প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৩৯+৪০

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_39
#Writer_TanhaTonu

আরশি ছুটে ওয়াশরুমের সামনে গেলো আর বেসিনে গড় গড় করে বমি করে দিলো।এতো বমি করার পরও থামছে না।মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।বমির সাথে কিছুটা রক্তও আসল।দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি না পেয়ে আরশির মাথাটা ঘুরে উঠল
চারপাশটা যেনো আবছা হতে আবছা হতে লাগল আর এক সময় অন্ধকারে ঢেকে গেলো।কিন্তু আরশি ফিল করতে পারল কেউ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।শক্ত করে নিজের মাঝে আগলে রেখে গালে হাত বুলাচ্ছে আর কিছু হয়ত বলছে যা আরশির কানে আসছে না।একসময় সম্পূর্ণ জ্ঞান হারালো মেয়েটা আর সাথে সাথে তাকে আগলে রাখা মানুষটাকে কোলে তুলে নিলো ওকে…
__________________________________

মিটমিট করে চোখ খুলতেই আরশি নিজেকে একটা হসপিটালে বেডে আবিষ্কার করে।বাম পাশে তাকিয়ে দেখে সাইড টেবিলটায় একটা প্যাকেট..সম্ভবত খাবারের হবে আর তার সাথেই গোল্ডের চেইন,কানের দুল আর রিং যেগুলো দেখে আরশির চিনতে একটুও দেরি হলো না যে এগুলো ওরই আর হয়ত এখানে আসার পরই ডক্টররা খুলেছে।তখনই আরশির খেয়াল হয় ও যখন জ্ঞান হারাচ্ছিলো তখন কেউ ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলো।কিন্তু প্রশ্ন কে আনল ওকে হসপিটালে?আরশি আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেবিনটায় ও ছাড়া কেউ নেই।দরজাটাও চাপানো।আরশি চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নেয়।রুমে কেউ প্রবেশ করছে বুঝতে পেরে আরশি চোখ খুলে।একজন নার্সকে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নার্সটি মিষ্টি হেসে বলে…
—”আপনার জ্ঞান ফিরেছে তাহলে?”

আরশিও মলিন হাসে।তারপর জিজ্ঞাসা করে…
—”আমাকে এখানে কে এনেছে?আর সে কোথায়?”
—”আপনাকে তো একজন পুরুষ নিয়ে এসেছে।আর সে এতক্ষণ আপনার ক্যাবিনেই ছিলো।এই দশ মিনিট হবে তাকে ওষুধ আনতে পাঠানো হয়েছে”

নার্স কথাগুলো বলতে বলতে আরশির হাত থেকে স্যালাইনের ক্যানেলাটা খুলতে লাগল।আরশি ছোট্ট করে মলিন কন্ঠে বলল..
—”ওহ”

নার্স ক্যানেলা খুলে দিয়ে চলে গেলো।দুর্বলতার কারণে আরশি চোখ বন্ধ করে ফেলল কিন্তু ঘুমোল না। একটু পরই বুঝতে পারল কেউ ভিতরে প্রবেশ করেছে।আরশির বুকটা কাঁপতে লাগল।চোখ খুলতে ভয় হচ্ছে।পার্ফিউমটা যে বড্ড চেনা…

সিদ্রাত ওষুধের প্যাকেটটা সাইড টেবিলে রেখে বেডের পাশে একটা টুল টেনে বসল।আরশির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই আরশি কেঁপে উঠল।তিনটা বছর!তিনটা বছর পর চেনা সেই স্পর্শ!তিনটা বছর মনের ভিতর কষ্টের যে আগুন জ্বলেছে তা যেনো এখন আরও বেশি দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন।সিদ্রাত মৃদু কন্ঠে বলল…
—”কিছুদিন পর নিজেই ডক্টর হবে অথচ শরীরের প্রতি এতো অবহেলা!রক্ত বমি যে খুব সাধারণ কিছু না সেটা তো তোমার জানার কথা”

আরশি আস্তে করে চোখ খুলল।ওমনি কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।ধরা গলায় বলল…
—”যার জীবনের সবকিছুই অস্বাভাবিক তার রোগটাও অস্বাভাবিক হতেই পারে..সিম্পল ব্যাপার।আর অবহেলা!যত্ন নেয়ার মানুষ না থাকলে তো অবহেলা হবেই”

এটুকু কথা বলেই আরশি ডুকরে কেঁদে উঠল।বেশি কিছু বলতে পারল না।বুকের একদম বামপাশটায় অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে।কষ্টটা আরও বেড়ে যাচ্ছে সামনে বসে থাকা প্রিয় মানুষটার ফেইস দেখে।ঠোঁট কামড়ে ধরে আরশি কাঁদতে লাগল।সিদ্রাত কয়েক সেকেন্ড আরশির দিকে তাকিয়ে থাকল।তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে সাইড টেবিল থেকে ব্যাগটা নিয়ে একটা বক্স বের করল।তারপর বক্সটা খুলে ভাত আর চিংড়ি ভুনা একটা প্লেটে নিয়ে মেখে আরশির মুখের সামনে ধরে বলল…

—”হা করো”

আরশি ফ্যালফ্যাল নয়নে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত বলতে লাগল….
—”খাওয়া দাওয়া তো ঠিক মতো করোই না।সেজন্যই আজ আলসারে ভুগছ।এবার অন্তত খাওয়া-দাওয়ায় মন দাও।লাইফের প্রতি যত্নশীল হও।আলসার বেড়ে গেলে কত প্রবলেম হয় জানো তুমি?”

আরশি হা করতেই সিদ্রাত আরশির মুখে লোকমাটা পুরে দিলো।আরশি ভাত চিবুতে চিবুতে অভিমানী গলায় বলল…
—”আলসার না হয়ে আরও বড় কোনো রোগ হলে ভালো হতো।সবাইকে মুক্তি দিয়ে চলে যেতে পারতাম।কেউ তো আর আমায় চায়না তাদের জীবনে”

সিদ্রাত আরশিকে খাইয়ে দিতে দিতে মুচকি হাসল আর বলল…
—”তাহলে তো দেখছি দেশে যত ভিক্ষুক,পঙ্গু,প্রতিবন্ধী আছে সবাইকে মেরে ফেলা উচিৎ।তাদেরকেই বা কয়জনে চায়?”

আরশি অবাক হয়ে গেলো সিদ্রাতের কথায়।সিদ্রাত কি বুঝাতে চেয়েছে তা আরশি ভালো করেই বুঝল।কিন্তু এখন অভিমান আর কষ্টটা বেশি কাজ করছে।আবারও অভিমানী গলায় বলল…
—”একটু বেশি কথা বলতে পারেন বলে নিজেকে এতো বড় ভাববেন না।আপনার চেয়ে মেন্টালি আমি স্ট্রং..আর যাই হোক সুইসাইড তো করতে যাইনি”

কথাটা বলতেই আরশির চোখ দিয়ে আবারও পানি পড়তে লাগল।সিদ্রাত নিশব্দে হাসল।খাওয়া শেষ হলে সিদ্রাত আরশির মুখ মুছে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো।তারপর আগের জায়গায় বসেই বলল…

—”বড়দের মতো কথা বলে লাভ নেই বুঝলে।তুমি এখনো সেই পিচ্চিই রয়ে গিয়েছো।পিচ্চি আরশি।পড়াশুনায় মন দাও।বড় একজন ডক্টর হও…পুরো দুনিয়া এক সাইডে রাখো আর স্টাডি একসাইডে রাখো”

আরশি মিনমিন করে বলল…
—”আমার দুনিয়া তো আপনি”

সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল…
—”ডক্টরদের এতো ইমোশনাল হলে চলে না”
—”আমি এখনো ডক্টর হইনি।মাত্র এইচএসসি শেষ করে ভার্সিটিতে উঠলাম।মক্কা এখনো বহুত দূরে।আর ডক্টর হওয়ার আগে আমি একজন মানুষ।আপনি যেটাকে আবেগ বলছেন সেটা আমার কাছে তীব্র এক অনুভূতি যা নিশব্দে আমাকে ভিতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে”

আরশির চোখ দিয়ে আগের ন্যায়ই পানি পড়তে লাগল।সিদ্রাত অপলক কিছুক্ষণ আরশির দিকে তাকিয়ে থাকল।তারপর বের হয়ে চলে গেলো।সিদ্রাত যেতেই আরশি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় যখন সামনের মানুষটাকে নিজের মনের আকুতিগুলো বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়।মানুষটা যে বুঝতেই চায়না…

আরও আধা ঘন্টা পর নুসাইফা এসে আরশিকে বাসায় নিয়ে যায়।আরশি বাসায় আসার পর নুসাইফার সাথে আর কথা বলেনি।আরশির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নুসাইফাও আর আরশির রুমে যায়নি।মেয়েটাকে এখন একা থাকতে দেয়াই ভালো হবে….
————————–

—”তোর কি মনে হয় আমি কোনো ভাবনা ছাড়াই এতোটা কঠোর হয়ে আছি?আমার কি কষ্ট হয়না?নাকি আমি রোবট?ওর আগে থেকে আমি ওকে ভালোবাসি।আমি জানি ওর স্বভাব।একবার যদি আমি ওকে কাছে টেনে নিই তাহলে ওর ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে”

শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
—”এর উল্টোটাও তো হতে পারে।মেয়েটা তো কম যন্ত্রণা পাচ্ছে না।স্বভাবতই এতো কষ্টের পর যদি তোকে ফিরে পায় তাহলে মূল্যটা একটু বেশিই করবে।তখন হয়ত তোর কথা ফেলতে পারবে না।তোর খুশির জন্য হলেও পড়াশুনাটা ঠিকভাবে চালিয়ে যাবে”

সিদ্রাত তাচ্ছিল্যময় হেসে বলে…
—”এখন দুঃখে আছে ঠিকি।কিন্তু সুখের ছোঁয়া পেলে মাথায় কুবুদ্ধিগুলো সব ফিরে আসবে।বাই এনি চান্স একটা ভুল যদি হয়ে যায়?যদি বেবি কন্সিভ করে ফেলে তখন?কি হবে ওর ভবিষ্যতের?আমাকে জবাব দিতে পারবি?”

সিদ্রাতের কথাটা যুক্তিযুক্ত হলেও শিশির বলে…
—”দেখ ভাই আমি জানি তুই যা বলছিস সবই লজিক্যাল।কিন্তু আমি তোকে একটা কথাই বলব…জীবনটা খুব বেশি বড় না।সময়গুলোকে এভাবে নষ্ট করে দিস না।আর রইল ফিউচার!সেটার মালিক আল্লাহ।আমার বা তোর হাতে তা নেই।তুই খুবই ইন্টেলিজেন্ট। আমি আর কিছু বলব না তোকে”

শিশির উঠে বেরিয়ে যায় সিদ্রাতদের বাসা থেকে।সিদ্রাত বেড সাইড টেবিলে থাকা এক্যুরিয়ামটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে….
চলবে..

ইনশা আল্লাহ কাল থেকে তাড়াতাড়ি দেয়ার চেষ্টা করব।পড়াশুনার চাপ থাকার কারণে সময় বের করতে পারছি না
প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_40
#Writer_TanhaTonu

শিশির উঠে বেরিয়ে যায় সিদ্রাতদের বাসা থেকে।সিদ্রাত বেড সাইড টেবিলে থাকা এক্যুরিয়ামটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে….
______________________________

সন্ধ্যার একটু পর সিদ্রাতের আম্মু কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে কাবার্ডে রাখছিলো আর আব্বু বেডে হেলান দিয়ে বসে কফি খাচ্ছিলো।সিদ্রাত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল…

—”আব্বু আসব?”
সিদ্রাতের আম্মু একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো আর আব্বু গম্ভীর কন্ঠে বলল…
—”হুম আসো”

সিদ্রাত ভেতরে ঢুকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল…
—”আন্টি-আঙ্কেলকে বলো আরশিকে নিয়ে আসতে।আজ মঙ্গলবার..শুক্রবারেই খুরমা-খেজুর দিয়ে বিয়ে হবে”

সিদ্রাতের আব্বু-আম্মু দুজনই চমকে গেলো।অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে তাদর ভাষাই হারিয়ে গিয়েছে।সিদ্রাতের আম্মু বলল…
—”ভেবে-চিন্তে বলছিস তো?পরে মত পাল্টাবে না তো?”
—”না আম্মু.. আমি ভেবেই বলছি।তোমরা যা করার তাড়াতাড়ি করো”

সিদ্রাতের আব্বু মুচকি হাসলেন…

রাত সাড়ে আটটা বাজে তখন…সিদ্রাতদের পুরো ফেইমলি আরশিদের বাসায় ডিনার করছে।ডিনার শেষ হলে সবাই সোফায় বসল।আরশির আব্বু হালকা হেসে বলল…

—”আশরাফ ভাই এবার কথা এগুনো যাবে।আগে খাওয়াটাই হলো আসল”
সিদ্রাতের আব্বুও হাসল।তারপর বলল…

—”তাহলে কথা শুরু করা যাক।সিদ্রাত চাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরশিকে ফিরিয়ে আনতে।বিয়ে হলে এই শুক্রবারই নাকি হবে”

আরশির আম্মু চমকে গেলো এমন কথায়।অবাক হয়ে বলল..
—”মানে আর দুদিন পর?”
সিদ্রাতের আব্বু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।আরশির আব্বু বলল…

—”কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে সম্ভব।বিয়ে মানেই তো কত আয়োজন।কত আত্মীয়দের দাওয়াত করতে হবে।তাছাড়া শুক্রবার বাদ দিলে দুদিন..এটা তো কিছুতেই সম্ভব না এতো কম সময়ে এতো কিছুর আয়োজন করা”

আরশির আম্মুও আরশির আব্বুর কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।সিদ্রাত এবার মুখ খুলল…

—”কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই আঙ্কেল।যতটা সাদামাটা ভাবে সব সম্পন্ন করা যায় ততই ভালো।যেসব আত্মীয়দের একবারেই দাওয়াত না দিলেই নয় তাদেরকে শুধু দাওয়াত দিন।আমরাও এটাই করব।তিনশ জন মানুষ নিয়ে বরযাত্রী গিয়ে তাদেরকে ফ্রিতে খাইয়ে বউ আনব।কিন্তু সেই বউ যখন আমার সন্তানের মা হতে চলে তখন মাত্র এক ব্যাগ রক্তও পাওয়া যায়না তাদের কাছ থেকে।প্রয়োজন নেই এসব বেহুদা আয়োজনের।বাসায় পাঁচশ জন মানুষ দাওয়াত করে না খাইয়ে আমি এক হাজার এতিমকে দুবেলা খাওয়াবো..এটা জেনে মনে শান্তি পাবো যে অসহায় বাচ্চাগুলো আমাদের নতুন জীবনের বিনিময়ে হলেও ভালো কিছু খেতে পেরেছে।আর তাছাড়া সহজ-সরলভাবে যে বিয়ের আয়োজন করা হয় তাতে আল্লাহর রহমতও থাকে।আমি সেই রহমতটাই চাই।কোনো গুনাহের মাধ্যমে আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায়টা শুরু করতে চাইনা”

আরশির আব্বু-আম্মুও সিদ্রাতের কথায় খুশি হলো।আরশির আব্বু বলল…
—”ঠিকি বলেছ..দুবেলা এতিম শিশুগুলোকে খাওয়ালে তারা মন থেকে যে দোয়াটা করবে সেটা আত্মীয় নামের লোকগুলোর থেকে পাওয়া যাবে না..তাহলে কথা এটাই রইল..”

এবার সিদ্রাতের আম্মু বলল…
—”সবই ঠিকাছে..কিন্তু বিয়ের কনেকে কে আনবে?সে কি রাজি হবে?যতই হোক অভিমানের পাহাড়টা একদমই ছোট না”

আরশির আম্মু বলল…
—”আপা চিন্তা করো না।ও আসবে ওর বাপ আসবে”
আরশির আব্বু গলা ঝেড়ে বলল…
—”ওর বাপ তোমার সামনেই আছে”

উপস্থিত সবাই মৃদু আওয়াজে হেসে উঠল।তারপর কথাবার্তা শেষ করে সিদ্রাতরা ওদের বাসায় চলে গেলো।এখন শুক্রবার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা।কে জানে কিভাবে আরশিকে ফিরিয়ে আনবে ওরা!
——————-

ল্যাব থেকে বের হয়ে হাতের গ্লাভসগুলো খুলতে খুলতে আরশি ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর পাশে নুসাইফা হাত নেড়ে নেড়ে এটা সেটা বলছে।আরশি ভ্রু কুচকে নুসাইফার দিকে তাকিয়ে বলল…
—”এই পেত্নী এতো কথা বলছিস কেন?চড় কিন্তু সব তোর গালে পড়বে এখন চুপ না হলে”

নুসাইফা ভেঙচি দিয়ে বলল…
—”ঢং!তুই আস্ত একটা রস-কষহীন মানুষ।তুই জানিস আমি আজ কতটা এক্সাইটেড?এই ফার্স্ট এমন একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম”

আরশি বিরক্তি নিয়ে বলল…
—”এমনভাবে বলছিস যেনো মানুষের ব্রেইন সার্জারি করে এসেছিস?জাস্ট আরশোলার শরীরের কাইটিনটাই রিমুভ করেছিস..এতো নাচার কি আছে?”

নুসাইফা ভেঙচি কাটল।ক্লাস রুমে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে দুজনই বেরিয়ে পড়ল বাসার উদ্দেশ্যে।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে হালকা পাতলা নাস্তা করে নুসাইফা বলল…

—”আরশি ছাদে যাবি,?আয় যাই”
আরশি কিছুক্ষণি ভেবে বলল…
—”আচ্ছা চল”

যাওয়ার সময় দুজন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করে নিউএ গেলো।ছাদে একটা ম্যাট বিছিয়ে দুজনের মাঝে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর সসের কাপটা রেখে আরশি বলল…
—”নুসু তুই অনেক সেলফিশ”
নুসাইফা হাসল,,এক পিস ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মুখে নিয়ে বলল…
—”এসব বলে লাভ নেই।আমি কিছুই বলব না”

আরশি বেদনাদায়ক কন্ঠে বলল…
—”আমি তোদের খেলার গুটি।খেল যে যেভাবে পারিস”

এবার নুসাইফারও মায়া হলো আরশির জন্য।ও করুণচোখে তাকালো।আরশি বলল…

—”দেখ আসল যেটা জানার সেটা তো আমি জেনেই ফেলেছি।এখন শুধু এটুকু জানতে চাচ্ছি এতোকিছু কিভাবে হলো?উনি আমায় কিভাবে কবে পেলেন আর তোর সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ…এটাও কোনো কাততালীয় নাকি অন্যকিছু?জাস্ট এটুকুই তো”

নুসাইফা জিহবা দিয়ে ঠোঁট একবার ভিজিয়ে নিলো।তারপর বলতে লাগল…
—”তোর সাথে আমার দেখা হয়েছে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ফার্স্ট ক্লাসে। এর আগে তুই একবছর একা কাটিয়েছিস..এটা মনে আছে তো?”

আরশি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।নুসাইফা আবারও বলল…
—”যা ঘটার সেই এক বছরেই ঘটেছে।ভাইয়ার সুইসাইড এটেম্প,অসুস্থতা সব..তুই চলে আসার প্রায় সাড়ে এগারো মাসের মাথায় ভাইয়া আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো ধানমন্ডি ১৫ তে। সেদিনই নাকি তোকে আফসার উদ্দিন রোডে দেখেছে।তখনও আমি এসব জানতাম না।তোকে দেখার পরই ভাইয়া আবারও আমাদের বাসায় আসে।আমাকে ডেকে ছাদে নিয়ে আসে আর এ টু জেট সবকিছু বলে।তখন ভাইয়ার অস্থিরতা দেখার মতো ছিলো।এতো অস্থির আমি কখনো দেখিনি ভাইয়াকে।আমাকে রিকুয়েস্ট করে যেনো আমি কলেজ চেইঞ্জ করে তোর কলেজে এডমিট হই আর তোর খেয়াল রাখি যেহেতু আমিও তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।জানিস ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনে আমার সেদিন মনে হয়েছিলো এই বুঝি কেঁদে দিবে।তার পুরো মুখে ভেসে উঠেছিলো তোকে নিয়ে চিন্তার ছাপ।বারবার পাগলের মতো আমায় বলছিলো যে নুসু আমার অনেক ভয় করছে।মেয়েটা খুবই বাচ্চাসুলভ।ওর কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যাবো।তুই প্লিজ ওর সাথে থাক।ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে আমাদের শাহবাগের বাড়িটায় দুজন চলে আয়।সেদিন ভাইয়ার অস্থিরতা দেখে আমি “না” করতে পারিনি।তার কথা আর অস্থিরতাই বলে দিয়েছিলো সে তোকে কতটা ভালোবাসে।তারপর আরও চার মাস পর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের এক্সাম শেষ হলে রেজাল্ট পাওয়ার পর আমি তোদের কলেজে যাই।ভাইয়া এই চারমাসে তোর সব ইনফর্মেশন বের করেছে..কোন ক্লাসে পড়িস,কোথায় থাকিস..সব…তারপরই তো ফার্স্ট ক্লাসে তোর সাথে আমার দেখা হলো আর এক সপ্তাহের মধ্যে ফ্রেন্ডশীপ।তারপর তোর থেকেই ধীরে ধীরে জানতে পারলাম তুই একটা বাসায় থাকিস যেখানে দশজন মেয়ে থাকে।রুমভাড়া এক হাজার করে প্রত্যেকের ভাগে।আবার টিউশনিও করাস।তখনই তো সুযোগ বুঝে আমি তোকে অফার দিলাম যে আমার এক মামার বাসা আছে সেখানে আমরা দুজন থাকতে পারব।যাই হোক….তবে মন থেকে বলছি প্রথমে ভাইয়ার কথায় তোর সাথে ফ্রেন্ডশীপ করার কথা ভাবলেও পরে তোকে দেখে আমার ধারণাই পাল্টে গিয়েছে।আমি ভাইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ ওর জন্য তোর মতো ফ্রেন্ড পেয়েছি”

নুসাইফা কথাগুলো শেষ করে আরশির চোখের পানিগুলো মুছে দিলো।ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিত হাসি ঝুলিয়ে বলল…
—”এই পাগল কাঁদছিস কেন?তুই ছিচকাঁদুনে হয়ে যাচ্ছিস”

আরশি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল…
—”উনিও বলত এটা”

নুসাইফা হেসে দিলো।আরশি মুখ বাঁকালো
নুসাইফা জিজ্ঞাস করল…
—”আরশি একটা কথা কিন্তু তুই আমায় এখনো বলিসনি।তুই তো আন্টি-আঙ্কেলের সাথে প্রতিদিনই কথা বলিস।তো তারা জানতে চায়না তুই কোথায় থাকিস?”

—”প্রথম প্রথম অনেক জোর করত।আমি তখন বলতাম যে তোমাদেরকে ফোন দিয়েছি মানে আমি ভালো আছি সুস্থ আছি..এটুকুই এনাফ।আর যদি আরও বেশি জোর করো অথবা সিদ্রাত স্যারকে কিছু বলো তাহলে আমি সিম চেইঞ্জ করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবো।তবুও প্রথম এক বছর অনেকবার জিজ্ঞাস করেছে।কিন্তু এই বাসায় আসার পর আর জিজ্ঞাস করেনি”

নুসাইফা ঠোঁট চেপে হেসে বলল…
—”জিজ্ঞাস করে আর কি করবে?তখন তারা অলরেডি জানে যে তুই কোথায়।তাদের হবু জামাই-ই তো বলে দিয়েছে”

আরশির চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেলো।ও অবাক হয়ে বলল…
—”এই ব্যাপারটা গত দুইদিনের ভিতর একবারও আমার মাথায় আসেনি”

নুসাইফা হাসল।আরশিও ফিক করে হেসে দিলো।হঠাৎ নুসাইফার ফোন বেজে উঠল।দেখল সিদ্রাত ফোন দিয়েছে।আরশিও সেটা দেখতে পেয়ে নুসাইফার দিকে চোখ সরু করে তাকালো।নুসাইফা বোকা হেসে উঠে ছাদের অন্যপ্রান্তে গিয়ে ফোন রিসিভ করল।প্রায় বিশ মিনিট পর আবারও ফিরে এলো।দেখল আরশি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।নুসাইফা আরশির পাশে বসে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল….

—”আরশি..ব্যাড নিউজ আছে”
আরশির ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠল।উদ্বিগ্ন কন্ঠে নুসাইফাকে জিজ্ঞাসা করল….
—”কি হয়েছে উনার?উনি ঠিক আছে তো?”

নুসাইফা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।আরশি জিজ্ঞাসু সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
—”তাহলে?কিসের ব্যাড নিউজ?”

—”তোর আব্বু-আম্মু আর আমার মামা-মামী জোর করে ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করেছে।তুই নাকি ফিরে যাবি না,তাই তোর পথ চেয়ে জীবনটা নষ্ট করা ঠিক হবে না..হেনতেন বুঝিয়েছে তোর আব্বু-আম্মু সিদ্রাত ভাইয়াকে।আজ বুধবার।শুক্রবার মানে পরশু দিনই নাকি ঘরোয়াভাবে বিয়ে হবে।পাত্রীও নাকি ঠিক করা।রাহা আপু আছে না?উনার ননদের সাথে নাকি ঠিক হয়েছে বিয়ে”

নুসাইফার কথা শুনে আরশির নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে।মাঝে মাত্র একদিন বাকি..তারপরই তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটা অন্যকারও হয়ে যাবে!এটা যেনো ভাবতেই মনে হচ্ছে শরীরের শিরা-উপিশিরাগুলো ছিড়ে যাচ্ছে।বুকের ভিতরটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে।আরশি দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।নুসাইফা আরশির কাঁধে হাত রাখে।আরশি মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে….

—”উনি কি রাজি নুসু?”
নুসাইফা দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বলল…
—”না রে আরশি।কিন্তু ভাইয়া বলছে সবাই নাকি খুব প্রেশার দিচ্ছে।আর মাঝে মাত্র একদিন আছে।এই একদিনে কিছু করাও সম্ভব না।ভাইয়া শুধু আমায় ফোন দিয়েছে তোকে এটা বলার জন্য যে তুই যেনো মাফ করে দিস ভাইয়াকে”

আরশির ভিতরে কষ্টের সাথে যুক্ত হলো চাপা এক অভিমান।দুইয়ের সংমিশ্রণে ভিতরটা যেনো শেষ হয়ে যাচ্ছে।আরশি কান্নামিশ্রিত অভিমানী গলায় বলল…
—”বিয়ে করে ফেলতে বল উনাকে।আমার কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই”

আরশির কথায় নুসাইফা থতমত খেলো।নিজেকে সামলে ও আরশিকে বলল…

—”আরশি তুই কি পাগল?বিয়ে মানে বুঝতে পারছিস?ওই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে ওদের মাঝে ফিজিক্যাল রিলেশন হবে,কয়দিন পর বেবি হবে।তোর সিদ্রাতকে ওই মেয়ে যেখানে সেখানে টাচ করবে।আর যতই হোক ভাইয়া তো পুরুষ মানুষ..সেও ওই মেয়ের এখানে-ওখানে আদর করবে..ওয়াক!আবার তোর ফিউচার বাচ্চাদের বাবাকে ওই পেত্নীর বাচ্চারা আব্বু বলবে।সিদ্রাত ভাইয়াও ওদেরকে কোলে নিয়ে আদর করবে..উফফ কি সাংঘাতিক ব্যাপার!তোর জায়গায় আমি হলে ওই পেত্নীর নাক কেটে দিতাম।আর তার আগে ভাইয়ার গলা টিপে ধরে বলতাম… ওই হাতি আমার জন্য সুইসাইড করতে পারিস অথচ পালাতে পারিস না।তুই তো কাপুরুষ,বান্দরের নানা,চামচিকার জামাই,সজারুর বাপ”

—”নুসুউউউ….”
আরশির চিৎকারে নুসাইফা থেমে গেলো।আরশির দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলল কারণ আরশি রেগে ফায়ার হয়ে আছে।দাঁতে দাঁত চেপে চোখ মুছতে মুছতে আরশি বলল..

—”কুত্তি তুই সজারু,চামচিকা, বান্দর..সব।
তুই উনাকে বকতে গিয়ে আমাকে চামচিকা,আমার বাবুদের সজারু বানিয়ে দিলি!হারামি তোর পোলাপান সব সজারু হবে”

নুসাইফা জিহবায় কামড় দিয়ে বোকা হাসল।আরশি আবারও কাঁদতে লাগল।নুসাইফা বলল…
—”আচ্ছা যাই হোক..এখন বল কি করবি?আর একদিন পরই তো বিয়ে”
—”ওই ইতি পেত্নীর চুলগুলো আমি ছিড়ব।বিয়ে করার শখ মজে যাবে সব।আর উনাকে যে কি করব আমি নিজেও জানি না।উনার নাকটা আমি যদি না ফাটাই আমার নামও আরশি না।চল রুমে।লাগেজ গুছাবো।কালই গুলশান যাবো।আন্টি-আঙ্কেলের থেকে পার্মিশন নিয়ে নিস যে তুইও তোর মামার বাসায় যাবি”

নুসাইফা দাঁত কেলিয়ে হাসল আর বলল…
—”আম্মু-আব্বু গুলশান আজই চলে যাবে।তার কত আদরের ভাইপো’র বিয়ে বলে কথা”

আরশি চোখ-মুখ ভালো করে মুছে ছাদ থেকে চলে গেলো।নুসাইফা ফিক করে হেসে দিলো।তারপর ফোনটা কানে নিয়ে বলল…

—”ভাইয়া সব ডান।সবই তো শুনলে”
সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল…
—”হুম ইউ আর সো ইন্টেলিজেন্ট নুসু।অবশ্য দেখতে হবে তো কার বোন?এবার বল কি চাস তুই?এতো বড় একটা কাজ করলি..যা চাবি তা-ই দিবো”

নুসাইফা দাঁত কেলিয়ে বলল…
—”ভাইয়া আমার বেস্টুটার বিয়ে হয়ে যাবে।তোমার ফুপি-ফুপাকে বলে আমার আর নিহানেরটাও সেড়ে দাওনা..তারপর একসাথে সবাই হানিমুনে যাবো”

সিদ্রাত হু হা করে হেসে দিলো।তারপর বলল…
—”এযুগের ছেলে-মেয়েগুলো তোরা আসলেই নির্লজ্জ।দশ বছরের বড় আমি তোর।আর তুই আমাকে,,বড় ভাইকে হানিমুনের কথা বলিস”

নুসাইফা ঠোঁট বাকিয়ে বলল…
—”আমার দশ বছরের বড় ভাই যখন আমার কাছে তার প্রেমঘটিত হেল্প নেয় সেটা নির্লজ্জতামি না।আমি বললেই দোষ..হুহ থাকো তুমি।বাই”

নুসাইফা ফোন কেটে দিলো।সিদ্রাত হাসল…
চলবে….

গত কালেরটা পুষিয়ে দিলাম বড় করে দিয়ে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here