো।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললো,

“আর ইউ শিয়র?”

তরী মুখ ছোট করে বললো, “হুম! কিন্তু আমার প্ল্যানে তো পানি ঢেলে দিলেন আপনি। এজন্য দূরে চলে এসেছিলাম আমি। তোমার ডাক্তারি চোখ থেকে তো কিছু লুকোনো সম্ভব নয়! হুহ!!”

সৌহার্দ্য হেসে তরীকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

“তো এই ছিল আমার ম্যাডামের প্ল্যান! আচ্ছা, যাও। তোমার প্ল্যান অনুযায়ী কিছু হয়নি তো কী হয়েছে? তুমি আমায় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে না? আমি সত্যি-ই অনেক সারপ্রাইজড্ হয়েছি, অনেক খুশিও! আমি ভাবতেও পারছি না, চাঁদ! আমি বাবা হবো, তুমি মা হবে। আমার পরিচয় পাবে। আমি ওকে নিজে কথা শেখাবো। আমার আঙ্গুল ধরে ও হাটা শিখবে। আমি সত্যি-ই অনেক এক্সাইটেড এটা নিয়ে! ইট’স দ্য বেস্ট ফিলিং ওফ মাই লাইফ।”

সৌহার্দ্য তরীর মাথায় গভীরভাবে ওষ্ঠ স্পর্শ করলো। তরী হাসার চেষ্টা করেও পারলো না। মাথা তুলে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর চোখের কোণে জল টলমল করছে। তরী মলিন মুখে বললো,

“বাচ্চা এতো পছন্দ আপনার? আগে তো কখনো বলেননি!”

সৌহার্দ্য হেসে বললো, “আসলেই! অনেক পছন্দ আমার। আমার চোখের সামনে কোনো বেবি পড়লেই ওকে আমি কোলে নেই। সেই ছোট ছোট হাত, একটা নিষ্পাপ মুখ, চাহনি অসাধারণ সুন্দর। আমার চোখে দেখা সেরা সৌন্দর্য!”

তরী থমথমে মুখে হাসার চেষ্টা করলো। সৌহার্দ্য নিজের ফোন হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে যেতে যেতে বললো,

“ডিনারের ব্যবস্থা করো। এমনিতেও খিদে পেয়েছে প্রচুর। আমি সবাইকে গুড নিউজটা জানাই ততক্ষণে। সবাই অনেক খুশি হবে।”

ঘড়ির কাটা রাত দুটোর ওপারে। বাইরে থেকে ডাহুকের শব্দ কানে ভেসে আসছে। এই মধ্যরাতে সবাই ঘুমে বিভোর। তরী সৌহার্দ্যের বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকালো। আবছা আলোয় সৌহার্দ্যের ঘুমন্ত মুখটা আর ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দে তরী নিশ্চিত হলো সৌহার্দ্য গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তরী ধীর গতিতে সৌহার্দ্যের বাহু বন্ধন ছাড়িয়ে নিয়ে শোয়া থেকে উঠে দাড়ালো। চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু মুছে ফেলে নিজের ব্যাগটা ড্রয়ার থেকে বের করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পাঁচ মিনিটের মাথায়ই বাসার গেইটের মাথায় এসে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড পর একটা কালো গাড়ি তরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তরী ড্রাইভিং আর ফ্রন্ট সিটে বসা দু’জনের দিকে রোষিত চোখে তাকিয়ে বললো,

“বলেছিলাম না গেইটের সামনে আগে আগে এসে দাঁড়াতে? আমি আসার পর কেন তোমাদের দেখলাম না কেন? স্টুপিড!”

তরী রেগেমেগে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ির ডোর লাগানোর সময় দেখতে পেল, মিস্টার আফনাদ নিজের ঘরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তরীর দিকেই তাকিয়ে আছেন। তরী গাড়ির ডোর লাগাতেই মিস্টার আফনাদের কল এলো। তরী রিসিভ করলো কল,

“হ্যাঁ, বাবা।”

“যা করার ভেবেচিন্তে করো। জানি না কেন আজ রাতেই তোমার কী প্রয়োজন পড়লো! কিন্তু এতো বছর তোমার পাশে ছিলাম, তোমায় সাপোর্ট দিয়েছি, তোমার নির্ভরতার খুঁটি ছিলাম। আমি এক্সপেক্ট করছি, তুমি কোনো অন্যায় করবে না। আমার তরী কোনো অপরাধ করবে না। এটা আমার বিশ্বাস তোমার প্রতি। আশা করি তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙবে না।”

তরী চোখ খিঁচে বন্ধ করে বসে রইলো। কেউ তার ভেতরের র*ক্ত*ক্ষ*র*ণ দেখতে পাচ্ছে না। আজকের মতো অসহায় পরিস্থিতিতে তরী আজ পর্যন্ত কখনো পড়েনি। মা হওয়া সহজ নয়। আর একজন মায়ের বুকের হাহাকারের চেয়ে বড় কষ্ট এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। তরী নাক টেনে চোখ মুছে বললো,

“আমি অতোটাও ভালো নই, বাবা! আর আজ আমি একটা অন্যায় করার পথেই পা বাড়িয়েছি। আমার জীবনের প্রথম খু*ন করতে যাচ্ছি। তোমার বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য আমি ক্ষমা চাইবো না, বাবা। কারণ আমি কারো ক্ষমার যোগ্য-ই থাকবো না আজকের পর থেকে।”

তরী ফোন কেটে সিমকার্ড খুলে ফেললো। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে বললো, “আর এক ঘন্টা সময় পাবে তুমি। এর মধ্যে আমাকে পৌঁছে দেবে।”

ড্রাইভার ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। সুনশান রাস্তায় ঝড়ের গতিতে ধুলো উড়িয়ে নিশ্চুপ শহরের বাইরের দিকে চলতে লাগলো গাড়িটি।

ফজরের আজান আশে পাশে ধ্বনিত হচ্ছে। তরী গাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের ডুপ্লেক্স বাড়ির ভেতরে চলে গেল। দারোয়ান সালাম দিলেও তরী শুধু উত্তর দিলো, কিন্তু কোনো দিকে তাকালো না। সিড়ি বেয়ে নিজের বেডরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো তরী। বিছানার উপরের দেয়াল জুড়ে নিজের মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মুখে হাত চেপে কেঁদে উঠলো সে।

“মা, আমি অনেক খারাপ একটা কাজ করতে যাচ্ছি, তাই না? নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে আমার। কিন্তু আমি কী করবো, বলো? তুমি তো জানো সব! এই পৃথিবীতে কেউ কিছু না জানলেও তোমাকে তো আমি সবটা বলি। তুমি-ই বলো, আমার কাছে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি না? নেই তো। একটা নিষ্পাপ প্রাণকে পৃথিবীর আলোই দেখতে দিতে পারবো না আমি। এর চেয়ে আমার নিজের মরণও ভালো ছিল।”

হঠাৎ দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠলো তরী। চোখ মুছতেই বাহির থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,

“অরিত্রী, দরজা খোল, মা! ভেতরে বসে আবার কান্নাকাটি লাগিয়েছিস!”

দারোয়ান আজাদের স্ত্রী এসেছেন। তরী দরজা খুলে দিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

“আমাকে তুমি কোনোদিনও ক্ষমা করো না, চাচী। আমার জন্য আজাদ চাচা মারা গেছেন। আমার জন্য আজ তুমি স্বামীহারা। তোমার এতো এতো কষ্টের জন্য শুধু আমি দায়ী, চাচী।”

“এসব কী বলছিস তুই, চাঁদ? তুই নিজেকে কেন দোষী ভাবছিস সব কিছুর জন্য? তোর দারোয়ান চাচার যতদিন পৃথিবীতে থাকার ছিল, তিনি থেকেছেন। এটার জন্য তুই দায়ী কেন হবি? তোর চাচাকে তো তুই খু*ন করিসনি, তাই না?”

“আমি আজ পর্যন্ত কাউকে খু*ন করিনি, চাচী। আমি তো শুধু মিস্টার আরমানের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চাই। এছাড়া কোনো অপরাধ করার কথা ভাবতেও পারি না আমি। কিন্তু আমার ভাগ্যটা-ই না অদ্ভুত! সবসময় আমার সাথে নিষ্ঠুরতা করে। আমার কপালে সুখ নেই, জানো চাচী? শুধু সৌহার্দ্যের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ মুহুর্তে ওকেও ঠকাতে হচ্ছে আমায়!”

“সৌহার্দ্যকে ঠকাচ্ছিস মানে? আচ্ছা, তুই এতোদিন পর এখানে এলি! তোকে একটা কথা বলা হয়নি আমার। সৌহার্দ্য এসেছিল এখানে।”

তরী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “কী? সৌহার্দ্য এসেছিল? ও কেন আসবে? চাচার মারা যাওয়ার পর ওর আসার তো কথা না!”

“এসেছিল। তোর চাচা মারা যাওয়ার আগে ওকে নিজের সিন্দুকের চাবি দিয়ে গিয়েছিল। যেই সিন্দুকে আমি বা তুই কোনোদিন হাত লাগাতে পারিনি, সেটার চাবি। ওতে কিছু কাগজপত্র আরো কী কী যেন ছিল! ওগুলো নিয়ে গেছে।”

তরী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে তরী বললো,

“তার মানে তো, সৌহার্দ্য আমার ব্যাপারে সব জানে! সব জেনে গেছে ও আগেই।”

“না, আমি এখনো কিছু জানি না! কিন্তু আজ আমি সবটা জানবো। আর তুমি যেই উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছো, সেটা আমি কোনোদিন পূরণ হতে দেব না। আমার অনাগত সন্তানের মৃত্যু এই ড. সৌহার্দ্য রায়হান পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে সম্ভব নয়!”

তরী বিস্ফোরিত চোখে পেছনে তাকাতেই দেখলো সৌহার্দ্য ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

#চলবে…..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here